জনপ্রতিনিধির ভাবনা-সমাজের অন্ধকারে বিপন্ন মানুষ by আবুল কালাম আজাদ
১৯৯১ সালের নির্বাচনে আমাকে বহনকারী জিপ গাড়িটি সহযাত্রীসহ পুকুরের পানিতে ডুবে গিয়েছিল। অল্পের জন্য সেদিন আমি প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলাম। দীর্ঘদিন নির্বাচনী প্রচারণার সময়ে আমার উপজেলার বিভিন্ন স্থানে যাওয়ার ফলে নিজের নির্বাচনী এলাকার মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার নানা কাহিনী, দুঃখ, বেদনা, অব্যক্ত কথা,
অব্যক্ত মর্মবেদনা, না বলা রূঢ় বাস্তবতার নির্মম কাহিনী শুনে কখনও কখনও স্তম্ভিত হয়েছি
জনপ্রতিধিদের নিয়ে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে যে, তাদের একটি অংশ এসেছে ছাত্ররাজনীতি থেকে, একটি অংশ নীতিহীন বুদ্ধিজীবী মহল থেকে, একটি অংশ মতলববাজ উচ্ছিষ্টভোগী ধর্মব্যবসায়ীদের থেকে, একটি অংশ অনৈতিক ব্যবসায়ী থেকে, কেউ প্রবেশ করেছে ব্লাডি সিভিলিয়ানকে সামরিক গণতন্ত্র শেখানোর জন্য অস্ত্র হাতে। আবার কেউ কেউ মহলবিশেষের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে অথবা জনমতের সমর্থনেই জনপ্রতিনিধি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। দেশকে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালনার জন্যই জনপ্রতিনিধিদের প্রয়োজন। জনপ্রতিনিধিত্ব সফল করতে দরকার নানা ধরনের, নানা পর্যায়ের কর্মী।
নেতৃত্বের প্রসঙ্গটি নানাভাবে পর্যবেক্ষণ এবং দলের প্রধানের অবস্থান বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, গ্রাম থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত নানা ধরনের এবং নানা পদের দলীয় লোক ও দলের সমর্থক কাজ করছে। মানুষ অবশ্য নিজের অবস্থান থেকে একটি সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা রাজনৈতিক দলের সমর্থক হয়ে বা নেতৃত্ব থেকে নিজের অস্তিত্বকে প্রকাশ করে। মানুষ রাজনীতি ছাড়াও ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক বা অন্যান্য পেশার লোকজনের সঙ্গেও বিনি সুতার মালার মতো একতাবদ্ধ থাকে।
যারা রাজনীতি করেন তারা ছোটবেলা থেকেই নিজের সুপ্ত আশাকে প্রতিফলিত করার জন্য পথপরিক্রমার মাধ্যমে নেতৃত্বের স্বপ্নকেই সঙ্গে নিয়ে চলেন। নেতৃত্বের নানা বাধা অতিক্রম করে অভীষ্ট লক্ষ্যে পেঁৗছার জন্য শিক্ষানবিশ হিসেবে নেতাকর্মীদের বিশ্বস্ততা অর্জন করে রাজনীতিতে চলার পথ তৈরি করেন।
নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেওয়ায় একদিকে যেমন বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি, অন্যদিকে তিক্ত অভিজ্ঞতারও মুখোমুখি হতে হয়েছে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে আমাকে বহনকারী জিপ গাড়িটি সহযাত্রীসহ পুকুরের পানিতে ডুবে গিয়েছিল। অল্পের জন্য সেদিন আমি প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলাম। দীর্ঘদিন নির্বাচনী প্রচারণার সময়ে আমার উপজেলার বিভিন্ন স্থানে যাওয়ার ফলে নিজের নির্বাচনী এলাকার মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার নানা কাহিনী, দুঃখ, বেদনা, অব্যক্ত কথা, অব্যক্ত মর্মবেদনা, না বলা রূঢ় বাস্তবতার নির্মম কাহিনী শুনে কখনও কখনও স্তম্ভিত হয়েছি।
প্রচারণার একপর্যায়ে একদিন রাতে রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার গুর্জ্জিপাড়া হাটে ভোট সংগ্রহের জন্য যাই। রাত সাড়ে ১০টার দিকে কয়েকজন কর্মীর পরামর্শে হাটের ছোট ছোট দোকানদারদের সঙ্গে সালাম বিনিময় ও হাত মেলানোর কাজ শুরু করি। সবাই কেনাবেচায় ব্যস্ত। এর মধ্যেই কুশল বিনিময় ও ভোটপ্রাপ্তির আবেদন। এভাবে সারা হাট ঘোরার পর হাটের এক কোনায় অবস্থিত মাছবাজারে যখন যাই, ঘড়িতে তখন রাত ১১টা। কেনাবেচার একেবারেই শেষ পর্যায়। বেশ কয়েকজন মাছ বিক্রেতার সঙ্গে কুশল বিনিময় শেষ হয়েছে। হঠাৎ দেখি দু'জন মাছ বিক্রেতা তাদের ডালায় রক্ষিত প্রায় ছয় ইঞ্চি লম্বা সিলভার কার্প মাছের পেটে টিপে মাছটা পচে গেছে না ভালো আছে তা পরখ করছে।
জিজ্ঞাসায় জেনেছি, ওই দোকানিদের একজনের নাম আবদুল, অন্যজনের নাম জিতেন্দ্র। দু'জনের মাছ পরখ করার দৃশ্যটি দেখে মনে মনে আঁতকে উঠেছি। আমি ওদের মাছ বিক্রির বাস্তব অবস্থা নিয়ে চিন্তার গভীরে পেঁৗছে গেছি। বড়জোর আধঘণ্টার মধ্যে হাট শেষ হবে। তারা তাদের ওই অবিক্রীত মাছ পচে গেছে না ভালো আছে সেটা নিয়েই যখন দ্বিধাদ্বন্দ্বে, তখন অন্যদিকে বাস্তব অবস্থা হলো, মাছগুলো প্রাকৃতিক জলাশয় বা বিল থেকে ধরা নয়। মাছচাষিদের কাছ থেকেই মাছগুলো কিনেছে তারা। লাভ করা দূরে থাক মূলধন রক্ষা করাই তাদের দায়। ঠিক সে সময়ের রূঢ় বাস্তবতা হলো, ক্ষুধার্ত স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা প্রয়োজনীয় চাল-ডাল কিনে তাদের ঘরে ফেরার প্রত্যাশা নিয়ে অপেক্ষারত।
নির্বাচনী প্রচারণার শেষ পর্যায়ে পীরগঞ্জের একটি গ্রামে গিয়েছিলাম। গ্রামটি গাইবান্ধা জেলার সাদুল্যাপুর উপজেলার ভেতরেই একটি ছিটমহলের মতো। রংপুর-ঢাকা মহাসড়কের ধাপেরহাটের কাছে গ্রামটির অবস্থান। ছোট্ট গ্রাম। কয়েক ঘর মধ্যবিত্ত এবং বেশিরভাগ নিম্নবিত্ত মানুষের বসবাস এই রসুলপুর নামের গ্রামে। দেশের হাজার হাজার গ্রামে যেমন সব ধর্মের লোকের সহাবস্থান, এই গ্রামটিতেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। মুসলমান ও হিন্দু উভয় ধর্মের লোকের অবস্থান গ্রামটিতে।
উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত গ্রামটি। বড় রাস্তা থেকে পূর্বদিকের রাস্তা ধরে হাঁটলে সরাসরি মসজিদ ঘরটির কাছ পর্যন্ত যাওয়া যায়। মসজিদের চারদিকে ইটের দেয়াল, ওপরে টিনের চালা। নির্বাচনী প্রচারণার একেবারেই শেষদিকে রাত ১১টায় মসজিদের আশপাশের লোকজনের সঙ্গে কুশল বিনিময় করি। প্রার্থীর পক্ষে ভোট চাইলে তারা দুঃখ করে বলেছিল, আমরা বরাবরই নৌকায় ভোট দিই। কিন্তু স্বাধীনতার পর কোনো নেতাকর্মী আমাদের কাছে ভোট চাইতে আসেননি। গ্রাম যাদের লেখাপড়া শিখিয়ে ডাক্তার-ব্যারিস্টার তৈরি করেছে, তারা এখন বড় বড় শহরে বাস করেন। আবার কেউ কেউ বিদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য পাড়ি জমান। শিক্ষিত লোক গ্রামে থেকে শহরে চলে যাওয়ার এ ধারা অব্যাহত থাকলে গ্রামগুলো আস্তে আস্তে অশিক্ষিত, টাউট-বাটপার এবং মিথ্যাবাদী লোকে ভরে যাবে।
গ্রামটির উত্তর দিকের দরিদ্র হিন্দু জেলেপাড়ায় যখন যাই রাত তখন সাড়ে ১১টা। পাড়ায় ঢুকেই তাদের পাড়ায় মন্দির আছে কি-না জিজ্ঞেস করেছি। আমার উদ্দেশ্য ছিল মন্দিরের কাছে সবাইকে নিয়ে ভোট চাওয়া। উদ্দেশ্য মতো আমাকে নেওয়া হলো তাদের মন্দিরের কাছে। মন্দিরটির চারদিকে ছোট ছোট কুঁড়েঘরে জেলেদের বসবাস। একদিকের কোনায় মন্দিরটির অবস্থান। খড়ের চালের ছোট্ট একটা ঘরেই বসানো হয়েছে তাদের ঠাকুর দেবতাকে। ঘরটিতে দরজা-জানালার বালাই নেই। মন্দিরের ঘরটি এবং রক্ষিত ঠাকুর দেবতাকে দেখলেই এর চারপাশের বাসিন্দাদের আর্থিক অবস্থা সহজে উপলব্ধি করা যায়। সেখানে অধিকাংশ মহিলা তখনও জেগে আছেন। মন্দিরের পাশে অনেকেই সমবেত।
উপস্থিত লোকজনের মধ্যে মহিলার সংখ্যাই বেশি। মন্দিরের সামনে দাঁড়ানো এক গৃহবধূকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তার নাম কী? উত্তরে বলেছিলেন শ্রীমতী। কৌতূহলে জিজ্ঞেস করেছি, তার রাতের খাবার তিনি রেঁধেছেন কি-না। শীর্ণকায় শরীর, বেশ চটপটে বউটি। হাসিমুখে বলেছিলেন, তার রাতের খাবার তিনি রেঁধেছেন। জিজ্ঞেস করেছিলাম, তার পরিবারের সদস্যসংখ্যা কত। বলেছিলেন_ শাশুড়ি, দুই বছরের মেয়ে এবং তারা স্বামী-স্ত্রী। এবার উপস্থিত মহিলাদের মধ্যে প্রায় জনাবিশেককে জিজ্ঞেস করেছিলাম তারা রাতের খাবার রেঁধেছেন কি-না। পিলে চমকে দেওয়ার মতো উত্তর দিয়েছেন_ না, তারা কেউ রাঁধেননি। ছোট মেয়েমেয়েরা অনেকেই অভুক্ত অবস্থায় শুধু পানি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।
