রাজনীতি-ধর্মনিরপেক্ষতা যেদিন কর্তন হলো by মমতাজ লতিফ
বঙ্গবল্পুব্দ সংবিধানের খসড়া উপস্থাপনের সময় বলেছিলেন, '... পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। ... কেউ যদি বলে, গণতান্ত্রিক মৌলিক অধিকার নেই, আমি বলব_ সাড়ে সাত কোটি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে যদি গুটি কয়েক লোকের অধিকার হরণ করতে হয়, তা করতেই হবে'
স্পষ্ট মনে আছে, আমার বাবা সাহিত্যিক আবুল ফজল একদিন সন্ধ্যার কাছাকাছি সময়ে খবর পেলেন উপদেষ্টাদের একটি সভা রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান আহ্বান করেছেন এবং সে সভায় তিনি আমন্ত্রণ লাভ করেননি! উল্লেখ্য, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হয়েছেন এবং ওই বছরের ৩ নভেম্বর ভোরে ঢাকা জেলে অন্তরীণ অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের দক্ষ পরিচালক তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী ও কামরুজ্জামান বঙ্গবন্ধুর খুনিদের হাতে নিহত হন। এরপর সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনতে গিয়ে সিপাহি জনতার বিপ্লবের নামে সেনা অফিসার হত্যা শুরু হলে মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখা তিন সামরিক কর্মকর্তা খালেদ মোশাররফ, কর্নেল নাজমুল হুদা ও লেফটেন্যান্ট হায়দার সাধারণ সৈনিকের হাতে এমপি হোস্টেলের কাছে নিহত হন! এমন এক ঘোর অন্ধকার সময়ে রাষ্ট্রপতি সায়েম জিয়াউর রহমানের অনুরোধে বাবাকে শিক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে উপদেষ্টামণ্ডলীতে যোগ দিতে বারবার অনুনয় করতে থাকেন। অবশেষে এক পর্যায়ে তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যা ও ঢাকা জেলে চার জাতীয় নেতা হত্যার বিচার করতে হবে_ এই শর্তে উপদেষ্টামণ্ডলীতে যোগ দিতে সম্মত হন। জিয়া ও সায়েম এ শর্ত মেনে নিয়েছিলেন।
যা হোক, বাবা যখন সংবাদ পেলেন উপদেষ্টামণ্ডলীর এক সভা হয়েছে অথচ তাকে জানানো হয়নি, তখন তিনি তার পরিচিত অন্য উপদেষ্টাদের ফোনে জিজ্ঞেস করলে জানতে পারেন_ ওই সভায় আবুল ফজল ও বিনিতা রায়কে (রাজা দেবাশীষের মা) আমন্ত্রণ জানানো হয়নি এবং ওই সভায় সংবিধান থেকে 'ধর্মনিরপেক্ষতা' বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে! বাবার কাছ থেকে এ খবর শুনে বাবার সঙ্গে আলোচনাকালে আমার প্রধান একটি বক্তব্য ছিল_ ধর্মনিরপেক্ষতা মৌলনীতিটি রাষ্ট্রীয় দলিলে থাকার কারণে ধর্মীয় বা ভিন্ন সংস্কৃতির সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠী বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে সংখ্যাগুরুর সমমর্যাদার অধিকারী ছিল, যা বাস্তবে সব সময় সব নাগরিক মান্য না করলেও সংখ্যালঘু তার অধিকার ক্ষুণ্ন হলে আইনের আশ্রয় নিতে সংখ্যাগুরুর সমান অধিকার ছিল। রাষ্ট্রের মৌলনীতিতে এটি বর্জিত হলে সমাজের সংখ্যালঘু, প্রান্তিক ভিন্ন জাতিগোষ্ঠী রাষ্ট্রেই দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হয় বা হবে। তার স্বার্থ, অধিকার লঙ্ঘিত হলে তার জন্য রাষ্ট্র কোনো আইনি সহায়তার দুয়ার খুলে দিতে পারবে না_ এখন বিষয়টি তেমনই হবে। বাবাকে বলেছিলাম, দাঙ্গা হলে তুমি, মা ছুটে গিয়ে হিন্দুদের সাহায্য করতে, মুক্তিযুদ্ধ সব ধর্ম-বর্ণ-জাতি-গোষ্ঠীর দ্বারা সংগঠিত হয়েছিল বলেই নতুন রাষ্ট্রের প্রথম সংবিধানে বঙ্গবন্ধু এবং জাতীয় নেতা ও আইনবিদরা 'ধর্মনিরপেক্ষতা'কে রাষ্ট্রের মৌল প্রত্যয় হিসেবে যুক্ত করেছিলেন। তাছাড়া বাঙালির সহজিয়া ভাবধারা ছিল বাঙালিয়ানার মূল, যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ লালনসহ বৈষ্ণব এবং সুফি-ফকির-সাধকদের জীবন, সাধনা ও কর্ম। বাঙালি আগে বাংলাভাষী বাঙালি-হিন্দ-মুসলিমে ভেদাভেদহীন বাংলাভাষী, পরে মুসলমান। দুর্বলকে সব সময় সহায়তা করতে হলে প্রথমেই তাকে দিতে হবে আইনি সহায়তা, তা বাস্তবে কার্যকর হোক বা না হোক_ রাষ্ট্রের আইনের বইয়ে এ দুর্বলের সহায়ক আইন লিপিবদ্ধ থাকতে হবে। দু-চারজন করে ধীরে ধীরে এ আইনের সাহায্য নিতে শুরু করবে, ক্রমেই সমাজ প্রস্তুত হবে, তারপর আইনটি সর্বমান্য হবে।
পাকিস্তানপন্থি ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ৪ দল, গোষ্ঠী, মানুষ কখনোই মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা, মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো অবস্থাতেই সমর্থন দেবে না। ভোট দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। বরং আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়, সমর্থন করে এমন মুক্তিযুদ্ধপন্থিদের অনেকেই সংবিধানের এ অবস্থা থাকলে ভোট কেন্দ্রেই যাবে না বলে আমাদের কাছে যে মত প্রকাশ করছে, সেটিই গুরুতর সমস্যা তৈরি করবে। যদি এমন হয়, মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরা অবশ্যই সদলবলে ভোট দিচ্ছে, দেবে; অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধপন্থিরা হতাশ হয়ে ভোটদান থেকে বিরত রইল! তখন কিন্তু শেষের সেদিন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে। শুধু ২০০১ সালের মতো নয়, এর চেয়ে অনেক বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে যুদ্ধাপরাধী ও তাদের সহযোগী পাকিস্তানপন্থি দলের দানব-দানবীরা! '৭১ সালে বাঙালি ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িতার ঐক্যবদ্ধ শক্তি দিয়ে ধর্মীয় রাজনীতির ধারক, পাকিস্তানপন্থি ঘাতক দল এবং সর্বোপরি পাকিস্তানি নির্যাতক গর্বোদ্ধত সেনাবাহিনীকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিল_ এ কথা ভুললে চলবে না। এখন নতুন প্রজন্ম ২০০৮ সালে প্রমাণ করেছে তাদের অধিকাংশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী এবং তারাই '৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়েছে। এ তরুণ দল গোঁজামিল পছন্দ করে না। ইসলামী দলের ভোটের মিথ্যা আসা করলে আওয়ামী লীগের নিজস্ব ভোট ব্যাংকে আঘাত আসবে_ একথা বলার জন্য গবেষণার প্রয়োজন নেই। এই নতুন প্রজন্ম যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আস্থা রেখে সব পুরনো অন্যায়কে শুধরিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার করে উন্নত ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার জন্য যখন এগিয়ে যাচ্ছে, তখন তাদের রাজনৈতিক ভুলের দ্বারা দণ্ড দেবেন না। বরং '৭১-এর যুদ্ধাপরাধী, '৭৫-এর ৭ নভেম্বর, ২০০১ সালের পর থেকে সংঘটিত সব অমানবিক হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার করে অপরাধীদের দণ্ডিত করে দেশ ও জাতিকে রাষ্ট্রীয় দানব-দানবীমুক্ত করুন এবং নতুন প্রজন্মের চলার পথকে বিঘ্নহীন, গোঁজামিলহীন, পরিষ্কার করুন।
এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য, বঙ্গবল্পুব্দ সংবিধানের খসড়া উপস্থাপনের সময় বলেছিলেন, '... পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। ... কেউ যদি বলে, গণতান্ত্রিক মৌলিক অধিকার নেই, আমি বলব_ সাড়ে সাত কোটি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে যদি গুটি কয়েক লোকের অধিকার হরণ করতে হয়, তা করতেই হবে।'
মমতাজ লতিফ : শিক্ষক
যা হোক, বাবা যখন সংবাদ পেলেন উপদেষ্টামণ্ডলীর এক সভা হয়েছে অথচ তাকে জানানো হয়নি, তখন তিনি তার পরিচিত অন্য উপদেষ্টাদের ফোনে জিজ্ঞেস করলে জানতে পারেন_ ওই সভায় আবুল ফজল ও বিনিতা রায়কে (রাজা দেবাশীষের মা) আমন্ত্রণ জানানো হয়নি এবং ওই সভায় সংবিধান থেকে 'ধর্মনিরপেক্ষতা' বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে! বাবার কাছ থেকে এ খবর শুনে বাবার সঙ্গে আলোচনাকালে আমার প্রধান একটি বক্তব্য ছিল_ ধর্মনিরপেক্ষতা মৌলনীতিটি রাষ্ট্রীয় দলিলে থাকার কারণে ধর্মীয় বা ভিন্ন সংস্কৃতির সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠী বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে সংখ্যাগুরুর সমমর্যাদার অধিকারী ছিল, যা বাস্তবে সব সময় সব নাগরিক মান্য না করলেও সংখ্যালঘু তার অধিকার ক্ষুণ্ন হলে আইনের আশ্রয় নিতে সংখ্যাগুরুর সমান অধিকার ছিল। রাষ্ট্রের মৌলনীতিতে এটি বর্জিত হলে সমাজের সংখ্যালঘু, প্রান্তিক ভিন্ন জাতিগোষ্ঠী রাষ্ট্রেই দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হয় বা হবে। তার