সমকালীন প্রসঙ্গ-সিরিয়া দখলের জন্য মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্ত by বদরুদ্দীন উমর

সিরিয়ায় লিবিয়ার মতো তেল না থাকলেও মধ্যপ্রাচ্যে Strategic অবস্থানের দিক দিয়ে সিরিয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। ইরান সরকার ও লেবাননের হিজবুল্লাহদের সঙ্গে সিরিয়ার খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তারা ইরান আক্রমণের জন্য যে প্রস্তুতি চালাচ্ছে তাতে সিরিয়ার বর্তমান সরকারকে উচ্ছেদ করা তাদের জন্য খুব দরকার।


এদিক দিয়ে দেখলে বর্তমানে ইরান ও সিরিয়ায় তারা যে চক্রান্ত করছে এবং নানা পদ্ধতিতে আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে তার মধ্যে সম্পর্ক আছে। সিরিয়ায় আসাদ সরকার উচ্ছেদ করতে পারলে ইরানে সামরিক আগ্রাসন চালালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলের জন্য

আমেরিকান এবং ইউরোপিয়ান সাম্রাজ্যবাদীরা লিবিয়ায় যে খেলা খেলেছে সেই একই খেলা তারা এখন সিরিয়ায় খেলছে। উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে তাদেরই সমর্থিত ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রনেতাদের দীর্ঘকালীন শাসনের বিরুদ্ধে যে গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল, তার সুযোগে তারা এ অঞ্চলে অনেক নতুন নতুন চক্রান্ত কার্যকর করছে। সমগ্র অঞ্চলে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ রক্ষার জন্য তারা এখন মরিয়া হয়ে লড়ছে। তাদের জন্য এ লড়াইয়ের প্রধান স্থল এখন দাঁড়িয়েছে সিরিয়া ও ইরান। এখানে আমরা সিরিয়ার পরিস্থিতির ওপরই সংক্ষেপে আলোচনা করব।
লিবিয়ার বেনগাজিতে গাদ্দাফির বিরুদ্ধে কিছু ক্ষোভ অনেক দিন থেকেই ছিল। সেখানকার ট্রাইবাল রেষারেষি এই ক্ষোভ সৃষ্টির অন্যতম প্রধান কারণ ছিল। তাছাড়া উত্তর-পূর্বাঞ্চলের এই এলাকায় মূল তেল ক্ষেত্রগুলো থাকা সত্ত্বেও তেলের মুনাফা বণ্টনের ক্ষেত্রেও তাদের কিছু অভিযোগ ছিল। এ কারণে আমেরিকান গোয়েন্দা বিভাগ সিআইএর দ্বারা প্রতিপালিত কিছু দেশত্যাগী লোকের ওপর নির্ভর করেই তারা বেনগাজি অঞ্চলে গাদ্দাফির বিরুদ্ধে আন্দোলনের একটা ক্ষেত্র তৈরি করে সেখানে গণবিক্ষোভের সূত্রপাত ঘটায়। তিউনিসিয়া, মিসর, ইয়েমেন, বাহরাইনের মতো কোনো দীর্ঘস্থায়ী ও বড় বিক্ষোভ সেখানে সম্ভব না হওয়ায় তারা তাদের এজেন্টদের বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও অর্থ সরবরাহ করে বেনগাজিতে গাদ্দাফির বিরুদ্ধে এক সশস্ত্র লড়াই শুরু করে। এ ধরনের কোনো লড়াই তিউনিসিয়া বা মিসরে দেখা যায়নি। এ কারণে লিবিয়ায় গণহত্যার কথা বলে তারা জাতিসংঘকে দিয়ে লিবিয়ায় ঘড় ভষু তড়হব ঘোষণা করে লিবিয়ার বিমান বাহিনীকে অকেজো করে। ঘড় ভষু তড়হব ঘোষণা করে তারা লিবিয়ায় বিমান বাহিনীর বিরুদ্ধে নয়, স্থলবাহিনী এবং সরকার সমর্থক জনগণের ওপর বিশাল আকারে আকাশ থেকে বোমাবর্ষণ করে গাদ্দাফির প্রতিরোধ শক্তি নিঃশেষ এবং হাজার হাজার লিবিয়াবাসীকে হত্যা করে। এভাবে তারা লিবিয়া দখল করে নিজেদের প্রতিপালিত লোকদের দিয়ে সরকার গঠন করে এখন অবাধে সেখানকার তেলসম্পদ লুটপাট করছে। গাদ্দাফির সরকারে তাদের যে এজেন্টরা ছিল তাদেরও তারা এ কাজে বেশ ভালোভাবেই ব্যবহার করেছিল।
