বাংলাদেশ কি ইমেজ সংকটের মুখে পড়েছে by তারেক শামসুর রেহমান
সৌদি দূতাবাসের প্রশাসনিক কর্মকর্তা খালাফ আল আলীর হত্যাকাণ্ডের পর মুসলিম বিশ্বের সংবাদপত্র তথা মিডিয়ায় যেভাবে সংবাদ পরিবেশন করা হয়েছে, তা বাংলাদেশের ইমেজ সংকটের জন্য যথেষ্ট। যদিও আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি কিংবা সৌদি উপরাষ্ট্রদূত জামির আল হিন্দ বলেছেন,
এই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে দুই দেশের সম্পর্কে কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে না। এটা মূলত 'কূটনৈতিক ভাষা'। কূটনীতিকরা এভাবেই কথা বলেন। সৌদি আরব আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র। সৌদি আরবের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক চমৎকার। এই একটি হত্যাকাণ্ড দিয়ে দুই দেশের সম্পর্ককে যাচাই করা যাবে না- এটা সত্য। কিন্তু বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। যদি ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য, সৌদি সরকারের বক্তব্য, সেই সঙ্গে সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর সরকার তথা রাষ্ট্রপ্রধানরা যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, তা বিশ্লেষণ করি, এটি আমাদের জন্য কোনো ভালো সংবাদ নয়। সৌদি দূতাবাসের কর্মকর্তা হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটল এমন একসময়, যখন ঢাকায় মার্কিন উপসহকারী প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস শিয়ার বললেন, অভ্যন্তরীণ ও বাইরের সন্ত্রাসী হামলার ঝুঁকিমুক্ত নয় বাংলাদেশ। (আমার দেশ ৭ মার্চ)। এটি একটি স্পষ্ট বক্তব্য। যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশকে কিভাবে দেখছে, এ ধরনের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তা স্পষ্ট হয়েছে।
'বাংলাদেশ সন্ত্রাসী হামলার ঝুঁকিমুক্ত নয়'- এ ধরনের বক্তব্যের সঙ্গে মিল রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর প্রশান্ত মহাসগরীয় অঞ্চলের প্রধান অ্যাডমিরাল রবার্ট উইলার্ডের একটি বক্তব্যের। ১ মার্চ উইলার্ড কংগ্রেস কমিটিকে জানিয়েছিলেন, 'সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের সহযোগিতার অংশ হিসেবে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ বাহিনী অবস্থান করছে। এর একটি ব্যাখ্যাও দিয়েছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা। তিনি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, বাংলাদেশে মার্কিন ঘাঁটি নেই, সহযোগিতা আছে। এখন সৌদি দূতাবাসের কর্মকর্তা যখন সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন, তখন এই মার্কিন কর্মকর্তাদের 'বাংলাদেশ সন্ত্রাসী হামলার ঝুঁকিমুক্ত নয়' বক্তব্যটি সামনে চলে আসে।
আমার কাছে এই মুহূর্তে যা বিবেচ্য তা হচ্ছে, এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়া। সৌদি সরকারের প্রতিক্রিয়া কূটনৈতিক শিষ্টাচার অনুসরণ করলেও একটি মেসেজ তাতে আছে। খুনিদের গ্রেপ্তার ও সঠিক তদন্ত চায় সৌদি আরব। সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও দাবি করেছেন।
এই 'দাবি' একটি মেসেজ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়টি যে কিভাবে নেবে, আমি জানি না।
কিন্তু সত্যি সত্যিই যদি প্রকৃত দুষ্কৃতকারীদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব না হয় কিংবা প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটন করা সম্ভব না হয়, তাহলে তা মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের জন্য বড় ধরনের কূটনৈতিক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। এই বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিবেচনায় নিলে ভালো করবে। এমনিতেই পুলিশের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে আমি রীতিমতো হতাশ। রুনি-সাগরের হত্যাকাণ্ড নিয়ে আজও কূলকিনারা হলো না। আমরা ধীরে ধীরে ভুলতে বসেছি এই হত্যাকাণ্ডের খবর। মিডিয়ায় লেখালেখির কারণে সম্ভবত এখানে একটি 'জজমিয়া নাটক' মঞ্চস্থ হয়নি। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বলেন, 'প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং রুনি-সাগরের হত্যাকাণ্ড মনিটর করছেন। আর আমি একটা ধন্দে পড়ে যাই। যদি সত্যি সত্যিই প্রধানমন্ত্রী মনিটর করে থাকনে, তাহলে এত দিন কেন লাগবে হত্যাকারীদের খুঁজে বের করতে? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের যোগ্যতা ও দক্ষতা তাই সংগতকারণেই উঠবে। পুলিশ যদি মূল কাজ ফেলে 'অন্য কাজে' বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ে, তাহলে হত্যাকারীরা তো এ সুযোগ নেবেই। পুলিশের উচিত, মূল কাজে মনোনিবেশ করা ও তাদের দক্ষতা বাড়ানো। একজন 'থ্রি স্টার জেনারেল'-এর পদ সৃষ্টি করে কিংবা পুলিশ বাহিনীর জন্য পাঁচজন সিনিয়র সচিব সৃষ্টি করে যে পুলিশ বাহিনীর দক্ষতা বাড়ানো যায় না, তা আবারও প্রমাণিত হলো খালাফ আল আলী হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। প্রধানমন্ত্রী এই মন্ত্রণালয়ের দিকে দৃষ্টি দিলে ভালো করবেন।
মার্কিন কর্মকর্তা জেমস শিয়ার যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। তিনি যখন বলেন, 'বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ ও বাইরের সন্ত্রাসী হামলার ঝুঁকিমুক্ত নয়', তখন সরকারের পক্ষ থেকে এর একটা ব্যাখ্যা দাবি করা উচিত ছিল। কেননা প্রধানমন্ত্রী তো জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, বাংলাদেশে কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নেই। এটা হচ্ছে বাস্তব কথা। বর্তমান সরকারের শাসনামলে গেল তিন বছরে আমরা কোনো বড় ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড লক্ষ করিনি। সন্ত্রাসীরা তেমনভাবে সংগঠিত হতে পারছে না। বিচ্ছিন্ন দু-একটি সংবাদ ছাপ হলেও তাদের তৎপরতা, সমাবেশ, লিফলেট বিতরণ কিংবা জমায়েতের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ থেকেছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে পুলিশ অতিরিক্ত তৎপর হয়েছে। কিন্তু ওই সব নিষিদ্ধ ঘোষিত গ্রুপ কর্তৃক কোনো ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতে আমরা দেখিনি। তাই অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসী হামলায় বাংলাদেশ একটি ঝুঁকিমুক্ত দেশ, তা নিঃসন্দেহে বলা যাবে না। বাইরের সন্ত্রাসী হামলা? এটাও তো আমাদের চোখে ধরা পড়েনি। কিছু 'ভারতীয় সন্ত্রাসী' বাংলাদেশে পাঠিয়েছিল। কিন্তু তাদের কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ছিল না এ দেশে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের হস্তান্তরের ফলে ওই অধ্যায়েরও সমাপ্তি ঘটেছে। এর বাইরে 'আল-কায়েদা' কিংবা 'লস্কর-ই-তৈয়বা'র মতো সন্ত্রাসী সংগঠনের কোনো নেটওয়ার্ক বাংলাদেশে কাজ করছে বলেও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আমাদের কখনো অবহিত করেনি। ফলে মার্কিন কর্মকর্তার বক্তব্য নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেল। তার ওই বক্তব্যের উদ্দেশ্য কী- এ প্রশ্ন এখন উঠতেই পারে।
আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিদেশ সফর করতে ভালোবাসেন। তিনি জানিয়েছেন, খালাফ আল আলীর মৃত্যুর ঘটনায় তিনি সৌদি আরবেও যাবেন। তিনি যেতেই পারেন। তাতে করে কি ভাবমূর্তি কিছুটা উজ্জ্বল হবে? বাংলাদেশি প্রায় ২৫ লাখ (প্রকারান্তরে ৩০ লাখ) নাগরিক এখন সৌদিতে কর্মরত। তাঁদের মধ্যে আতঙ্ক বাড়ছে। ৭ মার্চ রাতে একটি চ্যানেলে অংশ নিতে গিয়ে সৌদি আরব থেকে প্রবাসীরা ফোন করে আমাদের তাঁদের আতঙ্কের কথা জানিয়েছেন। এই আতঙ্কের খবরটি অত্যন্ত স্বাভাবিক। এমনিতেই বাংলাদেশ-সৌদি আরব সম্পর্ক খুব উচ্চ পর্যায়ে রয়েছে- এটা বলা যাবে না। গত ২০০৮ সাল থেকেই সৌদিতে বাংলাদেশি নাগরিকদের নিয়োগ পরিপূর্ণভাবে বন্ধ রয়েছে। এটা আমাদের একটা কূটনৈতিক ব্যর্থতা। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর এ বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দেয়নি কখনো। আমাদের পররাষ্ট্রনীতির জন্য মধ্যপ্রাচ্যের জনশক্তি বাজার যে গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান, আমাদের নীতিনির্ধারকরা তা আদৌ বিবেচনায় নেননি। আমাদের অদক্ষ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিদেশ সচিব পররাষ্ট্রনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই দিকটি বারবার এড়িয়ে গেছেন।