স্বার্থ, অধিকার লঙ্ঘিত হলে তার জন্য রাষ্ট্র কোনো আইনি সহায়তার দুয়ার খুলে দিতে পারবে না_ এখন বিষয়টি তেমনই হবে। বাবাকে বলেছিলাম, দাঙ্গা হলে তুমি, মা ছুটে গিয়ে হিন্দুদের সাহায্য করতে, মুক্তিযুদ্ধ সব ধর্ম-বর্ণ-জাতি-গোষ্ঠীর দ্বারা সংগঠিত হয়েছিল বলেই নতুন রাষ্ট্রের প্রথম সংবিধানে বঙ্গবন্ধু এবং জাতীয় নেতা ও আইনবিদরা 'ধর্মনিরপেক্ষতা'কে রাষ্ট্রের মৌল প্রত্যয় হিসেবে যুক্ত করেছিলেন। তাছাড়া বাঙালির সহজিয়া ভাবধারা ছিল বাঙালিয়ানার মূল, যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ লালনসহ বৈষ্ণব এবং সুফি-ফকির-সাধকদের জীবন, সাধনা ও কর্ম। বাঙালি আগে বাংলাভাষী বাঙালি-হিন্দ-মুসলিমে ভেদাভেদহীন বাংলাভাষী, পরে মুসলমান। দুর্বলকে সব সময় সহায়তা করতে হলে প্রথমেই তাকে দিতে হবে আইনি সহায়তা, তা বাস্তবে কার্যকর হোক বা না হোক_ রাষ্ট্রের আইনের বইয়ে এ দুর্বলের সহায়ক আইন লিপিবদ্ধ থাকতে হবে। দু-চারজন করে ধীরে ধীরে এ আইনের সাহায্য নিতে শুরু করবে, ক্রমেই সমাজ প্রস্তুত হবে, তারপর আইনটি সর্বমান্য হবে।
পাকিস্তানপন্থি ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ৪ দল, গোষ্ঠী, মানুষ কখনোই মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা, মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো অবস্থাতেই সমর্থন দেবে না। ভোট দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। বরং আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়, সমর্থন করে এমন মুক্তিযুদ্ধপন্থিদের অনেকেই সংবিধানের এ অবস্থা থাকলে ভোট কেন্দ্রেই যাবে না বলে আমাদের কাছে যে মত প্রকাশ করছে, সেটিই গুরুতর সমস্যা তৈরি করবে। যদি এমন হয়, মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরা অবশ্যই সদলবলে ভোট দিচ্ছে, দেবে; অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধপন্থিরা হতাশ হয়ে ভোটদান থেকে বিরত রইল! তখন কিন্তু শেষের সেদিন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে। শুধু ২০০১ সালের মতো নয়, এর চেয়ে অনেক বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে যুদ্ধাপরাধী ও তাদের সহযোগী পাকিস্তানপন্থি দলের দানব-দানবীরা! '৭১ সালে বাঙালি ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িতার ঐক্যবদ্ধ শক্তি দিয়ে ধর্মীয় রাজনীতির ধারক, পাকিস্তানপন্থি ঘাতক দল এবং সর্বোপরি পাকিস্তানি নির্যাতক গর্বোদ্ধত সেনাবাহিনীকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিল_ এ কথা ভুললে চলবে না। এখন নতুন প্রজন্ম ২০০৮ সালে প্রমাণ করেছে তাদের অধিকাংশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী এবং তারাই '৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়েছে। এ তরুণ দল গোঁজামিল পছন্দ করে না। ইসলামী দলের ভোটের মিথ্যা আসা করলে আওয়ামী লীগের নিজস্ব ভোট ব্যাংকে আঘাত আসবে_ একথা বলার জন্য গবেষণার প্রয়োজন নেই। এই নতুন প্রজন্ম যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আস্থা রেখে সব পুরনো অন্যায়কে শুধরিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার করে উন্নত ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার জন্য যখন এগিয়ে যাচ্ছে, তখন তাদের রাজনৈতিক ভুলের দ্বারা দণ্ড দেবেন না। বরং '৭১-এর যুদ্ধাপরাধী, '৭৫-এর ৭ নভেম্বর, ২০০১ সালের পর থেকে সংঘটিত সব অমানবিক হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার করে অপরাধীদের দণ্ডিত করে দেশ ও জাতিকে রাষ্ট্রীয় দানব-দানবীমুক্ত করুন এবং নতুন প্রজন্মের চলার পথকে বিঘ্নহীন, গোঁজামিলহীন, পরিষ্কার করুন।
এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য, বঙ্গবল্পুব্দ সংবিধানের খসড়া উপস্থাপনের সময় বলেছিলেন, '... পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। ... কেউ যদি বলে, গণতান্ত্রিক মৌলিক অধিকার নেই, আমি বলব_ সাড়ে সাত কোটি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে যদি গুটি কয়েক লোকের অধিকার হরণ করতে হয়, তা করতেই হবে।'
মমতাজ লতিফ : শিক্ষক
No comments