তত্ত্বাবধায়ক পুনর্বহালের দাবি, বাধা উপেক্ষা, চারদলীয় জোটের মহাসমাবেশে মানুষের ঢল-৯০ দিন সময় দিলেন খালেদা

কর্মসূচি  ২৯ মার্চ সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল  এপ্রিল ও মে জুড়ে দেশব্যাপী বিক্ষোভ  ১১ জুন ঢাকায় জনসভা  চারদলীয় জোট সম্প্রসারণের ঘোষণা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর বাধার মধ্যে শান্তিপূর্ণভাবেই শেষ হলো বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের মহাসমাবেশ।


নয়াপল্টনে মহাসমাবেশের জন্য নির্ধারিত এলাকা ছাপিয়ে আশপাশের সড়ক, অলিগলি ছিল জোটের হাজার হাজার নেতা-কর্মী আর সমর্থকের দখলে। দিনভর ওই এলাকাগুলো মুখরিত ছিল গান, করতালি, স্লোগান আর বক্তৃতায়।
রাজধানীর নয়াপল্টনে গতকাল সোমবার চারদলীয় জোটের বহুল আলোচিত মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে চারদলীয় জোট এ কর্মসূচির আয়োজন করে। চট্টগ্রামের রোডমার্চ-পরবর্তী সমাবেশ থেকে ঢাকায় মহাসমাবেশের ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল।
বিকেল পৌনে পাঁচটায় মহাসমাবেশের প্রধান অতিথি বিএনপির চেয়ারপারসন ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া বক্তব্য শুরু করেন। তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি পুনর্বহালের দাবিতে সরকারকে ৯০ দিনের সময় বেঁধে দেন। তিনি বলেন, ‘এই সময়ের মধ্যে দাবি মেনে নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণা দিতে হবে।’ ৯০ দিন শেষ হবে ১০ জুন। এর মধ্যে দাবি মানা না হলে ১১ জুন ঢাকায় জনসভা থেকে কঠোর কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়ার কথা জানিয়ে বিরোধীদলীয় নেতা বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া কোনো নির্বাচন হবে না, হতে দেওয়া হবে না।’
খালেদা জিয়া মহাসমাবেশ অনুষ্ঠানে সরকারের পদে পদে বাধা দেওয়ার প্রতিবাদে ২৯ মার্চ দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ঘোষণা দেন। তিনি এ সময় আরও জানান, তাঁরা চারদলীয় জোট সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। গতকাল তিনি সম্প্রসারিত জোটের পক্ষ থেকেই কর্মসূচিগুলোর ঘোষণা দেন।
গতকালের মহাসমাবেশ ঘিরে বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে যেমন উৎসাহ-উদ্দীপনা ছিল, তেমনি দিনভর শঙ্কাও ছিল। মহাসমাবেশের কারণে তিন-চার দিন ধরে রাজধানীর হোটেল, কমিউনিটি সেন্টারগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। তিন দিন ধরে ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের যান চলাচল ছিল প্রায় বিচ্ছিন্ন। ১১টি শর্ত দিয়ে মহাসমাবেশের অনুমতিও দেওয়া হয় শেষ মুহূর্তে। তাই কয়েক দিন ধরেই সারা দেশে চারদলীয় জোটের এই কর্মসূচি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়। সরকারের পক্ষ থেকে বারবার নাশকতার আশঙ্কাও করা হয়। প্রধানমন্ত্রী নিজেও জানমালের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন। তবে বিএনপির চেয়ারপারসন শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করার কথা বলে আসছিলেন।
