বাঘা তেঁতুল-ঘোড়াবন্ধন ও বিমান ভাঙচুর by সৈয়দ আবুল মকসুদ
প্রতিবাদের পদ্ধতি হিসেবে মানববন্ধন এক নম্বরে আজ বাংলার মাটিতে। এক যুগ আগেও এই জিনিস ছিল না। সাত-আট বছর ধরে এমন দিন নেই, যেদিন সারা দেশে ১০টি মানববন্ধন না হয়। তবে ঘোড়াবন্ধন ছিল না। সেটাও হয়ে গেল কক্সবাজারে।
সমুদ্রসৈকতে পর্যটকদের ঘোড়ায় চড়িয়ে ছবি তুলে অনেকে কিছু কামাই করত। সৈকত থেকে ঘোড়া সরানোর প্রতিবাদে জেলা প্রশাসকের অফিসের কাছে ঘোড়াবন্ধন হয়েছে বলে কাগজে পড়লাম।
মানববন্ধন শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের পদ্ধতি। গাড়ি ভাঙচুর সহিংস প্রতিবাদের ভাষা। আমার কাছে যে হিসাব আছে তাতে বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ১০টি গাড়ি ভাঙচুর অথবা পোড়ানো হয়। একটি গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে তো প্রতিবাদে ভাঙো ২৫টি। দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে ঝগড়া বেধেছে তো মাইল খানেকজুড়ে করো শ খানেক গাড়ি ভাঙচুর। গাড়ি ভাঙচুর হলেও বিমান ভাঙচুরের ঘটনা এখনো ঘটেনি। বাংলার মাটিতে ইতিহাসের প্রথম বিমান ভাঙচুর হতে যাচ্ছিল সৈয়দপুর বিমানবন্দরে।
একটি বেসরকারি বিমান সংস্থার সৈয়দপুর-ঢাকা ফ্লাইটটির জন্য ৩৩টি টিকিট বিক্রি করা হয়। ওই বিমানটি ছিল ৬০ আসনের। যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে নির্ধারিত বিমানটির পরিবর্তে ছোট একটি বিমান সৈয়দপুর পৌঁছে দেড় ঘণ্টা বিলম্বে। ২৯ আসনের বিমানটি রাজশাহী থেকেই নিয়ে আসে আট যাত্রী। বিমানবন্দরে উপস্থিত ৩৩ জন যাত্রীর মধ্যে ১২ জন আসন না পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। হট্টগোল শুরু হয়। যাত্রীদের দাবি, কেউ যাবেন আর কেউ যাবেন না, তা হবে না। গেলে ৩৩ জনের সবাই যাবেন, তা না হলে বিমান উড়তে দেওয়া হবে না। পরিস্থিতি বেসামাল দেখে কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে টার্মিনাল ভবন ও বিমানটি রক্ষায় পুলিশ মোতায়েন করে। পরে সৈয়দপুর থেকে কোনো যাত্রী না নিয়েই বিমানটি বিমানবন্দর ত্যাগ করে। বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠেছিল। বাধ্য হয়ে বিমানটি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।’
পরিস্থিতি যে ভয়াবহ হয়ে উঠেছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সরিয়ে না নিলে এক বিমান ভাঙচুরের জন্য ৩৩ জনই যথেষ্ট ছিল। তবে অ্যাকশন শুরু হলে আশপাশের গ্রামের হাজার কয়েক মানুষের স্বেচ্ছাসেবা ও পূর্ণ সহযোগিতা যে পাওয়া যেত না, তা আমরা বিশ্বাস করি না।
