অরণ্যে রোদন-এমনি সব গাধা... by আনিসুল হক
‘এমনি সব গাধা, ধুলারে মারি করিয়া দিল কাদা।’ এ তো রবীন্দ্রনাথের জুতা আবিষ্কারের চেয়েও কম বোকামো নয়। ‘করিতে ধুলা দূর, জগৎ হলো ধুলায় ভরপুর।’ বিরোধী দল ঢাকায় মহাসমাবেশ ডেকেছে। সেই মহাসমাবেশে যাতে লোকসমাগম কম হয়, সে জন্য সরকার যেন হরতাল ডেকে বসল।
বাস না পেয়ে ভ্যানে করে ঢাকায় আসছিলেন খেটে খাওয়া কয়েকজন মানুষ, পরিবার-পরিজনসহ, বলেছেন লাখ কথার এক কথা, আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকলেও হরতাল ডাকে, সরকারে থাকলেও হরতাল ডাকে।
‘মানুষের কত জরুরি প্রয়োজন থাকে। কাউকে বা বিদেশে যেতে বিমান ধরতে হবে, কারও বা ব্যবসায়িক জরুরি কাজ আছে, কারও বা চিকিৎসা প্রয়োজন, তাঁরা ঢাকায় যাবেন।’ এই সব কথা আমি একবার লিখেছিলাম হরতালের সমালোচনা করে। এই কথা লিখতে হচ্ছে সরকার আর সরকারি দলের নেওয়া পদক্ষেপগুলোর সমালোচনায়। সরকারের কাজ দেশটা চালানো, দেশটাকে থমকে দেওয়া নয়। দু-তিন দিন ধরে ঢাকামুখী লঞ্চ বন্ধ করে দেওয়া হলো, বাস বন্ধ করে দেওয়া হলো, এ কী দুর্বুদ্ধি! দেশের ভেতরে স্বাধীনভাবে চলাচল করা তো নাগরিক মাত্রেরই মৌলিক অধিকার। আর যে সমাবেশ বেআইনি ঘোষিত হয়নি, সে সমাবেশে যোগদান করাও তো যেকোনো নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। সরকার, তার প্রশাসন, পুলিশ, রাজনৈতিক সংগঠন সেই সমাবেশগামী মানুষকে বাধা দিল কোন আইনের বলে?
ফেসবুকে একজন বলেছেন, ‘আচ্ছা, ঢাকায় যেতে মানা, তা না হয় বুঝলাম, বিরোধী দলের ঢাকা চলো কর্মসূচি আর মহাসমাবেশে বাধা দেওয়া তার উদ্দেশ্য; কিন্তু ঢাকা থেকে লোকে বাইরে যাবে, তাতে বাধা দেওয়া হলো কেন? তার মানে, সরকারের নির্বুদ্ধিতা চরমে পৌঁছেছে।’ সরকারে বুদ্ধিমান লোকের অভাব নেই, এই সাধারণ প্রশ্নটির কোনো অসাধারণ উত্তর নিশ্চয়ই তাঁরা দিতে পারবেন।
সরকারের আতঙ্কিত হওয়ার কারণটা অনুমান করা যায়। ১৮ ডিসেম্বর ২০১১ বিরোধী জোট ঢাকায় ‘মুক্তিযোদ্ধা সংবর্ধনা’র আয়োজন করেছিল। ভোরবেলা থেকে দেখা গেল, বাসে আগুন দেওয়া শুরু হয়েছে। ওই সময় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সমালোচনা হয়েছিল যে তারা কেন আঁচ করতে পারেনি ওই মুক্তিযোদ্ধা সংবর্ধনা নিতান্তই নিরীহ সংবর্ধনা ছিল না, ছিল কোনো বৃহত্তর ফন্দির অংশ। এবার তাই গোয়েন্দা থেকে শুরু করে সরকারের মন্ত্রী, সরকারি দলের সম্পাদকেরা আগে থেকেই মহা তৎপর। ‘যেখানে যত আছিল জ্ঞানীগুণী/ দেশে বিদেশে আছিল যতেক যন্ত্রী, বসিল সবে চশমা চোখে আঁটি,/ ফুরায়ে গেল উনিশ পিপে নস্য।’ রাস্তাঘাট, নদনদী সব বন্ধ। ঢাকায় লোক ঢুকতে দেওয়া হবে না।
মানুষের কষ্ট হলো দুর্বিষহ। হঠাৎ দেখা গেল, রোববার ঢাকায় কোনো গণপরিবহন নেই—না মিনিবাস, না টেম্পো। সদরঘাটে লঞ্চ থেকে নেমে যাত্রীরা পড়েছেন লাল বাহিনীর উদ্যত লাঠির সামনে।
গতকাল সোমবার ঘর থেকে বেরিয়ে দেখি, রাস্তায় রিকশা পর্যন্ত কম। মাঝেমধ্যে অ্যাম্বুলেন্স ছুটছে সাইরেন বাজিয়ে আর চলেছে পুলিশের ট্রাক। ভয় পেয়ে গেলাম। কারফিউ নাকি? ‘এমনি সব গাধা, ধুলারে মারি করিয়া দিল কাদা।’
