বাঘা তেঁতুল-সহ-অবস্থান by সৈয়দ আবুল মকসুদ
গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিগ্রি কলেজের একটি কক্ষে বেঞ্চে বসাকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে কথা-কাটাকাটি ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে পাটগাতী ও গিমাডাঙ্গা গ্রামের লোকজন রামদা, ঢাল-সড়কিসহ দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। ঘটনাটি দুই গ্রামের অস্তিত্বের লড়াইয়ে পরিণত হয়।
এ সময় পার্শ্ববর্তী শ্রীরামকান্দী গ্রামের লোকজনও অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পাটগাতী বাসস্ট্যান্ডে সংঘর্ষের মুখোমুখি হয়। উভয় পক্ষ বৃষ্টির মতো ইট নিক্ষেপ করে। বিভিন্ন দোকান, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ভাঙচুর ও লুটপাট হয়। সংঘর্ষে উভয় গ্রামের কমপক্ষে ৫০ জন আহত হয়। আহত ব্যক্তিদের টুঙ্গিপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং গোপালগঞ্জ ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
জাতীয় পত্রপত্রিকাগুলোর খবরে আরও বলা হয়েছে, টুঙ্গিপাড়া থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হয়ে চার রাউন্ড টিয়ার গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে। এতে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়। টিয়ার গ্যাসের শেল থেকে যে ধোঁয়া বের হয়, তাতে পরিস্থিতি ঘোলাটে হতেই পারে; কিন্তু টিয়ার গ্যাস না ছুড়লে পরিস্থিতি যে স্ফটিক কাচের মতো স্বচ্ছ থাকত, তার কি নিশ্চয়তা ছিল? পুলিশ না গেলে বাসস্ট্যান্ডে লাশ কয়টি পড়ে থাকত, তা অনুমান করা কঠিন নয়। তবে আমাদের সরকার খুবই দূরদর্শী। কলেজের কাছেই ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালও প্রতিষ্ঠা করেছে। প্রতিটি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গেই শ খানেক বেডের হাসপাতাল থাকা এখন সময়ের দাবি।
টুঙ্গিপাড়ার অধিবাসীদের মধ্যে জিয়াপন্থী বিশেষ আছে বলে মনে হয় না। ওই এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনাপন্থীদেরই বসবাস। ওখানে কলেজের দু-তিনজন ছাত্রের বেঞ্চিতে বসা নিয়ে যে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয়ে গেল এবং তাতে তিন গ্রামের কয়েক শ লোক সব ভালো ভালো চেতনা বাস্তবায়ন করল, তা আমাদের জাতীয় জীবনে কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।
বসাকে কেন্দ্র করে বিবাদ, বিতণ্ডা এবং তা থেকে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়া বাংলাদেশে নতুন নয়। খুব বড় বড় মানুষও যখন বেঞ্চিতে বসা নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন, তখন ওই দুই ছাত্রকেই বা দোষ দেব কেন? ২০০১ সালে এবং ২০০৮-এ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ঘরটিতে প্রথম সারির বেঞ্চিতে বসাকে কেন্দ্র করে যা ঘটে গেছে, তা থেকেই তো তারা শিক্ষা গ্রহণ করেছে।
বাংলাদেশে বসা নিয়ে গন্ডগোল শুধু শ্রেণীকক্ষে নয়, সংসদকক্ষেও নয়—সর্বত্র। বাসের মধ্যে বসা নিয়ে মারামারিতে কতজনের মাথা ফেটেছে, একপাটি দাঁত খোয়া গেছে, জয়নুল আবদিন ফারুকের মতো কাপড় জামা রাস্তার মধ্যে রেখে উদোম গতরে বাড়ি ফিরেছেন, তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। ডাক্তারের চেম্বারে বসা নিয়ে মারামারিতে নাক দিয়ে গল গল করে রক্তের স্রোত বইতে দেখেছি আমি নিজে। এসেছিলেন গ্যাস্ট্রিক আলসারের চিকিৎসা করাতে; কিন্তু সেখান থেকে যেতে হলো ইএনটির ডাক্তারের চেম্বারে।
গত আড়াই বছরে সভা-সেমিনার-আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রথম সারিতে বসা নিয়ে তুলকালাম ঘটেছে কত জায়গায়, পত্রিকার পাতায় তা কালো অক্ষরে লেখা আছে। মঞ্চে চেয়ার ১০টি; কিন্তু অনুষ্ঠানে বীর ও সর্বজনশ্রদ্ধেয় সংখ্যা ১৪-১৫ জন। তা ছাড়া এলাকার কোনো ‘নয়নমণি’কে হয়তো কোনো অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির চেয়ারখানি বরাদ্দ করা হয়নি, হঠাৎ একদল ঝটিকা বাহিনীর আবির্ভাব সেখানে। মুহূর্তে সভাকক্ষটি পরিণত হয় সিডরবিধ্বস্ত উপকূল এলাকায়।
অন্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান বা খাপ খাইয়ে নেওয়ার মনোভাব একটি সুস্থ-সুন্দর সমাজ গঠনের প্রাথমিক শর্ত। যেখানে একই দলের দুজন মানুষ সহ-অবস্থান করতে পারে না, সেখানে দুটি বা তিনটি বা চারটি দল কীভাবে সহ-অবস্থান করবে?
