নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড-একটি জনপ্রিয় পত্রিকার হত্যারহস্য by মশিউল আলম
১৮৪৩ থেকে ২০১১। দীর্ঘ ১৬৮ বছর প্রবল সক্রিয়তার সঙ্গে বেঁচে ছিল একটি পত্রিকা। গতকাল রোববার ১০ জুলাই হত্যা করা হলো সেটিকে। পত্রিকাটির নাম নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড। বিলেতের সর্বাধিক প্রচারিত ট্যাবলয়েড সাপ্তাহিক পত্রিকা, জনপ্রিয় ট্যাবলয়েড দৈনিক দ্য সান-এর ‘ভগ্নি’। লন্ডন থেকে প্রকাশিত হতো প্রতি রোববার।
গতকাল এ পত্রিকার যে সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়েছে, সেটিই এর অস্তিত্বের সর্বশেষ নিদর্শন। এই খবর পূর্বঘোষিত, গত শুক্রবার সকালে ঘোষণাটি দিয়েছিলেন জেমস মারডক। এই যুবক মিডিয়া মোগল বলে খ্যাত রুপার্ট মারডকের পুত্র। মারডকের মিডিয়া-সাম্রাজ্য নিউজ করপোরেশনের এশীয় ও ইউরোপীয় শাখা নিউজ ইন্টারন্যাশনাল পরিচালনা করেন জেমস। নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড নিউজ ইন্টারন্যাশনাল গোষ্ঠীর একটি সাপ্তাহিক। ইংরেজি ভাষায় সর্বাধিক পঠিত সাপ্তাহিক ট্যাবলয়েড, সর্বশেষ প্রচারসংখ্যা ২৬ লাখ ৬০ হাজার, আগে আরও বেশি ছিল, ২৯ লাখ পর্যন্ত উঠেছিল। গত বছর মুনাফা করেছে ১৩ মিলিয়ন বিলেতি পাউন্ড।
তিন-চার দিন ধরে বিলেত ও আমেরিকার প্রধান সংবাদমাধ্যমে খুব হইচই হচ্ছে এই নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ডকে ঘিরে। মুদ্রিত সংবাদমাধ্যম যখন ক্রমাগত ক্ষতির শিকার হতে হতে একে একে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছে, ছাঁটাই হচ্ছেন শত শত সংবাদকর্মী, সে সময় এমন লাভজনক একটি জনপ্রিয় পত্রিকা কেন বন্ধ করে দেওয়া হলো? এমন নয় যে বিলেতের সরকার পত্রিকাটির ডিক্লারেশন বাতিল করেছে। এমনও নয় যে বিলেতের মুদ্রিত সংবাদমাধ্যমের অভিভাবক প্রেস কমপ্লেইন্টস কমিশন (পিসিসি) জেমস মারডককে ওই ট্যাবলয়েডটি বন্ধ করে দিতে বলেছে, বস্তুত পিসিসির সে রকম কোনো ক্ষমতাই নেই; এমনও নয় যে হাজার হাজার জনতা লন্ডনের রাস্তায় নেমে পত্রিকাটির বিরুদ্ধে প্রবল বিক্ষোভ করেছে, সেটির কার্যালয়ে ইটপাটকেল ছুড়েছে বা সংবাদকর্মীদের ওপর চড়াও হয়েছে। এ রকম কিছুই ঘটেনি। রুপার্ট ও জেমস—বাপ-বেটা দুই মারডকে মিলে সলা করে নিজেরাই হত্যা করলেন ১৬৮ বছরের পুরোনো পত্রিকাটি। দুনিয়াজোড়া আর্থিক দুর্দিনে জীবিকা হারিয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন শ দুয়েক সংবাদকর্মী।
কেন? রহস্যটা কী? মারডক পিতা-পুত্র বিলেতবাসীকে এই চমকটা দিলেন বেশ বড় এক ডামাডোলের মধ্যে, যা কি না তাঁদের মিডিয়া-সাম্রাজ্যের ওপর বিরাট আঘাত আকারে চড়াও হয়েছে। তাঁদের এই ট্যাবলয়েড পত্রিকাটির বিরুদ্ধে এমন গুরুতর ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ উঠেছে যে বেসরকারি গোয়েন্দাদের সহযোগিতা নিয়ে তাঁরা প্রায় চার হাজার ব্যক্তির ফোনের ভয়েসমেইল হ্যাক করেছেন। গত শনিবার পত্রিকাটির ভূতপূর্ব সম্পাদক অ্যান্ডি কুলসনকে লন্ডনের পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। এই কুলসন আবার বিলেতের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের বন্ধু, পত্রিকাটি থেকে পদত্যাগ করার পর তাঁকে প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন কনজারভেটিভ দলের কমিউনিকেশন ডিরেক্টর হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। ফোন হ্যাকিংয়ের ঘটনাগুলো ধরা পড়েছিল ২০০৭ সালে, যখন অ্যান্ডি কুলসন নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড-এর সম্পাদক ছিলেন, সে সময় তিনি পুলিশকে বলেছিলেন যে বিষয়টি তিনি জানতেন না।
