ইতিউতি-পানি রে পানি by আতাউস সামাদ
বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে ঝড়ঝাপ্টা কিছু তো হবেই। তবু প্রার্থনা থাকে, ঘূর্ণিঝড় বা টর্নেডো অথবা শিলাবৃষ্টি যেন না হয় এবং অঝরধারায় যেন বৃষ্টি না নামে। ঘূর্ণিঝড় হলে ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়, প্রাণহানিও ঘটে। আর তীব্র ঘূর্ণিবাত্যা, যা টর্নেডো নামেও পরিচিত, আঘাত হানলে গ্রামের পর গ্রাম ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।
অনেক মানুষ আর গবাদিপশু মারা যায়। ক্ষেতের ফসল মাটির সঙ্গে মিশে যায়। শিলাবৃষ্টিতে তো বটেই, মুষলধারে বৃষ্টি হলেও ক্ষেতের ধান নষ্ট হয়। সে জন্য কালবৈশাখীর ঘোর কালো সাজ দেখে বিস্ময় জাগলেও আমরা মনে মনে বলি, দমকা বাতাস যেন এ মেঘ উড়িয়ে নিয়ে যায়। এ থেকে বজ্রপাত হোক, কিছুটা বৃষ্টি হোক; কিন্তু এর বেশি আর কিছু যেন না হয়। খাদ্যের এই দুর্মূল্যের দিনে ঝড়-শিল-বর্ষণে যদি ধান নষ্ট হয় তাহলে আবার এক দফা চালের মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কা খেতে হবে। তবু কিছুটা স্বার্থপরের মতোই গত সপ্তাহে পর পর দু'তিন দিন যে বৃষ্টি হলো তাতে স্বস্তি অনুভব করেছিলাম। প্রথমত, গ্রীষ্মের ভাপটা কিছুক্ষণের জন্য কমেছিল বিধায়, আর দ্বিতীয়ত, এ কথা ভেবে যে আর কয়েক সপ্তাহ পরে বর্ষা আসা পর্যন্ত যদি মাঝেমধ্যে এ রকম বৃষ্টি হয় তাহলে ঢাকায় পানি সরবরাহের সংকট হয়তোবা কমবে। ওয়াসার গভীর নলকূপগুলো থেকে যদি ঠিকমতো পানি ওঠে তাহলে রাজধানীতে কলের পানি মোটামুটি নিয়মিতভাবে আসে বেশির ভাগ এলাকায়।
সম্প্রতি বেসরকারি চ্যানেল এনটিভিতে ঢাকায় সুপেয় পানি সরবরাহ নিয়ে একটি ধারাবাহিক রিপোর্টের শেষ পর্বে প্রচারিত একটা তথ্য শুনে খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েছে। ওই তথ্যের সূত্র ঢাকা ওয়াসার একজন কর্মকর্তা। তিনি এনটিভিকে বলেছেন, এ শহরের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর এখন ৩৫০ ফুট নিচে নেমে গেছে। আর কিছু নামলে মাটির তলা থেকে পানি তোলা কঠিন হয়ে পড়বে। ওদিকে ঢাকা শহরের চারধার দিয়ে যে তিনটি নদী বইছে, সেগুলোর পানিতে অবিরাম বিপুল পরিমাণ কলকারখানার বর্জ্য এসে পড়ায় সেই দূষিত পানি পরিশোধন করার সীমা ছাড়িয়ে গেছে।
রিপোর্টটিতে আরো বলা হয়েছে, এ অবস্থায় ভূগর্ভস্থ পানি এক কোটির বেশি ঢাকাবাসীর ভরসা হলেও সেই পানির স্তর ওপর দিকে না ওঠার একটা কারণ হলো, পর্যাপ্ত পরিমাণে বৃষ্টির পানি ঢাকার মাটি চুইয়ে নিচে যাচ্ছে না। আবার ঢাকার নদীগুলোতেও পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ায় সেগুলো থেকেও অল্পই পানি যাচ্ছে মাটির নিচে। এও জানানো হলো, মাটি আর ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের মাঝখানে এক বিশাল শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে এবং শক্তিশালী ভূমিকম্প এসে যদি ঢাকা শহরকে জোরে ধাক্কা দেয় তবে এই শূন্যতার ফলে এখানকার অট্টালিকাগুলো দেবে যাবে ও ধসে পড়বে।
