চরাচর-কটকা ট্র্যাজেডি by গৌরাঙ্গ নন্দী
নোনা জল-কাদার বন। নাম বাদা বন। ইংরেজিতে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। সাগরমাতার কোল ঘেঁষে উপকূলের বিশাল এলাকাজুড়ে বিশ্বের একক বৃহত্তম বন- সুন্দরবন। অসংখ্য নদী-নালা-খালের মধ্যকার ভূমিতে বিচিত্র প্রজাতির নানা উদ্ভিদ ও প্রাণিকুল নিয়ে অপার সৌন্দর্যের আধার।
মানুষের অপার বিস্ময় এবং কৌতূহলের বিষয়। নানাজন নানাভাবে একে চিত্রিত করেছেন। লিখেছেন অনেক কথা। এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি উঠে এসেছে এই বনসংলগ্ন এলাকার মানুষের কথা। তাদের দুঃখ-যন্ত্রণা-বিরহগাথা এবং প্রকৃতিকে জয় করার দুঃসহ সব কাহিনী। এসব সাফল্যগাথা মানুষকে যেমন উদ্দীপ্ত করে, দুঃখজনক ঘটনাগুলোও তেমনি মানুষকে কষ্ট দেয়। এমনি একটি দুঃখজনক ঘটনার দিন ১৩ মার্চ। ২০০৪ সালের এই দিনটিতে সাগরমাতার কোলে চিরদিনের মতো ঠাঁই হয় ১১ তরুণের। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের টানে ছুটে গিয়ে তাঁরা আর ফিরে আসতে পারেননি। বন্ধু-সহযাত্রীরা ফিরেছিলেন একবুক যন্ত্রণা আর হতাশা নিয়ে। ওই দিন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়- খুবির স্থাপত্য ডিসিপ্লিনের শিক্ষার্থীরা সুন্দরবনের অন্যতম একটি আকর্ষণীয় স্থান কটকায় পেঁৗছেন। পশ্চিম সুন্দরবনের কোণে অপরূপ সৌন্দর্যের এই স্থানটি সবার কাছেই প্রিয়। সেখানে আছে বেলাভূমি (সৈকত)। সেখানেই ছেলেমেয়েরা উচ্ছল আনন্দে মেতে ওঠে। বেশ কয়েকজন সেখানকার বাদামতলা নামের জায়গাটিতে ছোটাছুটি করতে থাকেন। হঠাৎ করেই জোয়ারের পানি ছুটে আসে। দমকে দমকে পানি বাড়তে থাকে। চোখের পলকে অনেক পানি বেড়ে যায়। আনন্দে মাতোয়ারা তরুণের দল বুঝেই উঠতে পারেনি যে পানি এত দ্রুত বেড়ে উঠতে পারে।
মুহূর্তের মধ্যে পায়ের পাতা ভেজা পানি কোমর পর্যন্ত উঠে যায়, সেই পানি গলা পর্যন্ত উঠে গিয়ে তাঁদের বিপদাপন্ন করে তোলে। সবাই বিপদ টের পেয়ে যে-যার মতো করে ঝাঁপিয়ে-সাঁতরিয়ে তীরে ওঠার চেষ্টা করেন। সেখানেই ছিল ছোট একটি খাল। যা পার হয়ে গিয়েছিল তরুণের দল। যাওয়ার সময় যেটি খাল হিসেবে মনে হয়নি, সেটিই ফেরার সময় মরণফাঁদ হিসেবে দেখা দেয়। সাগরপাড়ের বালুময় বেলাভূমিতে স্রোতের প্রবল ঘূর্ণিতে কাবু হয়ে পড়েন ছেলেমেয়েরা। শুরু হয় বাঁচার আকুতি। আর্তচিৎকার। সাহায্যের জন্য করুণ মিনতি। ততক্ষণে পানি অনেক বেড়ে গেছে। জোয়ারের প্রবল তোড় এবং পানির টানে শুরু হয় প্রকৃতি আর মানুষের চিরন্তন লড়াই। এই লড়াইয়ে অনেকেই প্রকৃতিকে হারিয়ে তীরে উঠতে সক্ষম হলেও ভেসে যান ১১ জন। খুবির আরনাজ রিফাত রূপা, আবদুল্লাহেল বাকী, তৌহিদুল এনাম অপু, কাজী মুয়ীদ বিন ওয়ালিদ কুশল, মাকসুমুল আজিজ মোন্তাজী নিপুণ, মুনাদিন রায়হান বিন মাহবুব শুভ, মো. কাউসার আহমেদ খান, মো. আশরাফুজ্জামান তোহা, মো. মাহমুদুর রহমান রাসেল এবং তাঁদের বন্ধু বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়- বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগের মো. সামিউল ইসলাম খান এবং শামসুল আরেফিন শাকিল। সেই থেকে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় এই দিনটিকে 'কটকা ট্র্যাজেডি' দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। তাঁদের স্মরণে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে গড়ে তোলা হয়েছে একটি স্মৃতিসৌধ। প্রতিবছরের মতো আজ সেখানে সহপাঠী-অনুজরা পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে তাঁদের হারিয়ে যাওয়া অগ্রজদের স্মরণ করবেন।
গৌরাঙ্গ নন্দী
মুহূর্তের মধ্যে পায়ের পাতা ভেজা পানি কোমর পর্যন্ত উঠে যায়, সেই পানি গলা পর্যন্ত উঠে গিয়ে তাঁদের বিপদাপন্ন করে তোলে। সবাই বিপদ টের পেয়ে যে-যার মতো করে ঝাঁপিয়ে-সাঁতরিয়ে তীরে ওঠার চেষ্টা করেন। সেখানেই ছিল ছোট একটি খাল। যা পার হয়ে গিয়েছিল তরুণের দল। যাওয়ার সময় যেটি খাল হিসেবে মনে হয়নি, সেটিই ফেরার সময় মরণফাঁদ হিসেবে দেখা দেয়। সাগরপাড়ের বালুময় বেলাভূমিতে স্রোতের প্রবল ঘূর্ণিতে কাবু হয়ে পড়েন ছেলেমেয়েরা। শুরু হয় বাঁচার আকুতি। আর্তচিৎকার। সাহায্যের জন্য করুণ মিনতি। ততক্ষণে পানি অনেক বেড়ে গেছে। জোয়ারের প্রবল তোড় এবং পানির টানে শুরু হয় প্রকৃতি আর মানুষের চিরন্তন লড়াই। এই লড়াইয়ে অনেকেই প্রকৃতিকে হারিয়ে তীরে উঠতে সক্ষম হলেও ভেসে যান ১১ জন। খুবির আরনাজ রিফাত রূপা, আবদুল্লাহেল বাকী, তৌহিদুল এনাম অপু, কাজী মুয়ীদ বিন ওয়ালিদ কুশল, মাকসুমুল আজিজ মোন্তাজী নিপুণ, মুনাদিন রায়হান বিন মাহবুব শুভ, মো. কাউসার আহমেদ খান, মো. আশরাফুজ্জামান তোহা, মো. মাহমুদুর রহমান রাসেল এবং তাঁদের বন্ধু বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়- বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগের মো. সামিউল ইসলাম খান এবং শামসুল আরেফিন শাকিল। সেই থেকে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় এই দিনটিকে 'কটকা ট্র্যাজেডি' দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। তাঁদের স্মরণে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে গড়ে তোলা হয়েছে একটি স্মৃতিসৌধ। প্রতিবছরের মতো আজ সেখানে সহপাঠী-অনুজরা পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে তাঁদের হারিয়ে যাওয়া অগ্রজদের স্মরণ করবেন।
গৌরাঙ্গ নন্দী
No comments