জনগণ চলতে-ফিরতে পারছে না, রাস্তাঘাট ফাঁকা। তাতে সুবিধা হলো বেগম খালেদা জিয়ার, ফাঁকা রাস্তা ধরে তিনি আধঘণ্টার মধ্যেই গুলশান থেকে নয়াপল্টনে পৌঁছাতে পারলেন। দেড় কোটি লোকের শহরে জনসভার লোকের অভাব হবে? নয়াপল্টন ছাপিয়ে জনসমাবেশ আশপাশের রাস্তা উপচে ছড়িয়ে পড়ল আরও দূরে। ‘করিতে ধুলা দূর, জগৎ হলো ধুলায় ভরপুর।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর পাত্রমিত্র অমাত্যদের ডেকে অভিনন্দন জানাতে পারেন, তাঁদের কল্যাণেই বিরোধী দলের ডাকা ১২ মার্চের কর্মসূচি আশাতীত সাফল্য লাভ করেছে। এর প্রচারে আওয়ামী নেতারা ও প্রশাসন যে অবদান রেখেছে, খালেদা জিয়া-মাওলানা নিজামীর উচিত তা চিরকাল স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখা। তাঁরা সারা দেশের মানুষের দৃষ্টি ওই মহাসমাবেশের দিকে আকৃষ্ট করেছেন, স্কুল-কলেজ, দোকানপাট বন্ধ করে দিয়ে সমাবেশে লোকসাধারণকে উপস্থিত হতে সাহায্য করেছেন। এই রকম সহযোগিতাই তো আমরা চাই। সরকারি দলে ও বিরোধী দলে সহযোগিতা।
আওয়ামী লীগের মতো আন্দোলন-অভিজ্ঞ দল আন্দোলনকে ভয় পায়? মানুষের সমাবেশকে ভয় পায়? চরম অজনপ্রিয় এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে তিন জোটের মহাসমাবেশের প্রতিটিতে কয়েক লাখ লোক হতো, তা দিয়ে বিএনপি-আওয়ামী লীগ-বাম-জামায়াত মিলে এরশাদ সরকারের পতন ঘটাতে পেরেছিল কি? আওয়ামী লীগ বা বিএনপি এর আগের মেয়াদে কোনো সরকারকে মেয়াদপূর্তির এক দিন আগে সরাতে পেরেছে? তাহলে?
মানুষকে ভয় কেন পাচ্ছে আওয়ামী লীগ? সত্য বটে, সরকার দ্রুত জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে, তা তো এ কারণে নয় যে, বিরোধী দলের প্রতি মানুষের সমর্থন বাড়ছে। তা এ কারণে যে, সরকার আর সরকারদলীয় লোকেরা এমন সব কাণ্ড ঘটাচ্ছেন, মানুষ তাঁদের ওপর বিরক্ত হতে বাধ্য। সরকারের সাংসদ যদি এলাকায় একই পদে নিয়োগের নাম করে এলাকার অনেক মানুষের কাছে টাকা গ্রহণ করে থাকেন, তাতে সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়বে? সরকার যখন বিচারের রায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত খুনিকে শুধু দলীয় পরিচয়ের কারণে ক্ষমা করে দেয়, তখন দেশের মানুষ খুশি হয়? অর্থনীতির অবস্থা খারাপ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো নয়, দলীয়করণ ব্যাপক, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কেউ রা-টি করে না। শেয়ারবাজারে ধসের জন্যে যাদের দায়ী করা হয়েছে, তাদের মাথার ওপর থেকে স্নেহের ছায়াটি সরানো হলো না।
মানুষ সরকারের ওপর বিরক্ত। তার মানে এই নয় যে তারা এর আগের বারের সরকারের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু দেশের মানুষের ভাগ্য তো টেনিস বলের মতো, তারা একবার এর কোর্টে, আরেকবার ওর কোর্টে যাচ্ছে ব্যাটের বাড়ি খেয়ে।