এখন সিরিয়াতেও তারা সেই একই পথ অনুসরণ করে অগ্রসর হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আমেরিকার সদানুগত আরব লীগকে তারা ব্যবহার করছে, যার মধ্যে সৌদি আরব এবং কুয়েতই হলো অগ্রগণ্য। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তাদের অসুবিধা দাঁড়িয়েছে এই যে, রাশিয়া ও চীন সিরিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাবিত ঘড় ভষু তড়হব কার্যকর করার বিরুদ্ধে নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো দেওয়ায় সেটা তাদের আগ্রাসনের পক্ষে বাধা সৃষ্টি করেছে। তবে তারা বেশ খোলাখুলিভাবেই এখন সিরিয়ায় তাদের এজেন্টদের অস্ত্র এবং অর্থ সরবরাহ করে সেখানে সিরিয়া সরকারের বিরুদ্ধে এক সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু করেছে। এই অস্ত্র সরবরাহের ক্ষেত্রে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন কোনো রাখঢাক না করেই নিজেদের ভূমিকা স্বীকার করেছেন। যে কাজ প্রথমে গোপনে সৌদি আরবকে দিয়ে তারা শুরু করেছিল, এখন তারা সেটা নিজেরাই খোলাখুলিভাবে করছে।
এ ধরনের অন্তর্ঘাতমূলক কাজের ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা যে কোনো দেশের সেনাবাহিনী, শাসনযন্ত্র, রাজনীতিবিদ, এমনকি সরকারি দলের মধ্যেও নিজেদের অনুপ্রবেশ ঘটায় এবং এজেন্ট তৈরি করে। লিবিয়ায় এটা দেখা দিয়েছিল এবং এখন সিরিয়াতেও তাই দেখা যাচ্ছে। এদিক দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে সাম্রাজ্যবাদী মহলের মোড়ল হিসেবে বিশ্বের সব থেকে শক্তিশালী ও মারাত্মক সন্ত্রাসী, এটাই নতুন করে প্রমাণিত হচ্ছে। তারা তাদের এই সন্ত্রাস ইরাক, আফগানিস্তান ও লিবিয়ায় সরাসরি করেছে এবং সিরিয়ায় তা গোপনে শুরু করলেও এখন খোলাখুলিভাবেই করছে।
সিরিয়ায় লিবিয়ার মতো তেল না থাকলেও মধ্যপ্রাচ্যে ঝঃৎধঃবমরপ অবস্থানের দিক দিয়ে সিরিয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। ইরান সরকার ও লেবাননের হিজবুল্লাহদের সঙ্গে সিরিয়ার খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তারা ইরান আক্রমণের জন্য যে প্রস্তুতি চালাচ্ছে তাতে সিরিয়ার বর্তমান সরকারকে উচ্ছেদ করা তাদের জন্য খুব দরকার। এদিক দিয়ে দেখলে বর্তমানে ইরান ও সিরিয়ায় তারা যে চক্রান্ত করছে এবং নানা পদ্ধতিতে আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে তার মধ্যে সম্পর্ক আছে। সিরিয়ায় আসাদ সরকার উচ্ছেদ করতে পারলে ইরানে সামরিক আগ্রাসন চালালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলের জন্য অনেক সহজ হবে। তাছাড়া সিরিয়ার সরকার উচ্ছেদ করলে এরপর লেবাননেও তাদের প্রাধান্য ও দখল প্রতিষ্ঠার পথেও তাদের বড় রকম কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকে না। কাজেই সিরিয়া দখল করতে তারা এখন বদ্ধপরিকর এবং সেদিকেই তারা অগ্রসর হচ্ছে।
নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী স্ট্র্যাটেজি কার্যকর করা এবং অন্য দেশে অনুপ্রবেশ ও হামলার পথ পরিষ্কার করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই জাতিসংঘ, বিশেষত তার নিরাপত্তা পরিষদকে ব্যবহার করে এসেছে। এই ব্যবহার ক্ষেত্রে অসুবিধা দেখা দিলে তারা জাতিসংঘের পরোয়া না করে নিজেরা এককভাবেই অন্য দেশ আক্রমণ করেছে। ইরাকই হলো এর সব থেকে উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত। বর্তমানে সিরিয়ার ক্ষেত্রে তারা জাতিসংঘকে দিয়ে অনেক প্রকার উদ্যোগ গ্রহণ করছে। জাতিসংঘের সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল কফি আনান এই মুহূর্তে সিরিয়া সফর করছেন। তাছাড়া আরব লীগকেও তারা এ কাজে ব্যবহার করছে। কিন্তু ইতিপূর্বে কিছুটা তড়িঘড়ি করে আমেরিকা আরব লীগ থেকে সিরিয়াকে বহিষ্কার করার ফলে আরব লীগের পক্ষে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা সম্ভব না হলেও আরবদের এই চরম প্রতিক্রিয়াশীল সংগঠনটিকে তারা অন্তর্ঘাতমূলক কাজ চালিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে যথাসাধ্য ব্যবহার করছে। তবে এখনও পর্যন্ত রাশিয়া ও চীন সিরিয়ায় জাতিসংঘ কর্তৃক বল প্রয়োগের বিরোধী থাকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিছুটা অসুবিধার মধ্যে আছে।
কিন্তু এসব অসুবিধা সত্ত্বেও তারা সিরিয়ায় এক বড় সংকটজনক পরিস্থিতি তৈরি করতে ইতিমধ্যেই সক্ষম হয়েছে। সেখানে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদবিরোধী পক্ষের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করলেও বিরোধী পক্ষ আসাদ সরকার উচ্ছেদের ক্ষেত্রে অনমনীয় এবং যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকায় সরকারের পক্ষে তাদের সামরিক তৎপরতা বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রতিদিনই সেখানে অনেক লোক নিহত হচ্ছে। বিরোধী বাহিনীর হাতেও যে বহু লোক ও সরকারি সেনা নিহত হচ্ছে এ ব্যাপারটি সম্পূর্ণ চাপা দিয়ে সাম্রাজ্যবাদী প্রচারমাধ্যমে শুধু সিরিয়া সরকারের হাতে লোকজন নিহত হওয়ার কথাই দিবারাত্র অক্লান্তভাবে প্রচার করছে। এখন লিবিয়ার মতো সিরিয়াতেও সরকারের মধ্যে নিজেদের অনুপ্রবেশ ঘটাতে যে তারা সক্ষম হয়েছে এর প্রমাণ পাওয়া গেল আসাদ সরকারের এক মন্ত্রীর পক্ষত্যাগের মাধ্যমে। কিন্তু লিবিয়ায় সাম্রাজ্যবাদীরা যত সহজে সাফল্য লাভ করেছিল তত সহজে সাফল্য তাদের আসছে না। তবে তারা যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে তাতে শেষ পর্যন্ত সিরিয়াতেও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দখল প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়ার উপায় নেই।
১১.৩.২০১২
অনেক সহজ হবে

No comments

Powered by Blogger.