পত্রিকাটি যেসব ব্যক্তির ফোন হ্যাক করেছে, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন প্রিন্স উইলিয়াম ও প্রিন্স হ্যারি, মন্ত্রিসভা ও ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কয়েকজন সদস্য, অনেক অভিনেতা ও খেলোয়াড়, ইরাক ও আফগানিস্তানের যুদ্ধে নিহত ব্রিটিশ সেনাদের পরিবারের সদস্যরা এবং ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন, হত্যাকাণ্ডের শিকার বেশ কিছু নারী-পুরুষ ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের অনেকে। অভিযোগ পৌঁছে যায় প্রেস কমপ্লেইন্টস কমিশনের কাছে, আলাদাভাবে অনুসন্ধান চালায় লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশ (স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড)। এসব অভিযোগ ধামাচাপা দিতে মারডকপুত্র জেমস প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড তদন্তের ঘোষণা দেয়, কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পরই আবার সংবাদমাধ্যমকে জানিয়ে দেয় যে তদন্ত শেষ। যেসব অভিযোগ নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড-এর বিরুদ্ধে তোলা হয়েছে, সেগুলোর কোনো ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্তু ব্রিটেনের মর্যাদাসম্পন্ন দৈনিক গার্ডিয়ান ও আমেরিকার শীর্ষস্থানীয় দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমস-এর অনুসন্ধানী সাংবাদিকেরা বিষয়টির পেছনে লেগে থাকেন। এ বছরের জানুয়ারি মাসে গার্ডিয়ান এমন তথ্য প্রকাশ করে যে মারডকের ভাড়াটে প্রাইভেট ডিটেকটিভ গ্লেন মালকেয়ার নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড পত্রিকাটি তাঁকে লোকজনের ফোন হ্যাক করার কাজে নিয়োগ করেছিল। পত্রিকাটির চাকরি ছেড়ে দিয়ে একজন রিপোর্টার গার্ডিয়ানকে জানান, সম্পাদক অ্যান্ডি কুলসন যে বলেছেন ফোন হ্যাকিংয়ের কথা তিনি জানতেন না, এটা সত্য নয়। এ বছরের এপ্রিলে পত্রিকাটির আরও তিনজন সংবাদকর্মীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে, তাঁরা ফোন হ্যাকিংয়ের ঘটনা স্বীকার করেন। তখন নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড-এর পক্ষ থেকে ভুল স্বীকার করে দুঃখ প্রকাশ করা হয়।
কিন্তু এটা এমন কোনো ভুল নয়, যা স্বীকার করলেই সব দোষ ধুয়েমুছে যাবে। এমনকি পত্রিকাটি স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দিয়ে এই গুরুতর অপরাধের প্রতিকার হচ্ছে না। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এ নিয়ে ভীষণ হইচই হয়েছে। লেবার পার্টির নেতা এড মিলিব্যান্ড দাবি করেছেন, প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন অ্যান্ডি কুলসনের মতো একজন দুর্জনকে কমিউনিকেশন ডিরেক্টর পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন বলে এখন জাতির কাছে তাঁর ক্ষমা চাওয়া উচিত। প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন অবশ্য বলেছেন, তিনি অ্যান্ডি কুলসনকে ‘সেকেন্ড চান্স’ দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি প্রচণ্ড খেপে গিয়েছেন রুপার্ট মারডকের ট্যাবলয়েড সাংবাদিকতার সংস্কৃতির ওপর। খেপেছেন স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ওপর, আরও খেপেছেন প্রেস কমপ্লেইন্টস কমিশনের ওপর। তিনি পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, প্রেস কমপ্লেইন্টস কমিশন ব্যর্থ হয়েছে। একটি বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। তবে তিনি বা তাঁর সরকারের কেউই দাবি করেননি, নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ করে দিতে হবে।
তাহলে মারডক পিতা-পুত্র নিজেরাই কেন হত্যা করলেন লাভজনক প্রাচীন পত্রিকাটি? গত শুক্রবার পত্রিকাটির সাংবাদিকদের সামনে জেমস মারডক পত্রিকা বন্ধ করার ঘোষণা দিতে একটা বক্তৃতা করেন, তখন তিনি সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, দায়িত্ব ইত্যাদি নিয়ে অনেক সুন্দর সুন্দর কথা বলেছেন। সেই সঙ্গে বলেছেন, ‘নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিল অন্যদের দায়িত্বশীলতা, জবাবদিহি নিশ্চিত করার কাজে; কিন্তু নিজের বেলাতেই তা করতে ব্যর্থ হয়েছে।’ তিনি বলেছেন, তাঁরা ভুল করেছেন, ভবিষ্যতে সেরকম ভুল আর করবেন না ইত্যাদি। কিন্তু পত্রিকাটির প্রকাশনা কেন স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দিলেন, এর কোনো ব্যাখ্যা তাঁর বক্তব্যে পাওয়া গেল না। মারডকের পুরো মিডিয়া সাম্রাজ্যের ভাবমূর্তি যে একদম নীতিহীন অপরাধীর মতো হয়ে গেল, সেই কালিমা মোচনের বাসনায় আর নিউজ করপোরেশনের অবশিষ্ট ব্যবসা রক্ষার মতলবেই কি বলি দেওয়া হলো একটি ট্যাবলয়েড? ১৯৬৯ সালে নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড কেনার সঙ্গে সঙ্গে রুপার্ট মারডক পত্রিকাটির সম্পাদককে বরখাস্ত করেছিলেন। পরে একসময় তিনি নাকি কৌতুকের ছলে একবার বলেছিলেন, ‘ওই সম্পাদক এতই নোংরা/জঘন্য ছিলেন যে আমার মতো (নিম্ন রুচির) লোকের পক্ষেও তাঁকে রাখা সম্ভব ছিল না (হি ওয়াজ ঠু ন্যাস্টি ইভেন ফর মি)’। এখন তিনি আর তাঁর পুত্র মিলে খোদ পত্রিকাটিই বন্ধ করে দিলেন একই রকমের হাস্যকর পরিহাসের সঙ্গে। পিতা-পুত্র বলতে চাইছেন, নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড এতই ন্যাস্টি হয়ে গেছে যে, আমাদের মতো নিম্ন রুচির লোকদের পক্ষেও পত্রিকাটিকে আর রাখা সম্ভব হচ্ছে না। নোংরামি, রগড়, কেলেঙ্কারি, যৌনতা আর চাঞ্চল্যের বেসাতি করে ধনবান ও ক্ষমতাধর হয়ে ওঠা মারডক পিতা-পুত্রের রুচিবান ভালো মানুষ সাজার এই কসরত দেখে হাসাহাসি করছে বিলেত-আমেরিকার দায়িত্বশীল সাংবাদিক জগৎ ।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com
তিন-চার দিন ধরে বিলেত ও আমেরিকার প্রধান সংবাদমাধ্যমে খুব হইচই হচ্ছে এই নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ডকে ঘিরে। মুদ্রিত সংবাদমাধ্যম যখন ক্রমাগত ক্ষতির শিকার হতে হতে একে একে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছে, ছাঁটাই হচ্ছেন শত শত সংবাদকর্মী, সে সময় এমন লাভজনক একটি জনপ্রিয় পত্রিকা কেন বন্ধ করে দেওয়া হলো? এমন নয় যে বিলেতের সরকার পত্রিকাটির ডিক্লারেশন বাতিল করেছে। এমনও নয় যে বিলেতের মুদ্রিত সংবাদমাধ্যমের অভিভাবক প্রেস কমপ্লেইন্টস কমিশন (পিসিসি) জেমস মারডককে ওই ট্যাবলয়েডটি বন্ধ করে দিতে বলেছে, বস্তুত পিসিসির সে রকম কোনো ক্ষমতাই নেই; এমনও নয় যে হাজার হাজার জনতা লন্ডনের রাস্তায় নেমে পত্রিকাটির বিরুদ্ধে প্রবল বিক্ষোভ করেছে, সেটির কার্যালয়ে ইটপাটকেল ছুড়েছে বা সংবাদকর্মীদের ওপর চড়াও হয়েছে। এ রকম কিছুই ঘটেনি। রুপার্ট ও জেমস—বাপ-বেটা দুই মারডকে মিলে সলা করে নিজেরাই হত্যা করলেন ১৬৮ বছরের পুরোনো পত্রিকাটি। দুনিয়াজোড়া আর্থিক দুর্দিনে জীবিকা হারিয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন শ দুয়েক সংবাদকর্মী।
কেন? রহস্যটা কী? মারডক পিতা-পুত্র বিলেতবাসীকে এই চমকটা দিলেন বেশ বড় এক ডামাডোলের মধ্যে, যা কি না তাঁদের মিডিয়া-সাম্রাজ্যের ওপর বিরাট আঘাত আকারে চড়াও হয়েছে। তাঁদের এই ট্যাবলয়েড পত্রিকাটির বিরুদ্ধে এমন গুরুতর ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ উঠেছে যে বেসরকারি গোয়েন্দাদের সহযোগিতা নিয়ে তাঁরা প্রায় চার হাজার ব্যক্তির ফোনের ভয়েসমেইল হ্যাক করেছেন। গত শনিবার পত্রিকাটির ভূতপূর্ব সম্পাদক অ্যান্ডি কুলসনকে লন্ডনের পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। এই কুলসন আবার বিলেতের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের বন্ধু, পত্রিকাটি থেকে পদত্যাগ করার পর তাঁকে প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন কনজারভেটিভ দলের কমিউনিকেশন ডিরেক্টর হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। ফোন হ্যাকিংয়ের ঘটনাগুলো ধরা পড়েছিল ২০০৭ সালে, যখন অ্যান্ডি কুলসন নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড-এর সম্পাদক ছিলেন, সে সময় তিনি পুলিশকে বলেছিলেন যে বিষয়টি তিনি জানতেন না।
পত্রিকাটি যেসব ব্যক্তির ফোন হ্যাক করেছে, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন প্রিন্স উইলিয়াম ও প্রিন্স হ্যারি, মন্ত্রিসভা ও ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কয়েকজন সদস্য, অনেক অভিনেতা ও খেলোয়াড়, ইরাক ও আফগানিস্তানের যুদ্ধে নিহত ব্রিটিশ সেনাদের পরিবারের সদস্যরা এবং ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন, হত্যাকাণ্ডের শিকার বেশ কিছু নারী-পুরুষ ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের অনেকে। অভিযোগ পৌঁছে যায় প্রেস কমপ্লেইন্টস কমিশনের কাছে, আলাদাভাবে অনুসন্ধান চালায় লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশ (স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড)। এসব অভিযোগ ধামাচাপা দিতে মারডকপুত্র জেমস প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড তদন্তের ঘোষণা দেয়, কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পরই আবার সংবাদমাধ্যমকে জানিয়ে দেয় যে তদন্ত শেষ। যেসব অভিযোগ নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড-এর বিরুদ্ধে তোলা হয়েছে, সেগুলোর কোনো ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্তু ব্রিটেনের মর্যাদাসম্পন্ন দৈনিক গার্ডিয়ান ও আমেরিকার শীর্ষস্থানীয় দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমস-এর অনুসন্ধানী সাংবাদিকেরা বিষয়টির পেছনে লেগে থাকেন। এ বছরের জানুয়ারি মাসে গার্ডিয়ান এমন তথ্য প্রকাশ করে যে মারডকের ভাড়াটে প্রাইভেট ডিটেকটিভ গ্লেন মালকেয়ার নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড পত্রিকাটি তাঁকে লোকজনের ফোন হ্যাক করার কাজে নিয়োগ করেছিল। পত্রিকাটির চাকরি ছেড়ে দিয়ে একজন রিপোর্টার গার্ডিয়ানকে জানান, সম্পাদক অ্যান্ডি কুলসন যে বলেছেন ফোন হ্যাকিংয়ের কথা তিনি জানতেন না, এটা সত্য নয়। এ বছরের এপ্রিলে পত্রিকাটির আরও তিনজন সংবাদকর্মীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে, তাঁরা ফোন হ্যাকিংয়ের ঘটনা স্বীকার করেন। তখন নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড-এর পক্ষ থেকে ভুল স্বীকার করে দুঃখ প্রকাশ করা হয়।
কিন্তু এটা এমন কোনো ভুল নয়, যা স্বীকার করলেই সব দোষ ধুয়েমুছে যাবে। এমনকি পত্রিকাটি স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দিয়ে এই গুরুতর অপরাধের প্রতিকার হচ্ছে না। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এ নিয়ে ভীষণ হইচই হয়েছে। লেবার পার্টির নেতা এড মিলিব্যান্ড দাবি করেছেন, প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন অ্যান্ডি কুলসনের মতো একজন দুর্জনকে কমিউনিকেশন ডিরেক্টর পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন বলে এখন জাতির কাছে তাঁর ক্ষমা চাওয়া উচিত। প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন অবশ্য বলেছেন, তিনি অ্যান্ডি কুলসনকে ‘সেকেন্ড চান্স’ দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি প্রচণ্ড খেপে গিয়েছেন রুপার্ট মারডকের ট্যাবলয়েড সাংবাদিকতার সংস্কৃতির ওপর। খেপেছেন স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ওপর, আরও খেপেছেন প্রেস কমপ্লেইন্টস কমিশনের ওপর। তিনি পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, প্রেস কমপ্লেইন্টস কমিশন ব্যর্থ হয়েছে। একটি বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। তবে তিনি বা তাঁর সরকারের কেউই দাবি করেননি, নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ করে দিতে হবে।
তাহলে মারডক পিতা-পুত্র নিজেরাই কেন হত্যা করলেন লাভজনক প্রাচীন পত্রিকাটি? গত শুক্রবার পত্রিকাটির সাংবাদিকদের সামনে জেমস মারডক পত্রিকা বন্ধ করার ঘোষণা দিতে একটা বক্তৃতা করেন, তখন তিনি সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, দায়িত্ব ইত্যাদি নিয়ে অনেক সুন্দর সুন্দর কথা বলেছেন। সেই সঙ্গে বলেছেন, ‘নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিল অন্যদের দায়িত্বশীলতা, জবাবদিহি নিশ্চিত করার কাজে; কিন্তু নিজের বেলাতেই তা করতে ব্যর্থ হয়েছে।’ তিনি বলেছেন, তাঁরা ভুল করেছেন, ভবিষ্যতে সেরকম ভুল আর করবেন না ইত্যাদি। কিন্তু পত্রিকাটির প্রকাশনা কেন স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দিলেন, এর কোনো ব্যাখ্যা তাঁর বক্তব্যে পাওয়া গেল না। মারডকের পুরো মিডিয়া সাম্রাজ্যের ভাবমূর্তি যে একদম নীতিহীন অপরাধীর মতো হয়ে গেল, সেই কালিমা মোচনের বাসনায় আর নিউজ করপোরেশনের অবশিষ্ট ব্যবসা রক্ষার মতলবেই কি বলি দেওয়া হলো একটি ট্যাবলয়েড? ১৯৬৯ সালে নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড কেনার সঙ্গে সঙ্গে রুপার্ট মারডক পত্রিকাটির সম্পাদককে বরখাস্ত করেছিলেন। পরে একসময় তিনি নাকি কৌতুকের ছলে একবার বলেছিলেন, ‘ওই সম্পাদক এতই নোংরা/জঘন্য ছিলেন যে আমার মতো (নিম্ন রুচির) লোকের পক্ষেও তাঁকে রাখা সম্ভব ছিল না (হি ওয়াজ ঠু ন্যাস্টি ইভেন ফর মি)’। এখন তিনি আর তাঁর পুত্র মিলে খোদ পত্রিকাটিই বন্ধ করে দিলেন একই রকমের হাস্যকর পরিহাসের সঙ্গে। পিতা-পুত্র বলতে চাইছেন, নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড এতই ন্যাস্টি হয়ে গেছে যে, আমাদের মতো নিম্ন রুচির লোকদের পক্ষেও পত্রিকাটিকে আর রাখা সম্ভব হচ্ছে না। নোংরামি, রগড়, কেলেঙ্কারি, যৌনতা আর চাঞ্চল্যের বেসাতি করে ধনবান ও ক্ষমতাধর হয়ে ওঠা মারডক পিতা-পুত্রের রুচিবান ভালো মানুষ সাজার এই কসরত দেখে হাসাহাসি করছে বিলেত-আমেরিকার দায়িত্বশীল সাংবাদিক জগৎ ।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com
No comments