দিব্যচোখে যে দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি তা হলো: বিমানটি উড়াল দিল। আকাশের দিকে তাকিয়ে ৩৩টি হতাশ মুখ। প্রথমে মওলানা ভাসানীর মতো ‘কেউ খাবে তো কেউ খাবে না’ বলে সমাজবাদী চেতনার প্রকাশ ঘটালেও, শেষ পর্যন্ত যে ৩৩ জন ঐক্যবদ্ধ ছিলেন, তা নয়। আমাদের মাওবাদী কমিউনিস্টদের মতো তাঁরা বহু ভাগে বিভক্ত হননি। মাত্র দুটি ভাগ। একদিকে প্রায় ভাগ্যবান ২১ সাবেক যাত্রী। তাঁদের হতাশা ছিল গভীরতর। তাঁদের বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছেন যে ১২ জন, তাঁরা দ্বিতীয় দলে। হতাশার মধ্যেও তাঁদের চোখেমুখে মিশ্রিত ছিল নির্মল আনন্দের আভা। তাঁদের মনোভাব: আমরা যাইতে পারি নাই তো ক্ষতি নাই, তোমাদেরও যাইতে দেই নাই। বোঝো, সিট না পাওয়ার ব্যথা। তাঁরা সিট পানেঅলাদের দিকে হাসিমুখে তাকিয়েছেন। সিটবঞ্চিতদের দিকে চোখ লাল করে দৃষ্টি হেনেছেন প্রায়-ভাগ্যবানেরা।
যা হোক, আনন্দের কথা এই যে, বিমান ভাঙচুর হয়নি। বিমান উড়াল দেওয়ার পরও দুই গ্রুপের মধ্যে এমন কিছু ঘটেনি, যাতে স্থানীয় ক্লিনিকের মালিকদের হতো পোয়াবারো এবং ঢাকা থেকে অন্য বিমান পাঠাতে হতো কোনো কোনো সাবেক যাত্রীকে পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে আসতে।
প্রতিদিন টেলিভিশনের পর্দা বলছে, বাঙালি বীরের জাতি। বাঙালি প্রতিবাদী। মানববন্ধন, ঘোড়াবন্ধন, গাড়ি ভাঙচুর প্রভৃতি তো প্রতিবাদ করতেই করা হয়। প্রতিবাদের বিচিত্র পদ্ধতি। ছেলে খাওয়া-পরা দেয় না। ছেলের বাড়ির সামনে বাবা-মা অনশন করছেন, কাগজে পড়লাম। পাশের গ্রামের বেকার লিকলিকে ছোকরা কথা দিয়েও বিয়ে করছে না। তার বাড়ির সামনে গিয়ে মেয়েটির অনশন। বহু মেয়ের বাপের বাড়ির দরজায়ও অবস্থান ধর্মঘট হচ্ছে। রাজশাহীতে এতিম শিশুরা রাস্তায় শুয়ে প্রতিবাদ করেছে এবং তাতে ভালো কাজও হয়েছে। নিউইয়র্ক বিমানবন্দর ও জাতিসংঘের সদর দপ্তরের সামনে বাঙালিরা যত বিক্ষোভ ও কালো পতাকা প্রদর্শন করেছে, সারা দুনিয়ার সব জাতি মিলেও তা করেনি। একটি প্রতিবাদের উপলক্ষ পেলে বাঙালি তা হাতছাড়া করে না।
বাঙালি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে কোনো সমস্যার সমাধান চায় না। আগেই গলার রগ ফুলায়, আস্তিন গোটায়, মালকোচা মারে অথবা কোমরে শাড়ি পেঁচায়। ধারণা করি, সৈয়দপুর বিমানবন্দরের ওই পরিস্থিতি জাপান, কোরিয়া, ফিনল্যান্ডের কোনো বিমানবন্দরে সৃষ্টি হলে ৩৩ যাত্রীর সবাই বলতেন, যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে বড় বিমান আসতে পারেনি। এই ছোট বিমানটিতে যাঁদের খুব বেশি দরকার তাঁরা যান। আমরা পরের ফ্লাইটে যাব। কেউই না যাওয়ার চেয়ে তো কেউ কেউ যাওয়া ভালো।
