মত দ্বিমত-এখন হরতালের অপপ্রয়োগ হচ্ছে by এম এম আকাশ
হরতালে জনদুর্ভোগ ছাড়াও যে বিপুল অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়, মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর আঘাত আসে, তার দায় কার? কীভাবে এই ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি থেকে মানুষকে রেহাই দেওয়া যায়, এ নিয়ে দুই অর্থনীতিবিদের অভিমত প্রকাশ করা হলো:
হরতালে অর্থনৈতিক ক্ষতির বিষয়ে ইউএনডিপি একটা জরিপ করেছিল এবং আমাদের প্রয়াত অর্থনীতিবিদ নাসরিন খন্দকার ওই জরিপ পরিচালনা করেছিলেন। তিনি একটা পরিমাপও দাঁড় করান। সম্ভবত এটিই হরতালের ক্ষতির তাত্ত্বিক পদ্ধতিগত প্রচেষ্টা। এরপর বিশ্বব্যাংকও একাধিক পরিমাপ প্রকাশ করেছে। অন্যান্য অর্থনীতিবিদও এ বিষয়ে কাজ করেছেন। এসব পরিমাপের প্রধান ভিত্তি হলো জিডিপি। সহজ অনুমান হচ্ছে, এক দিন সব অর্থনৈতিক কাজকর্ম বন্ধ থাকলে এক দিনের জিডিপির ক্ষতি হয়। কিন্তু এই অনুমিতির দুর্বলতা আছে একাধিক। প্রথমত, আমাদের অর্ধেকের বেশি অর্থনৈতিক কাজকর্ম অনানুষ্ঠানিক খাতে এবং আত্মনিয়োজিত ও সেবা খাত, কৃষি খাত এবং অনানুষ্ঠানিক খাতের সবই সাধারণত হরতাল সত্ত্বেও সক্রিয় থাকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে। সে হিসেবে ধরে নেওয়া যায়, এক দিনের হরতালে ষাট ভাগ অর্থনৈতিক কার্যক্রম চালু থাকে এবং চল্লিশ ভাগ বন্ধ থাকে।
এই অর্থনৈতিক ক্ষতির চূড়ান্ত ফলাফল কী, তা-ও আমাদের দেখতে হবে। কোনো বৃহত্তর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য জনগণ যদি স্বেচ্ছায় এই ছোট অর্থনৈতিক ক্ষতি বরণ করে নিতে রাজি হয়, তবে তা সমর্থনযোগ্য। ইতিহাসে এ রকম অনেক ঐতিহাসিক মহৎ হরতালের দৃষ্টান্ত রয়েছে।
আরও যদি মনে করি যে, কোনো হরতাল জনসমর্থনহীন ইস্যুতে হচ্ছে, তাহলে সরকারি কর্মচারী ও ব্যবসায়ী শিল্পপতিরাও চেষ্টা করেন হরতালের মধ্যে যথাসম্ভব কাজ করতে। তাহলে ক্ষতির মাত্রা আরও কমে এক দিনের জিডিপির ১০ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশে সীমাবদ্ধ হবে। মূলত পরিবহন খাতের ক্ষতিটাই সর্ববৃহৎ। তবে এই ক্ষতির মাত্রা বৃদ্ধি পাবে, যদি হরতাল স্বতঃস্ফূর্ত থাকে।
কল্পনা করুন, ঊনসত্তরের হরতালের কথা, অথবা একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলনের একটি দিনের কথা। তখন বিশাল অর্থনৈতিক ক্ষতি হতো ঠিকই, কিন্তু বিনিময়ে বিশাল রাজনৈতিক লাভ হতো। সুতরাং হরতালের অর্থনৈতিক ক্ষতির বিষয়ে প্রথম আমাদের যা বিবেচনা করতে হবে তা হলো, হরতালের প্রকৃতি। তা কি জনস্বার্থ রক্ষায় হচ্ছে, না এর বিরুদ্ধে হচ্ছে? নন-ইস্যুতে জনসমর্থনহীন হরতাল যা আসলে নিছক ক্ষমতা দখলের লড়াই এবং যার ফল হচ্ছে হরতালের মাধ্যমে সংকট সৃষ্টি করে কোনো মতে ক্ষমতা দখলের পর আরও বর্ধিত দুর্নীতি ও প্রবলতর প্রতিশোধের রাজনীতি। সে রকম হরতাল শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতিই ঘটায় না, তা রাজনৈতিক-সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক সর্বপর্যায়ে হতাশা ও বিপর্যয় ডেকে আনে। আগুয়ান ইস্যুতে জনস্বার্থে এবং ক্রমান্বয়ে সব আন্দোলনের ধাপ অতিক্রম করার পর জনগণের ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষায় ডাকা যে হরতাল, এর জন্য আগের রাতে বোমাও ফাটাতে হয় না, গাড়িও পোড়াতে হয় না। তা হতাশাও সৃষ্টি করে না, বিপর্যয়ও সৃষ্টি করে না। তা মানুষকে শিরদাঁড়া খাড়া করে দাঁড়াতে শেখায় এবং সে রকম হরতাল হয়ে যায় জনগণের উৎসব।
আমাদের দেশে এখন হরতাল হচ্ছে আগুয়ান ইস্যুতে নয়, সমাজকে পেছন দিকে অন্ধকারে টেনে নেওয়ার জন্য কাপুরুষোচিত হরতাল। যেমন—তেল-গ্যাসের হরতালকে এ ক্ষেত্রে আমি ব্যতিক্রম ধরছি। এখন মূলত হরতাল ডাকছে প্রধান বিরোধী দল এবং ইসলামপন্থী দলগুলো। প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দলের হরতালের আশু ইস্যুটি হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ইস্যু। যেহেতু আদালতের রায়ে আছে, দুই মেয়াদের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করার কথা। সুতরাং আদালতের এই রায় ধরেই বিএনপি সংসদে গিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে তাদের যুক্তিগুলো তুলে ধরতে পারত এবং এই প্রশ্নে শান্তিপূর্ণ ও ইতিবাচক ধারায় আন্দোলন এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে পারত। সেটা ব্যর্থ হলে তখন সংসদ ত্যাগ করে আরও জঙ্গি আন্দোলনের পন্থা গ্রহণ করাই তাদের জন্য সংগত হতো।
কিন্তু আন্দোলন ক্রমান্বয়ে বিকাশের কৌশল ত্যাগ করে, আমি বলব, তারা বোকার মতো এক লাফে হরতাল কর্মসূচি দিয়ে জনসমর্থন হারিয়েছে। দ্বিতীয়ত, হরতালকে এই এক ইস্যুর মধ্যে তারা সীমাবদ্ধ রাখেনি। তাদের নেতাদের বক্তৃতা থেকে মনে হয়, তারেক জিয়া ও কোকোর দুর্নীতি মামলা প্রত্যাহারও এই হরতালের একটি দাবি। সংবিধানে শিক্ষানীতি এবং নারীনীতিকে আরও ধর্মীয়করণ ও সাম্প্রদায়িকীকরণও তাদের দাবি।
এ ছাড়া ইসলামপন্থীদের আরও প্রতিক্রিয়াশীল দাবির প্রতি সংহতি জানিয়ে তাদের হরতালেও তারা সংহতি জানিয়েছে। ফলে, কৌশলের দিক থেকে এবং সারবস্তুর দিক থেকেও তাদের হরতাল গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল মহলের সমর্থন পাবে না। একমাত্র তাদের অন্ধ স্তাবক এবং তাদের আমলের সুবিধাভোগীরাও ইনিয়েবিনিয়ে সাতকাহন গেয়ে এসব হরতাল সমর্থন করবে এবং সেই সাতকাহনের বড় অংশজুড়েই থাকবে অতীতে আওয়ামী লীগ কী কী করেছিল, তার ফিরিস্তি। কিন্তু ‘অন্যে মন্দ করিলে আমি ভালো করিব না’ এটা কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়।