কেন তারা রাঁধেননি? বারবার জিজ্ঞেস করেও কোনো সদুত্তর না পেয়ে আবার শ্রীমতীকেই জিজ্ঞেস করেছিলাম, বাকিরা তাদের খাবার রাঁধেননি কেন? এবার শ্রীমতী অবনতমস্তকে দুঃখভারাক্রান্ত মনে বিনীতভাবে খুব আস্তে আস্তে বলেছিলেন, আমাদের এ পাড়ার সবাই গরিব জেলে। পশ্চিম দিকের বড় রাস্তার ধারে নদীতে আমাদের পাড়ার লোকেরা মাছ ধরত। নদী এখন শুকনো। বর্ষায়ও আগের মতো আর তেমন মাছ পাওয়া যায় না। গ্রামের পাশের একসময় মাছে পরিপূর্ণ খাটমারা বিলটি বড়লোকেরা লিজ নিয়ে ভরাট করে ধান চাষ করে। আর গ্রামের পূর্বদিকের বিলটি এখন এলাকার মতলববাজ লোকরা লিজ নিয়েছে। সেখানে তারা আমাদের জেলেদের মাছ ধরতে দেয় না। বিভিন্ন পুকুরে চাষ করা মাছ কেনাবেচা করেই আমাদের পাড়ার জেলেরা সংসার চালায়। হাট শেষে তাদের ব্যবসার লভ্যাংশ দিয়েই চাল, ডাল, সবজি কিনে বাড়িতে ফিরবে। হাট বেশ দূরে হওয়ায় এখনও কেউ পাড়ায় ফেরেনি। তারা ফিরলেই সবার হাঁড়িতে চাল, ডাল, সবজি সিদ্ধ হবে। এর পরই হবে তাদের ছেলেমেয়ে নিয়ে খাওয়াদাওয়া। অত্যন্ত সত্য এবং বাস্তবতার নির্মম অবস্থাটির বর্ণনা শুনে গভীর দুঃখবোধে ভারাক্রান্ত হয়েছি। সে দিনের মতো প্রচারণার কাজ শেষ করে বাড়িতে ফেরার পথে মনে মনে ভেবেছি, যেসব পরিবারে এক সন্ধ্যা খাবারের সঞ্চয় থাকে না, আবদুল আর জিতেন্দ্রদের মতো জেলেদের মাঝরাতে অবিক্রীত মাছের পেট টিপে পচে গেছে কি-না পরখ করতে হয়, বউ-ছেলে-মেয়ে নিয়ে পুরো পরিবার তীব্র ক্ষুধায় চাল, ডাল, সবজি নিয়ে জেলেদের ঘরে ফেরার অপেক্ষায় থাকে; বারবার মনে প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে, শতমুখী অভাবের এই দরিদ্র মানুষগুলোর সমস্যার সমাধান কীভাবে সম্ভব হবে?
আবুল কালাম আজাদ : সংসদ সদস্য
জনপ্রতিধিদের নিয়ে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে যে, তাদের একটি অংশ এসেছে ছাত্ররাজনীতি থেকে, একটি অংশ নীতিহীন বুদ্ধিজীবী মহল থেকে, একটি অংশ মতলববাজ উচ্ছিষ্টভোগী ধর্মব্যবসায়ীদের থেকে, একটি অংশ অনৈতিক ব্যবসায়ী থেকে, কেউ প্রবেশ করেছে ব্লাডি সিভিলিয়ানকে সামরিক গণতন্ত্র শেখানোর জন্য অস্ত্র হাতে। আবার কেউ কেউ মহলবিশেষের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে অথবা জনমতের সমর্থনেই জনপ্রতিনিধি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। দেশকে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালনার জন্যই জনপ্রতিনিধিদের প্রয়োজন। জনপ্রতিনিধিত্ব সফল করতে দরকার নানা ধরনের, নানা পর্যায়ের কর্মী।
