সপ্তাহের হালচাল-হরতাল ও লজ্জা-শরমের সমীকরণ by আব্দুল কাইয়ুম
ইসলামপন্থী দলগুলোর হরতাল ছাত্রলীগকে বিন্দুমাত্র বিচলিত করেনি, হরতালের মধ্যে দলটির জাতীয় সম্মেলনে যথারীতি বিপুলসংখ্যক কর্মী উপস্থিত হন। এটাই তো স্বাভাবিক। একে তো সরকারি দলের আয়োজন, তার ওপর স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করবেন, সেখানে লোকসমাগম কম হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী সেই স্বাভাবিক সমাবেশের ওপর অস্বাভাবিক গৌরব আরোপ করে বলেন, ‘হরতালের অবস্থা কী, তা হরতাল আহ্বানকারীরা দেখতে পাচ্ছেন। এরপর লজ্জা থাকলে তাঁরা আর হরতাল ডাকবেন না।’
প্রধানমন্ত্রী অবশ্য ভুল বলেননি। এখনকার হরতালে রাস্তায় কোনো কর্মীও থাকেন না। আর সেদিন তো ছিল আরও নির্জীব। লজ্জার কথাই বটে। তাও বলতে হয়, লজ্জার সঙ্গে হরতাল আহ্বানের কোনো সম্পর্ক নেই। প্রায় দেড় যুগ ধরে যে হরতালের রাজনীতি চলছে, তার প্রধান কারণ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সমঝোতার অভাব। পরস্পরের রাজনীতির প্রতি অসহিষ্ণুতা দেশের পরিস্থিতিকে ক্রমশ জটিল করে তুলেছে। অব্যাহত সংঘাত ও সহিংসতা যেন অমোঘ নিয়তি হয়ে উঠেছে।
হরতাল বন্ধের জন্য দরকার এই অসহিষ্ণু রাজনীতির অবসান। গত সপ্তাহে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুককে পুলিশ যে নির্মমভাবে পিটিয়ে জখম করেছে, তারপর কি হরতাল বন্ধের আশা করা যায়? ক্ষমতাসীনেরা বলবে, বিএনপির আমলেও এমন হয়েছে, রাজপথে হরতাল করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের নেতা মতিয়া চৌধুরী, সাবের হোসেন চৌধুরী, মোহাম্মদ নাসিমসহ অনেকে কম-বেশি একই ধরনের পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। কিন্তু সেটা কি কেউ সমর্থন করেছিল? আওয়ামী লীগ কি সেই নির্যাতনের প্রতিবাদে আবার বিক্ষোভ-সমাবেশ, হরতাল করেনি? তখনো তো হরতালের সময় রাস্তায় মোটামুটি রিকশা, গাড়ি চলত। তার পরও কি হরতাল ডাকতে কারও লজ্জাবোধ হয়েছিল? সেদিন আওয়ামী লীগের যদি না হয়ে থাকে, আজ বিএনপি বা সমমনাদের কেন হবে?
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগ সরকারের বিগত মেয়াদের সময় বলেছিলেন, তাঁরা বিরোধী দলে থাকলেও হরতাল করবেন না। আর বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, তাঁরা ইস্যুভিত্তিক ওয়াকআউট করলেও সংসদের সেশন বা বৈঠক বর্জন করবেন না। কেউ কথা রাখেননি। হরতাল চলেছে সমান গতিতে, আর চলছে সংসদ বর্জনও। এক দিনের হরতালে দেশের এক হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়। এই হিসাব দিয়েছে চট্টগ্রাম চেম্বার (দৈনিক ইত্তেফাক, ৭ জুলাই, ২০১১)। এক দিন (চার ঘণ্টার সেশন) সংসদে অচলাবস্থা চললে, কাজ না হলে, ক্ষতি হয় এক কোটি টাকারও বেশি (টিআইবির হিসাব অনুযায়ী)। এক মাসে ছয় দিন হরতাল করলে যে ক্ষতি হয়, সেই টাকায় দেশের অন্তত দুই কোটি গরিব মানুষকে এক মাস খাইয়ে-পরিয়ে সুখে-শান্তিতে রাখা যায়।
আমাদের মতো গরিব দেশের রাজনীতিকেরা যদি এই সহজ হিসাবটা না বোঝেন, তাহলে কে বুঝবে? এই তো সেদিন আমাদের কাছের দেশ থাইল্যান্ডে নির্বাচন হয়ে গেল। ২০০৬ সালের পর থেকে সেখানে একধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছিল। সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত থাকসিনের লাল শার্ট পরিহিত কর্মীবাহিনী আর সেনাসমর্থক হলুদ শার্ট পরিহিত কর্মীবাহিনীর মধ্যে কত রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চলল। শুধু গত বছরই সহিংসতায় থাকসিন-সমর্থক ৯২ জন প্রাণ দিলেন (দি ইকোনমিস্ট, ৯ জুলাই, ২০১১)। এত কিছুর পর সেখানে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন পক্ষ পরাজয় মেনে নিয়েছে। নির্বাচনের আগেই দুই দল যৌথ ঘোষণায় স্বাক্ষর করেছিল যে নির্বাচনের ফলাফল তারা মেনে নেবে। ৩ জুলাই নির্বাচনের পর ভোট গণনা শুরু হলে মাত্র ৫০ শতাংশ ভোটকেন্দ্রের ফলাফল পাওয়ার পরই ক্ষমতাসীন দলের নেতা অভিসিত হাসিমুখে পরাজয় মেনে নিলেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী থাকসিনের বোন, ইংলাকের দল ৫০০ আসনের মধ্যে পেয়েছে ২৬৫ আসন, আর অভিসিতের দল পেয়েছে মাত্র ১৫৯ আসন। নির্বাচনের পরপরই ব্যাংকক শেয়ারবাজারে সূচক বাড়তে শুরু করে। সেখানে গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাবনা সম্পর্কে এখন সবাই আশাবাদী।
থাইল্যান্ডের মানুষ ভাত খায়, আমরাও তো ভাতই খাই। ওরা পারলে আমরা কী দোষ করেছি? থাইল্যান্ডের মানুষ নাকি খুব নরম মনের। তারা সহিংসতার বিরুদ্ধে। এ ব্যাপারে বাঙালির সুনামও কিন্তু কম নয়। আমরা যেমন সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ করে দেশের স্বাধীনতা এনেছি, তেমনি আবার শান্তিপূর্ণ, সাদামাটা জীবন যাপনেও অভ্যস্ত। পূর্বদেশীয় সংস্কৃতি যদি থাইল্যান্ডকে উতরে নিয়ে যেতে পারে, বাংলাদেশকেও পারবে।
এই লেখা যেদিন প্রকাশিত হবে, সেদিন, বুধবার বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সারা দিন গণ-অনশন করবে। হরতালের চেয়ে ভালো কর্মসূচি। বিএনপি হয়তো পল্টন ময়দানেই এই অনশন করত। কিন্তু গত বছরের ২৫ জুলাই তারা পল্টন ময়দানে অনশন কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েও তা করতে পারেনি। কারণ, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ অনুমতি দেয়নি। তারা তখন বাধ্য হয়ে মুক্তাঙ্গনে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছিল। গত এক বছরে পরিস্থিতি অনেকটা বদলে গেছে। এখন সরকারের প্রতি মানুষের সমর্থন আগের চেয়ে কম। এ অবস্থায় বিএনপি যে পল্টনের মতো বড় মাঠ ছেড়ে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে গেছে, সেটাই যথেষ্ট। এই কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে হয়ে যাক, এটাই কাম্য।
গণতন্ত্রে সভা-সমাবেশ, বিক্ষোভ, অনশন হবেই। হরতাল এড়িয়ে চলাই আসল ব্যাপার। সরকার যদি ভাবে যে কাউকে মাঠে নামতে দেওয়া হবে না, তাহলে ভুল করবে। আজকাল মানুষের চোখ-কান খোলা। বাংলাদেশ তো আর ধনী দেশ না যে জনজীবনে সুখের বন্যা বয়ে যাবে। দেশ যখন গরিব, সমস্যাও তেমন বেশি থাকবে। আজ যে বাজারে জিনিসপত্রের অগ্নিমূল্য, তা তো নতুন কিছু নয়। দেশের মানুষের নুন আনতে পান্তা ফুরায় চিরকালই। তাই অভাব-অভিযোগ জানানোর সুযোগ দিতেই হবে। রাজপথে পুলিশ নামিয়ে লাঠি মেরে মাথা ফাটিয়ে পুলিশি রাজত্ব চলতে পারে, গণতন্ত্র নয়।