মহাসমাবেশস্থলে সকাল থেকেই দলীয় নেতা-কর্মী আর সমর্থকের ঢল নামে। দুপুর ১২টার আগেই সমাবেশের জন্য নির্ধারিত নাইটিঙ্গেল মোড় থেকে ফকিরাপুল মোড় পর্যন্ত এলাকা ভরে যায়। এরপর মহাসমাবেশে আগত মানুষ শান্তিনগর মোড়, কাকরাইল মসজিদ, নটর ডেম কলেজ, দৈনিক বাংলা ও পুরানা পল্টন মোড় পর্যন্ত এলাকায় অবস্থান নেন। তবে মহাসমাবেশের জন্য মাইক ছিল একদিকে নাইটিঙ্গেল মোড়, অন্যদিকে ফকিরাপুল মোড় পর্যন্ত। তাই যাঁরা দূরে ছিলেন, বক্তব্য শুনতে না পেয়ে তাঁদের অনেকেই মহাসমাবেশ শেষ হওয়ার আগেই চলে যেতে শুরু করেন।
কর্মসূচিতে ১৬টি দলের নেতা-কর্মীরা অংশ নেন। এই ১৬ দল নিয়ে জোট সম্প্রসারিত হচ্ছে। তাঁরা ব্যানার, পোস্টার, প্ল্যাকার্ড বহন করেন। আশপাশের এলাকা ব্যানারে ছেয়ে যায়। সমাবেশস্থলে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত জামায়াতের নেতাদের ব্যানার দেখা না গেলেও জামায়াত ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরা তাঁদের মুক্তি চেয়ে পোস্টার, ব্যানার বহন করেন। সমাবেশে বক্তব্যে জামায়াতের নেতারা ছাড়া আর কেউ অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মুক্তি দাবি করেননি।
গতকাল রাজধানীতে গণপরিবহন ছিল না বললেই চলে। ফলে দূরদূরান্ত থেকে মানুষ পায়ে হেঁটে সমাবেশস্থলে আসেন। আশপাশে কোনো খাবার হোটেলও খোলা ছিল না। ফলে খাবার না পেয়ে ঢাকার বাইরের নেতা-কর্মীরা বিপাকে পড়েন।
বেলা দুইটা ৩৫ মিনিটে সমাবেশের জন্য তৈরি মঞ্চে ওঠেন খালেদা জিয়া। এ সময় স্লোগানে স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে আশপাশের এলাকা। বিকেল চারটা ৪৮ মিনিটে বক্তব্য শুরু করেন বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, সরকার ভীত হয়ে পড়েছে। এ জন্য তিন দিন ধরে সবকিছু বন্ধ করে রেখেছে। তার পরও জনস্রোত ঠেকাতে পারেনি। তিনি সমাবেশ সফল হয়েছে দাবি করে বলেন, সরকার বাধা না দিলে আজ ঢাকা জনসমুদ্রে পরিণত হতো। বিএনপিপ্রধান বলেন, ‘এত দিন দেখেছি, বিরোধী দল হরতাল ডাকে। আজ দেখলাম, সরকারি দল ভয় পেয়ে হরতাল করছে। কয়বার আটকাবেন। বারবার কর্মসূচি দেব।’
খালেদা জিয়া প্রায় এক ঘণ্টা ২০ মিনিট বক্তব্য দেন। তাঁর বক্তব্যে রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকারের ব্যর্থতার কথা উঠে আসে। পাশাপাশি ভবিষ্যতে জোট ক্ষমতায় গেলে তাঁর দল কী কী করবে, তা-ও তুলে ধরেন।
সরকারের ব্যর্থতা ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এবং গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি না থাকাসহ সরকারের জনস্বার্থ-পরিপন্থী কাজের প্রতিবাদে এপ্রিল মাসজুড়ে সারা দেশে জেলা-উপজেলায় বিক্ষোভ সমাবেশ কর্মসূচির ঘোষণা করেন খালেদা জিয়া। আর কৃষি উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি, কৃষককে ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত করার প্রতিবাদে মে মাসজুড়ে উপজেলা ও থানা ঘেরাও কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়।