নেতৃত্বের প্রসঙ্গটি নানাভাবে পর্যবেক্ষণ এবং দলের প্রধানের অবস্থান বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, গ্রাম থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত নানা ধরনের এবং নানা পদের দলীয় লোক ও দলের সমর্থক কাজ করছে। মানুষ অবশ্য নিজের অবস্থান থেকে একটি সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা রাজনৈতিক দলের সমর্থক হয়ে বা নেতৃত্ব থেকে নিজের অস্তিত্বকে প্রকাশ করে। মানুষ রাজনীতি ছাড়াও ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক বা অন্যান্য পেশার লোকজনের সঙ্গেও বিনি সুতার মালার মতো একতাবদ্ধ থাকে।
যারা রাজনীতি করেন তারা ছোটবেলা থেকেই নিজের সুপ্ত আশাকে প্রতিফলিত করার জন্য পথপরিক্রমার মাধ্যমে নেতৃত্বের স্বপ্নকেই সঙ্গে নিয়ে চলেন। নেতৃত্বের নানা বাধা অতিক্রম করে অভীষ্ট লক্ষ্যে পেঁৗছার জন্য শিক্ষানবিশ হিসেবে নেতাকর্মীদের বিশ্বস্ততা অর্জন করে রাজনীতিতে চলার পথ তৈরি করেন।
নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেওয়ায় একদিকে যেমন বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি, অন্যদিকে তিক্ত অভিজ্ঞতারও মুখোমুখি হতে হয়েছে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে আমাকে বহনকারী জিপ গাড়িটি সহযাত্রীসহ পুকুরের পানিতে ডুবে গিয়েছিল। অল্পের জন্য সেদিন আমি প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলাম। দীর্ঘদিন নির্বাচনী প্রচারণার সময়ে আমার উপজেলার বিভিন্ন স্থানে যাওয়ার ফলে নিজের নির্বাচনী এলাকার মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার নানা কাহিনী, দুঃখ, বেদনা, অব্যক্ত কথা, অব্যক্ত মর্মবেদনা, না বলা রূঢ় বাস্তবতার নির্মম কাহিনী শুনে কখনও কখনও স্তম্ভিত হয়েছি।
প্রচারণার একপর্যায়ে একদিন রাতে রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার গুর্জ্জিপাড়া হাটে ভোট সংগ্রহের জন্য যাই। রাত সাড়ে ১০টার দিকে কয়েকজন কর্মীর পরামর্শে হাটের ছোট ছোট দোকানদারদের সঙ্গে সালাম বিনিময় ও হাত মেলানোর কাজ শুরু করি। সবাই কেনাবেচায় ব্যস্ত। এর মধ্যেই কুশল বিনিময় ও ভোটপ্রাপ্তির আবেদন। এভাবে সারা হাট ঘোরার পর হাটের এক কোনায় অবস্থিত মাছবাজারে যখন যাই, ঘড়িতে তখন রাত ১১টা। কেনাবেচার একেবারেই শেষ পর্যায়। বেশ কয়েকজন মাছ বিক্রেতার সঙ্গে কুশল বিনিময় শেষ হয়েছে। হঠাৎ দেখি দু'জন মাছ বিক্রেতা তাদের ডালায় রক্ষিত প্রায় ছয় ইঞ্চি লম্বা সিলভার কার্প মাছের পেটে টিপে মাছটা পচে গেছে না ভালো আছে তা পরখ করছে।
জিজ্ঞাসায় জেনেছি, ওই দোকানিদের একজনের নাম আবদুল, অন্যজনের নাম জিতেন্দ্র। দু'জনের মাছ পরখ করার দৃশ্যটি দেখে মনে মনে আঁতকে উঠেছি। আমি ওদের মাছ বিক্রির বাস্তব অবস্থা নিয়ে চিন্তার গভীরে পেঁৗছে গেছি। বড়জোর আধঘণ্টার মধ্যে হাট শেষ হবে। তারা তাদের ওই অবিক্রীত মাছ পচে গেছে না ভালো আছে সেটা নিয়েই যখন দ্বিধাদ্বন্দ্বে, তখন অন্যদিকে বাস্তব অবস্থা হলো, মাছগুলো প্রাকৃতিক জলাশয় বা বিল থেকে ধরা নয়। মাছচাষিদের কাছ থেকেই মাছগুলো কিনেছে তারা। লাভ করা দূরে থাক মূলধন রক্ষা করাই তাদের দায়। ঠিক সে সময়ের রূঢ় বাস্তবতা হলো, ক্ষুধার্ত স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা প্রয়োজনীয় চাল-ডাল কিনে তাদের ঘরে ফেরার প্রত্যাশা নিয়ে অপেক্ষারত।
নির্বাচনী প্রচারণার শেষ পর্যায়ে পীরগঞ্জের একটি গ্রামে গিয়েছিলাম। গ্রামটি গাইবান্ধা জেলার সাদুল্যাপুর উপজেলার ভেতরেই একটি ছিটমহলের মতো। রংপুর-ঢাকা মহাসড়কের ধাপেরহাটের কাছে গ্রামটির অবস্থান। ছোট্ট গ্রাম। কয়েক ঘর মধ্যবিত্ত এবং বেশিরভাগ নিম্নবিত্ত মানুষের বসবাস এই রসুলপুর নামের গ্রামে। দেশের হাজার হাজার গ্রামে যেমন সব ধর্মের লোকের সহাবস্থান, এই গ্রামটিতেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। মুসলমান ও হিন্দু উভয় ধর্মের লোকের অবস্থান গ্রামটিতে।
উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত গ্রামটি। বড় রাস্তা থেকে পূর্বদিকের রাস্তা ধরে হাঁটলে সরাসরি মসজিদ ঘরটির কাছ পর্যন্ত যাওয়া যায়। মসজিদের চারদিকে ইটের দেয়াল, ওপরে টিনের চালা। নির্বাচনী প্রচারণার একেবারেই শেষদিকে রাত ১১টায় মসজিদের আশপাশের লোকজনের সঙ্গে কুশল বিনিময় করি। প্রার্থীর পক্ষে ভোট চাইলে তারা দুঃখ করে বলেছিল, আমরা বরাবরই নৌকায় ভোট দিই। কিন্তু স্বাধীনতার পর কোনো নেতাকর্মী আমাদের কাছে ভোট চাইতে আসেননি। গ্রাম যাদের লেখাপড়া শিখিয়ে ডাক্তার-ব্যারিস্টার তৈরি করেছে, তারা এখন বড় বড় শহরে বাস করেন। আবার কেউ কেউ বিদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য পাড়ি জমান। শিক্ষিত লোক গ্রামে থেকে শহরে চলে যাওয়ার এ ধারা অব্যাহত থাকলে গ্রামগুলো আস্তে আস্তে অশিক্ষিত, টাউট-বাটপার এবং মিথ্যাবাদী লোকে ভরে যাবে।
গ্রামটির উত্তর দিকের দরিদ্র হিন্দু জেলেপাড়ায় যখন যাই রাত তখন সাড়ে ১১টা। পাড়ায় ঢুকেই তাদের পাড়ায় মন্দির আছে কি-না জিজ্ঞেস করেছি। আমার উদ্দেশ্য ছিল মন্দিরের কাছে সবাইকে নিয়ে ভোট চাওয়া। উদ্দেশ্য মতো আমাকে নেওয়া হলো তাদের মন্দিরের কাছে। মন্দিরটির চারদিকে ছোট ছোট কুঁড়েঘরে জেলেদের বসবাস। একদিকের কোনায় মন্দিরটির অবস্থান। খড়ের চালের ছোট্ট একটা ঘরেই বসানো হয়েছে তাদের ঠাকুর দেবতাকে। ঘরটিতে দরজা-জানালার বালাই নেই। মন্দিরের ঘরটি এবং রক্ষিত ঠাকুর দেবতাকে দেখলেই এর চারপাশের বাসিন্দাদের আর্থিক অবস্থা সহজে উপলব্ধি করা যায়। সেখানে অধিকাংশ মহিলা তখনও জেগে আছেন। মন্দিরের পাশে অনেকেই সমবেত।
উপস্থিত লোকজনের মধ্যে মহিলার সংখ্যাই বেশি। মন্দিরের সামনে দাঁড়ানো এক গৃহবধূকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তার নাম কী? উত্তরে বলেছিলেন শ্রীমতী। কৌতূহলে জিজ্ঞেস করেছি, তার রাতের খাবার তিনি রেঁধেছেন কি-না। শীর্ণকায় শরীর, বেশ চটপটে বউটি। হাসিমুখে বলেছিলেন, তার রাতের খাবার তিনি রেঁধেছেন। জিজ্ঞেস করেছিলাম, তার পরিবারের সদস্যসংখ্যা কত। বলেছিলেন_ শাশুড়ি, দুই বছরের মেয়ে এবং তারা স্বামী-স্ত্রী। এবার উপস্থিত মহিলাদের মধ্যে প্রায় জনাবিশেককে জিজ্ঞেস করেছিলাম তারা রাতের খাবার রেঁধেছেন কি-না। পিলে চমকে দেওয়ার মতো উত্তর দিয়েছেন_ না, তারা কেউ রাঁধেননি। ছোট মেয়েমেয়েরা অনেকেই অভুক্ত অবস্থায় শুধু পানি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।
কেন তারা রাঁধেননি? বারবার জিজ্ঞেস করেও কোনো সদুত্তর না পেয়ে আবার শ্রীমতীকেই জিজ্ঞেস করেছিলাম, বাকিরা তাদের খাবার রাঁধেননি কেন? এবার শ্রীমতী অবনতমস্তকে দুঃখভারাক্রান্ত মনে বিনীতভাবে খুব আস্তে আস্তে বলেছিলেন, আমাদের এ পাড়ার সবাই গরিব জেলে। পশ্চিম দিকের বড় রাস্তার ধারে নদীতে আমাদের পাড়ার লোকেরা মাছ ধরত। নদী এখন শুকনো। বর্ষায়ও আগের মতো আর তেমন মাছ পাওয়া যায় না। গ্রামের পাশের একসময় মাছে পরিপূর্ণ খাটমারা বিলটি বড়লোকেরা লিজ নিয়ে ভরাট করে ধান চাষ করে। আর গ্রামের পূর্বদিকের বিলটি এখন এলাকার মতলববাজ লোকরা লিজ নিয়েছে। সেখানে তারা আমাদের জেলেদের মাছ ধরতে দেয় না। বিভিন্ন পুকুরে চাষ করা মাছ কেনাবেচা করেই আমাদের পাড়ার জেলেরা সংসার চালায়। হাট শেষে তাদের ব্যবসার লভ্যাংশ দিয়েই চাল, ডাল, সবজি কিনে বাড়িতে ফিরবে। হাট বেশ দূরে হওয়ায় এখনও কেউ পাড়ায় ফেরেনি। তারা ফিরলেই সবার হাঁড়িতে চাল, ডাল, সবজি সিদ্ধ হবে। এর পরই হবে তাদের ছেলেমেয়ে নিয়ে খাওয়াদাওয়া। অত্যন্ত সত্য এবং বাস্তবতার নির্মম অবস্থাটির বর্ণনা শুনে গভীর দুঃখবোধে ভারাক্রান্ত হয়েছি। সে দিনের মতো প্রচারণার কাজ শেষ করে বাড়িতে ফেরার পথে মনে মনে ভেবেছি, যেসব পরিবারে এক সন্ধ্যা খাবারের সঞ্চয় থাকে না, আবদুল আর জিতেন্দ্রদের মতো জেলেদের মাঝরাতে অবিক্রীত মাছের পেট টিপে পচে গেছে কি-না পরখ করতে হয়, বউ-ছেলে-মেয়ে নিয়ে পুরো পরিবার তীব্র ক্ষুধায় চাল, ডাল, সবজি নিয়ে জেলেদের ঘরে ফেরার অপেক্ষায় থাকে; বারবার মনে প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে, শতমুখী অভাবের এই দরিদ্র মানুষগুলোর সমস্যার সমাধান কীভাবে সম্ভব হবে?
আবুল কালাম আজাদ : সংসদ সদস্য
No comments