অনেক সময় যাকে হরতাল নামে অভিহিত করা হয়, তা আসলে ভয়তাল। আমি এই ধরনের হরতালকে মনে করি ফ্যাসিস্ট হরতাল। আগের দিন রাতে ফ্যাসিস্টরা তাদের গুন্ডা বাহিনী নামিয়ে দিল, অনেক জায়গায় আগুন দিল, দু-চার জায়গায় বোমা ফাটাল, চাপাতি হাতে, লাঠি হাতে রাজপথে মহড়া দিল এবং কোনো গাড়ি বা অফিসযাত্রীকে পেলে তাকে আক্রমণ করল। গাড়ি তো ভাঙলই, অফিসযাত্রীকে উলঙ্গ করে ফেলল। এটা কল্পকাহিনি নয়, এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশে ঘটেছে। এ ধরনের কাজ যত মহান রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই করা হোক না কেন, তা সমর্থনযোগ্য নয়।
হরতালের গণতান্ত্রিক অধিকার কোনো রাজনৈতিক দলই এখন পর্যন্ত অস্বীকার করেনি। যদিও সুশীল সমাজ এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে হরতাল করার গণতান্ত্রিক অধিকার সমর্থন করি। তবে, আমি এই অধিকারের অপপ্রয়োগে বিশ্বাসী নই।
ড. এম এম আকাশ: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এই অর্থনৈতিক ক্ষতির চূড়ান্ত ফলাফল কী, তা-ও আমাদের দেখতে হবে। কোনো বৃহত্তর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য জনগণ যদি স্বেচ্ছায় এই ছোট অর্থনৈতিক ক্ষতি বরণ করে নিতে রাজি হয়, তবে তা সমর্থনযোগ্য। ইতিহাসে এ রকম অনেক ঐতিহাসিক মহৎ হরতালের দৃষ্টান্ত রয়েছে।
আরও যদি মনে করি যে, কোনো হরতাল জনসমর্থনহীন ইস্যুতে হচ্ছে, তাহলে সরকারি কর্মচারী ও ব্যবসায়ী শিল্পপতিরাও চেষ্টা করেন হরতালের মধ্যে যথাসম্ভব কাজ করতে। তাহলে ক্ষতির মাত্রা আরও কমে এক দিনের জিডিপির ১০ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশে সীমাবদ্ধ হবে। মূলত পরিবহন খাতের ক্ষতিটাই সর্ববৃহৎ। তবে এই ক্ষতির মাত্রা বৃদ্ধি পাবে, যদি হরতাল স্বতঃস্ফূর্ত থাকে।
কল্পনা করুন, ঊনসত্তরের হরতালের কথা, অথবা একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলনের একটি দিনের কথা। তখন বিশাল অর্থনৈতিক ক্ষতি হতো ঠিকই, কিন্তু বিনিময়ে বিশাল রাজনৈতিক লাভ হতো। সুতরাং হরতালের অর্থনৈতিক ক্ষতির বিষয়ে প্রথম আমাদের যা বিবেচনা করতে হবে তা হলো, হরতালের প্রকৃতি। তা কি জনস্বার্থ রক্ষায় হচ্ছে, না এর বিরুদ্ধে হচ্ছে? নন-ইস্যুতে জনসমর্থনহীন হরতাল যা আসলে নিছক ক্ষমতা দখলের লড়াই এবং যার ফল হচ্ছে হরতালের মাধ্যমে সংকট সৃষ্টি করে কোনো মতে ক্ষমতা দখলের পর আরও বর্ধিত দুর্নীতি ও প্রবলতর প্রতিশোধের রাজনীতি। সে রকম হরতাল শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতিই ঘটায় না, তা রাজনৈতিক-সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক সর্বপর্যায়ে হতাশা ও বিপর্যয় ডেকে আনে। আগুয়ান ইস্যুতে জনস্বার্থে এবং ক্রমান্বয়ে সব আন্দোলনের ধাপ অতিক্রম করার পর জনগণের ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষায় ডাকা যে হরতাল, এর জন্য আগের রাতে বোমাও ফাটাতে হয় না, গাড়িও পোড়াতে হয় না। তা হতাশাও সৃষ্টি করে না, বিপর্যয়ও সৃষ্টি করে না। তা মানুষকে শিরদাঁড়া খাড়া করে দাঁড়াতে শেখায় এবং সে রকম হরতাল হয়ে যায় জনগণের উৎসব।