পুলিশের ১১ শর্ত ও বাস্তব পরিস্থিতি: নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের সড়কে মঞ্চ স্থাপন এবং এর পূর্ব দিকে ফকিরাপুল ও পশ্চিম দিকে নাইটিঙ্গেল মোড় পর্যন্ত সমাবেশস্থল হিসেবে সীমানা চিহ্নিত করে মহাসমাবেশের অনুমতি দিয়েছিল ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ। পুলিশের আরেক শর্ত ছিল, দুই ঘণ্টা আগে সমাবেশে আসা যাবে।
কিন্তু সকাল থেকেই লোকজন সমাবেশে আসতে শুরু করে। নগরে গণপরিবহন বন্ধ এবং পথে পথে পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের তল্লাশি চৌকি ও বাধা ছিল। এর মধ্যেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা এমনকি নারায়ণগঞ্জ, সাভারের আমিনবাজার, গাজীপুর থেকেও মানুষ পুলিশ ও সরকারি দলের কর্মীদের ফাঁকি দিয়ে রিকশা, ভ্যান, অটোরিকশা ও পায়ে হেঁটে সকাল থেকে সমবেত হতে শুরু করে। বেলা দুইটার মধ্যে জনসমাগম নয়াপল্টন থেকে পূর্ব দিকে ফকিরাপুল কাঁচাবাজার আর পশ্চিম দিকে কাকরাইল উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের ফটক পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। এ ছাড়া কাকরাইল মোড় থেকে মালিবাগের দিকের রাস্তায় এস এ পরিবহনের কার্যালয় পর্যন্ত, দক্ষিণে দৈনিক বাংলা মোড়মুখী রাস্তার কিছু অংশ ও বিজয়নগরমুখী রাস্তার কিছু অংশেও লোকজন অবস্থান নেয়। আর দূরদূরান্ত থেকে পায়ে হেঁটে আসা ক্লান্ত মানুষদের অনেকেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিলেন সমাবেশস্থলের বাইরের রাস্তায়। পুরো মতিঝিল-পল্টন, ফকিরাপুল, বিজয়নগর ও আশপাশের এলাকার হোটেল-রেস্তোরাঁ বন্ধ থাকায় দূরদূরান্ত থেকে আসা অনেককে রেস্তোরাঁর সন্ধানে ঘুরতেও দেখা যায়।
পুলিশের বেঁধে দেওয়া সীমানার বাইরে মাইক না থাকায় সমবেত জনতার বড় অংশ বক্তৃতা শুনতে পারেনি। বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল বাংলাভিশন, একুশে টিভি ও ইসলামী টিভি সরাসরি সম্প্রচারের চেষ্টা করলে ক্যাবল অপারেটররা এসব টিভির সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়। খালেদার বক্তৃতার পর আবার চালু করা হয়।
রিকশাশ্রমিকের বক্তব্য দিয়ে সমাবেশ শুরু: দুপুর একটার দিকে রিকশাশ্রমিক এম এ মালেকের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সমাবেশ শুরু হয়। এরপর বক্তব্য দেন শেয়ারবাজারের ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী হারুন অর রশীদ ও হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য ফ্রন্টের আহ্বায়ক। তাঁদের বক্তব্যের পর রাজনৈতিক নেতারা বক্তব্য শুরু করেন। পর্যায়ক্রমে ইসলামী ছাত্রশিবির ও ছাত্রদল, মহিলা দল, স্বেচ্ছাসেবক দল, যুবদল, জোটের নেতা, বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা, স্থায়ী কমিটির সদস্য, চারদলীয় জোটের কেন্দ্রীয় নেতারা বক্তব্য দেন। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও ঢাকা মহানগরের সভাপতি সাদেক হোসেন খোকার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মহাসমাবেশ পরিচালনা করেন যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলন, প্রচার সম্পাদক জয়নুল আবদিন ফারুক, মহানগর বিএনপির সদস্যসচিব আবদুস সালাম ও মহানগর জামায়াতের সেক্রেটারি নুরুল ইসলাম বুলবুল।

No comments

Powered by Blogger.