সময়ের কথা-পায়ের কোথায় যেন জুতার পেরেক খোঁচাচ্ছে... by অজয় দাশগুপ্ত
ঘাতকের হাতে নিহত জাতির জনকের আত্মার মাগফিরাত কামনা করাও ছিল সামরিক শাসকদের দৃষ্টিতে গুরুতর অপরাধ। এটাও বলা দরকার যে ১৯৭৬ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবল্পুব্দর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে দেশের কোনো সংবাদপত্রে এ সংক্রান্ত একটি লাইনও প্রকাশিত হয়নি।
পরের দিনেও ছিল না দিবসটি পালনের কোনো সংবাদ। দেশে গণতন্ত্র কায়েমের জন্যই নাকি বঙ্গবল্পুব্দকে হত্যা করা হয়েছিল!
তিন যুগ_ ৩৬ বছর আগের কথা। ১৯৭৫ সালের প্রত্যুষে বঙ্গবল্পুব্দ নিহত হয়েছিলেন। এর এক বছর পর ১৯৭৬ সালের ১৫ আগস্ট তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী পালনের জন্য ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের কর্মসূচি ছিল নিম্নরূপ : ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবল্পুব্দর বাসভবনে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে মিলাদ মাহফিল। তখনও সামরিক শাসন চলছিল। রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক পদে বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম দায়িত্ব পালন করছেন। তবে সবাই জানত যে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। সরকারে তার দায়িত্ব অর্থ, তথ্যসহ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার পদ। আর সামরিক আইন বলবতে তিনি রয়েছেন উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে। নৌ ও বিমানবাহিনীর প্রধানদ্বয়ও দায়িত্ব পালন করছেন উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে। ১৯৭৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের আগের সন্ধ্যায় বিচারপতি সায়েম এবং তিনজন উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের মধ্যে একজন জিয়াউর রহমান জাতির উদ্দেশে ভাষণ প্রদান করেন। তবে এ ভাষণে তাদের একজনও বঙ্গবল্পুব্দ শেখ মুজিবুর রহমানের নাম উচ্চারণ করেননি, শ্রদ্ধা নিবেদন তো দূরের কথা। সে সময়ের সংবাদপত্র এবং সরকার নিয়ন্ত্রিত বেতার ও টেলিভিশনে স্বাধীনতার স্থপতি ছিলেন নিষিদ্ধ একটি নাম। তবে তাকে অপবাদ দিতে সক্রিয় ছিল চেনা একটি মহল। সরকারের উদ্যোগে কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমেও বঙ্গবল্পুব্দ ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে কুৎসা রটিয়ে প্রচার করা হতো এবং তা দেশের সংবাদপত্র-বেতার-টিভিতে ফলাও করে প্রচারের ব্যবস্থা করত সামরিক সরকার।
বঙ্গবল্পুব্দ হত্যার প্রথম র্বাির্ষকীর কয়েক দিন আগে ২৭ জুলাই (১৯৭৬) বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সায়েমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের নেতাদের সভায় ৩০ জুলাই থেকে ঘরোয়া রাজনীতির অনুমতি প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়। সামরিক ফরমান দিয়ে জানানো হয়, যারা রাজনৈতিক দল করতে চায় তাদের সরকারের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। দলের ঘোষণাপত্র ও কর্মসূচি এবং গঠনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য দলগুলো চার দেয়ালের মধ্যে বৈঠক করতে পারবে এবং এ সংক্রান্ত খবর সংবাদপত্রও প্রচার করতে পারবে। তবে সে সময়ে সংবাদপত্রে ছিল কড়া সেন্সরশিপ। সরকারের ইচ্ছার বাইরে কিছু প্রকাশ করা সম্ভব ছিল না। গণতন্ত্রের কী অপার মহিমা!
১৫ আগস্ট ঘাতকদের একাধিক সূত্র এবং ওই ভয়ঙ্কর সময়ে সেখানে উপস্থিত কেউ কেউ জানিয়েছেন, ঘাতকদের উদ্দেশে বঙ্গবল্পুব্দ বলেছিলেন, 'তাকে হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশে গণতন্ত্রকেও হত্যা করা হবে।' এ কথা বলার পরপরই ঘাতকের ব্রাশফায়ারে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
বঙ্গবল্পুব্দর শেষ কথাটি কতই না প্রফেটিক ছিল!
১৫ আগস্টের প্রথম বার্ষিকী পালন করতে গিয়ে আবারও তার প্রমাণ মিলেছিল। ঘরোয়া রাজনীতি চালু হওয়ায় বঙ্গবল্পুব্দর বাসভবনে ফুল দিয়ে শ্রদব্দা নিবেদনের মতো সাধারণ কর্মসূচি পালনে সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাধা সৃষ্টি করবে না, এমন ধারণা করেছিলেন উদ্যোক্তা ছাত্র নেতৃবৃন্দ। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের সামরিক শাসকদের চিনতে তাদের অনেক বাকি ছিল! ১৫ আগস্ট ভোরে নাজনীন সুলতানা (বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী অফিসার) এবং নিনু নাজমুন আরা নামে দু'জন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা বঙ্গবল্পুব্দর বাসভবনের গেটে ফুল রেখে প্রথম শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। তাদের বাসার ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। পরে ছাত্রছাত্রীদের ছোট ছোট গ্রুপ ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের পথে রওনা দেয়। কিন্তু ততক্ষণে পুলিশ, সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দারা বঙ্গবল্পুব্দর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের কর্মসূচির খবর জেনে গেছে। তারা আর কাউকে বাসভবনের গেটের কাছে তো দূরের কথা, ৩২ নম্বরেও প্রবেশ করতে দেয়নি। অনেককে মারধর করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়।
দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে মিলাদ অনুষ্ঠানকে ঘিরে রেখেছিল পুলিশের একটি বড় দল। তারা মিলাদে অংশ নিতে আসা ছাত্রদের নানাভাবে হয়রানি করে। ঘাতকের হাতে নিহত জাতির জনকের আত্মার মাগফিরাত কামনা করাও ছিল সামরিক শাসকদের দৃষ্টিতে গুরুতর অপরাধ। এটাও বলা দরকার যে ১৯৭৬ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবল্পুব্দর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে দেশের কোনো সংবাদপত্রে এ সংক্রান্ত একটি লাইনও প্রকাশিত হয়নি। পরের দিনেও ছিল না দিবসটি পালনের কোনো সংবাদ। দেশে গণতন্ত্র কায়েমের জন্যই নাকি বঙ্গবল্পুব্দকে হত্যা করা হয়েছিল!
২৭ জুলাই (১৯৭৬) বঙ্গভবনে অনুষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের বৈঠকে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ (মোজাফফর) এবং সিপিবি_ এ তিনটি দলের নেতাদের কেন আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে তা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন কয়েকটি দলের নেতারা। জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, ইউপিপি (কাজী জাফর আহমদ) প্রভৃতি দলের নেতারা সামরিক শাসকদের কাছে দাবি করেন যে শেখ মুজিবের অনুগামীদের কোনোভাবেই যেন রাজনীতি করার অধিকার প্রদান করা না হয়।
বঙ্গবল্পুব্দ একজন নন-এনটিটি বা কোনো কালে এমন কেউ ছিলেন না, এটাই চেয়েছিলেন জিয়াউর রহমান এবং তার ঘনিষ্ঠজনরা। ১৯৭৬ সালের ৪ আগস্ট সামরিক সরকার এক নতুন বিধি ইস্যু করে জানিয়ে দেয় :'জীবিত বা মৃত কোনো ব্যক্তিকে কেন্দ্র করিয়া কোনো প্রকার ব্যক্তি পূজার উদ্রেক বা ব্যক্তিত্বের মাহাত্ম্য প্রচার ও বিকাশ' সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকবে। জিয়াউর রহমান-পরবর্তী সামরিক শাসক এইচএম এরশাদের আমলেও বঙ্গবল্পুব্দ ছিলেন বাংলাদেশের শাসকদের কাছে নিষিদ্ধ।
কেন এমনটি তারা চেয়েছিলেন, সেটা স্পষ্ট। বঙ্গবল্পুব্দ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি ছিলেন। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর কথা তিনি সব সময় বলতেন। দেশের সমস্যাগুলোর ব্যাপারে তার পর্যবেক্ষণ ছিল অনুপুঙ্খ, অন্তর্দৃষ্টি ছিল গভীর। যারা বাংলাদেশ চায়নি একাত্তরে, তারা বঙ্গবল্পুব্দকেই স্বাধীন দেশের পথের কাঁটা মনে করেছে। তাকে নির্মমভাবে হত্যা করার পরও নব্য শাসকদের স্বস্তি ছিল না। স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি যেন রাজনীতির অঙ্গনে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে সেজন্য তারা দমননীতি ও অপপ্রচারসহ সব ধরনের কূটকৌশল অবলম্বন করেছে। গ্রেফতার করা হয়েছে শত শত নেতাকর্মীকে। মানবাধিকার বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব সামরিক শাসকদের কাছে ছিল না। জিয়াউর রহমান প্রথমদিকে বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে শিখণ্ডীর মতো সামনে রেখে ক্ষমতার দণ্ড পরিচালনা করেন। ১৯৭৬ সালের নভেম্বরে তিনি প্রধান সামরিক শাসকের পদ গ্রহণ করেন এবং কিছুদিন পর রাষ্ট্রপতি পদ থেকে বিচারপতি সায়েম সাহেবকে সরিয়ে দিয়ে নিজেই সে পদ গ্রহণ করেন। ১৯৭৮ সালের জুন মাসে সামরিক শাসন বজায় রেখেই দেশে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে 'এক কোটিরও বেশি ভোটের ব্যবধানে'। ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়ও ছিল দেশে সামরিক শাসন এবং এ সংসদই কুখ্যাত পঞ্চম সংশোধনী অনুমোদন করে, যা সম্প্রতি সর্বোচ্চ আদালতে অবৈধ ঘোষিত হয়েছে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবল্পুব্দকে হত্যার সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অস্থিরতা ছিল যথেষ্ট। এ ঘটনার মাত্র দুই মাস নয় দিন আগে (৬ জুন রাতে) একক রাজনৈতিক দল (বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা বাকশাল) এবং তার বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়। এসব কমিটিতে অন্য কয়েকটি দলের কিছু প্রতিনিধি রাখা হলেও বিপুল প্রাধান্য ছিল আওয়ামী লীগ এবং তার বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের নেতাদের। জেলা ও থানা কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া চলছিল এবং দেশের সর্বত্র আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের অনেকেই নিজেদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করায় তৎপর ছিল। এ সুযোগে যে ঘরের শত্রু বিভীষণরূপী খন্দকার মোশতাক আহমদকে সামনে রেখে ঘাতক চক্র শক্তি সঞ্চয় করে, সেটা তারা বোঝার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেনি। এ কারণেই ১৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের পক্ষে গা ঝাড়া দিয়ে উঠতে কিছুটা সময় লাগে।
বর্তমানে এ দলটি অনেক সংহত। কিন্তু পঁচাত্তরের ঘটনাপ্রবাহের একজন নিবিড় পর্যবেক্ষক হিসেবে সে সময়ের সঙ্গে যেন কিছুটা সামঞ্জস্যও খুঁজে পাই। তখন ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের অনেকের ব্যস্ততা ছিল নিজেদের নিয়ে। এখনও তেমন লক্ষণই প্রকট। দল ও অঙ্গ সংগঠনগুলোর সাংগঠনিক কার্যক্রম সীমিত, সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বিভিন্ন প্রকল্প এবং সরকারি-আধা সরকারি নানা প্রতিষ্ঠান থেকে সুবিধা গ্রহণের অভিযোগ অনেকের বিরুদ্ধে। ছাত্রলীগ এখন যা করছে, স্বাধীনতার পরবর্তী সময়েও এ ধরনের অভিযোগই ছিল তাদের বিরুদ্ধে। স্বাধীনতার পর এ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়েছিলেন শফিউল আলম প্রধান, যার নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশ্য সাতজন ছাত্রকে গুলি করে হত্যা করা হয়। শেখ হাসিনার সামনে এখন যেসব এজেন্ডা তা বাস্তবায়নে সরকার ও দলের পক্ষে জনসমর্থন আদায়ে আরও বেশি সক্রিয়তা আওয়ামী লীগ এবং তাদের সমর্থক বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, গণতান্ত্রিক পন্থা ব্যতিরেকে অন্য উপায়ে ক্ষমতা দখলকে চিরকালের জন্য অবৈধ ঘোষণা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্থায়ী রূপ দেওয়া, ধর্মান্ধ জঙ্গি শক্তিকে দমন প্রভৃতি প্রতিটি পদক্ষেপে প্রবল প্রতিরোধ আসা স্বাভাবিক এবং সেটা আসছেও। ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে সক্রিয় রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা কি বুঝতে পারছে না যে এখনও 'পায়ে জুতার কোন পেরেক খোঁচাচ্ছে?' এটা চিহ্নিত করতে না পারলে কিন্তু পুরো পেরেক পায়ে ঢুকে যেতে পারে এবং তা ডেকে আনতে পারে প্রাণঘাতী ধনুষ্টঙ্কার ব্যাধি।
লেখাটি শেষ করব ১৯৭৬ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে কাজল ব্যানার্জি (এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক) সম্পাদিত 'দেখা পেলেম ফাল্গুনে' সংকলনে মৃণাল সরকারের 'সরকার মুজিব বিন' ছদ্মনামে লেখা কবিতার অংশবিশেষ উল্লেখ করে : এই সেদিনও তো রাজ্য ছিল/ সোনার সংসার ছিল/ পাণ্ডবেরা রাজা ছিল/ হায়! যুধিষ্ঠির চলে গেলে/ ছারখারে ছাই হয় সোনার সংসার।
ছাই হওয়া সোনার সংসার ফিরিয়ে আনার কাজ কিন্তু মোটেই সহজ নয়।
অজয় দাশগুপ্ত :সাংবাদিক
ajoydg@gmail.com
তিন যুগ_ ৩৬ বছর আগের কথা। ১৯৭৫ সালের প্রত্যুষে বঙ্গবল্পুব্দ নিহত হয়েছিলেন। এর এক বছর পর ১৯৭৬ সালের ১৫ আগস্ট তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী পালনের জন্য ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের কর্মসূচি ছিল নিম্নরূপ : ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবল্পুব্দর বাসভবনে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে মিলাদ মাহফিল। তখনও সামরিক শাসন চলছিল। রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক পদে বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম দায়িত্ব পালন করছেন। তবে সবাই জানত যে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। সরকারে তার দায়িত্ব অর্থ, তথ্যসহ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার পদ। আর সামরিক আইন বলবতে তিনি রয়েছেন উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে। নৌ ও বিমানবাহিনীর প্রধানদ্বয়ও দায়িত্ব পালন করছেন উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে। ১৯৭৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের আগের সন্ধ্যায় বিচারপতি সায়েম এবং তিনজন উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের মধ্যে একজন জিয়াউর রহমান জাতির উদ্দেশে ভাষণ প্রদান করেন। তবে এ ভাষণে তাদের একজনও বঙ্গবল্পুব্দ শেখ মুজিবুর রহমানের নাম উচ্চারণ করেননি, শ্রদ্ধা নিবেদন তো দূরের কথা। সে সময়ের সংবাদপত্র এবং সরকার নিয়ন্ত্রিত বেতার ও টেলিভিশনে স্বাধীনতার স্থপতি ছিলেন নিষিদ্ধ একটি নাম। তবে তাকে অপবাদ দিতে সক্রিয় ছিল চেনা একটি মহল। সরকারের উদ্যোগে কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমেও বঙ্গবল্পুব্দ ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে কুৎসা রটিয়ে প্রচার করা হতো এবং তা দেশের সংবাদপত্র-বেতার-টিভিতে ফলাও করে প্রচারের ব্যবস্থা করত সামরিক সরকার।
বঙ্গবল্পুব্দ হত্যার প্রথম র্বাির্ষকীর কয়েক দিন আগে ২৭ জুলাই (১৯৭৬) বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সায়েমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের নেতাদের সভায় ৩০ জুলাই থেকে ঘরোয়া রাজনীতির অনুমতি প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়। সামরিক ফরমান দিয়ে জানানো হয়, যারা রাজনৈতিক দল করতে চায় তাদের সরকারের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। দলের ঘোষণাপত্র ও কর্মসূচি এবং গঠনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য দলগুলো চার দেয়ালের মধ্যে বৈঠক করতে পারবে এবং এ সংক্রান্ত খবর সংবাদপত্রও প্রচার করতে পারবে। তবে সে সময়ে সংবাদপত্রে ছিল কড়া সেন্সরশিপ। সরকারের ইচ্ছার বাইরে কিছু প্রকাশ করা সম্ভব ছিল না। গণতন্ত্রের কী অপার মহিমা!
১৫ আগস্ট ঘাতকদের একাধিক সূত্র এবং ওই ভয়ঙ্কর সময়ে সেখানে উপস্থিত কেউ কেউ জানিয়েছেন, ঘাতকদের উদ্দেশে বঙ্গবল্পুব্দ বলেছিলেন, 'তাকে হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশে গণতন্ত্রকেও হত্যা করা হবে।' এ কথা বলার পরপরই ঘাতকের ব্রাশফায়ারে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
বঙ্গবল্পুব্দর শেষ কথাটি কতই না প্রফেটিক ছিল!
১৫ আগস্টের প্রথম বার্ষিকী পালন করতে গিয়ে আবারও তার প্রমাণ মিলেছিল। ঘরোয়া রাজনীতি চালু হওয়ায় বঙ্গবল্পুব্দর বাসভবনে ফুল দিয়ে শ্রদব্দা নিবেদনের মতো সাধারণ কর্মসূচি পালনে সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাধা সৃষ্টি করবে না, এমন ধারণা করেছিলেন উদ্যোক্তা ছাত্র নেতৃবৃন্দ। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের সামরিক শাসকদের চিনতে তাদের অনেক বাকি ছিল! ১৫ আগস্ট ভোরে নাজনীন সুলতানা (বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী অফিসার) এবং নিনু নাজমুন আরা নামে দু'জন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা বঙ্গবল্পুব্দর বাসভবনের গেটে ফুল রেখে প্রথম শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। তাদের বাসার ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। পরে ছাত্রছাত্রীদের ছোট ছোট গ্রুপ ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের পথে রওনা দেয়। কিন্তু ততক্ষণে পুলিশ, সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দারা বঙ্গবল্পুব্দর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের কর্মসূচির খবর জেনে গেছে। তারা আর কাউকে বাসভবনের গেটের কাছে তো দূরের কথা, ৩২ নম্বরেও প্রবেশ করতে দেয়নি। অনেককে মারধর করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়।
দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে মিলাদ অনুষ্ঠানকে ঘিরে রেখেছিল পুলিশের একটি বড় দল। তারা মিলাদে অংশ নিতে আসা ছাত্রদের নানাভাবে হয়রানি করে। ঘাতকের হাতে নিহত জাতির জনকের আত্মার মাগফিরাত কামনা করাও ছিল সামরিক শাসকদের দৃষ্টিতে গুরুতর অপরাধ। এটাও বলা দরকার যে ১৯৭৬ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবল্পুব্দর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে দেশের কোনো সংবাদপত্রে এ সংক্রান্ত একটি লাইনও প্রকাশিত হয়নি। পরের দিনেও ছিল না দিবসটি পালনের কোনো সংবাদ। দেশে গণতন্ত্র কায়েমের জন্যই নাকি বঙ্গবল্পুব্দকে হত্যা করা হয়েছিল!
২৭ জুলাই (১৯৭৬) বঙ্গভবনে অনুষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের বৈঠকে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ (মোজাফফর) এবং সিপিবি_ এ তিনটি দলের নেতাদের কেন আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে তা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন কয়েকটি দলের নেতারা। জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, ইউপিপি (কাজী জাফর আহমদ) প্রভৃতি দলের নেতারা সামরিক শাসকদের কাছে দাবি করেন যে শেখ মুজিবের অনুগামীদের কোনোভাবেই যেন রাজনীতি করার অধিকার প্রদান করা না হয়।
বঙ্গবল্পুব্দ একজন নন-এনটিটি বা কোনো কালে এমন কেউ ছিলেন না, এটাই চেয়েছিলেন জিয়াউর রহমান এবং তার ঘনিষ্ঠজনরা। ১৯৭৬ সালের ৪ আগস্ট সামরিক সরকার এক নতুন বিধি ইস্যু করে জানিয়ে দেয় :'জীবিত বা মৃত কোনো ব্যক্তিকে কেন্দ্র করিয়া কোনো প্রকার ব্যক্তি পূজার উদ্রেক বা ব্যক্তিত্বের মাহাত্ম্য প্রচার ও বিকাশ' সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকবে। জিয়াউর রহমান-পরবর্তী সামরিক শাসক এইচএম এরশাদের আমলেও বঙ্গবল্পুব্দ ছিলেন বাংলাদেশের শাসকদের কাছে নিষিদ্ধ।
কেন এমনটি তারা চেয়েছিলেন, সেটা স্পষ্ট। বঙ্গবল্পুব্দ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি ছিলেন। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর কথা তিনি সব সময় বলতেন। দেশের সমস্যাগুলোর ব্যাপারে তার পর্যবেক্ষণ ছিল অনুপুঙ্খ, অন্তর্দৃষ্টি ছিল গভীর। যারা বাংলাদেশ চায়নি একাত্তরে, তারা বঙ্গবল্পুব্দকেই স্বাধীন দেশের পথের কাঁটা মনে করেছে। তাকে নির্মমভাবে হত্যা করার পরও নব্য শাসকদের স্বস্তি ছিল না। স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি যেন রাজনীতির অঙ্গনে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে সেজন্য তারা দমননীতি ও অপপ্রচারসহ সব ধরনের কূটকৌশল অবলম্বন করেছে। গ্রেফতার করা হয়েছে শত শত নেতাকর্মীকে। মানবাধিকার বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব সামরিক শাসকদের কাছে ছিল না। জিয়াউর রহমান প্রথমদিকে বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে শিখণ্ডীর মতো সামনে রেখে ক্ষমতার দণ্ড পরিচালনা করেন। ১৯৭৬ সালের নভেম্বরে তিনি প্রধান সামরিক শাসকের পদ গ্রহণ করেন এবং কিছুদিন পর রাষ্ট্রপতি পদ থেকে বিচারপতি সায়েম সাহেবকে সরিয়ে দিয়ে নিজেই সে পদ গ্রহণ করেন। ১৯৭৮ সালের জুন মাসে সামরিক শাসন বজায় রেখেই দেশে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে 'এক কোটিরও বেশি ভোটের ব্যবধানে'। ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়ও ছিল দেশে সামরিক শাসন এবং এ সংসদই কুখ্যাত পঞ্চম সংশোধনী অনুমোদন করে, যা সম্প্রতি সর্বোচ্চ আদালতে অবৈধ ঘোষিত হয়েছে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবল্পুব্দকে হত্যার সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অস্থিরতা ছিল যথেষ্ট। এ ঘটনার মাত্র দুই মাস নয় দিন আগে (৬ জুন রাতে) একক রাজনৈতিক দল (বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা বাকশাল) এবং তার বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়। এসব কমিটিতে অন্য কয়েকটি দলের কিছু প্রতিনিধি রাখা হলেও বিপুল প্রাধান্য ছিল আওয়ামী লীগ এবং তার বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের নেতাদের। জেলা ও থানা কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া চলছিল এবং দেশের সর্বত্র আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের অনেকেই নিজেদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করায় তৎপর ছিল। এ সুযোগে যে ঘরের শত্রু বিভীষণরূপী খন্দকার মোশতাক আহমদকে সামনে রেখে ঘাতক চক্র শক্তি সঞ্চয় করে, সেটা তারা বোঝার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেনি। এ কারণেই ১৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের পক্ষে গা ঝাড়া দিয়ে উঠতে কিছুটা সময় লাগে।
বর্তমানে এ দলটি অনেক সংহত। কিন্তু পঁচাত্তরের ঘটনাপ্রবাহের একজন নিবিড় পর্যবেক্ষক হিসেবে সে সময়ের সঙ্গে যেন কিছুটা সামঞ্জস্যও খুঁজে পাই। তখন ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের অনেকের ব্যস্ততা ছিল নিজেদের নিয়ে। এখনও তেমন লক্ষণই প্রকট। দল ও অঙ্গ সংগঠনগুলোর সাংগঠনিক কার্যক্রম সীমিত, সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বিভিন্ন প্রকল্প এবং সরকারি-আধা সরকারি নানা প্রতিষ্ঠান থেকে সুবিধা গ্রহণের অভিযোগ অনেকের বিরুদ্ধে। ছাত্রলীগ এখন যা করছে, স্বাধীনতার পরবর্তী সময়েও এ ধরনের অভিযোগই ছিল তাদের বিরুদ্ধে। স্বাধীনতার পর এ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়েছিলেন শফিউল আলম প্রধান, যার নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশ্য সাতজন ছাত্রকে গুলি করে হত্যা করা হয়। শেখ হাসিনার সামনে এখন যেসব এজেন্ডা তা বাস্তবায়নে সরকার ও দলের পক্ষে জনসমর্থন আদায়ে আরও বেশি সক্রিয়তা আওয়ামী লীগ এবং তাদের সমর্থক বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, গণতান্ত্রিক পন্থা ব্যতিরেকে অন্য উপায়ে ক্ষমতা দখলকে চিরকালের জন্য অবৈধ ঘোষণা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্থায়ী রূপ দেওয়া, ধর্মান্ধ জঙ্গি শক্তিকে দমন প্রভৃতি প্রতিটি পদক্ষেপে প্রবল প্রতিরোধ আসা স্বাভাবিক এবং সেটা আসছেও। ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে সক্রিয় রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা কি বুঝতে পারছে না যে এখনও 'পায়ে জুতার কোন পেরেক খোঁচাচ্ছে?' এটা চিহ্নিত করতে না পারলে কিন্তু পুরো পেরেক পায়ে ঢুকে যেতে পারে এবং তা ডেকে আনতে পারে প্রাণঘাতী ধনুষ্টঙ্কার ব্যাধি।
লেখাটি শেষ করব ১৯৭৬ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে কাজল ব্যানার্জি (এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক) সম্পাদিত 'দেখা পেলেম ফাল্গুনে' সংকলনে মৃণাল সরকারের 'সরকার মুজিব বিন' ছদ্মনামে লেখা কবিতার অংশবিশেষ উল্লেখ করে : এই সেদিনও তো রাজ্য ছিল/ সোনার সংসার ছিল/ পাণ্ডবেরা রাজা ছিল/ হায়! যুধিষ্ঠির চলে গেলে/ ছারখারে ছাই হয় সোনার সংসার।
ছাই হওয়া সোনার সংসার ফিরিয়ে আনার কাজ কিন্তু মোটেই সহজ নয়।
অজয় দাশগুপ্ত :সাংবাদিক
ajoydg@gmail.com
No comments