আমাদের দেশে এখন হরতাল হচ্ছে আগুয়ান ইস্যুতে নয়, সমাজকে পেছন দিকে অন্ধকারে টেনে নেওয়ার জন্য কাপুরুষোচিত হরতাল। যেমন—তেল-গ্যাসের হরতালকে এ ক্ষেত্রে আমি ব্যতিক্রম ধরছি। এখন মূলত হরতাল ডাকছে প্রধান বিরোধী দল এবং ইসলামপন্থী দলগুলো। প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দলের হরতালের আশু ইস্যুটি হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ইস্যু। যেহেতু আদালতের রায়ে আছে, দুই মেয়াদের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করার কথা। সুতরাং আদালতের এই রায় ধরেই বিএনপি সংসদে গিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে তাদের যুক্তিগুলো তুলে ধরতে পারত এবং এই প্রশ্নে শান্তিপূর্ণ ও ইতিবাচক ধারায় আন্দোলন এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে পারত। সেটা ব্যর্থ হলে তখন সংসদ ত্যাগ করে আরও জঙ্গি আন্দোলনের পন্থা গ্রহণ করাই তাদের জন্য সংগত হতো।
কিন্তু আন্দোলন ক্রমান্বয়ে বিকাশের কৌশল ত্যাগ করে, আমি বলব, তারা বোকার মতো এক লাফে হরতাল কর্মসূচি দিয়ে জনসমর্থন হারিয়েছে। দ্বিতীয়ত, হরতালকে এই এক ইস্যুর মধ্যে তারা সীমাবদ্ধ রাখেনি। তাদের নেতাদের বক্তৃতা থেকে মনে হয়, তারেক জিয়া ও কোকোর দুর্নীতি মামলা প্রত্যাহারও এই হরতালের একটি দাবি। সংবিধানে শিক্ষানীতি এবং নারীনীতিকে আরও ধর্মীয়করণ ও সাম্প্রদায়িকীকরণও তাদের দাবি।
এ ছাড়া ইসলামপন্থীদের আরও প্রতিক্রিয়াশীল দাবির প্রতি সংহতি জানিয়ে তাদের হরতালেও তারা সংহতি জানিয়েছে। ফলে, কৌশলের দিক থেকে এবং সারবস্তুর দিক থেকেও তাদের হরতাল গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল মহলের সমর্থন পাবে না। একমাত্র তাদের অন্ধ স্তাবক এবং তাদের আমলের সুবিধাভোগীরাও ইনিয়েবিনিয়ে সাতকাহন গেয়ে এসব হরতাল সমর্থন করবে এবং সেই সাতকাহনের বড় অংশজুড়েই থাকবে অতীতে আওয়ামী লীগ কী কী করেছিল, তার ফিরিস্তি। কিন্তু ‘অন্যে মন্দ করিলে আমি ভালো করিব না’ এটা কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়।
অনেক সময় যাকে হরতাল নামে অভিহিত করা হয়, তা আসলে ভয়তাল। আমি এই ধরনের হরতালকে মনে করি ফ্যাসিস্ট হরতাল। আগের দিন রাতে ফ্যাসিস্টরা তাদের গুন্ডা বাহিনী নামিয়ে দিল, অনেক জায়গায় আগুন দিল, দু-চার জায়গায় বোমা ফাটাল, চাপাতি হাতে, লাঠি হাতে রাজপথে মহড়া দিল এবং কোনো গাড়ি বা অফিসযাত্রীকে পেলে তাকে আক্রমণ করল। গাড়ি তো ভাঙলই, অফিসযাত্রীকে উলঙ্গ করে ফেলল। এটা কল্পকাহিনি নয়, এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশে ঘটেছে। এ ধরনের কাজ যত মহান রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই করা হোক না কেন, তা সমর্থনযোগ্য নয়।
হরতালের গণতান্ত্রিক অধিকার কোনো রাজনৈতিক দলই এখন পর্যন্ত অস্বীকার করেনি। যদিও সুশীল সমাজ এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে হরতাল করার গণতান্ত্রিক অধিকার সমর্থন করি। তবে, আমি এই অধিকারের অপপ্রয়োগে বিশ্বাসী নই।
ড. এম এম আকাশ: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments