নারী নির্যাতন-ফিসফিসানি নয়, এটা লড়াইয়ের জায়গা by জোবাইদা নাসরীন

স্বামীর অত্যাচারে শরীয়তপুরের ডামুড্যা উপজেলার নার্গিস আক্তারের মৃত্যু, যৌতুকের জন্য গায়ে কেরোসিন ঢেলে দিয়ে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার হালিমাকে হত্যা, স্বামীর নির্যাতনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রুমানা মনজুরের দৃষ্টি হারানো, বখাটেদের উৎপাতে পাবনা সদর উপজেলার শামীমা আক্তারের আত্মহত্যা,

ঢাকার নামকরা বিদ্যাপীঠ ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রী নির্যাতন—সবই সমাজে বিরাজমান পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতার দাম্ভিক অভিব্যক্তি।
এসব ঘটনা গত তিন মাসে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে নারীর প্রতি সহিংসতার কেবল গুটিকয়েক নমুনা মাত্র। নিপীড়িত নারীরা বিভিন্ন বয়সী, বিভিন্ন শ্রেণীর। কিন্তু তারা একই মিছিলে, একই পাটাতনে দাঁড়িয়ে আছে। সমাজের অপ্রতিরোধ্য পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতার দাপটের আঁচ সবার গায়ে। এই দাপটের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে রাজনৈতিক ক্ষমতা। ক্ষমতাবাদী রাজনীতি, পুরুষতন্ত্র, ধর্মীয় বিধিনিষেধ, শ্রেণী, বর্ণ, জাতিগত ভেদ এবং সমাজে ‘ভালো মেয়ে’, ‘মন্দ মেয়ে’র ধারণা এত কিছু পেরিয়ে এসব নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিচার পাওয়া খুবই কঠিন হয়ে পড়ে। নির্যাতনের খবরগুলো আমাদের নিরাপত্তাহীনতার জায়গাগুলো এতই স্পষ্ট করে চেনায় যে মনে হতে থাকে, আমরা যে কেউই যেকোনো মুহূর্তে এর শিকার হতে পারি। আজ একজনের হয়েছে বলে অন্যরা ভাববে, তিনি বেঁচে গেছেন, তা নয়। তিনিও কাল হতে পারেন আক্রান্ত। নারী ঘরে নিরাপদ নয়, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, হাটে-ঘাটে, পথে-বাজারে নয়, তাহলে নারীর নিরাপদ পরিসরটি কোথায়?
কিন্তু এত কিছুর মধ্যেও আশা জাগানিয়া বিষয় হলো, এ ধরনের বিষয় নিয়ে সামাজিক ফিসফিসানি, কানাকানি কিংবা গোপন করার প্রবণতার বাইরে জনগণের কাছে প্রকাশ করার মনস্কতা। ‘সামাজিক’ নারীরা সামাজিক চাহিদার একটি জায়গায় অন্তত নিজেদের আলাদা করতে পেরেছেন। তাঁরা ‘গোপনীয়’, ‘ব্যক্তিগত’ এই বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব রাজনৈতিকভাবে হাজির করার চেষ্টা করছেন। সবাই না করলেও কয়েকজন করতে পেরেছেন, সেটি অত্যন্ত ইতিবাচক। তাঁদের কণ্ঠ সরব হয়েছে। সেই কয়েকজনের মধ্যে পথিকৃৎ হতে পেরেছে ভিকারুননিসার সেই ছোট্ট মেয়েটি। সে আমাদের বোধের জায়গায় প্রচণ্ড জোরে কড়া নেড়েছে। ১৪ বছরের লড়াকু মেয়ে আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে, তার ওপর যে নির্যাতন হয়েছে, তা কোনোভাবেই হজম করার বিষয় নয়, এড়িয়ে যাওয়ার গলি নয়, এর বিরুদ্ধে লড়তে হবে। শুধু নিজেই নয়, সহপাঠীদের উদ্বুদ্ধ করেছে লড়তে। তারা একজোট হয়ে ঘটনাটি জানিয়েছিল প্রশাসনকে। এ ধরনের ঘটনা ঘিরে সাধারণ মানুষের সংবেদনশীলতা এবং সচেতনতাও বেড়েছে অনেকখানি। মিডিয়াও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিচ্ছে। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার পাশাপাশি লেখালেখি চলছে ব্লগ, ফেসবুকসহ সামাজিক নেটওয়ার্কগুলোতে। একে অন্যকে জানান দিচ্ছেন, নিজেরাও নতুন খবরের অপেক্ষায় থাকছেন। একত্র হয়েছেন অভিভাবকেরাও। মানবিক বোধের এই সচেতন নড়াচড়া আমাদের এই বার্তা দেয় যে নির্যাতনের শিকার শুধু মেয়েটি নয়, আমরা সবাই। এর প্রতিবাদ হওয়া প্রয়োজন, সবার একসঙ্গে আওয়াজ তোলা প্রয়োজন। সে আওয়াজটির লক্ষ্য নির্যাতকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি।
নারীর নির্যাতনের পরিসর ক্রমেই বড় হচ্ছে। সেই পরিসরে স্বামী থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সহপাঠী, অফিসের সহকর্মী, পরিচিত-অপরিচিত পুরুষদের অনেকেই বিভিন্ন জায়গায় স্তরজনিত মেজাজ-মর্জি হাজির করলেও এ ক্ষেত্রে মর্যাদাকে অভিন্ন করে নির্যাতকরূপে হাজির হচ্ছেন। নির্যাতক শুধু আর অচেনা কেউই নয়, আশপাশে থাকা পরিচিতদের মধ্যেও আছে। এই নির্যাতন সামাজিকভাবে হজম করার মধ্য দিয়ে নির্যাতনকে একভাবে বৈধতা দেওয়া হয়। একজন এগিয়ে এলে অন্যরাও তা দেখে সাহসের ওপর ভর করে এগোয়। সেটিও দেখা গেল এ ক্ষেত্রে। জানা গেল একজন নয়, আরও কয়েকজন শিক্ষক ছাত্রীদের নানাভাবে নির্যাতন করে আসছেন। শুধু ভিকারুননিসার পরিমল জয়ধরের কথাই হয়তো আমরা জানতে পেরেছি, কিন্তু সমাজ-রাষ্ট্রের ওপরতলা থেকে নিচতলা পর্যন্ত আরও অনেক পরিমল যে আছে, তা সহজেই অনুমেয়।
প্রতিটি ঘটনার পর আমরা আক্রান্ত হই, বিক্ষুব্ধ হই, কয়েক দিন প্রতিবাদ হয়। তারপর সেটি একসময় থিতু হয়ে আসে। কিন্তু নির্যাতনের পরিমাণ কমে না; বরং নির্যাতনের নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ২০০৯ সালের ১৪ মে বাংলাদেশ হাইকোর্ট যৌন হয়রানি বিষয়ে এক যুগান্তকারী রায় দেন এবং আরও বলা হয়, এ বিষয়ে আইন না হওয়া পর্যন্ত হাইকোর্টের নির্দেশনাটি সবাইকে অনুসরণ করতে হবে। সেই সঙ্গে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং কর্মক্ষেত্রে হাইকোর্টের এই নির্দেশনার আলোকে যৌন হয়রানি নিরোধ আচরণবিধি এবং সেল করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু কী এক অজ্ঞাত কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং কর্মক্ষেত্রে এখনো এই আচরণবিধি এবং যৌন নিপীড়নবিরোধী সেল তৈরি করা হয়নি। ফলে এ ধরনের নির্যাতনের ঘটনায় নারী কার কাছে অভিযোগ করবে, সে জায়গাটি পায় না। প্রশ্ন হলো পুরুষতান্ত্রিক নির্যাতনের ভয়াবহ রূপ যখন সারা দেশে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে, তখন যৌন হয়রানি নিরোধ আইন কেন করা হচ্ছে না?
বিদ্যালয় প্রশাসনে যারা ছাত্রীটিকে স্কুল থেকে বের করে দেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত নিয়েছে, মেয়েদের অভিযোগের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে এবং ধর্ষককে আইনের হাতে তুলে দেয়নি, যারা এত দিন ধরে বিষয়টি নিয়ে ‘সামাজিক তামাশা’ করেছে; এদেরও শাস্তি হতে হবে। আর যারা ভিকারুননিসা নূনের মতো নামী স্কুল অ্যান্ড কলেজের ‘মানসম্মান’ কিংবা ‘ভাবমূর্তি’ নিয়ে ভীষণভাবে বিচলিত, তাদের বলতে চাই, এ ধরনের নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জীবনকে সমৃদ্ধ করে, পরিমলদের চিনিয়ে দেয়। এতে প্রতিষ্ঠানটির মর্যাদা আরও বাড়ে।
নির্যাতক পরিমল ধরা পড়েছেন। তাঁর পাওনা শাস্তি নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক। সেই সঙ্গে আরও নিশ্চিত করা প্রয়োজন সব প্রতিষ্ঠানে নারীর নিরাপত্তা। কেন এত দিনেও ঘর ও বাইরের পরিসরে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গেল না, সে বিষয়ে সরকারকে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিতে হবে। কেন যৌন হয়রানি নিরোধ আইন এখনো হলো না, তা-ও খোলাসা করতে হবে। এ আইনটি হওয়ার জন্য আর কত ঘটনা ঘটতে হবে?
জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
zobaidanasreen@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.