একাত্তরে যদি হেরে যেতাম? by মামুন রশীদ
যদি আমরা একাত্তরে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে জয়লাভ করতে না পারতাম, তাহলে এর বেশিরভাগই ঘটত না। আমাদের এত বিপুলসংখ্যক সফল শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী, প্রধান নির্বাহী, সামরিক ও বেসামরিক আমলা, উপাচার্য ও পেশাজীবী চারপাশ আলোকিত করতে পারতেন না।
ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করত না নানা দেশের পতাকাবাহী এত সংখ্যক বিমান। উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থার এত বেশিসংখ্যক বিশেষজ্ঞ ও কর্মকর্তা আলোচনায় বসতেন না আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। আমরা হেরে গেলে সবকিছু নির্ধারিত হতো ৪১ বছর আগের মতো পিন্ডি-ইসলামাবাদে। কৃষকদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কেউ ভাবত না, দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতো না। শিক্ষিত বেকারের বোঝা বাড়ত
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস অ্যান্ড ইকোনমিক্স ফোরামে একাত্তরে বিজয়ের চলি্লশ বছর উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। এর আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মান জানানো। কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা তাদের সেই স্বপ্ন ও সাহসের দিনগুলোর অভিজ্ঞতা জানান তরুণ শিক্ষার্থীদের। একাত্তরের যোদ্ধারা অনেকেই সক্রিয় জীবনে রয়েছেন। বয়সে প্রবীণ, কিন্তু সে সময়ের কথা বলতে গিয়ে তারাও হয়ে পড়েন নবীনের মতো প্রাণবন্ত, উচ্ছল। আবেগ তো স্বাভাবিকভাবেই থাকে। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে একটি ইংরেজি দৈনিকের মুক্তিযোদ্ধা সম্পাদক প্রশ্ন রাখেন_ যদি একাত্তরে আমরা হেরে যেতাম, তাহলে কী ঘটত? তিনি কিছু সময় থেমে নিজেই ফিরে যান চার যুগ আগের স্মৃতিতে।
তার এ প্রশ্ন আমাকেও আলোড়িত করেছে। সত্যিই তো, এভাবে বিষয়টি ভেবে দেখিনি। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, যদি বাঙালিরা পাকিস্তানিদের সঙ্গে স্বাধীনতার যুদ্ধে পরাজিত হতো তাহলে আরও অনেক মানুষকে নিষ্ঠুুর হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হতো। এটা চলত দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। শহর-বন্দর-গ্রাম সর্বত্র দখলদার বাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় দোসরদের করুণার ওপর নির্ভর করত আমাদের বেঁচে থাকা। ফিলিস্তিনিরা যেমন যুগ যুগ ধরে আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উদ্বাস্তুর জীবন কাটাচ্ছে, বাংলাদেশের লাখ লাখ নাগরিকের জন্যও নেমে আসত তেমন অবমাননাকর দুঃসহ জীবন। তাদের নিজ বাসভূমে ফেরার আকুতি থাকত; কিন্তু সেখানে যে অপেক্ষা করে আছে মৃত্যু পরোয়ানা কার্যকর করার ঘাতক বাহিনী।
কয়েক দিন আগে বাংলাদেশের উদ্যোক্তা শ্রেণীর উত্থান বিষয়ে একটি আলোচনা ছিল। এতে অংশ নিয়ে কেউ কেউ বলেন, স্বাধীনতার যুদ্ধ যে মাত্র ৯ মাস স্থায়ী হয়েছিল, সে জন্য সৃষ্টিকর্তাকে অশেষ ধন্যবাদ। অনেক দেশে এ সংগ্রাম দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে। আমাদের ক্ষেত্রে তেমনটি ঘটলে অর্থনীতির জন্য তা আরও ক্ষতি ডেকে আনত। এ ক্ষত কাটিয়ে উঠতে প্রয়োজন হতো দীর্ঘ সময়।