অথচ সৌদি আরব বাংলাদেশকে বাইরে রেখে নেপালের মতো দেশ থেকে কর্মী সংগ্রহ করে আসছিল। শুধু তা-ই নয়, সংবিধানে ২৫(২) ধারাটি সংযোজন করে আমরা মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ককে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলাম। এটি ছিল বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির একটি মূল নির্দেশনা। কিন্তু সংবিধান সংশোধনের ফলে সংবিধানের ওই ধারাটি এখন আর নেই। এতে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে 'বিশেষ সম্পর্ক'-এর ওপর যে প্রভাব ফেলছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ককে এ প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করা যেতে পারে। মোটা দাগে যেটা বলা যায়, তা হচ্ছে বাংলাদেশের নিজের স্বার্থেই উচিত এই হত্যাকাণ্ডের 'মোটিভ' খুঁজে বের করে হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করা। প্রায়াজনে সৌদি গোয়েন্দা সংস্থা কিংবা আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সহযোগিতাও নেওয়া যেতে পারে। দেশে এ মুহূর্তে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে। বিরোধী দল ১২ মার্চের কর্মসূচি পালন করে সরকারবিরোধী আন্দোলন ধীরে ধীরে শক্তিশালী করছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের উচিত হবে, অতিদ্রুত হত্যাকাণ্ডের মোটিভটি সুস্পষ্ট করা। এটি একটি স্পর্শকাতর হত্যাকাণ্ড। এর কিনারার সঙ্গে আমাদের অনেক স্বার্থ জড়িত। একটি বিদেশি রাষ্ট্রের দিকে ইঙ্গিত করে একটি সংবাদও কোনো কোনো সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। এরই প্রতিধ্বনি আমরা দেখতে পাই Global threat নামে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে গত ৯ মার্চ। সেখানেও মধ্যপ্রাচ্যের ওই রাষ্ট্রটির দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। এটা আমাদের জন্য নিঃসন্দেহে একটা চিন্তার কারণ। খুব দ্রুত আমরা যদি এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করতে না পারি, তাহলে তা শুধু সৌদি আরবের সঙ্গেই আমাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটাবে না, বরং মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোতেও এর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। তাতে করে জনশক্তি রপ্তানিতে আরো ধস নামবে। রেমিট্যান্সের প্রবাহ কমবে। আর মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত লাখ লাখ বাংলাদেশি কর্মী থাকবেন এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতায়। আমাদের জন্য সত্যিকারার্থেই তা কোনো ভালো সংবাদ নয়।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
'বাংলাদেশ সন্ত্রাসী হামলার ঝুঁকিমুক্ত নয়'- এ ধরনের বক্তব্যের সঙ্গে মিল রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর প্রশান্ত মহাসগরীয় অঞ্চলের প্রধান অ্যাডমিরাল রবার্ট উইলার্ডের একটি বক্তব্যের। ১ মার্চ উইলার্ড কংগ্রেস কমিটিকে জানিয়েছিলেন, 'সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের সহযোগিতার অংশ হিসেবে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ বাহিনী অবস্থান করছে। এর একটি ব্যাখ্যাও দিয়েছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা। তিনি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, বাংলাদেশে মার্কিন ঘাঁটি নেই, সহযোগিতা আছে। এখন সৌদি দূতাবাসের কর্মকর্তা যখন সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন, তখন এই মার্কিন কর্মকর্তাদের 'বাংলাদেশ সন্ত্রাসী হামলার ঝুঁকিমুক্ত নয়' বক্তব্যটি সামনে চলে আসে।
আমার কাছে এই মুহূর্তে যা বিবেচ্য তা হচ্ছে, এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়া। সৌদি সরকারের প্রতিক্রিয়া কূটনৈতিক শিষ্টাচার অনুসরণ করলেও একটি মেসেজ তাতে আছে। খুনিদের গ্রেপ্তার ও সঠিক তদন্ত চায় সৌদি আরব। সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও দাবি করেছেন।
এই 'দাবি' একটি মেসেজ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়টি যে কিভাবে নেবে, আমি জানি না।
কিন্তু সত্যি সত্যিই যদি প্রকৃত দুষ্কৃতকারীদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব না হয় কিংবা প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটন করা সম্ভব না হয়, তাহলে তা মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের জন্য বড় ধরনের কূটনৈতিক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। এই বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিবেচনায় নিলে ভালো করবে। এমনিতেই পুলিশের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে আমি রীতিমতো হতাশ। রুনি-সাগরের হত্যাকাণ্ড নিয়ে আজও কূলকিনারা হলো না। আমরা ধীরে ধীরে ভুলতে বসেছি এই হত্যাকাণ্ডের খবর। মিডিয়ায় লেখালেখির কারণে সম্ভবত এখানে একটি 'জজমিয়া নাটক' মঞ্চস্থ হয়নি। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বলেন, 'প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং রুনি-সাগরের হত্যাকাণ্ড মনিটর করছেন। আর আমি একটা ধন্দে পড়ে যাই। যদি সত্যি সত্যিই প্রধানমন্ত্রী মনিটর করে থাকনে, তাহলে এত দিন কেন লাগবে হত্যাকারীদের খুঁজে বের করতে? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের যোগ্যতা ও দক্ষতা তাই সংগতকারণেই উঠবে। পুলিশ যদি মূল কাজ ফেলে 'অন্য কাজে' বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ে, তাহলে হত্যাকারীরা তো এ সুযোগ নেবেই। পুলিশের উচিত, মূল কাজে মনোনিবেশ করা ও তাদের দক্ষতা বাড়ানো। একজন 'থ্রি স্টার জেনারেল'-এর পদ সৃষ্টি করে কিংবা পুলিশ বাহিনীর জন্য পাঁচজন সিনিয়র সচিব সৃষ্টি করে যে পুলিশ বাহিনীর দক্ষতা বাড়ানো যায় না, তা আবারও প্রমাণিত হলো খালাফ আল আলী হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। প্রধানমন্ত্রী এই মন্ত্রণালয়ের দিকে দৃষ্টি দিলে ভালো করবেন।
মার্কিন কর্মকর্তা জেমস শিয়ার যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। তিনি যখন বলেন, 'বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ ও বাইরের সন্ত্রাসী হামলার ঝুঁকিমুক্ত নয়', তখন সরকারের পক্ষ থেকে এর একটা ব্যাখ্যা দাবি করা উচিত ছিল। কেননা প্রধানমন্ত্রী তো জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, বাংলাদেশে কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নেই। এটা হচ্ছে বাস্তব কথা। বর্তমান সরকারের শাসনামলে গেল তিন বছরে আমরা কোনো বড় ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড লক্ষ করিনি। সন্ত্রাসীরা তেমনভাবে সংগঠিত হতে পারছে না। বিচ্ছিন্ন দু-একটি সংবাদ ছাপ হলেও তাদের তৎপরতা, সমাবেশ, লিফলেট বিতরণ কিংবা জমায়েতের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ থেকেছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে পুলিশ অতিরিক্ত তৎপর হয়েছে। কিন্তু ওই সব নিষিদ্ধ ঘোষিত গ্রুপ কর্তৃক কোনো ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতে আমরা দেখিনি। তাই অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসী হামলায় বাংলাদেশ একটি ঝুঁকিমুক্ত দেশ, তা নিঃসন্দেহে বলা যাবে না। বাইরের সন্ত্রাসী হামলা? এটাও তো আমাদের চোখে ধরা পড়েনি। কিছু 'ভারতীয় সন্ত্রাসী' বাংলাদেশে পাঠিয়েছিল। কিন্তু তাদের কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ছিল না এ দেশে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের হস্তান্তরের ফলে ওই অধ্যায়েরও সমাপ্তি ঘটেছে। এর বাইরে 'আল-কায়েদা' কিংবা 'লস্কর-ই-তৈয়বা'র মতো সন্ত্রাসী সংগঠনের কোনো নেটওয়ার্ক বাংলাদেশে কাজ করছে বলেও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আমাদের কখনো অবহিত করেনি। ফলে মার্কিন কর্মকর্তার বক্তব্য নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেল। তার ওই বক্তব্যের উদ্দেশ্য কী- এ প্রশ্ন এখন উঠতেই পারে।
আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিদেশ সফর করতে ভালোবাসেন। তিনি জানিয়েছেন, খালাফ আল আলীর মৃত্যুর ঘটনায় তিনি সৌদি আরবেও যাবেন। তিনি যেতেই পারেন। তাতে করে কি ভাবমূর্তি কিছুটা উজ্জ্বল হবে? বাংলাদেশি প্রায় ২৫ লাখ (প্রকারান্তরে ৩০ লাখ) নাগরিক এখন সৌদিতে কর্মরত। তাঁদের মধ্যে আতঙ্ক বাড়ছে। ৭ মার্চ রাতে একটি চ্যানেলে অংশ নিতে গিয়ে সৌদি আরব থেকে প্রবাসীরা ফোন করে আমাদের তাঁদের আতঙ্কের কথা জানিয়েছেন। এই আতঙ্কের খবরটি অত্যন্ত স্বাভাবিক। এমনিতেই বাংলাদেশ-সৌদি আরব সম্পর্ক খুব উচ্চ পর্যায়ে রয়েছে- এটা বলা যাবে না। গত ২০০৮ সাল থেকেই সৌদিতে বাংলাদেশি নাগরিকদের নিয়োগ পরিপূর্ণভাবে বন্ধ রয়েছে। এটা আমাদের একটা কূটনৈতিক ব্যর্থতা। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর এ বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দেয়নি কখনো। আমাদের পররাষ্ট্রনীতির জন্য মধ্যপ্রাচ্যের জনশক্তি বাজার যে গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান, আমাদের নীতিনির্ধারকরা তা আদৌ বিবেচনায় নেননি। আমাদের অদক্ষ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিদেশ সচিব পররাষ্ট্রনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই দিকটি বারবার এড়িয়ে গেছেন।
অথচ সৌদি আরব বাংলাদেশকে বাইরে রেখে নেপালের মতো দেশ থেকে কর্মী সংগ্রহ করে আসছিল। শুধু তা-ই নয়, সংবিধানে ২৫(২) ধারাটি সংযোজন করে আমরা মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ককে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলাম। এটি ছিল বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির একটি মূল নির্দেশনা। কিন্তু সংবিধান সংশোধনের ফলে সংবিধানের ওই ধারাটি এখন আর নেই। এতে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে 'বিশেষ সম্পর্ক'-এর ওপর যে প্রভাব ফেলছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ককে এ প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করা যেতে পারে। মোটা দাগে যেটা বলা যায়, তা হচ্ছে বাংলাদেশের নিজের স্বার্থেই উচিত এই হত্যাকাণ্ডের 'মোটিভ' খুঁজে বের করে হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করা। প্রায়াজনে সৌদি গোয়েন্দা সংস্থা কিংবা আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সহযোগিতাও নেওয়া যেতে পারে। দেশে এ মুহূর্তে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে। বিরোধী দল ১২ মার্চের কর্মসূচি পালন করে সরকারবিরোধী আন্দোলন ধীরে ধীরে শক্তিশালী করছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের উচিত হবে, অতিদ্রুত হত্যাকাণ্ডের মোটিভটি সুস্পষ্ট করা। এটি একটি স্পর্শকাতর হত্যাকাণ্ড। এর কিনারার সঙ্গে আমাদের অনেক স্বার্থ জড়িত। একটি বিদেশি রাষ্ট্রের দিকে ইঙ্গিত করে একটি সংবাদও কোনো কোনো সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। এরই প্রতিধ্বনি আমরা দেখতে পাই Global threat নামে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে গত ৯ মার্চ। সেখানেও মধ্যপ্রাচ্যের ওই রাষ্ট্রটির দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। এটা আমাদের জন্য নিঃসন্দেহে একটা চিন্তার কারণ। খুব দ্রুত আমরা যদি এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করতে না পারি, তাহলে তা শুধু সৌদি আরবের সঙ্গেই আমাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটাবে না, বরং মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোতেও এর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। তাতে করে জনশক্তি রপ্তানিতে আরো ধস নামবে। রেমিট্যান্সের প্রবাহ কমবে। আর মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত লাখ লাখ বাংলাদেশি কর্মী থাকবেন এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতায়। আমাদের জন্য সত্যিকারার্থেই তা কোনো ভালো সংবাদ নয়।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
No comments