সৈয়দপুরের ঘটনাটি আমার কাছে মনে হচ্ছে আমাদের জাতীয় রাজনীতির রূপক। আমরা ক্ষমতায় নেই তো তোমাদেরও শান্তিতে থাকতে দেব না। আমরা যদি আবার ক্ষমতায় না যেতে পারি, তো তোমাদেরও যেতে দেব না। তাতে আমাদের দুই পক্ষকে বাদ দিয়ে অন্য যাদের খুশি তারা ক্ষমতার বিমানটিতে চড়ে যেদিকে খুশি সেদিকে যাক।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
মানববন্ধন শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের পদ্ধতি। গাড়ি ভাঙচুর সহিংস প্রতিবাদের ভাষা। আমার কাছে যে হিসাব আছে তাতে বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ১০টি গাড়ি ভাঙচুর অথবা পোড়ানো হয়। একটি গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে তো প্রতিবাদে ভাঙো ২৫টি। দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে ঝগড়া বেধেছে তো মাইল খানেকজুড়ে করো শ খানেক গাড়ি ভাঙচুর। গাড়ি ভাঙচুর হলেও বিমান ভাঙচুরের ঘটনা এখনো ঘটেনি। বাংলার মাটিতে ইতিহাসের প্রথম বিমান ভাঙচুর হতে যাচ্ছিল সৈয়দপুর বিমানবন্দরে।
একটি বেসরকারি বিমান সংস্থার সৈয়দপুর-ঢাকা ফ্লাইটটির জন্য ৩৩টি টিকিট বিক্রি করা হয়। ওই বিমানটি ছিল ৬০ আসনের। যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে নির্ধারিত বিমানটির পরিবর্তে ছোট একটি বিমান সৈয়দপুর পৌঁছে দেড় ঘণ্টা বিলম্বে। ২৯ আসনের বিমানটি রাজশাহী থেকেই নিয়ে আসে আট যাত্রী। বিমানবন্দরে উপস্থিত ৩৩ জন যাত্রীর মধ্যে ১২ জন আসন না পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। হট্টগোল শুরু হয়। যাত্রীদের দাবি, কেউ যাবেন আর কেউ যাবেন না, তা হবে না। গেলে ৩৩ জনের সবাই যাবেন, তা না হলে বিমান উড়তে দেওয়া হবে না। পরিস্থিতি বেসামাল দেখে কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে টার্মিনাল ভবন ও বিমানটি রক্ষায় পুলিশ মোতায়েন করে। পরে সৈয়দপুর থেকে কোনো যাত্রী না নিয়েই বিমানটি বিমানবন্দর ত্যাগ করে। বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠেছিল। বাধ্য হয়ে বিমানটি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।’
পরিস্থিতি যে ভয়াবহ হয়ে উঠেছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সরিয়ে না নিলে এক বিমান ভাঙচুরের জন্য ৩৩ জনই যথেষ্ট ছিল। তবে অ্যাকশন শুরু হলে আশপাশের গ্রামের হাজার কয়েক মানুষের স্বেচ্ছাসেবা ও পূর্ণ সহযোগিতা যে পাওয়া যেত না, তা আমরা বিশ্বাস করি না।
দিব্যচোখে যে দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি তা হলো: বিমানটি উড়াল দিল। আকাশের দিকে তাকিয়ে ৩৩টি হতাশ মুখ। প্রথমে মওলানা ভাসানীর মতো ‘কেউ খাবে তো কেউ খাবে না’ বলে সমাজবাদী চেতনার প্রকাশ ঘটালেও, শেষ পর্যন্ত যে ৩৩ জন ঐক্যবদ্ধ ছিলেন, তা নয়। আমাদের মাওবাদী কমিউনিস্টদের মতো তাঁরা বহু ভাগে বিভক্ত হননি। মাত্র দুটি ভাগ। একদিকে প্রায় ভাগ্যবান ২১ সাবেক যাত্রী। তাঁদের হতাশা ছিল গভীরতর। তাঁদের বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছেন যে ১২ জন, তাঁরা দ্বিতীয় দলে। হতাশার মধ্যেও তাঁদের চোখেমুখে মিশ্রিত ছিল নির্মল আনন্দের আভা। তাঁদের মনোভাব: আমরা যাইতে পারি নাই তো ক্ষতি নাই, তোমাদেরও যাইতে দেই নাই। বোঝো, সিট না পাওয়ার ব্যথা। তাঁরা সিট পানেঅলাদের দিকে হাসিমুখে তাকিয়েছেন। সিটবঞ্চিতদের দিকে চোখ লাল করে দৃষ্টি হেনেছেন প্রায়-ভাগ্যবানেরা।
যা হোক, আনন্দের কথা এই যে, বিমান ভাঙচুর হয়নি। বিমান উড়াল দেওয়ার পরও দুই গ্রুপের মধ্যে এমন কিছু ঘটেনি, যাতে স্থানীয় ক্লিনিকের মালিকদের হতো পোয়াবারো এবং ঢাকা থেকে অন্য বিমান পাঠাতে হতো কোনো কোনো সাবেক যাত্রীকে পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে আসতে।
প্রতিদিন টেলিভিশনের পর্দা বলছে, বাঙালি বীরের জাতি। বাঙালি প্রতিবাদী। মানববন্ধন, ঘোড়াবন্ধন, গাড়ি ভাঙচুর প্রভৃতি তো প্রতিবাদ করতেই করা হয়। প্রতিবাদের বিচিত্র পদ্ধতি। ছেলে খাওয়া-পরা দেয় না। ছেলের বাড়ির সামনে বাবা-মা অনশন করছেন, কাগজে পড়লাম। পাশের গ্রামের বেকার লিকলিকে ছোকরা কথা দিয়েও বিয়ে করছে না। তার বাড়ির সামনে গিয়ে মেয়েটির অনশন। বহু মেয়ের বাপের বাড়ির দরজায়ও অবস্থান ধর্মঘট হচ্ছে। রাজশাহীতে এতিম শিশুরা রাস্তায় শুয়ে প্রতিবাদ করেছে এবং তাতে ভালো কাজও হয়েছে। নিউইয়র্ক বিমানবন্দর ও জাতিসংঘের সদর দপ্তরের সামনে বাঙালিরা যত বিক্ষোভ ও কালো পতাকা প্রদর্শন করেছে, সারা দুনিয়ার সব জাতি মিলেও তা করেনি। একটি প্রতিবাদের উপলক্ষ পেলে বাঙালি তা হাতছাড়া করে না।
বাঙালি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে কোনো সমস্যার সমাধান চায় না। আগেই গলার রগ ফুলায়, আস্তিন গোটায়, মালকোচা মারে অথবা কোমরে শাড়ি পেঁচায়। ধারণা করি, সৈয়দপুর বিমানবন্দরের ওই পরিস্থিতি জাপান, কোরিয়া, ফিনল্যান্ডের কোনো বিমানবন্দরে সৃষ্টি হলে ৩৩ যাত্রীর সবাই বলতেন, যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে বড় বিমান আসতে পারেনি। এই ছোট বিমানটিতে যাঁদের খুব বেশি দরকার তাঁরা যান। আমরা পরের ফ্লাইটে যাব। কেউই না যাওয়ার চেয়ে তো কেউ কেউ যাওয়া ভালো।
সৈয়দপুরের ঘটনাটি আমার কাছে মনে হচ্ছে আমাদের জাতীয় রাজনীতির রূপক। আমরা ক্ষমতায় নেই তো তোমাদেরও শান্তিতে থাকতে দেব না। আমরা যদি আবার ক্ষমতায় না যেতে পারি, তো তোমাদেরও যেতে দেব না। তাতে আমাদের দুই পক্ষকে বাদ দিয়ে অন্য যাদের খুশি তারা ক্ষমতার বিমানটিতে চড়ে যেদিকে খুশি সেদিকে যাক।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments