বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক-যুগান্তকারী পরিবর্তনের মুখে by মার্ক টালি

বাংলাদেশে এ নিয়ে যে রাজনৈতিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে তা শেখ হাসিনা মোকাবেলা করার যথেষ্ট সাহস প্রদর্শন করতে না পারলে বল্পুব্দত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার আশা পূরণ হওয়ার নয়। আজ শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে থাকলে তার কন্যা হাসিনার সাহসের যথেষ্ট তারিফ করতেন।

তিনি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে ভারত-বাংলাদেশ শান্তি ও বল্পুব্দত্বের চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন। উভয় দেশের মধ্যে সমস্যা দেখা দিলে তিনি সেসব সমস্যা মোকাবেলার ক্ষেত্রে প্রতিবেশীর সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখার প্রয়োজনীয়তাকে মাথায় রাখতেন


১৫ আগস্ট ভারতের জনগণ আনন্দ-উৎসবের মাধ্যমে স্বাধীনতা দিবস পালন করবে। কিন্তু তখন তাদের সীমান্তের ওপারে বাংলাদেশে বিষাদের কালো ছায়া। দেশটির মানুষ এ দিনটি উদ্যাপন করবে তাদের জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিয়োগান্ত হত্যাকাণ্ড স্মরণে ৩৬তম জাতীয় শোক দিবস হিসেবে।
তবে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বল্পুব্দত্বের যে বন্ধন একদা হারিয়ে গিয়েছিল এ বছর উভয়পক্ষের গ্রহযোগ্যতার ভিত্তিতে তা পুনঃপ্রতিষ্ঠার সমূহ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে জাতির পিতার যে স্বপ্ন ছিল এ বছর বাংলাদেশের মানুষ তার রূপায়ণ দেখতে পাবে। ভারতও তাদের এক সময়ের ঘনিষ্ঠ বল্পুব্দ বাংলাদেশের সঙ্গে সম্প্রীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য ৬৪তম স্বাধীনতা দিবসে উদ্বেলিত হতে পারে। আগামী ৬ সেপ্টেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের কথা রয়েছে। এ সময় উভয় দেশ তাদের মধ্যে সীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করবে। দু'দেশের মধ্যে বিরাজমান বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে এই সীমান্ত বিরোধ গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে। তাই এবার উভয় দেশের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তিগুলোর মধ্যে সীমান্ত চুক্তিই হবে প্রধান।
পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রতিটি ছোট পদক্ষেপ, প্রতিটি হোঁচট খাওয়া, প্রতিটি বিপর্যয় বা আশার ক্ষীণ আলো দেখা যাওয়া নিয়ে ভারতীয় মিডিয়া যেভাবে তৎপর হয়, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক নিয়ে তাদের তেমন আগ্রহ লক্ষ্য করা যায় না। অথচ পাকিস্তানের চেয়েও বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের অনেক লম্বা সীমান্ত রয়েছে। তা ছাড়া এখানে ভারতীয় শত্রুদেরও আস্তানা ছিল। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর মাঝখানে অবস্থান হওয়ার কারণে বাংলাদেশ এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে উঠতে যাতায়াতের রুট হিসেবে কাজ করতে পারে। ভারতীয় পণ্য ও সেবার জন্য বাংলাদেশ একটি বড় সম্ভাবনীয় বাজার এবং বাংলাদেশিরাও পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে তাদের সাংস্কৃতিক বন্ধন বিশেষত রবীন্দ্রনাথের উত্তরাধিকার নিয়ে গর্ব অনুভব করেন।
ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিক্ততাকে অনেকদিন পর্যন্ত মেনে নিয়েছিল। তবে সম্পর্কটা ফের উন্নত করা যাবে না এমন পর্যায়ে তা কখনও নেমে যায়নি। দু'দেশের সম্পর্ক খারাপ হওয়ার জন্য এককভাবে ভারতকে দায়ী করা যায় না। শেখ মুজিবুর রহমানের বিয়োগান্ত হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের একশ্রেণীর রাজনীতিক ভারত সম্পর্কে আতঙ্ক ছড়ায় ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করে। এই ভারত-বিদ্বেষ এসব রাজনীতিকের রাজনীতির মূল উপজীব্য হয়ে দাঁড়ায়। যারা ভারত জুজুর ভয় ও বিদ্বেষে বিশ্বাস করতেন না তারাও এরপর ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বলার ক্ষেত্রে সেটা নয়াদিলি্লর সঙ্গে আপস করা বোঝাবে কিনা সেদিকে সতর্ক থাকতেন। এর অর্থ দাঁড়ায় শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সমঝোতা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে অপরিমেয় সাহস দেখিয়েছেন। এ সমঝোতা দু'দেশের সম্পর্কে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনবে। সমঝোতা বা চুক্তিগুলো অনেকাংশে বাংলাদেশের জন্য লাভজনক হলেও হাসিনাকে এজন্য ভারতের কাছে দেশ বিক্রির সমালোচনার শিকার হতে হয়েছে। চুক্তিগুলো অবশ্যই ভারতের পক্ষেও লাভজনক। বিশেষত এটা দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জন্য উপকারী।
সম্পর্কোন্নয়নের এ উদ্যোগটা বাংলাদেশের দিক থেকেই প্রথমে আসে। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে শেখ হাসিনার দিলি্ল সফরের সময় এ সম্পর্কোন্নয়নের নতুন যাত্রা শুরু হয়। ওই সফরের পরপরই দু'দেশের আমলাতন্ত্র তাদের চিরাচরিত ঢিলেমি নীতি প্রয়োগ করে চূড়ান্ত চুক্তির মুহূর্তে সবকিছু গুবলেট করে দিতে পারে বলে একটা শঙ্কা দেখা দেয়। এ ভয় দূর করতে শেখ হাসিনা উলফা নেতাদের ভারতের হাতে তুলে দিয়ে সমঝোতা বাস্তবায়ন শুরু করে দেন। এভাবেই তিনি বাংলাদেশের ভূখণ্ডকে ভারতবিরোধী কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য ব্যবহৃত হতে দেবে না বলে তার দেওয়া অঙ্গীকারের প্রতি অবিচলতা দেখান।
ভারতীয় আমলাদের এ ব্যাপারে দ্রুত কর্ম সম্পাদনে সক্রিয় করে মনমোহন সিংও প্রশংসনীয় কাজ করেছেন বলতে হয়। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই ভারতীয় আমলারা বিস্ময়করভাবে অনেকগুলো চুক্তির খসড়া প্রস্তুত করে ফেলেন। এগুলোর মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সীমান্ত চুক্তি। সীমান্ত সমস্যার একটা বিহিত করা সত্যিই দুঃসাধ্য। এগুলোর মধ্যে স্থানীয় অনেক সমস্যা জড়িয়ে আছে। জাতি-ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নদী ও এঁকেবেঁকে বয়ে চলা খাল চিরে চলে গেছে দু'দেশের সীমান্তরেখা। এ সীমান্তের ব্যাপ্তি চার হাজার কিলোমিটারের ওপর। এখন সাড়ে ছয় কিলোমিটার বিরোধপূর্ণ সীমান্ত চিহ্নিত করা নিয়ে চূড়ান্ত কাজ চলছে। ঔপবিবেশিক উত্তরাধিকার ছিটমহল এভাবেই অতীতের বিষয়ে পরিণত হবে। এ ছিটমহল উভয় দেশের ভেতরই পড়েছে। এখন এ ছিটমহলের বাসিন্দারা নিজ নিজ দেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি পাবেন। এতদিন তারা না ঘরকা না ঘাটকা অবস্থায় ছিলেন। অন্য দেশ পরিবেষ্টিত ভূখণ্ডে বসবাসকারীরা ওই দেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে নিজ দেশে যাতায়াত করতে পারবেন ।
ট্রানজিট শব্দটি বাংলাদেশে অত্যন্ত মানসিক চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী। শেখ হাসিনার প্রধান বিরোধী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির একটি স্লোগান হচ্ছে, 'আমরা জান দেব, তবু ট্রানজিট দেব না।' বাংলাদেশ এখন ভারত, নেপাল ও ভুটানকে তার দেশের ভেতর দিয়ে যাত্রী ও মালপত্র পরিবহন করতে দিতে সম্মত হয়েছে। বাংলাদেশও এতে বিপুলভাবে লাভবান হবে। রেল পরিবহন ও বন্দর থেকে তার অনেক আয় হবে। এতে বাংলাদেশ রেলওয়ে উন্নত করার জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা পাওয়া যাবে।
বর্তমানে ঢাকা-কলকাতার মধ্যে ট্রেন সার্ভিস চালু রয়েছে। কিন্তু কাস্টমস ও ইমিগ্রেশন কাজের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয় বলে যাত্রীদের ভেগান্তি সয়ে যাতায়াতের মতো মানসিকতা আর থাকে না। যাত্রী ভোগান্তি দূর করার জন্য এখন কাস্টমস ও ইমিগ্রেশন কাজগুলো সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ট্রেনেই সারবেন বলে প্রস্তাব উঠেছে।
তিস্তার ব্যাপারেও একটি চুক্তিতে উপনীত হচ্ছে উভয় দেশ। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিকূল বাণিজ্যিক ভারসাম্যহীনতা দূর করার ক্ষেত্রেও অগ্রগতি হয়েছে। তবে ভারতের পোশাক তৈরিকারকরা বাংলাদেশ যেমনটা চায় সেরূপ তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা দিয়ে বাংলাদেশি পোশাক আমদানির তীব্র বিরোধিতা করছে।
কয়েক বছর আগে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের একজন আমাকে যে কথা বলেছিলেন তার অর্থ দাঁড়ায়, ভারত মনে করত যে, প্রতিবেশী দেশগুলো শক্তি ও বৃহৎ ভৌগোলিক অবস্থার কারণে তাকে ভয় করে থাকতে পারে। তাই তার ব্যাপারে প্রতিবেশীদের রিজার্ভেশন থাকটাই স্বাভাবিক বলে ভারত মনে করত এবং এটাকে তারা মেনেও নিয়েছিল। ভারতের এ ধরনের মনোভাবের কারণে তারা প্রতিবেশীদের সেনসিটিভিটিকে অতটা পাত্তা দিত না। ভারত তার অতীত মনোভাব পরিবর্তন করে বৃহত্তর সেনসিটিভিটি না দেখালে বাংলাদেশের সঙ্গে বল্পুব্দত্বপূর্ণ সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে না। বাংলাদেশের সঙ্গে বল্পুব্দত্বপূর্ণ সম্পর্ক ভারতের অপরাপর প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার ক্ষেত্রেও উদাহরণ হয়ে থাকবে। বাংলাদেশে এ নিয়ে যে রাজনৈতিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে তা শেখ হাসিনা মোকাবেলা করার যথেষ্ট সাহস প্রদর্শন করতে না পারলে বল্পুব্দত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার আশা পূরণ হওয়ার নয়। আজ শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে থাকলে তার কন্যা হাসিনার সাহসের যথেষ্ট তারিফ করতেন। তিনি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে ভারত-বাংলাদেশ শান্তি ও বল্পুব্দত্বের চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন। উভয় দেশের মধ্যে সমস্যা দেখা দিলে তিনি সেসব সমস্যা মোকাবেলার ক্ষেত্রে প্রতিবেশীর সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখার প্রয়োজনীয়তাকে মাথায় রাখতেন।
তাই জাতির পিতার হত্যাকাণ্ড স্মরণে জাতীয় শোক দিবসের প্রাক্কালে বাংলাদেশ তার বৃহৎ প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে যুগান্তকারী পরিবর্তনের সম্ভাবনা নিয়ে আশাবাদী হতে পারে। কয়েক সপ্তাহ পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের মাধ্যমে এ প্রক্রিয়া আরও এগিয়ে যাবে।

স্যার মার্ক টালি :বিশিষ্ট কলামিস্ট; তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের খবর ব্যাপকভাবে কাভার করেন। ভাষান্তর সুভাষ সাহা
 

No comments

Powered by Blogger.