মালয়েশিয়ায় হয়তো ওরকম চলতে পেরেছে। মাহাথির মোহাম্মদের নেতৃত্বে সেখানে বিরাট উন্নতি হয়েছে। সেখানে বিরোধী দলকে সহজে কথা বলতে দেওয়া হয় না। এটাই সেখানকার রীতি হয়ে গেছে। সংসদ আছে, নির্বাচনও হয়, তবে বিরোধী দলের অস্তিত্ব একেবারেই ক্ষীণ। সংসদীয় একনায়কত্বের এক পীড়াদায়ক নমুনা হলো মালয়েশিয়া। কেউ ভাবতে পারেন, সেখানে যদি বিরোধী দলকে ডান্ডাপেটা করে, দাবড়িয়ে রেখে অর্থনৈতিক উন্নয়ন করা যায়, তাহলে সেই মডেল বাংলাদেশে চলবে না কেন? বাংলাদেশের কোনো দল এ রকম চিন্তা করলে বিরাট ভুল হবে। কারণ, মালয়েশিয়ার পরিস্থিতি বাংলাদেশ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেখানে বিরোধী দলকে চাপে রাখলেও অর্থনীতিতে যে অভাবনীয় উন্নতি করেছে, বাংলাদেশে সে রকম হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে।
নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর গত দেড় যুগ ধরে কেবল রাজনৈতিক ঝগড়াই চলছে, মানুষের আয়-উন্নয়ন কি হয়েছে? কয়টা লোকের নতুন চাকরির সুযোগ বেড়েছে? আয় যদি ১০ টাকা বেড়েছে, তো জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে তার দুই-তিন গুণ। সুতরাং মালয়েশিয়ার স্বপ্ন দেখে লাভ নেই। সিঙ্গাপুরের কথা না-ই বা বললাম। সেখানেও বিরোধী দলের অস্তিত্ব প্রায় নেই। কিন্তু আছে বিপুল উন্নয়ন।
এ ব্যাপারে কারও কোনো দ্বিধা থাকা উচিত নয় যে বাংলাদেশে ওসব চলবে না। এখানে গণতন্ত্র মানে সভা-সমাবেশ, ক্ষোভ-বিক্ষোভ প্রকাশের অধিকার। উন্নয়ন হলে ক্ষোভ কমবে, না হলে বাড়বে। পাঁচ বছর পর পর নির্বাচনে ক্ষমতার হাতবদল প্রায় নিয়মে পরিণত হয়েছে। এই বাস্তবতা অস্বীকার করার চেষ্টা বৃথা।
বরং ক্ষমতায় এসে অন্তত পাঁচটা বছর ভালোভাবে দেশ চালানো, ঘুষ-দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই জনসমর্থন ধরে রাখা সম্ভব। এর মধ্য দিয়ে উন্নয়ন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসবে।
একটা ভালো সরকারের জন্য এর চেয়ে ভালো কৌশল আর কী হতে পারে?
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com
প্রধানমন্ত্রী অবশ্য ভুল বলেননি। এখনকার হরতালে রাস্তায় কোনো কর্মীও থাকেন না। আর সেদিন তো ছিল আরও নির্জীব। লজ্জার কথাই বটে। তাও বলতে হয়, লজ্জার সঙ্গে হরতাল আহ্বানের কোনো সম্পর্ক নেই। প্রায় দেড় যুগ ধরে যে হরতালের রাজনীতি চলছে, তার প্রধান কারণ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সমঝোতার অভাব। পরস্পরের রাজনীতির প্রতি অসহিষ্ণুতা দেশের পরিস্থিতিকে ক্রমশ জটিল করে তুলেছে। অব্যাহত সংঘাত ও সহিংসতা যেন অমোঘ নিয়তি হয়ে উঠেছে।
হরতাল বন্ধের জন্য দরকার এই অসহিষ্ণু রাজনীতির অবসান। গত সপ্তাহে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুককে পুলিশ যে নির্মমভাবে পিটিয়ে জখম করেছে, তারপর কি হরতাল বন্ধের আশা করা যায়? ক্ষমতাসীনেরা বলবে, বিএনপির আমলেও এমন হয়েছে, রাজপথে হরতাল করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের নেতা মতিয়া চৌধুরী, সাবের হোসেন চৌধুরী, মোহাম্মদ নাসিমসহ অনেকে কম-বেশি একই ধরনের পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। কিন্তু সেটা কি কেউ সমর্থন করেছিল? আওয়ামী লীগ কি সেই নির্যাতনের প্রতিবাদে আবার বিক্ষোভ-সমাবেশ, হরতাল করেনি? তখনো তো হরতালের সময় রাস্তায় মোটামুটি রিকশা, গাড়ি চলত। তার পরও কি হরতাল ডাকতে কারও লজ্জাবোধ হয়েছিল? সেদিন আওয়ামী লীগের যদি না হয়ে থাকে, আজ বিএনপি বা সমমনাদের কেন হবে?
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগ সরকারের বিগত মেয়াদের সময় বলেছিলেন, তাঁরা বিরোধী দলে থাকলেও হরতাল করবেন না। আর বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, তাঁরা ইস্যুভিত্তিক ওয়াকআউট করলেও সংসদের সেশন বা বৈঠক বর্জন করবেন না। কেউ কথা রাখেননি। হরতাল চলেছে সমান গতিতে, আর চলছে সংসদ বর্জনও। এক দিনের হরতালে দেশের এক হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়। এই হিসাব দিয়েছে চট্টগ্রাম চেম্বার (দৈনিক ইত্তেফাক, ৭ জুলাই, ২০১১)। এক দিন (চার ঘণ্টার সেশন) সংসদে অচলাবস্থা চললে, কাজ না হলে, ক্ষতি হয় এক কোটি টাকারও বেশি (টিআইবির হিসাব অনুযায়ী)। এক মাসে ছয় দিন হরতাল করলে যে ক্ষতি হয়, সেই টাকায় দেশের অন্তত দুই কোটি গরিব মানুষকে এক মাস খাইয়ে-পরিয়ে সুখে-শান্তিতে রাখা যায়।
আমাদের মতো গরিব দেশের রাজনীতিকেরা যদি এই সহজ হিসাবটা না বোঝেন, তাহলে কে বুঝবে? এই তো সেদিন আমাদের কাছের দেশ থাইল্যান্ডে নির্বাচন হয়ে গেল। ২০০৬ সালের পর থেকে সেখানে একধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছিল। সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত থাকসিনের লাল শার্ট পরিহিত কর্মীবাহিনী আর সেনাসমর্থক হলুদ শার্ট পরিহিত কর্মীবাহিনীর মধ্যে কত রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চলল। শুধু গত বছরই সহিংসতায় থাকসিন-সমর্থক ৯২ জন প্রাণ দিলেন (দি ইকোনমিস্ট, ৯ জুলাই, ২০১১)। এত কিছুর পর সেখানে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন পক্ষ পরাজয় মেনে নিয়েছে। নির্বাচনের আগেই দুই দল যৌথ ঘোষণায় স্বাক্ষর করেছিল যে নির্বাচনের ফলাফল তারা মেনে নেবে। ৩ জুলাই নির্বাচনের পর ভোট গণনা শুরু হলে মাত্র ৫০ শতাংশ ভোটকেন্দ্রের ফলাফল পাওয়ার পরই ক্ষমতাসীন দলের নেতা অভিসিত হাসিমুখে পরাজয় মেনে নিলেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী থাকসিনের বোন, ইংলাকের দল ৫০০ আসনের মধ্যে পেয়েছে ২৬৫ আসন, আর অভিসিতের দল পেয়েছে মাত্র ১৫৯ আসন। নির্বাচনের পরপরই ব্যাংকক শেয়ারবাজারে সূচক বাড়তে শুরু করে। সেখানে গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাবনা সম্পর্কে এখন সবাই আশাবাদী।
থাইল্যান্ডের মানুষ ভাত খায়, আমরাও তো ভাতই খাই। ওরা পারলে আমরা কী দোষ করেছি? থাইল্যান্ডের মানুষ নাকি খুব নরম মনের। তারা সহিংসতার বিরুদ্ধে। এ ব্যাপারে বাঙালির সুনামও কিন্তু কম নয়। আমরা যেমন সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ করে দেশের স্বাধীনতা এনেছি, তেমনি আবার শান্তিপূর্ণ, সাদামাটা জীবন যাপনেও অভ্যস্ত। পূর্বদেশীয় সংস্কৃতি যদি থাইল্যান্ডকে উতরে নিয়ে যেতে পারে, বাংলাদেশকেও পারবে।
এই লেখা যেদিন প্রকাশিত হবে, সেদিন, বুধবার বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সারা দিন গণ-অনশন করবে। হরতালের চেয়ে ভালো কর্মসূচি। বিএনপি হয়তো পল্টন ময়দানেই এই অনশন করত। কিন্তু গত বছরের ২৫ জুলাই তারা পল্টন ময়দানে অনশন কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েও তা করতে পারেনি। কারণ, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ অনুমতি দেয়নি। তারা তখন বাধ্য হয়ে মুক্তাঙ্গনে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছিল। গত এক বছরে পরিস্থিতি অনেকটা বদলে গেছে। এখন সরকারের প্রতি মানুষের সমর্থন আগের চেয়ে কম। এ অবস্থায় বিএনপি যে পল্টনের মতো বড় মাঠ ছেড়ে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে গেছে, সেটাই যথেষ্ট। এই কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে হয়ে যাক, এটাই কাম্য।
গণতন্ত্রে সভা-সমাবেশ, বিক্ষোভ, অনশন হবেই। হরতাল এড়িয়ে চলাই আসল ব্যাপার। সরকার যদি ভাবে যে কাউকে মাঠে নামতে দেওয়া হবে না, তাহলে ভুল করবে। আজকাল মানুষের চোখ-কান খোলা। বাংলাদেশ তো আর ধনী দেশ না যে জনজীবনে সুখের বন্যা বয়ে যাবে। দেশ যখন গরিব, সমস্যাও তেমন বেশি থাকবে। আজ যে বাজারে জিনিসপত্রের অগ্নিমূল্য, তা তো নতুন কিছু নয়। দেশের মানুষের নুন আনতে পান্তা ফুরায় চিরকালই। তাই অভাব-অভিযোগ জানানোর সুযোগ দিতেই হবে। রাজপথে পুলিশ নামিয়ে লাঠি মেরে মাথা ফাটিয়ে পুলিশি রাজত্ব চলতে পারে, গণতন্ত্র নয়।
মালয়েশিয়ায় হয়তো ওরকম চলতে পেরেছে। মাহাথির মোহাম্মদের নেতৃত্বে সেখানে বিরাট উন্নতি হয়েছে। সেখানে বিরোধী দলকে সহজে কথা বলতে দেওয়া হয় না। এটাই সেখানকার রীতি হয়ে গেছে। সংসদ আছে, নির্বাচনও হয়, তবে বিরোধী দলের অস্তিত্ব একেবারেই ক্ষীণ। সংসদীয় একনায়কত্বের এক পীড়াদায়ক নমুনা হলো মালয়েশিয়া। কেউ ভাবতে পারেন, সেখানে যদি বিরোধী দলকে ডান্ডাপেটা করে, দাবড়িয়ে রেখে অর্থনৈতিক উন্নয়ন করা যায়, তাহলে সেই মডেল বাংলাদেশে চলবে না কেন? বাংলাদেশের কোনো দল এ রকম চিন্তা করলে বিরাট ভুল হবে। কারণ, মালয়েশিয়ার পরিস্থিতি বাংলাদেশ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেখানে বিরোধী দলকে চাপে রাখলেও অর্থনীতিতে যে অভাবনীয় উন্নতি করেছে, বাংলাদেশে সে রকম হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে।
নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর গত দেড় যুগ ধরে কেবল রাজনৈতিক ঝগড়াই চলছে, মানুষের আয়-উন্নয়ন কি হয়েছে? কয়টা লোকের নতুন চাকরির সুযোগ বেড়েছে? আয় যদি ১০ টাকা বেড়েছে, তো জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে তার দুই-তিন গুণ। সুতরাং মালয়েশিয়ার স্বপ্ন দেখে লাভ নেই। সিঙ্গাপুরের কথা না-ই বা বললাম। সেখানেও বিরোধী দলের অস্তিত্ব প্রায় নেই। কিন্তু আছে বিপুল উন্নয়ন।
এ ব্যাপারে কারও কোনো দ্বিধা থাকা উচিত নয় যে বাংলাদেশে ওসব চলবে না। এখানে গণতন্ত্র মানে সভা-সমাবেশ, ক্ষোভ-বিক্ষোভ প্রকাশের অধিকার। উন্নয়ন হলে ক্ষোভ কমবে, না হলে বাড়বে। পাঁচ বছর পর পর নির্বাচনে ক্ষমতার হাতবদল প্রায় নিয়মে পরিণত হয়েছে। এই বাস্তবতা অস্বীকার করার চেষ্টা বৃথা।
বরং ক্ষমতায় এসে অন্তত পাঁচটা বছর ভালোভাবে দেশ চালানো, ঘুষ-দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই জনসমর্থন ধরে রাখা সম্ভব। এর মধ্য দিয়ে উন্নয়ন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসবে।
একটা ভালো সরকারের জন্য এর চেয়ে ভালো কৌশল আর কী হতে পারে?
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com
No comments