সহ-অবস্থান ছাড়া গণতন্ত্র হয় না। অতি উত্তম শাসন হতে পারে, খলিফা হারুনুর রশীদের মতো শাসন হতে পারে, অশোকের মতো সরকার হতে পারে—কিন্তু গণতান্ত্রিক শাসন হয় না। আমাদের অভিধান থেকে সহ-অবস্থান শব্দটি সংসদে আইন করে নিষিদ্ধ করার সময় এসেছে।
রোববার বিভিন্ন কাগজে দেখলাম, ‘শনিবার টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার পালিমায় বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীকে সমাবেশ করতে দেয়নি আওয়ামী লীগ। সমাবেশে দলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি কাদের সিদ্দিকী প্রধান অতিথি থাকবেন বলে ঘোষণা দিয়ে আগের দিন এলাকায় মাইকিং করা হয়। হঠাৎ শনিবার সকালে আওয়ামী লীগ মাইকিং করে একই স্থানে ও একই সময়ে পাল্টা সমাবেশ করার। যথাসময়ে উভয় পক্ষের নেতা-কর্মীরা সভাস্থলে এলে বিপুলসংখ্যক পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের নেতা-কর্মীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। তখন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ওই স্থানে সমাবেশ করেন।’ [ইত্তেফাক]
পক্বকেশ পণ্ডিত থেকে তুখোড় সাংস্কৃতিক নেতারা প্রতিদিন বলছেন, আজ ‘মুক্তিযুদ্ধের সরকার’ ক্ষমতায়। কাদের সিদ্দিকীর চেয়ে বড় মুক্তিযোদ্ধা বর্তমান মন্ত্রিসভায় কে আছেন, আমার জানা নেই। বঙ্গবন্ধুকে তাঁর চেয়ে বেশি ভালোবাসেন ও ভক্তি করেন, এমন মানুষ বাংলাদেশে ১০ জনের বেশি আছেন কি না, সন্দেহ। তাঁকে সভা করতে দেওয়া হয় না।
গণতন্ত্রের যাঁরা মানসসৈনিক এবং ভালো ভালো চেতনার যাঁরা ঝাণ্ডাবরদার, তাঁদের উচিত সহ-অবস্থান শব্দটিকে সম্মান করা।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
জাতীয় পত্রপত্রিকাগুলোর খবরে আরও বলা হয়েছে, টুঙ্গিপাড়া থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হয়ে চার রাউন্ড টিয়ার গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে। এতে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়। টিয়ার গ্যাসের শেল থেকে যে ধোঁয়া বের হয়, তাতে পরিস্থিতি ঘোলাটে হতেই পারে; কিন্তু টিয়ার গ্যাস না ছুড়লে পরিস্থিতি যে স্ফটিক কাচের মতো স্বচ্ছ থাকত, তার কি নিশ্চয়তা ছিল? পুলিশ না গেলে বাসস্ট্যান্ডে লাশ কয়টি পড়ে থাকত, তা অনুমান করা কঠিন নয়। তবে আমাদের সরকার খুবই দূরদর্শী। কলেজের কাছেই ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালও প্রতিষ্ঠা করেছে। প্রতিটি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গেই শ খানেক বেডের হাসপাতাল থাকা এখন সময়ের দাবি।
টুঙ্গিপাড়ার অধিবাসীদের মধ্যে জিয়াপন্থী বিশেষ আছে বলে মনে হয় না। ওই এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনাপন্থীদেরই বসবাস। ওখানে কলেজের দু-তিনজন ছাত্রের বেঞ্চিতে বসা নিয়ে যে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয়ে গেল এবং তাতে তিন গ্রামের কয়েক শ লোক সব ভালো ভালো চেতনা বাস্তবায়ন করল, তা আমাদের জাতীয় জীবনে কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।
বসাকে কেন্দ্র করে বিবাদ, বিতণ্ডা এবং তা থেকে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়া বাংলাদেশে নতুন নয়। খুব বড় বড় মানুষও যখন বেঞ্চিতে বসা নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন, তখন ওই দুই ছাত্রকেই বা দোষ দেব কেন? ২০০১ সালে এবং ২০০৮-এ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ঘরটিতে প্রথম সারির বেঞ্চিতে বসাকে কেন্দ্র করে যা ঘটে গেছে, তা থেকেই তো তারা শিক্ষা গ্রহণ করেছে।
বাংলাদেশে বসা নিয়ে গন্ডগোল শুধু শ্রেণীকক্ষে নয়, সংসদকক্ষেও নয়—সর্বত্র। বাসের মধ্যে বসা নিয়ে মারামারিতে কতজনের মাথা ফেটেছে, একপাটি দাঁত খোয়া গেছে, জয়নুল আবদিন ফারুকের মতো কাপড় জামা রাস্তার মধ্যে রেখে উদোম গতরে বাড়ি ফিরেছেন, তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। ডাক্তারের চেম্বারে বসা নিয়ে মারামারিতে নাক দিয়ে গল গল করে রক্তের স্রোত বইতে দেখেছি আমি নিজে। এসেছিলেন গ্যাস্ট্রিক আলসারের চিকিৎসা করাতে; কিন্তু সেখান থেকে যেতে হলো ইএনটির ডাক্তারের চেম্বারে।
গত আড়াই বছরে সভা-সেমিনার-আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রথম সারিতে বসা নিয়ে তুলকালাম ঘটেছে কত জায়গায়, পত্রিকার পাতায় তা কালো অক্ষরে লেখা আছে। মঞ্চে চেয়ার ১০টি; কিন্তু অনুষ্ঠানে বীর ও সর্বজনশ্রদ্ধেয় সংখ্যা ১৪-১৫ জন। তা ছাড়া এলাকার কোনো ‘নয়নমণি’কে হয়তো কোনো অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির চেয়ারখানি বরাদ্দ করা হয়নি, হঠাৎ একদল ঝটিকা বাহিনীর আবির্ভাব সেখানে। মুহূর্তে সভাকক্ষটি পরিণত হয় সিডরবিধ্বস্ত উপকূল এলাকায়।
অন্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান বা খাপ খাইয়ে নেওয়ার মনোভাব একটি সুস্থ-সুন্দর সমাজ গঠনের প্রাথমিক শর্ত। যেখানে একই দলের দুজন মানুষ সহ-অবস্থান করতে পারে না, সেখানে দুটি বা তিনটি বা চারটি দল কীভাবে সহ-অবস্থান করবে?
সহ-অবস্থান ছাড়া গণতন্ত্র হয় না। অতি উত্তম শাসন হতে পারে, খলিফা হারুনুর রশীদের মতো শাসন হতে পারে, অশোকের মতো সরকার হতে পারে—কিন্তু গণতান্ত্রিক শাসন হয় না। আমাদের অভিধান থেকে সহ-অবস্থান শব্দটি সংসদে আইন করে নিষিদ্ধ করার সময় এসেছে।
রোববার বিভিন্ন কাগজে দেখলাম, ‘শনিবার টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার পালিমায় বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীকে সমাবেশ করতে দেয়নি আওয়ামী লীগ। সমাবেশে দলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি কাদের সিদ্দিকী প্রধান অতিথি থাকবেন বলে ঘোষণা দিয়ে আগের দিন এলাকায় মাইকিং করা হয়। হঠাৎ শনিবার সকালে আওয়ামী লীগ মাইকিং করে একই স্থানে ও একই সময়ে পাল্টা সমাবেশ করার। যথাসময়ে উভয় পক্ষের নেতা-কর্মীরা সভাস্থলে এলে বিপুলসংখ্যক পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের নেতা-কর্মীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। তখন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ওই স্থানে সমাবেশ করেন।’ [ইত্তেফাক]
পক্বকেশ পণ্ডিত থেকে তুখোড় সাংস্কৃতিক নেতারা প্রতিদিন বলছেন, আজ ‘মুক্তিযুদ্ধের সরকার’ ক্ষমতায়। কাদের সিদ্দিকীর চেয়ে বড় মুক্তিযোদ্ধা বর্তমান মন্ত্রিসভায় কে আছেন, আমার জানা নেই। বঙ্গবন্ধুকে তাঁর চেয়ে বেশি ভালোবাসেন ও ভক্তি করেন, এমন মানুষ বাংলাদেশে ১০ জনের বেশি আছেন কি না, সন্দেহ। তাঁকে সভা করতে দেওয়া হয় না।
গণতন্ত্রের যাঁরা মানসসৈনিক এবং ভালো ভালো চেতনার যাঁরা ঝাণ্ডাবরদার, তাঁদের উচিত সহ-অবস্থান শব্দটিকে সম্মান করা।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments