মৃণাল দা, মনে পড়ে সেই ফ্রিজ শট? by মৃধা রেজাউল
আজ তোমার কত বছর পূর্ণ হচ্ছে মৃণাল দা? সবাই বলবে ৭৮। কিন্তু আসল বয়স কি ২৮-এর বেশি? এ কথা সবাই তো জানে, মানুষের মনের বয়সই আসল বয়স। সেই কবে থেকে বিশ্ব চলচ্চিত্রের মহান এক অধিপতি তুমি, হাঁটতে শুরু করেছিলে এই বাংলার এক সবুজ শহর থেকে। তারপর ক্রমাগত ডিঙিয়েছ সম্মুখে যা ছিল।
যখন ডিঙোবার কোনো অবশেষ নেই, তখন ডিঙিয়েছ নিজেকেই। সে প্রায় এক শতাব্দীর গল্প। হেমিংওয়ের সান্তিয়াগোর মতো জীবন-সমুদ্রের উপকূলে প্রতিটি দিনকেই তুমি গ্রহণ করেছ পৌরুষের চ্যালেঞ্জ হিসেবে। প্রকৃতিও দিয়েছিল সুঠাম গড়ন। তাই তোমার প্রতিটি নিবিষ্ট স্টিল ফটোগ্রাফকে আমাদের ভ্রম হয় এঞ্জেলো বা রোদ্যাঁর ছেনির কাজ বলে।
তোমার কি মনে পড়ে ত্রিশ-চলি্লশের কোঠার বাংলাদেশের ফরিদপুরকে! নীরব, নিথর, সলাজ এক শহর। চুন-সুরকির সম্ভ্রম জাগানো এক সাদা বাড়ি। বৃক্ষচ্ছায়ায় মায়াময়, সারা দিন নারকেল-সুপারির আলপনা আঁকা উঠোন। রোদের রেণুভরা দুপুর। জীবনানন্দের বুকের পশমের মতো নরম ঘাসে ভরা পেছনের পালানটুকু পেরোলেই ধু ধু ঢোলসমুদ্র। ঢোলসমুদ্রের কিনারে দুর্গের মতো দাঁড়িয়ে প্রত্নচেহারার চাঁদমারী। দূর পৃথিবীর ঘ্রাণ এনে তোমার বাড়ির পুকুরের ঘাটলায় মাখত ঢোলসমুদ্রের ঢেউ। এর সবই কি খেয়ে ফেলেছে বিস্মৃতির ঘুণপোকা?
তবে একটা কথা আমরা প্রায় হলফ করে বলতে পারি, চাঁদমারী চকের বিরাট প্রকৃতি তোমাকে যা শিখিয়েছিল, রেনোয়ার প্রতিভাবান ক্যামেরাও তা আপনাকে শেখাতে পারেনি। গ্রীষ্মের প্রথম বৃষ্টি চষা মাঠের জমি থেকে পল্লীকবির হৃদয়ের সুরভি মেখে যে সোঁদা গন্ধ আনত, এখনো কি তার জন্য তোমার পরাণের গহিনে কোনো বেদনা জাগে?
দিলি্ল, ভেনিস, কান, বার্লিন মস্ত মস্ত সব উৎসবে হয়েছে তোমার প্রতিভার অভিষেক। তোমার বুক ঝলমলিয়ে উঠেছে স্বর্ণময় ক্রেস্টের শোভায়। অথচ বুকের নিচেই যে হৃদয়, তা খালি হয়ে আছে সুদূর শৈশব থেকে। কেউ সে শূন্যতা ভরে দিতে পারেনি। কবিতার কাজলাদিদির মতো একটা বোন ছিল তোমার, নাম রেবা। এক দিন পুকুরের জলে ডুবে মারা যায় সেই বোন। বোন হারানোর শোক দিয়ে তোমার পরিবার ফরিদপুরের বাড়িতে গড়েছিল ধূসর এক স্মৃতিস্তম্ভ। স্তম্ভটি ছুঁয়ে হারানো বোনটিকে অনুভবে পাওয়ার আকুতি আমরা তোমার দেখেছিলাম ১৯৯১-তে, যে বার তুমি অনেককাল পর বাংলাদেশে এসেছিলে, ফরিদপুরে এসেছিলে।
সব ফিল্ম-মেকারের কাছেই ফ্রিজ শটের অর্থবহ প্রয়োগের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হয়ে আছে ফঁ্রাসোয়া ক্রফোর ঋড়ঁৎ ঐঁহফৎবফ ইষড়ংি-এর শেষ দৃশ্যটি। তোমার কাছেও কি তাই? না, আমরা প্রায় নিশ্চিত, তোমার স্মৃতিতে তার চেয়েও অর্থবহ একটা ফ্রিজ শট আছে। তোমার মা তখন প্রায় শয্যাশায়ী। ডাক্তারের কড়া নিষেধ চলাফেরার ওপর। সে সময়, ১৯৬৯ সালের কোনো একদিন কবি জসীমউদ্দীন যান রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ডি.লিট উপাধি নিতে। জসীমউদ্দীন তোমার বড়দা'র বন্ধু। ফরিদপুরে থাকতে তোমাদের বাড়িতে খুব যাতায়াত ছিল। তোমার মা জসীমউদ্দীনকে নিজের ছেলের মতো আদর করতেন। মুখে তুলে ভাত খাওয়াতেন। তুমি সেদিন জসীমউদ্দীনকে গাড়িতে করে বাসায় নিয়ে যাও। জসীমউদ্দীন মা মা করে দোতলায় উঠতে থাকেন। তোমার মা ডাক্তারের নিষেধের তোয়াক্কা না করে খাট থেকে প্রায় লাফিয়ে নেমে জসীমউদ্দীনকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন মা ও ছেলে_'সাধু তুই এসেছিস, বাপ আমার, কত দিন দেখি না।' এই অভাবিত অবিশ্বাস্যতায় তোমরা পারিপাশ্র্বের সবাই বিহ্বল-হতবাক। রুগ্ণ মা দুর্বল হাতে জড়িয়ে আছেন ছেলেকে। স্থির, নিষ্কম্প, বাষ্পরুদ্ধ। কী মহত্তম এই দৃশ্য_হিন্দু জড়িয়ে আছে মুসলমানকে, পশ্চিমবাংলা পূর্বকে, নাকি মানবতা রাজনীতিকে? কী দেখেছিলে সেদিনের এই ফ্রিজ শটে? মহাত্মা গান্ধীকে ডেকে কোন ব্রহ্মসত্য দেখাতে চেয়েছিলেন মা ও ছেলের এই জীবন্ত ভাস্কর্যে? দেশ বিভাগ নিয়ে দেশে দেশে কত কেতাব লেখা হয়েছে। একখানা সহি কেতাবের নাম আমাদের মনে খুব লেগে আছে, 'অপারেশন উইদাউট অ্যানেস্থেশিয়া'। এই অপারেশনের এক বড় বলি ঋতি্বক ঘটক। তুমিও কি নও?
প্রিয় মৃণাল দা, চলি্লশের দশকে শেষবারের মতো ছেড়ে যাওয়ার সময় ফরিদপুরের স্মৃতি হিসেবে কলকাতায় নিয়ে গিয়েছিলে একখানা নকশিকাঁথা। দীর্ঘ ৭০ বছর তা আগলে ছিলে। অবশেষে তোমার সাম্প্রতিকতম ছবি 'আমার ভুবন' চলচ্চিত্র উৎসবগুলোতে যখন বিশেষ প্রদর্শনে যায়, তার প্রচারপত্র তৈরি করতে আবহমান বাংলার নিদর্শন সেই নকশিকাঁথাই তুমি তুলে দিয়েছ শিল্পনির্দেশক গৌতম বসুর হাতে। কিন্তু মৃণাল দা তোমার দানের মর্যাদা আমরা রাখতে পারিনি। সর্বগ্রাসী এক বাজারি যুগে আমাদের বাস। গর্বের সঙ্গে আমোদ মিশিয়ে বলত 'মৃণাল সেনের বাড়ি'। এ গর্ব আমরা আর কোনো দিনই করতে পারব না। সম্প্রতি ডেভেলপারের হাতুড়ির ঘায়ে তছনছ হয়ে গেছে মায়াঘেরা আদরের বাড়িটির অর্ধেক। বাকি অর্ধেক দাঁড়িয়ে আছে বজ্রাহতের মতো। কিন্তু কী আশ্চর্য! এ মাটি ঠিক বুঝেছিল তোমাকে। ভগ্নস্তূপ থেকে দেখা যায়_মোট তিন ধরনের ইট দিয়ে বানানো হয়েছিল তোমাদের বাড়ি। ইটের গায়ে কম্পানির খোদিত পরিচয়লিপি। সত্যিই কি কম্পানির পরিচয়লিপি! নাকি সময়ের কুহকী হাতে আঁকা দূর ভবিষ্যতের কোনো লিথোগ্রাফ। প্রথম ইটে লেখা গ (অর্থাৎ মৃণাল), দ্বিতীয় ইটে গ-ঝ (অর্থাৎ মৃণাল-সেন), তৃতীয় ইটে গ-ঘ-ঝ (অর্থাৎ মৃ-ণাল-সেন)। মৃণাল দা অভিমান রেখো না। এ মাটি তোমার নাম মাটিতে মাটিতে রুয়ে দিয়েছে। আর কী-ই বা অক্ষয় মাটির চেয়ে। অক্ষয় আয়ু হোক তোমারও।
লেখক : যুগ্ম আহ্বায়ক, মৃণাল সেন চলচ্চিত্র সংসদ, ফরিদপুর।
তোমার কি মনে পড়ে ত্রিশ-চলি্লশের কোঠার বাংলাদেশের ফরিদপুরকে! নীরব, নিথর, সলাজ এক শহর। চুন-সুরকির সম্ভ্রম জাগানো এক সাদা বাড়ি। বৃক্ষচ্ছায়ায় মায়াময়, সারা দিন নারকেল-সুপারির আলপনা আঁকা উঠোন। রোদের রেণুভরা দুপুর। জীবনানন্দের বুকের পশমের মতো নরম ঘাসে ভরা পেছনের পালানটুকু পেরোলেই ধু ধু ঢোলসমুদ্র। ঢোলসমুদ্রের কিনারে দুর্গের মতো দাঁড়িয়ে প্রত্নচেহারার চাঁদমারী। দূর পৃথিবীর ঘ্রাণ এনে তোমার বাড়ির পুকুরের ঘাটলায় মাখত ঢোলসমুদ্রের ঢেউ। এর সবই কি খেয়ে ফেলেছে বিস্মৃতির ঘুণপোকা?
তবে একটা কথা আমরা প্রায় হলফ করে বলতে পারি, চাঁদমারী চকের বিরাট প্রকৃতি তোমাকে যা শিখিয়েছিল, রেনোয়ার প্রতিভাবান ক্যামেরাও তা আপনাকে শেখাতে পারেনি। গ্রীষ্মের প্রথম বৃষ্টি চষা মাঠের জমি থেকে পল্লীকবির হৃদয়ের সুরভি মেখে যে সোঁদা গন্ধ আনত, এখনো কি তার জন্য তোমার পরাণের গহিনে কোনো বেদনা জাগে?
দিলি্ল, ভেনিস, কান, বার্লিন মস্ত মস্ত সব উৎসবে হয়েছে তোমার প্রতিভার অভিষেক। তোমার বুক ঝলমলিয়ে উঠেছে স্বর্ণময় ক্রেস্টের শোভায়। অথচ বুকের নিচেই যে হৃদয়, তা খালি হয়ে আছে সুদূর শৈশব থেকে। কেউ সে শূন্যতা ভরে দিতে পারেনি। কবিতার কাজলাদিদির মতো একটা বোন ছিল তোমার, নাম রেবা। এক দিন পুকুরের জলে ডুবে মারা যায় সেই বোন। বোন হারানোর শোক দিয়ে তোমার পরিবার ফরিদপুরের বাড়িতে গড়েছিল ধূসর এক স্মৃতিস্তম্ভ। স্তম্ভটি ছুঁয়ে হারানো বোনটিকে অনুভবে পাওয়ার আকুতি আমরা তোমার দেখেছিলাম ১৯৯১-তে, যে বার তুমি অনেককাল পর বাংলাদেশে এসেছিলে, ফরিদপুরে এসেছিলে।
সব ফিল্ম-মেকারের কাছেই ফ্রিজ শটের অর্থবহ প্রয়োগের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হয়ে আছে ফঁ্রাসোয়া ক্রফোর ঋড়ঁৎ ঐঁহফৎবফ ইষড়ংি-এর শেষ দৃশ্যটি। তোমার কাছেও কি তাই? না, আমরা প্রায় নিশ্চিত, তোমার স্মৃতিতে তার চেয়েও অর্থবহ একটা ফ্রিজ শট আছে। তোমার মা তখন প্রায় শয্যাশায়ী। ডাক্তারের কড়া নিষেধ চলাফেরার ওপর। সে সময়, ১৯৬৯ সালের কোনো একদিন কবি জসীমউদ্দীন যান রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ডি.লিট উপাধি নিতে। জসীমউদ্দীন তোমার বড়দা'র বন্ধু। ফরিদপুরে থাকতে তোমাদের বাড়িতে খুব যাতায়াত ছিল। তোমার মা জসীমউদ্দীনকে নিজের ছেলের মতো আদর করতেন। মুখে তুলে ভাত খাওয়াতেন। তুমি সেদিন জসীমউদ্দীনকে গাড়িতে করে বাসায় নিয়ে যাও। জসীমউদ্দীন মা মা করে দোতলায় উঠতে থাকেন। তোমার মা ডাক্তারের নিষেধের তোয়াক্কা না করে খাট থেকে প্রায় লাফিয়ে নেমে জসীমউদ্দীনকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন মা ও ছেলে_'সাধু তুই এসেছিস, বাপ আমার, কত দিন দেখি না।' এই অভাবিত অবিশ্বাস্যতায় তোমরা পারিপাশ্র্বের সবাই বিহ্বল-হতবাক। রুগ্ণ মা দুর্বল হাতে জড়িয়ে আছেন ছেলেকে। স্থির, নিষ্কম্প, বাষ্পরুদ্ধ। কী মহত্তম এই দৃশ্য_হিন্দু জড়িয়ে আছে মুসলমানকে, পশ্চিমবাংলা পূর্বকে, নাকি মানবতা রাজনীতিকে? কী দেখেছিলে সেদিনের এই ফ্রিজ শটে? মহাত্মা গান্ধীকে ডেকে কোন ব্রহ্মসত্য দেখাতে চেয়েছিলেন মা ও ছেলের এই জীবন্ত ভাস্কর্যে? দেশ বিভাগ নিয়ে দেশে দেশে কত কেতাব লেখা হয়েছে। একখানা সহি কেতাবের নাম আমাদের মনে খুব লেগে আছে, 'অপারেশন উইদাউট অ্যানেস্থেশিয়া'। এই অপারেশনের এক বড় বলি ঋতি্বক ঘটক। তুমিও কি নও?
প্রিয় মৃণাল দা, চলি্লশের দশকে শেষবারের মতো ছেড়ে যাওয়ার সময় ফরিদপুরের স্মৃতি হিসেবে কলকাতায় নিয়ে গিয়েছিলে একখানা নকশিকাঁথা। দীর্ঘ ৭০ বছর তা আগলে ছিলে। অবশেষে তোমার সাম্প্রতিকতম ছবি 'আমার ভুবন' চলচ্চিত্র উৎসবগুলোতে যখন বিশেষ প্রদর্শনে যায়, তার প্রচারপত্র তৈরি করতে আবহমান বাংলার নিদর্শন সেই নকশিকাঁথাই তুমি তুলে দিয়েছ শিল্পনির্দেশক গৌতম বসুর হাতে। কিন্তু মৃণাল দা তোমার দানের মর্যাদা আমরা রাখতে পারিনি। সর্বগ্রাসী এক বাজারি যুগে আমাদের বাস। গর্বের সঙ্গে আমোদ মিশিয়ে বলত 'মৃণাল সেনের বাড়ি'। এ গর্ব আমরা আর কোনো দিনই করতে পারব না। সম্প্রতি ডেভেলপারের হাতুড়ির ঘায়ে তছনছ হয়ে গেছে মায়াঘেরা আদরের বাড়িটির অর্ধেক। বাকি অর্ধেক দাঁড়িয়ে আছে বজ্রাহতের মতো। কিন্তু কী আশ্চর্য! এ মাটি ঠিক বুঝেছিল তোমাকে। ভগ্নস্তূপ থেকে দেখা যায়_মোট তিন ধরনের ইট দিয়ে বানানো হয়েছিল তোমাদের বাড়ি। ইটের গায়ে কম্পানির খোদিত পরিচয়লিপি। সত্যিই কি কম্পানির পরিচয়লিপি! নাকি সময়ের কুহকী হাতে আঁকা দূর ভবিষ্যতের কোনো লিথোগ্রাফ। প্রথম ইটে লেখা গ (অর্থাৎ মৃণাল), দ্বিতীয় ইটে গ-ঝ (অর্থাৎ মৃণাল-সেন), তৃতীয় ইটে গ-ঘ-ঝ (অর্থাৎ মৃ-ণাল-সেন)। মৃণাল দা অভিমান রেখো না। এ মাটি তোমার নাম মাটিতে মাটিতে রুয়ে দিয়েছে। আর কী-ই বা অক্ষয় মাটির চেয়ে। অক্ষয় আয়ু হোক তোমারও।
লেখক : যুগ্ম আহ্বায়ক, মৃণাল সেন চলচ্চিত্র সংসদ, ফরিদপুর।
No comments