এই অবস্থায় মানুষ চুপচাপ নির্বাচনের দিনটার জন্য অপেক্ষা করে। ২০০১-২০০৬-এর বিএনপি-জামায়াতের দুঃশাসনের সময় তা-ই করেছিল মানুষ। সেটা বুঝেই ওই সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণাটিকে হাইজ্যাক করার চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছিল। শেষ রক্ষা তাতে হয়নি। এই সরকারও উচ্চ আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায় বেরোনোর আগেই সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করেছে।
মূল গোলযোগটা ওখানেই।
কাজেই ‘জুতা আবিষ্কার’ কবিতাতেই ফিরে যেতে হবে। ‘নিজের দুটি চরণ ঢাকো তবে, ধরণী আর ঢাকিতে নাহি হবে।’ সরকারকে সারা দেশের যানবাহন বন্ধ করতে হবে না, নিজের মন্ত্রী-এমপি-নেতা-ক্যাডারদের দুর্নীতি-বাড়াবাড়ি বন্ধ করতে হবে, মন্ত্রিসভার অদক্ষতা দূর করতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্নে বিরোধী দলের সঙ্গে একটা সমঝোতায় আসতেই হবে। এবং সেটা হতে পারে উচ্চ আদালতের রায়ের আলোকেই।
শেখ হাসিনার সরকার মনে করে, পত্রপত্রিকায় খবরও বেরিয়েছে, এই মর্মে অভিযোগও দায়ের করা হয়েছে যে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সঙ্গে সেই সময়ের সরকারের কেউ কেউ জড়িত। প্রশ্ন হলো, যারা শেখ হাসিনাকে প্রাণে মেরে ফেলতে চায়, তাদের সঙ্গে কোনো রকমের সমঝোতা আদৌ সম্ভব কি না? এইখানেই আসে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার বিষয়টি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আটকের পর হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল, তার পরও কি বঙ্গবন্ধু আলোচনায় বসেননি, নির্বাচনে যাননি?
যারা শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলা করেছে, তাদের বিচার করুন, শাস্তি দিন। তাদের মুখোশ উন্মোচন করুন। জনগণই তাদের বয়কট করবে। কিন্তু গণতান্ত্রিক রাজনীতি গণতান্ত্রিকভাবেই চলতে দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, পলিটিকস ইজ দি আর্ট অব কম্প্রোমাইজ।
১২ মার্চের বিরোধী দলের মহাসমাবেশকে আশাতীত সাফল্যদানের জন্য সরকারকে আরেকবার অভিনন্দন জানাই।
শেষ করি জুতা আবিষ্কারের চারটি লাইন দিয়ে:
‘কহিল রাজা, এত কি হবে সিধে
ভাবিয়া ম’ল সকল দেশ-শুদ্ধ,
মন্ত্রী কহে, বেটারে শূল বিঁধে
কারার মাঝে করিয়া রাখো রুদ্ধ।’
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
‘মানুষের কত জরুরি প্রয়োজন থাকে। কাউকে বা বিদেশে যেতে বিমান ধরতে হবে, কারও বা ব্যবসায়িক জরুরি কাজ আছে, কারও বা চিকিৎসা প্রয়োজন, তাঁরা ঢাকায় যাবেন।’ এই সব কথা আমি একবার লিখেছিলাম হরতালের সমালোচনা করে। এই কথা লিখতে হচ্ছে সরকার আর সরকারি দলের নেওয়া পদক্ষেপগুলোর সমালোচনায়। সরকারের কাজ দেশটা চালানো, দেশটাকে থমকে দেওয়া নয়। দু-তিন দিন ধরে ঢাকামুখী লঞ্চ বন্ধ করে দেওয়া হলো, বাস বন্ধ করে দেওয়া হলো, এ কী দুর্বুদ্ধি! দেশের ভেতরে স্বাধীনভাবে চলাচল করা তো নাগরিক মাত্রেরই মৌলিক অধিকার। আর যে সমাবেশ বেআইনি ঘোষিত হয়নি, সে সমাবেশে যোগদান করাও তো যেকোনো নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। সরকার, তার প্রশাসন, পুলিশ, রাজনৈতিক সংগঠন সেই সমাবেশগামী মানুষকে বাধা দিল কোন আইনের বলে?
ফেসবুকে একজন বলেছেন, ‘আচ্ছা, ঢাকায় যেতে মানা, তা না হয় বুঝলাম, বিরোধী দলের ঢাকা চলো কর্মসূচি আর মহাসমাবেশে বাধা দেওয়া তার উদ্দেশ্য; কিন্তু ঢাকা থেকে লোকে বাইরে যাবে, তাতে বাধা দেওয়া হলো কেন? তার মানে, সরকারের নির্বুদ্ধিতা চরমে পৌঁছেছে।’ সরকারে বুদ্ধিমান লোকের অভাব নেই, এই সাধারণ প্রশ্নটির কোনো অসাধারণ উত্তর নিশ্চয়ই তাঁরা দিতে পারবেন।
সরকারের আতঙ্কিত হওয়ার কারণটা অনুমান করা যায়। ১৮ ডিসেম্বর ২০১১ বিরোধী জোট ঢাকায় ‘মুক্তিযোদ্ধা সংবর্ধনা’র আয়োজন করেছিল। ভোরবেলা থেকে দেখা গেল, বাসে আগুন দেওয়া শুরু হয়েছে। ওই সময় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সমালোচনা হয়েছিল যে তারা কেন আঁচ করতে পারেনি ওই মুক্তিযোদ্ধা সংবর্ধনা নিতান্তই নিরীহ সংবর্ধনা ছিল না, ছিল কোনো বৃহত্তর ফন্দির অংশ। এবার তাই গোয়েন্দা থেকে শুরু করে সরকারের মন্ত্রী, সরকারি দলের সম্পাদকেরা আগে থেকেই মহা তৎপর। ‘যেখানে যত আছিল জ্ঞানীগুণী/ দেশে বিদেশে আছিল যতেক যন্ত্রী, বসিল সবে চশমা চোখে আঁটি,/ ফুরায়ে গেল উনিশ পিপে নস্য।’ রাস্তাঘাট, নদনদী সব বন্ধ। ঢাকায় লোক ঢুকতে দেওয়া হবে না।
মানুষের কষ্ট হলো দুর্বিষহ। হঠাৎ দেখা গেল, রোববার ঢাকায় কোনো গণপরিবহন নেই—না মিনিবাস, না টেম্পো। সদরঘাটে লঞ্চ থেকে নেমে যাত্রীরা পড়েছেন লাল বাহিনীর উদ্যত লাঠির সামনে।
গতকাল সোমবার ঘর থেকে বেরিয়ে দেখি, রাস্তায় রিকশা পর্যন্ত কম। মাঝেমধ্যে অ্যাম্বুলেন্স ছুটছে সাইরেন বাজিয়ে আর চলেছে পুলিশের ট্রাক। ভয় পেয়ে গেলাম। কারফিউ নাকি? ‘এমনি সব গাধা, ধুলারে মারি করিয়া দিল কাদা।’
জনগণ চলতে-ফিরতে পারছে না, রাস্তাঘাট ফাঁকা। তাতে সুবিধা হলো বেগম খালেদা জিয়ার, ফাঁকা রাস্তা ধরে তিনি আধঘণ্টার মধ্যেই গুলশান থেকে নয়াপল্টনে পৌঁছাতে পারলেন। দেড় কোটি লোকের শহরে জনসভার লোকের অভাব হবে? নয়াপল্টন ছাপিয়ে জনসমাবেশ আশপাশের রাস্তা উপচে ছড়িয়ে পড়ল আরও দূরে। ‘করিতে ধুলা দূর, জগৎ হলো ধুলায় ভরপুর।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর পাত্রমিত্র অমাত্যদের ডেকে অভিনন্দন জানাতে পারেন, তাঁদের কল্যাণেই বিরোধী দলের ডাকা ১২ মার্চের কর্মসূচি আশাতীত সাফল্য লাভ করেছে। এর প্রচারে আওয়ামী নেতারা ও প্রশাসন যে অবদান রেখেছে, খালেদা জিয়া-মাওলানা নিজামীর উচিত তা চিরকাল স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখা। তাঁরা সারা দেশের মানুষের দৃষ্টি ওই মহাসমাবেশের দিকে আকৃষ্ট করেছেন, স্কুল-কলেজ, দোকানপাট বন্ধ করে দিয়ে সমাবেশে লোকসাধারণকে উপস্থিত হতে সাহায্য করেছেন। এই রকম সহযোগিতাই তো আমরা চাই। সরকারি দলে ও বিরোধী দলে সহযোগিতা।
আওয়ামী লীগের মতো আন্দোলন-অভিজ্ঞ দল আন্দোলনকে ভয় পায়? মানুষের সমাবেশকে ভয় পায়? চরম অজনপ্রিয় এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে তিন জোটের মহাসমাবেশের প্রতিটিতে কয়েক লাখ লোক হতো, তা দিয়ে বিএনপি-আওয়ামী লীগ-বাম-জামায়াত মিলে এরশাদ সরকারের পতন ঘটাতে পেরেছিল কি? আওয়ামী লীগ বা বিএনপি এর আগের মেয়াদে কোনো সরকারকে মেয়াদপূর্তির এক দিন আগে সরাতে পেরেছে? তাহলে?
মানুষকে ভয় কেন পাচ্ছে আওয়ামী লীগ? সত্য বটে, সরকার দ্রুত জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে, তা তো এ কারণে নয় যে, বিরোধী দলের প্রতি মানুষের সমর্থন বাড়ছে। তা এ কারণে যে, সরকার আর সরকারদলীয় লোকেরা এমন সব কাণ্ড ঘটাচ্ছেন, মানুষ তাঁদের ওপর বিরক্ত হতে বাধ্য। সরকারের সাংসদ যদি এলাকায় একই পদে নিয়োগের নাম করে এলাকার অনেক মানুষের কাছে টাকা গ্রহণ করে থাকেন, তাতে সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়বে? সরকার যখন বিচারের রায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত খুনিকে শুধু দলীয় পরিচয়ের কারণে ক্ষমা করে দেয়, তখন দেশের মানুষ খুশি হয়? অর্থনীতির অবস্থা খারাপ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো নয়, দলীয়করণ ব্যাপক, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কেউ রা-টি করে না। শেয়ারবাজারে ধসের জন্যে যাদের দায়ী করা হয়েছে, তাদের মাথার ওপর থেকে স্নেহের ছায়াটি সরানো হলো না।
মানুষ সরকারের ওপর বিরক্ত। তার মানে এই নয় যে তারা এর আগের বারের সরকারের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু দেশের মানুষের ভাগ্য তো টেনিস বলের মতো, তারা একবার এর কোর্টে, আরেকবার ওর কোর্টে যাচ্ছে ব্যাটের বাড়ি খেয়ে।
এই অবস্থায় মানুষ চুপচাপ নির্বাচনের দিনটার জন্য অপেক্ষা করে। ২০০১-২০০৬-এর বিএনপি-জামায়াতের দুঃশাসনের সময় তা-ই করেছিল মানুষ। সেটা বুঝেই ওই সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণাটিকে হাইজ্যাক করার চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছিল। শেষ রক্ষা তাতে হয়নি। এই সরকারও উচ্চ আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায় বেরোনোর আগেই সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করেছে।
মূল গোলযোগটা ওখানেই।
কাজেই ‘জুতা আবিষ্কার’ কবিতাতেই ফিরে যেতে হবে। ‘নিজের দুটি চরণ ঢাকো তবে, ধরণী আর ঢাকিতে নাহি হবে।’ সরকারকে সারা দেশের যানবাহন বন্ধ করতে হবে না, নিজের মন্ত্রী-এমপি-নেতা-ক্যাডারদের দুর্নীতি-বাড়াবাড়ি বন্ধ করতে হবে, মন্ত্রিসভার অদক্ষতা দূর করতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্নে বিরোধী দলের সঙ্গে একটা সমঝোতায় আসতেই হবে। এবং সেটা হতে পারে উচ্চ আদালতের রায়ের আলোকেই।
শেখ হাসিনার সরকার মনে করে, পত্রপত্রিকায় খবরও বেরিয়েছে, এই মর্মে অভিযোগও দায়ের করা হয়েছে যে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সঙ্গে সেই সময়ের সরকারের কেউ কেউ জড়িত। প্রশ্ন হলো, যারা শেখ হাসিনাকে প্রাণে মেরে ফেলতে চায়, তাদের সঙ্গে কোনো রকমের সমঝোতা আদৌ সম্ভব কি না? এইখানেই আসে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার বিষয়টি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আটকের পর হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল, তার পরও কি বঙ্গবন্ধু আলোচনায় বসেননি, নির্বাচনে যাননি?
যারা শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলা করেছে, তাদের বিচার করুন, শাস্তি দিন। তাদের মুখোশ উন্মোচন করুন। জনগণই তাদের বয়কট করবে। কিন্তু গণতান্ত্রিক রাজনীতি গণতান্ত্রিকভাবেই চলতে দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, পলিটিকস ইজ দি আর্ট অব কম্প্রোমাইজ।
১২ মার্চের বিরোধী দলের মহাসমাবেশকে আশাতীত সাফল্যদানের জন্য সরকারকে আরেকবার অভিনন্দন জানাই।
শেষ করি জুতা আবিষ্কারের চারটি লাইন দিয়ে:
‘কহিল রাজা, এত কি হবে সিধে
ভাবিয়া ম’ল সকল দেশ-শুদ্ধ,
মন্ত্রী কহে, বেটারে শূল বিঁধে
কারার মাঝে করিয়া রাখো রুদ্ধ।’
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments