স্মরণ-রাজুর পায়ের ছাপ পথ দেখায় সূর্যের দিকে

দিন পাঁচ-ছয় আগে একটি বিদেশি নম্বর থেকে কল আসে আমার মোবাইল ফোনে। আমি ফোনটি কানে তুলে ‘হ্যালো’ বলার সঙ্গে সঙ্গে সেই পরিচিত কণ্ঠটি শুনতে পাই, যার সঙ্গে পরিচিত হয়েছি আজ থেকে ২০ বছর আগের এই দিনে। বছরের অন্যান্য সময় যোগাযোগের কিছুটা ব্যবধান থাকলেও মার্চ মাস এলে নিশ্চিতভাবে কণ্ঠটি শুনতে পাই।


সারা বছর নিজেকে লুকানোর, কষ্টকে আড়াল করার শত চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায় মার্চ ঘনিয়ে এলে। টগবগে তারুণ্যোদ্দীপ্ত উচ্ছল প্রিয় সন্তানকে নিজেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছে দিয়েছিলেন ১৯৯২ সালের ১৩ মার্চের সকালে। সেই মা বিকেলে সংবাদ পেলেন, তাঁর প্রিয় ‘রাজু’ এক সাহসী ইতিহাসের জন্ম দিয়েছেন। রাজু হত্যার প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিল সারা দেশ, বাংলার বিবেক। কিন্তু তার কিছুই শুনতে পারছিলেন না রাজুর মা। তাঁর দুই চোখ শুধু খুঁজে বেড়াচ্ছিল সেই আদরের মুখটি, অপেক্ষায় ছিলেন সেই প্রিয় কণ্ঠ থেকে কখন ‘মা’ ডাক শুনতে পাবেন, কখন দেখবেন রাজুর মায়াময় চোখের দুষ্টু চাহনি। সেই অপেক্ষা দীর্ঘায়িত হতে হতে আজ ২০ বছরে পা দিয়েছে। আর এই অপেক্ষা থেকেই মার্চ ঘনিয়ে এলে মায়ের মনের অস্থিরতা বেড়ে যায়, ঘন হয়ে আসে বুকের ভেতরে লুকানো তীব্র যন্ত্রণা। তাই তো ছেলের বন্ধুদের, সহযোদ্ধাদের কাছে টেনে নিয়ে কিছুটা হালকা হতে চান।
১৩ মার্চ ১৯৯২ থেকে ১৩ মার্চ ২০১২—২০টি বছর অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু রাজুর মিছিলের সঙ্গীদের কাছে এই তো সেদিনের ঘটনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দখল নিয়ে তৎকালীন সরকারের ছাত্র সংগঠন ছাত্রদল ও প্রধান বিরোধী দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ অস্ত্রের মহড়ায় লিপ্ত ছিল। তাদের গুলির আঘাতে লজ্জিত হচ্ছিল মুক্তবুদ্ধির চর্চাকেন্দ্র আমাদের প্রিয় ক্যাম্পাস। কিন্তু দুই পক্ষের সেদিকে নজর দেওয়ার সময় কই? তারা ব্যস্ত অস্ত্রের নগ্ন আওয়াজে নিজেদের পৈশাচিক রূপটি ফুটিয়ে তুলতে, গৌরবোজ্জ্বল ছাত্ররাজনীতির কপালে কলঙ্কের টিপ পরাতে।
এই পৈশাচিকতাকে মেনে নিতে পারেনি প্রকৃত বিবেকসম্পন্ন কিছু সাহসী যুবক। সমাজতান্ত্রিক আদর্শে উজ্জীবিত ছাত্র সংগঠনগুলোর জোট গণতান্ত্রিক ছাত্রঐক্যের ব্যানারে এই সাহসী যুবকেরা গর্জে ওঠে পবিত্র ক্যাম্পাস কলুষিত করার প্রতিবাদে। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতা, মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগের মেধাবী ছাত্র মইন হোসেন রাজু সংগত কারণেই এই বিবেকতাড়িত মিছিলের বলিষ্ঠ সৈনিক ছিলেন। একদিকে চলছে ছাত্রনামধারী মাস্তানদের অস্ত্রের মহড়া, অন্যদিক থেকে বিবেকতাড়িত মিছিলের সাহসী প্রতিবাদ। অস্ত্র-গুলিকে ধিক্কার জানানো মিছিলের আওয়াজে ভীত হয়ে তৎকালীন সরকারি দলের সন্ত্রাসীরা গুলি করে সাহসী মিছিলের দিকে। টিএসসি সড়কদ্বীপের কালো রাজপথ রঞ্জিত হয় রাজুর রক্তে।
সেদিন থেকে আজ ২০ বছর। আমাদের ঐতিহ্যবাহী ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে সন্ত্রাসের বসবাসটা আরও ব্যাপৃত হয়েছে। তথাকথিত ছাত্রনেতারা ব্যস্ত নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে। মূল দলের লেজুড়বৃত্তিই তাদের যোগ্যতার মূলমন্ত্র! এসব কলঙ্কিত অন্যায়ের বাইরে অবশ্য এখনো আরেকটি স্রোতের উপস্থিতি দৃশ্যমান। যারা এখনো রাজুর আদর্শ বহন করে শিক্ষার পরিবেশ তথা ছাত্রদের ন্যায় অধিকার প্রতিষ্ঠায় গর্জে ওঠে।
আপাতদৃষ্টিতে এই স্রোতটিকে ক্ষীণকায় মনে হলেও যেকোনো সময় আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মতো বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বদলে দিতে পারে বর্তমান হতাশাব্যঞ্জক পরিস্থিতি। সন্ত্রাসীদের তথা অন্যায়কারীদের শক্তিশালী মনে হলেও বাস্তবে তারা দুর্বল। ব্যাপক সাধারণ জনগণের তীব্র ঘৃণা আছে তাদের বিরুদ্ধে। সেই ঘৃণাকে সংগঠিত করে জাগিয়ে তুলতে পারলে জয় অনিবার্য। আগস্ট ২০০৭-এর ছাত্র-আন্দোলন যার জ্বলন্ত উদাহরণ। রাজুর আদর্শের উত্তরসূরিদের সঠিক নেতৃত্বে সেদিনের শাসক পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিলেন। এমনিভাবে ভবিষ্যতেও অনাচারের বিরুদ্ধে, অনিয়মের বিরুদ্ধে, শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে" অবশ্যম্ভাবীভাবে গর্জে উঠবে রাজুর উত্তরসূরিরা। জয় হবে সত্যের, ন্যায়ের। হয়তো সেদিনের অপেক্ষায়ই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন রাজুর মা, প্রহর গুণছেন শুভক্ষণের, যেদিন রাজুর আদর্শের উত্তরসূরিরা বিজয়ের মুকুট ছিনিয়ে আনবে। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি হবে সন্ত্রাসমুক্ত, প্রতিষ্ঠিত হবে ন্যায়বিচার, চিরতরে বিদায় নেবে শোষণ-বঞ্চনা।
তাহমিদুজ্জামান tahmid1971@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.