ওয়াসার কর্মকর্তা এনটিভিকে বলেছেন, রাজধানীতে অসংখ্য ইমারত তৈরি হওয়ায় এবং রাস্তাঘাট পাকা হয়ে যাওয়ায় ঢাকা শহরের মাটি কংক্রিটের নিচে ঢাকা পড়েছে এবং সেই কংক্রিট ভেদ করে বৃষ্টির পানি নিচে যেতে পারছে না। তিনি বলেছেন, ঢাকা ওয়াসা গবেষণা করে দেখছে, মাটিতে গভীর ছেঁদা (boring) করে তার ভেতর দিয়ে বৃষ্টির পানি মাটির নিচে প্রবাহিত করা যায় কি না। শুনে মনে হয় কৌশলটা এমন, গভীর নলকূপ দিয়ে অনেক নিচ থেকে পানি তোলা হয় আর এ ক্ষেত্রে হবে তার বিপরীত_কয়েকটা তলাহীন কূপ দিয়ে বৃষ্টির পানি ভূগর্ভে পাঠানো হবে। গবেষণার ফল জানার জন্য আমরা নিশ্চয়ই গভীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করব। তবে ও-রকম 'বোর' বা বড় ব্যাসের গভীর ছিদ্র তৈরি করা গেলেও একই সঙ্গে আরো দুটি বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে হবে। প্রথমত, পর্যাপ্ত পরিমাণ বৃষ্টির পানি এ বিশেষ ছিদ্রপথগুলোর কাছে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, ঢাকায় যাতে বৃষ্টির পরিমাণ বাড়ে তাও দেখতে হবে। কারণ এই শহরে সারা বছরের বৃষ্টিপাত নাকি আগের চেয়ে কমেছে। বৃষ্টির পানি চুইয়ে নিচে যাওয়ার জন্য মাটি উন্মুক্ত করারও ব্যবস্থা করা যায়। ঢাকায় যেসব নতুন বহুতল ভবন হয়েছে সেগুলোর চৌহদ্দির মধ্যে পুরো জমিই ইট বা কংক্রিট দিয়ে পাকা করে ফেলা হয়েছে। আমাদের জানা মতে, রাজউক বাড়িঘরের জন্য যেসব নকশা অনুমোদন করে তাতে কিছুটা খোলা জায়গা দেখানো হয়। এখন সরকার সব ইমারত মালিককে তাঁদের বাড়ির সীমানায় ইট বা কংক্রিটের আচ্ছাদন ভেঙে দুই-তিন হাত প্রস্থ করে মাটি খোলা রাখতে বাধ্য করলেই হয়।
এদিকে পরিবেশপ্রতিমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ সম্প্রতি বলেছেন, যমুনা থেকে পানি প্রবাহিত করে ধলেশ্বরী নদীতে পানির প্রাপ্যতা বাড়িয়ে আবার সেখান থেকে বুড়িগঙ্গায় কিছু পানি এনে ঢাকায় পানি সরবরাহ করার জন্য একটা বড় প্রকল্প হাতে নিতে যাচ্ছে সরকার। এর আগে কেরানীগঞ্জের মধ্য দিয়ে খাল কেটে ধলেশ্বরী থেকে বুড়িগঙ্গায় পানি আনার একটা প্রস্তাব যে শুনেছিলাম তা আমার স্পষ্ট মনে পড়ছে। এও মনে পড়ছে, ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর সপরিবারে ঢাকা থেকে পালানোর সময় বুড়িগঙ্গার তীরে সদরঘাটে নৌকায় উঠে অন্যদিকে একটি খাল বেয়ে ধলেশ্বরীতে পেঁৗছেছিলাম। হতে পারে ওটাকে সংস্কার বা বড় করার কথা হচ্ছিল।
ড. হাছান মাহমুদ যমুনা থেকে ধলেশ্বরী হয়ে বুড়িগঙ্গায় পানি আনার প্রস্তাব বা প্রকল্পের কথা বলায় আমার মনে হচ্ছে, ভারতের দেশজুড়ে নদী সংযোগ প্রকল্পের মতো (ন্যাশনাল ওয়াটার গ্রিড) আমাদেরও অবিলম্বে নিজস্ব নদী সংযোগের কাজে ব্রতী হওয়া খুবই প্রয়োজন। এ ধরনের প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা যদি আমাদের মৃতপ্রায় বা মরে যাওয়া অন্তত কিছু নদী বাঁচিয়ে তুলতে পারি তাহলে দেশের বিরাট উপকার হবে। প্রথমত, নদী তীরবর্তী লোকালয় ও ফসলের মাঠ পানি পাবে; দ্বিতীয়ত, এই পানি দেশের দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হলে সমুদ্রের লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ কমবে। তদুপরি আমরা এ রকম প্রকল্পের কাজ শুরু করার আগেই যদি ভারত পূর্বে ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে পানি প্রত্যাহার করে পশ্চিম দিকের নদীগুলোতে সরবরাহ করা শুরু করে তাহলে পদ্মার মতো ব্রহ্মপুত্রেও আমরা পানি পাব না। স্মরণ করা যেতে পারে, ভারত আসাম থেকে পশ্চিমবঙ্গ পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র-গঙ্গা সংযোগ খাল বানাতে চেয়েছিল বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে। আমরা তাতে রাজি হইনি।
ভারতের নদী সংযোগ নেটওয়ার্ক প্রকল্প আনুষ্ঠানিকভাবে দিলি্লতে প্রকাশ করেন ১৯৭২ সালে সে দেশের সেচমন্ত্রী ড. কে এল রাও। আমি সেই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলাম। দেয়ালে টাঙ্গানো ভারতের বিশাল মানচিত্রে মোটা লাল রেখা দিয়ে সংযোগ খালগুলো দেখানো ছিল। এরই মধ্যে একটি লাল রেখা আসাম থেকে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে চলে গিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে ফারাক্কা বাঁধের উজানে। অর্থাৎ ওই সংযোগ খালের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকত ভারতের মুঠোয়। আমার প্রশ্নের উত্তরে সেদিন ড. কে এল রাও বলেছিলেন, ব্রহ্মপুত্র-গঙ্গা সংযোগ খালের বিষয়ে তখনো বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা হয়নি। তিনি বলেছিলেন, এটা তো এখনো একটা ধারণা মাত্র। ওই অজুহাতে তখন খবরটা না প্রচার করতেও বলেছিলেন; কিন্তু আমার পক্ষে ওই বিষয়ে সেলফ-সেন্সরশিপ করা একেবারেই অসম্ভব ছিল। বাংলাদেশের সংবাদ সংস্থা বাসস (আমি তখন এ প্রতিষ্ঠানের দিলি্লস্থ বিশেষ সংবাদদাতা) মারফত খবরটি প্রচারিত হওয়ার পর আমাদের এখানে যথেষ্ট উদ্বেগের সৃষ্টি হয়। পরে এ নিয়ে যখন বাংলাদেশ ও ভারত বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে তখন একদিন আমি ভারতের সেচ মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব শ্রী সি এস প্যাটেলের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেয়ে বলেছিলাম, প্রস্তাবিত ব্রহ্মপুত্র-গঙ্গা সংযোগ খালের নিয়ন্ত্রণ আপনাদের হাতে রাখছেন, যা আমরা মানতে পারি না; অথচ আপনারা গঙ্গা থেকে আমাদের পানির হিস্যা বাড়াবেন না। এখন আমরা নিজেরাই যদি বাংলাদেশের ভেতরে এ রকম একটা খাল করে ব্রহ্মপুত্র ও পদ্মাকে যোগ করি তাহলে? উত্তরে শ্রী প্যাটেল খুব দৃঢ়ভাবে বলেছিলেন, আমরা তাতে আপত্তি জানাব। আমার পাল্টা প্রশ্ন ছিল, 'আমাদের খাল হবে বাংলাদেশের ভেতরে। আপনারা আপত্তি দেবেন কিভাবে? তিনি বললেন, আপনারা ওই প্রকল্প করে ফেললে ব্রহ্মপুত্রের পানির ওপর আপনাদের অধিকার (prescriptive right) জন্মে যাবে আর তখন আমরা ব্রহ্মপুত্রের পানি অন্যদিকে প্রবাহিত করতে পারব না। তাই আমরা এখনই বাধা দেব। এ কথোপকথনের ভিত্তিতে আমি রিপোর্ট লিখেছিলাম এবং পরে দিলি্ল সফরে আসা বাংলাদেশি পানি বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলাম। তাঁরা বলেছিলেন, যেহেতু এক নদীর অববাহিকা থেকে অন্য নদীর অববাহিকায় পানি প্রবাহিত করার তাঁরা বিরোধী তাই আমি আমাদের নিজেদের যে ব্যবস্থা করার কথা বলছি তাঁরা এটারও বিরোধী। তা ছাড়া আমার প্রস্তাব বাস্তবসম্মত নাও হতে পারে। কারণ সেই তো নদীর মতো একটা খাল কাটার কথা উঠছে, যা ভারতও চাইছে। আমার পাল্টা যুক্তি ছিল বাংলাদেশের ভেতরে ব্রহ্মপুত্র থেকে পদ্মার মধ্যবর্তী অঞ্চলে বেশ কয়েকটি নদী প্রবহমান, এখন আমরা যদি স্বল্পদৈর্ঘ্যের একেকটা খাল দিয়ে একটার সঙ্গে আরেকটা নদী যোগ করি তাহলেও তো ব্রহ্মপুত্রের কিছু পানি পদ্মায় নিতে পারব। বলাবাহুল্য, আমার এসব কথা তখন কেউ আমলে নেননি। যতদূর জানি কেউ কোনো পাত্তাই দেননি। কিন্তু এখন পরিবেশপ্রতিমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের কথা শুনে আমার আশা জন্মাচ্ছে, শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ বোধ হয় নিজস্ব নদী সংযোগ প্রকল্পের পথে পা বাড়াবে। কারণ আর তো কোনো গতি নেই।
মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী একবার বলেছিলেন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও বোধ হয় বলেছিলেন, বাংলাদেশকে খালে-বিলে বর্ষার পানি ধরে রাখতে হবে। আমি মনে করি, আমাদের উচিত অবিলম্বে এ বিষয়ে কাজ শুরু করা। দেশে বহু ভরাট হয়ে আসা খাল আছে, পুনঃখনন করে যেগুলোর গভীরতা বাড়ানো যায়। সেই সংস্কার করা খালগুলোতে স্লুইসগেট বসিয়ে বর্ষার শেষ দিকে অর্থাৎ ভাদ্র মাসে, যে পানি থাকবে তা ধরে রাখা যায়। এই পানি শীতে এবং গ্রীষ্মের শুরুতে সেচের জন্য ব্যবহার করা সম্ভব হবে। তা ছাড়া সংস্কার করা খাল দিয়ে এবং নদী পুনঃখনন করলে সেগুলোর মাধ্যমেও বর্ষায় চুইয়ে ভূগর্ভে পানি যাবে এবং এতে সারা দেশে ভূগর্ভস্থ জলাধারে পানির পরিমাণ বাড়বে। এই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াকে 'ন্যাচারাল রি-চার্জিং অব আন্ডারগ্রাউন্ড অ্যাকুইফার্স' (Natural recharging of underground aquifers) বলা হয়। আগের কথায় কিছুটা ফিরে এসে বলি, ঢাকা শহরের নিচে যে ভূগর্ভস্থ পানি তা হয়তো রাজধানীর সীমানার বাইরেও বিস্তৃত। তাই শুধু ঢাকার বৃষ্টির পানিই নয়, আশপাশের পানির প্রবাহ অর্থাৎ নদী ও খাল থেকে পানি রিচার্জ করার সম্ভাবনার কথাও মনে রাখতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সম্প্রতি বেসরকারি চ্যানেল এনটিভিতে ঢাকায় সুপেয় পানি সরবরাহ নিয়ে একটি ধারাবাহিক রিপোর্টের শেষ পর্বে প্রচারিত একটা তথ্য শুনে খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েছে। ওই তথ্যের সূত্র ঢাকা ওয়াসার একজন কর্মকর্তা। তিনি এনটিভিকে বলেছেন, এ শহরের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর এখন ৩৫০ ফুট নিচে নেমে গেছে। আর কিছু নামলে মাটির তলা থেকে পানি তোলা কঠিন হয়ে পড়বে। ওদিকে ঢাকা শহরের চারধার দিয়ে যে তিনটি নদী বইছে, সেগুলোর পানিতে অবিরাম বিপুল পরিমাণ কলকারখানার বর্জ্য এসে পড়ায় সেই দূষিত পানি পরিশোধন করার সীমা ছাড়িয়ে গেছে।
রিপোর্টটিতে আরো বলা হয়েছে, এ অবস্থায় ভূগর্ভস্থ পানি এক কোটির বেশি ঢাকাবাসীর ভরসা হলেও সেই পানির স্তর ওপর দিকে না ওঠার একটা কারণ হলো, পর্যাপ্ত পরিমাণে বৃষ্টির পানি ঢাকার মাটি চুইয়ে নিচে যাচ্ছে না। আবার ঢাকার নদীগুলোতেও পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ায় সেগুলো থেকেও অল্পই পানি যাচ্ছে মাটির নিচে। এও জানানো হলো, মাটি আর ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের মাঝখানে এক বিশাল শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে এবং শক্তিশালী ভূমিকম্প এসে যদি ঢাকা শহরকে জোরে ধাক্কা দেয় তবে এই শূন্যতার ফলে এখানকার অট্টালিকাগুলো দেবে যাবে ও ধসে পড়বে।
ওয়াসার কর্মকর্তা এনটিভিকে বলেছেন, রাজধানীতে অসংখ্য ইমারত তৈরি হওয়ায় এবং রাস্তাঘাট পাকা হয়ে যাওয়ায় ঢাকা শহরের মাটি কংক্রিটের নিচে ঢাকা পড়েছে এবং সেই কংক্রিট ভেদ করে বৃষ্টির পানি নিচে যেতে পারছে না। তিনি বলেছেন, ঢাকা ওয়াসা গবেষণা করে দেখছে, মাটিতে গভীর ছেঁদা (boring) করে তার ভেতর দিয়ে বৃষ্টির পানি মাটির নিচে প্রবাহিত করা যায় কি না। শুনে মনে হয় কৌশলটা এমন, গভীর নলকূপ দিয়ে অনেক নিচ থেকে পানি তোলা হয় আর এ ক্ষেত্রে হবে তার বিপরীত_কয়েকটা তলাহীন কূপ দিয়ে বৃষ্টির পানি ভূগর্ভে পাঠানো হবে। গবেষণার ফল জানার জন্য আমরা নিশ্চয়ই গভীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করব। তবে ও-রকম 'বোর' বা বড় ব্যাসের গভীর ছিদ্র তৈরি করা গেলেও একই সঙ্গে আরো দুটি বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে হবে। প্রথমত, পর্যাপ্ত পরিমাণ বৃষ্টির পানি এ বিশেষ ছিদ্রপথগুলোর কাছে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, ঢাকায় যাতে বৃষ্টির পরিমাণ বাড়ে তাও দেখতে হবে। কারণ এই শহরে সারা বছরের বৃষ্টিপাত নাকি আগের চেয়ে কমেছে। বৃষ্টির পানি চুইয়ে নিচে যাওয়ার জন্য মাটি উন্মুক্ত করারও ব্যবস্থা করা যায়। ঢাকায় যেসব নতুন বহুতল ভবন হয়েছে সেগুলোর চৌহদ্দির মধ্যে পুরো জমিই ইট বা কংক্রিট দিয়ে পাকা করে ফেলা হয়েছে। আমাদের জানা মতে, রাজউক বাড়িঘরের জন্য যেসব নকশা অনুমোদন করে তাতে কিছুটা খোলা জায়গা দেখানো হয়। এখন সরকার সব ইমারত মালিককে তাঁদের বাড়ির সীমানায় ইট বা কংক্রিটের আচ্ছাদন ভেঙে দুই-তিন হাত প্রস্থ করে মাটি খোলা রাখতে বাধ্য করলেই হয়।
এদিকে পরিবেশপ্রতিমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ সম্প্রতি বলেছেন, যমুনা থেকে পানি প্রবাহিত করে ধলেশ্বরী নদীতে পানির প্রাপ্যতা বাড়িয়ে আবার সেখান থেকে বুড়িগঙ্গায় কিছু পানি এনে ঢাকায় পানি সরবরাহ করার জন্য একটা বড় প্রকল্প হাতে নিতে যাচ্ছে সরকার। এর আগে কেরানীগঞ্জের মধ্য দিয়ে খাল কেটে ধলেশ্বরী থেকে বুড়িগঙ্গায় পানি আনার একটা প্রস্তাব যে শুনেছিলাম তা আমার স্পষ্ট মনে পড়ছে। এও মনে পড়ছে, ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর সপরিবারে ঢাকা থেকে পালানোর সময় বুড়িগঙ্গার তীরে সদরঘাটে নৌকায় উঠে অন্যদিকে একটি খাল বেয়ে ধলেশ্বরীতে পেঁৗছেছিলাম। হতে পারে ওটাকে সংস্কার বা বড় করার কথা হচ্ছিল।
ড. হাছান মাহমুদ যমুনা থেকে ধলেশ্বরী হয়ে বুড়িগঙ্গায় পানি আনার প্রস্তাব বা প্রকল্পের কথা বলায় আমার মনে হচ্ছে, ভারতের দেশজুড়ে নদী সংযোগ প্রকল্পের মতো (ন্যাশনাল ওয়াটার গ্রিড) আমাদেরও অবিলম্বে নিজস্ব নদী সংযোগের কাজে ব্রতী হওয়া খুবই প্রয়োজন। এ ধরনের প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা যদি আমাদের মৃতপ্রায় বা মরে যাওয়া অন্তত কিছু নদী বাঁচিয়ে তুলতে পারি তাহলে দেশের বিরাট উপকার হবে। প্রথমত, নদী তীরবর্তী লোকালয় ও ফসলের মাঠ পানি পাবে; দ্বিতীয়ত, এই পানি দেশের দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হলে সমুদ্রের লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ কমবে। তদুপরি আমরা এ রকম প্রকল্পের কাজ শুরু করার আগেই যদি ভারত পূর্বে ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে পানি প্রত্যাহার করে পশ্চিম দিকের নদীগুলোতে সরবরাহ করা শুরু করে তাহলে পদ্মার মতো ব্রহ্মপুত্রেও আমরা পানি পাব না। স্মরণ করা যেতে পারে, ভারত আসাম থেকে পশ্চিমবঙ্গ পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র-গঙ্গা সংযোগ খাল বানাতে চেয়েছিল বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে। আমরা তাতে রাজি হইনি।
ভারতের নদী সংযোগ নেটওয়ার্ক প্রকল্প আনুষ্ঠানিকভাবে দিলি্লতে প্রকাশ করেন ১৯৭২ সালে সে দেশের সেচমন্ত্রী ড. কে এল রাও। আমি সেই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলাম। দেয়ালে টাঙ্গানো ভারতের বিশাল মানচিত্রে মোটা লাল রেখা দিয়ে সংযোগ খালগুলো দেখানো ছিল। এরই মধ্যে একটি লাল রেখা আসাম থেকে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে চলে গিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে ফারাক্কা বাঁধের উজানে। অর্থাৎ ওই সংযোগ খালের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকত ভারতের মুঠোয়। আমার প্রশ্নের উত্তরে সেদিন ড. কে এল রাও বলেছিলেন, ব্রহ্মপুত্র-গঙ্গা সংযোগ খালের বিষয়ে তখনো বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা হয়নি। তিনি বলেছিলেন, এটা তো এখনো একটা ধারণা মাত্র। ওই অজুহাতে তখন খবরটা না প্রচার করতেও বলেছিলেন; কিন্তু আমার পক্ষে ওই বিষয়ে সেলফ-সেন্সরশিপ করা একেবারেই অসম্ভব ছিল। বাংলাদেশের সংবাদ সংস্থা বাসস (আমি তখন এ প্রতিষ্ঠানের দিলি্লস্থ বিশেষ সংবাদদাতা) মারফত খবরটি প্রচারিত হওয়ার পর আমাদের এখানে যথেষ্ট উদ্বেগের সৃষ্টি হয়। পরে এ নিয়ে যখন বাংলাদেশ ও ভারত বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে তখন একদিন আমি ভারতের সেচ মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব শ্রী সি এস প্যাটেলের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেয়ে বলেছিলাম, প্রস্তাবিত ব্রহ্মপুত্র-গঙ্গা সংযোগ খালের নিয়ন্ত্রণ আপনাদের হাতে রাখছেন, যা আমরা মানতে পারি না; অথচ আপনারা গঙ্গা থেকে আমাদের পানির হিস্যা বাড়াবেন না। এখন আমরা নিজেরাই যদি বাংলাদেশের ভেতরে এ রকম একটা খাল করে ব্রহ্মপুত্র ও পদ্মাকে যোগ করি তাহলে? উত্তরে শ্রী প্যাটেল খুব দৃঢ়ভাবে বলেছিলেন, আমরা তাতে আপত্তি জানাব। আমার পাল্টা প্রশ্ন ছিল, 'আমাদের খাল হবে বাংলাদেশের ভেতরে। আপনারা আপত্তি দেবেন কিভাবে? তিনি বললেন, আপনারা ওই প্রকল্প করে ফেললে ব্রহ্মপুত্রের পানির ওপর আপনাদের অধিকার (prescriptive right) জন্মে যাবে আর তখন আমরা ব্রহ্মপুত্রের পানি অন্যদিকে প্রবাহিত করতে পারব না। তাই আমরা এখনই বাধা দেব। এ কথোপকথনের ভিত্তিতে আমি রিপোর্ট লিখেছিলাম এবং পরে দিলি্ল সফরে আসা বাংলাদেশি পানি বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলাম। তাঁরা বলেছিলেন, যেহেতু এক নদীর অববাহিকা থেকে অন্য নদীর অববাহিকায় পানি প্রবাহিত করার তাঁরা বিরোধী তাই আমি আমাদের নিজেদের যে ব্যবস্থা করার কথা বলছি তাঁরা এটারও বিরোধী। তা ছাড়া আমার প্রস্তাব বাস্তবসম্মত নাও হতে পারে। কারণ সেই তো নদীর মতো একটা খাল কাটার কথা উঠছে, যা ভারতও চাইছে। আমার পাল্টা যুক্তি ছিল বাংলাদেশের ভেতরে ব্রহ্মপুত্র থেকে পদ্মার মধ্যবর্তী অঞ্চলে বেশ কয়েকটি নদী প্রবহমান, এখন আমরা যদি স্বল্পদৈর্ঘ্যের একেকটা খাল দিয়ে একটার সঙ্গে আরেকটা নদী যোগ করি তাহলেও তো ব্রহ্মপুত্রের কিছু পানি পদ্মায় নিতে পারব। বলাবাহুল্য, আমার এসব কথা তখন কেউ আমলে নেননি। যতদূর জানি কেউ কোনো পাত্তাই দেননি। কিন্তু এখন পরিবেশপ্রতিমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের কথা শুনে আমার আশা জন্মাচ্ছে, শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ বোধ হয় নিজস্ব নদী সংযোগ প্রকল্পের পথে পা বাড়াবে। কারণ আর তো কোনো গতি নেই।
মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী একবার বলেছিলেন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও বোধ হয় বলেছিলেন, বাংলাদেশকে খালে-বিলে বর্ষার পানি ধরে রাখতে হবে। আমি মনে করি, আমাদের উচিত অবিলম্বে এ বিষয়ে কাজ শুরু করা। দেশে বহু ভরাট হয়ে আসা খাল আছে, পুনঃখনন করে যেগুলোর গভীরতা বাড়ানো যায়। সেই সংস্কার করা খালগুলোতে স্লুইসগেট বসিয়ে বর্ষার শেষ দিকে অর্থাৎ ভাদ্র মাসে, যে পানি থাকবে তা ধরে রাখা যায়। এই পানি শীতে এবং গ্রীষ্মের শুরুতে সেচের জন্য ব্যবহার করা সম্ভব হবে। তা ছাড়া সংস্কার করা খাল দিয়ে এবং নদী পুনঃখনন করলে সেগুলোর মাধ্যমেও বর্ষায় চুইয়ে ভূগর্ভে পানি যাবে এবং এতে সারা দেশে ভূগর্ভস্থ জলাধারে পানির পরিমাণ বাড়বে। এই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াকে 'ন্যাচারাল রি-চার্জিং অব আন্ডারগ্রাউন্ড অ্যাকুইফার্স' (Natural recharging of underground aquifers) বলা হয়। আগের কথায় কিছুটা ফিরে এসে বলি, ঢাকা শহরের নিচে যে ভূগর্ভস্থ পানি তা হয়তো রাজধানীর সীমানার বাইরেও বিস্তৃত। তাই শুধু ঢাকার বৃষ্টির পানিই নয়, আশপাশের পানির প্রবাহ অর্থাৎ নদী ও খাল থেকে পানি রিচার্জ করার সম্ভাবনার কথাও মনে রাখতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
No comments