একাত্তরে হেরে গেলে প্রকৃতই কী ঘটত, এমন প্রশ্ন থেকে এখনও নিজেকে মুক্ত করতে পারছি না। বাংলাদেশ এখন তার হাজার হাজার উদ্যোক্তা, পেশাজীবী, কূটনীতিকদের নিয়ে গর্ববোধ করে। বিশ্ব সমাজে রয়েছে আমাদের দেশের মর্যাদার আসন। আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রগতি সর্বত্র প্রশংসিত হচ্ছে। নারীর ক্ষমতায়ন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, শিক্ষার প্রসার নিয়ে আমরা উচ্চকিত হতে পারি। মাত্র দুই বছরে ১৪-১৫ লাখ কিশোরী অষ্টম শ্রেণীর পাবলিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে, এ তথ্য অনেক উন্নত দেশের জন্যও চমকে ওঠার বিষয়। উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য প্রচুরসংখ্যক ছাত্রছাত্রী প্রতি বছর বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে। তাদের মেধা-প্রতিভা ও উদ্যমী মনোভাবে মুগ্ধ হন জগৎসেরা বিজ্ঞানী, শিক্ষক ও করপোরেট বসরা। বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকা নিয়ে গাড়িতে বিশ্বের নানা দেশের শহর ও গ্রামীণ জনপদে ঘুরে বেড়ান আমাদের কূটনীতিকরা। প্রবাসে কাজ করছেন ৭০-৭৫ লাখ বাংলাদেশি. এমন তথ্যও আমাদের আর চমকিত করে না। তাদের পাঠানো অর্থে সমৃদ্ধ থাকছে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার। তাদের ভালো কাজ নানা দেশে স্বীকৃত। অনেক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে অফিস স্থাপন করেছে। এর ফলে একদিকে নতুন নতুন কাজের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে, একই সঙ্গে তরুণ প্রজন্মের জন্য তা এনে দিচ্ছে সৃষ্টিশীলতার অভাবনীয় সম্ভাবনা। বিশ্ববাজারে 'মেইড ইন বাংলাদেশ' এখন জনপ্রিয় ব্র্র্যান্ড। বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তর পোশাক তৈরির দেশ বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক সরবরাহকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের স্থান দ্বিতীয়। আফ্রিকার কয়েকটি দেশে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের ভূমিকা বিপুলভাবে প্রশংসিত হচ্ছে। জাতিসংঘের শীর্ষ কর্মকর্তারাও তাদের অবদানের স্বীকৃতি দিচ্ছেন। বাংলাদেশের ক্ষুদ্রঋণের সফল মডেল এখন অনেক দেশ অনুসরণ করে। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সোশ্যাল বিজনেসের মডেলকেও বাংলাদেশের 'খুব ভালো উদ্ভাবন' হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া কিংবা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতরা এখন বিভিন্ন দেশে নিজের যোগ্যতায় স্থান করে নিচ্ছেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি আমাদের আনুগত্যও বিশ্বব্যাপী সম্মান ও শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখা হয়। এ ক্ষেত্রে এখনও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে, কিন্তু মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অধ্যুষিত দেশগুলোতে উদারনীতিক গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য বাংলাদেশ একটি মডেল হিসেবেই গণ্য হচ্ছে। অর্থনীতির চাকা আমরা সচল রাখতে পারছি, প্রবৃদ্ধির হার বিশ্বব্যাপী মন্দার মধ্যেও ধারাবাহিক সন্তোষজনক থাকছে। এখানে ব্যবসা করা যায়, সরকার বদল হলেও নীতি খুব একটা বদলায় না কিংবা খুব ব্যয় না করেই দক্ষ শ্রমিক পাওয়া যায়_ ক্রমেই বেশি বেশি করে বিজনেস হাউস এর স্বীকৃতি দিচ্ছে।
যদি আমরা একাত্তরে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে জয়লাভ করতে না পারতাম, তাহলে এর বেশিরভাগই ঘটত না। আমাদের এত বিপুলসংখ্যক সফল শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী, প্রধান নির্বাহী, সামরিক ও বেসামরিক আমলা, উপাচার্য ও পেশাজীবী চারপাশ আলোকিত করতে পারতেন না। ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করত না নানা দেশের পতাকাবাহী এত সংখ্যক বিমান। উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থার এত বেশিসংখ্যক বিশেষজ্ঞ ও কর্মকর্তা আলোচনায় বসতেন না আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। আমরা হেরে গেলে সবকিছু নির্ধারিত হতো ৪১ বছর আগের মতো পিন্ডি-ইসলামাবাদে। কৃষকদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কেউ ভাবত না, দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতো না। শিক্ষিত বেকারের বোঝা বাড়ত।
সাত-আট বছর আগে, বিজয় দিবসে গুলশান মসজিদে জুমার নামাজ আদায়কালে ইমাম সাহেব মোনাজাত করলেন ইরাক, আফগানিস্তান এবং আরও কয়েকটি দেশের নির্যাতিত মুসলমানদের কল্যাণ ও শান্তি কামনায়। এক তরুণ নামাজি স্বগতোক্তির মতোই বলে ওঠেন_ যেসব মুক্তিযোদ্ধা একাত্তরে স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিল, আরও যারা লড়ে গেল অসম সাহসে তাদের জন্য কেন দোয়া করা হবে না? আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সব ধর্মের নারী-পুরুষ অংশ নিয়েছে। কিন্তু এটাও তো ঠিক যে, তাদের বেশিরভাগই ছিল ইসলাম ধর্মাবলম্বী। স্বাধীন দেশে গণতান্ত্রিক ও শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা ছিল তাদের।
আমার অনেক বন্ধুই মনে করেন, একাত্তরে আমাদের বিজয় ছিল অবধারিত এবং কোনোভাবেই এর অন্যথা হওয়ার কথা নয়। এর কারণ আমাদের ওপর অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং মুষ্টিমেয় রাজাকার-আলবদর ছাড়া গোটা দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল স্বাধীনতার জন্য। কিন্তু তারপরও বারবার ঘুরেফিরে আসে দুঃস্বপ্নের মতো_ হেরে গেলে কী হতো? যারা বাংলাদেশের জন্য অমিত তেজে লড়ে আত্মাহুতি দিয়েছেন, যারা আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন তাদের সবার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
মামুন রশীদ : ব্যাংকার ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক mamun1960@gmail.com
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস অ্যান্ড ইকোনমিক্স ফোরামে একাত্তরে বিজয়ের চলি্লশ বছর উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। এর আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মান জানানো। কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা তাদের সেই স্বপ্ন ও সাহসের দিনগুলোর অভিজ্ঞতা জানান তরুণ শিক্ষার্থীদের। একাত্তরের যোদ্ধারা অনেকেই সক্রিয় জীবনে রয়েছেন। বয়সে প্রবীণ, কিন্তু সে সময়ের কথা বলতে গিয়ে তারাও হয়ে পড়েন নবীনের মতো প্রাণবন্ত, উচ্ছল। আবেগ তো স্বাভাবিকভাবেই থাকে। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে একটি ইংরেজি দৈনিকের মুক্তিযোদ্ধা সম্পাদক প্রশ্ন রাখেন_ যদি একাত্তরে আমরা হেরে যেতাম, তাহলে কী ঘটত? তিনি কিছু সময় থেমে নিজেই ফিরে যান চার যুগ আগের স্মৃতিতে।
তার এ প্রশ্ন আমাকেও আলোড়িত করেছে। সত্যিই তো, এভাবে বিষয়টি ভেবে দেখিনি। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, যদি বাঙালিরা পাকিস্তানিদের সঙ্গে স্বাধীনতার যুদ্ধে পরাজিত হতো তাহলে আরও অনেক মানুষকে নিষ্ঠুুর হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হতো। এটা চলত দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। শহর-বন্দর-গ্রাম সর্বত্র দখলদার বাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় দোসরদের করুণার ওপর নির্ভর করত আমাদের বেঁচে থাকা। ফিলিস্তিনিরা যেমন যুগ যুগ ধরে আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উদ্বাস্তুর জীবন কাটাচ্ছে, বাংলাদেশের লাখ লাখ নাগরিকের জন্যও নেমে আসত তেমন অবমাননাকর দুঃসহ জীবন। তাদের নিজ বাসভূমে ফেরার আকুতি থাকত; কিন্তু সেখানে যে অপেক্ষা করে আছে মৃত্যু পরোয়ানা কার্যকর করার ঘাতক বাহিনী।
কয়েক দিন আগে বাংলাদেশের উদ্যোক্তা শ্রেণীর উত্থান বিষয়ে একটি আলোচনা ছিল। এতে অংশ নিয়ে কেউ কেউ বলেন, স্বাধীনতার যুদ্ধ যে মাত্র ৯ মাস স্থায়ী হয়েছিল, সে জন্য সৃষ্টিকর্তাকে অশেষ ধন্যবাদ। অনেক দেশে এ সংগ্রাম দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে। আমাদের ক্ষেত্রে তেমনটি ঘটলে অর্থনীতির জন্য তা আরও ক্ষতি ডেকে আনত। এ ক্ষত কাটিয়ে উঠতে প্রয়োজন হতো দীর্ঘ সময়।
একাত্তরে হেরে গেলে প্রকৃতই কী ঘটত, এমন প্রশ্ন থেকে এখনও নিজেকে মুক্ত করতে পারছি না। বাংলাদেশ এখন তার হাজার হাজার উদ্যোক্তা, পেশাজীবী, কূটনীতিকদের নিয়ে গর্ববোধ করে। বিশ্ব সমাজে রয়েছে আমাদের দেশের মর্যাদার আসন। আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রগতি সর্বত্র প্রশংসিত হচ্ছে। নারীর ক্ষমতায়ন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, শিক্ষার প্রসার নিয়ে আমরা উচ্চকিত হতে পারি। মাত্র দুই বছরে ১৪-১৫ লাখ কিশোরী অষ্টম শ্রেণীর পাবলিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে, এ তথ্য অনেক উন্নত দেশের জন্যও চমকে ওঠার বিষয়। উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য প্রচুরসংখ্যক ছাত্রছাত্রী প্রতি বছর বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে। তাদের মেধা-প্রতিভা ও উদ্যমী মনোভাবে মুগ্ধ হন জগৎসেরা বিজ্ঞানী, শিক্ষক ও করপোরেট বসরা। বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকা নিয়ে গাড়িতে বিশ্বের নানা দেশের শহর ও গ্রামীণ জনপদে ঘুরে বেড়ান আমাদের কূটনীতিকরা। প্রবাসে কাজ করছেন ৭০-৭৫ লাখ বাংলাদেশি. এমন তথ্যও আমাদের আর চমকিত করে না। তাদের পাঠানো অর্থে সমৃদ্ধ থাকছে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার। তাদের ভালো কাজ নানা দেশে স্বীকৃত। অনেক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে অফিস স্থাপন করেছে। এর ফলে একদিকে নতুন নতুন কাজের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে, একই সঙ্গে তরুণ প্রজন্মের জন্য তা এনে দিচ্ছে সৃষ্টিশীলতার অভাবনীয় সম্ভাবনা। বিশ্ববাজারে 'মেইড ইন বাংলাদেশ' এখন জনপ্রিয় ব্র্র্যান্ড। বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তর পোশাক তৈরির দেশ বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক সরবরাহকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের স্থান দ্বিতীয়। আফ্রিকার কয়েকটি দেশে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের ভূমিকা বিপুলভাবে প্রশংসিত হচ্ছে। জাতিসংঘের শীর্ষ কর্মকর্তারাও তাদের অবদানের স্বীকৃতি দিচ্ছেন। বাংলাদেশের ক্ষুদ্রঋণের সফল মডেল এখন অনেক দেশ অনুসরণ করে। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সোশ্যাল বিজনেসের মডেলকেও বাংলাদেশের 'খুব ভালো উদ্ভাবন' হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া কিংবা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতরা এখন বিভিন্ন দেশে নিজের যোগ্যতায় স্থান করে নিচ্ছেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি আমাদের আনুগত্যও বিশ্বব্যাপী সম্মান ও শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখা হয়। এ ক্ষেত্রে এখনও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে, কিন্তু মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অধ্যুষিত দেশগুলোতে উদারনীতিক গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য বাংলাদেশ একটি মডেল হিসেবেই গণ্য হচ্ছে। অর্থনীতির চাকা আমরা সচল রাখতে পারছি, প্রবৃদ্ধির হার বিশ্বব্যাপী মন্দার মধ্যেও ধারাবাহিক সন্তোষজনক থাকছে। এখানে ব্যবসা করা যায়, সরকার বদল হলেও নীতি খুব একটা বদলায় না কিংবা খুব ব্যয় না করেই দক্ষ শ্রমিক পাওয়া যায়_ ক্রমেই বেশি বেশি করে বিজনেস হাউস এর স্বীকৃতি দিচ্ছে।
যদি আমরা একাত্তরে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে জয়লাভ করতে না পারতাম, তাহলে এর বেশিরভাগই ঘটত না। আমাদের এত বিপুলসংখ্যক সফল শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী, প্রধান নির্বাহী, সামরিক ও বেসামরিক আমলা, উপাচার্য ও পেশাজীবী চারপাশ আলোকিত করতে পারতেন না। ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করত না নানা দেশের পতাকাবাহী এত সংখ্যক বিমান। উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থার এত বেশিসংখ্যক বিশেষজ্ঞ ও কর্মকর্তা আলোচনায় বসতেন না আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। আমরা হেরে গেলে সবকিছু নির্ধারিত হতো ৪১ বছর আগের মতো পিন্ডি-ইসলামাবাদে। কৃষকদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কেউ ভাবত না, দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতো না। শিক্ষিত বেকারের বোঝা বাড়ত।
সাত-আট বছর আগে, বিজয় দিবসে গুলশান মসজিদে জুমার নামাজ আদায়কালে ইমাম সাহেব মোনাজাত করলেন ইরাক, আফগানিস্তান এবং আরও কয়েকটি দেশের নির্যাতিত মুসলমানদের কল্যাণ ও শান্তি কামনায়। এক তরুণ নামাজি স্বগতোক্তির মতোই বলে ওঠেন_ যেসব মুক্তিযোদ্ধা একাত্তরে স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিল, আরও যারা লড়ে গেল অসম সাহসে তাদের জন্য কেন দোয়া করা হবে না? আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সব ধর্মের নারী-পুরুষ অংশ নিয়েছে। কিন্তু এটাও তো ঠিক যে, তাদের বেশিরভাগই ছিল ইসলাম ধর্মাবলম্বী। স্বাধীন দেশে গণতান্ত্রিক ও শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা ছিল তাদের।
আমার অনেক বন্ধুই মনে করেন, একাত্তরে আমাদের বিজয় ছিল অবধারিত এবং কোনোভাবেই এর অন্যথা হওয়ার কথা নয়। এর কারণ আমাদের ওপর অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং মুষ্টিমেয় রাজাকার-আলবদর ছাড়া গোটা দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল স্বাধীনতার জন্য। কিন্তু তারপরও বারবার ঘুরেফিরে আসে দুঃস্বপ্নের মতো_ হেরে গেলে কী হতো? যারা বাংলাদেশের জন্য অমিত তেজে লড়ে আত্মাহুতি দিয়েছেন, যারা আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন তাদের সবার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
মামুন রশীদ : ব্যাংকার ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক mamun1960@gmail.com
No comments