প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য-সুন্দরবনের পরাজয়ের পর by মোহীত উল আলম

আমরা, এবং কিছুটা ভারত, চেষ্টা করেছিলাম সুন্দরবনকে প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্যের একটি করার জন্য। পারলাম না। যে সাতটি নতুন স্থান নির্বাচিত হয়েছে সেগুলো হলো আমাজন নদী, ভিয়েতনামের হালং বে, আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের সীমান্তবর্তী ইগুয়াজু জলপ্রপাত, দক্ষিণ কোরিয়ার জেজু দ্বীপ, ইন্দোনেশিয়ার কোমাডো জাতীয় উদ্যান, ফিলিপিনসের পুয়ের্তো প্রিন্সেসা নামের ভূগর্ভস্থ নদীটি,


এবং দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত টেবল মাউন্টেন বা টেবিল পর্বত। টিভি থেকে যতটুকু পর্বতটাকে দেখেছি ততটুকুতেই মনে হয়েছে, এটি শুধু প্রকৃতি প্রদত্ত একটি রাজকীয় ভোজসভার টেবিল নয়, এটার দাঁড়ানোর মধ্যে একটি ভয়ংকর সমীহ জাগানোর ব্যাপার আছে।
সৌন্দর্য ও ভয়ংকরতা মিলে যা হয়, যাকে ইংরেজ কবি উইলিয়াম ব্লেইক ‘ফিয়ারফুল সিমেট্রি’ (ভয় জাগানিয়া সমন্বিত সৌন্দর্য) বলেছিলেন তাঁর বিখ্যাত ‘টাইগার’ কবিতাটিতে, এবং যাকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ‘ভয়ংকর সুন্দর’ নামে অভিহিত করে একটি কিশোর উপন্যাস রচনা করেছিলেন, যে ভয়ংকর সুন্দরের উপস্থিতি আমরা প্রাচীন সপ্তাশ্চর্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত মিসরের মমি কিংবা পিসা নগরের হেলানো মন্দিরে দেখতে পাই, সে ভয়ংকর সৌন্দর্য সুন্দরবনকে প্রচারিত করার ক্ষেত্রে আমরা উপস্থিত করতে পারিনি বলে যুদ্ধে জিততে পারিনি।
শুধু নিপাট রোম্যান্টিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হলে সপ্তাশ্চর্যের তালিকায় টিকে থাকা মুশকিল; সে রকম হলে পৃথিবীর বহু জায়গা আছে, যেমন ক্যারিবিয়ান সমুদ্রের দ্বীপপুঞ্জগুলো যেখানে সাগরের নীল পানি, সাদা বালির সৈকত আর নারকেলগাছের সারির সঙ্গে বাঁধা হয়েছে মনোরম রিসর্ট, সেগুলোই পেয়ে যেত ভোট। সুন্দর চাখতে চাখতে একটু ভয় পেতে হবে, এই সংমিশ্রণটা না থাকলে প্রতিযোগিতায় শেষ পর্যন্ত দাঁড়ানো যায় না। অনেকে হয়তো বলবেন, তাহলে ‘তাজমহল’ কীভাবে টিকে গেল? তার মধ্যে ভয়ের কী আছে? অন্যদের কথা বলতে পারব না, তবে আমি ‘তাজমহল’ মোট তিনবার দেখেছি, এবং প্রতিবারই অসম্ভব এক অনির্বচনীয় সৌন্দর্যের সঙ্গে সঙ্গে বোধ করেছি মৃত্যুর হিমশীতল স্পর্শ। আগ্রার খুব গরমের দিনেও, মে কিংবা জুন মাসে, আপনি তাজমহলের সমাধিসৌধের মূল চাতালে উঠে শুয়ে পড়ুন, দেখবেন শ্বেত মার্বেল পাথরের ঠান্ডা স্পর্শে আপনার গা জুড়িয়ে যাচ্ছে। মৃত্যুর সময় সম্ভবত এ রকম গা জুড়িয়ে যাওয়ার খেলা থাকে। জানি না, জানব আর কী?
কিন্তু সুন্দরবন ভ্রমণে গেলে খাপছাড়াভাবে আপনি একটা নৈরাশ্যের শিকার হবেন। কারণ সাদামাটা পর্যটক হিসেবে গেলে আপনি কখনো সে বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার বা ডোরাকাটা হলুদ বর্ণের বাঘমামার দেখা পাবেন না। বাঘমামা দূরে থাক, তার থাবার দাগও খুঁজে পাবেন না (হয়তো অনেকে জানেন, স্থানীয় বনবাসীরা বাঘকে বাঘ বলে না, বলে মামা)। বাঘ দেখতে চাইলে ওরা কৌতুক করে বলে, মামাকে দেখতে না পাওয়াই ভালো, কারণ ওইটাই হয়তো হয়ে যাবে শেষ দেখা। যে দেখায় জীবন চলে যেতে পারে সে ধরনের দেখার কথা বলছি না, বলছি বাঘ দেখার ব্যবস্থা থাকার কথা। সুন্দরবন চার দিনের প্যাকেজ টুরে ঘুরে এসে আপনার মনে হবে, সুন্দর নদী, খাল, খাঁড়ি ও বৃক্ষাবৃত প্রাকৃতিক নিসর্গে আপনি একটি পোস্টকার্ডের ছবির মতো জীবন যাপন করলেন। কিন্তু কোথাও কোনো ভয় ছিল না, কোনো ঝুঁকি ছিল না। সে জন্য সুন্দরবন ভ্রমণটা উন্নততর একটি পিকনিক মনে হয়, কিন্তু অ্যাডভেঞ্চার করলাম মনে হয় না। আবার আরেকটা উপায় আছে, সেটা হলো ক্যামেরা এবং বন্দুক নিয়ে, ভাতের মোচা বেঁধে রাতের পর রাত গাছে মাচা বেঁধে থাকা। গাছের নিচে একটা ছাগল বেঁধে রেখে তারপর বাঘমামার জন্য অপেক্ষা করা। ইদানীং সুন্দরবনের দৃশ্যাবলির ওপর ন্যাশন্যাল জিওগ্রাফিক ও ডিসকভারি চ্যানেল দুটো কি তিনটে ছবি বানিয়েছে, যেগুলো ওরা ঘুরেফিরে কিছুদিন পরপর দেখায়। চিত্রগ্রাহকদের বর্ণনায় বুঝতে পেরেছি, তাদের দীর্ঘ সময় ধরে রাতের পর রাত মাচা বেঁধে বনের ভেতর মশার কামড় খেয়ে থাকতে হয়েছে। তার পরও ছবিগুলোতে বাঘমামার উপস্থিতি তার খ্যাতির তুলনায় খুব কম।
সুন্দরবন নিশ্চয় আফ্রিকার সেরেংগেটি, ক্রুগার, কালাহারি, ইতোশা বা সাহারা ন্যাশন্যাল পার্কের মতো অতটা ভয়ংকর বনাঞ্চল নয়। কিন্তু ওখানে বনের ভেতরে গিয়ে খুব কাছ থেকে পশুর রাজা সিংহ, পশুদলের ভিম গন্ডার, কিংবা পশুদলের খলনায়ক হায়েনা বা সুন্দরী লম্ফঝম্পের ওস্তাদিনী টমসন গ্যাজেল বা নিষ্পাপ চিত্রল হরিণী, কিংবা পশুর দলের জনতা ওয়াইল্ডার বিস্ট, কিংবা পাঁচ টনী হাতি, কিংবা করাত দাঁতওয়ালা নীল নদের কুমির, কিংবা জলহস্তি, সাপ, মনিটর প্রায় সবই গাড়ির কাচের নিরাপদ দূরত্বে থেকে অবলোকন করা যায়, ছবি নেওয়া যায়, গবেষণা করা যায়। জীবজন্তু, পক্ষিশ্রেণী, সরিসৃপ ও কীটপতঙ্গের জীবনবৃত্তান্ত সংগ্রহ ও দেখানোর জন্য পর্যটনবিজ্ঞানীরা এসব বনাঞ্চলের কর্তৃপক্ষের দেওয়া সব রকম সুযোগ-সুবিধার অকাতর ব্যবহার করেন। সিংহ যখন জিপের সামনে মুখ ব্যাদান করে হামলে পড়ে, কাচের ওপর আঁচড়ায় তখন ভ্রমণকারীদের শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে যায়, তার পরও ভ্রমণকারীরা জানে যে এ ভয়টা নিছক ইন্দ্রিয়গত, যৌক্তিক ভয় না, এবং তাদের পাওনা হয়ে যাচ্ছে সারা জীবনের জন্য এক অনুপম অভিজ্ঞতা। তাই তাদের ভয় পাওয়ার অভিজ্ঞতাও হয়, আবার ভয় থেকে বেরিয়ে আসার অভিজ্ঞতাও হয়। কিন্তু সুন্দরবন নিছক পর্যটক হিসেবে ঘুরে এলে মিরপুর চিড়িয়াখানায় বাঘের খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে যে ভয়টা হয়, তার কণামাত্রও হয় না। ‘সুন্দরবনে গেলাম, অথচ রয়েল বেঙ্গল টাইগারের দেখা পেলাম না’—এটি যখন মন্তব্যাকারে সপ্তাশ্চর্য বিচারকারী আন্তর্জাতিক কমিটির কাছে পৌঁছাবে, সেটিই বিশ্বজনমত হিসেবে তৈরি হবে এবং তখন সুন্দরবন নেতিবাচক প্রচারণার শিকার হয়ে প্রতিযোগিতা থেকে বাদ পড়বে, যা বস্তুত হয়েছেও।
ভোটের হিসাবটা কী রকম জানি না। কিন্তু ভারত-বাংলাদেশ মিলে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশ, সেখানে সুন্দরবন ভোট গণনায় হারতে পারে সেটা আমার মনে হয় না, মনে হয় হেরে গেছে ‘পর্যটন-প্রচারণা’, ‘ভ্রমণ-সুবিধা’ ও ‘ভৌগোলিক অবস্থানের দুর্গমতা বা সুগমতা’র বিবেচনায়।
এ পর্যায়ে আলাপে এসে যাচ্ছে আমাদের পর্যটনশিল্প নিয়ে কথাবার্তা। পর্যটনশিল্পের ভাষা হচ্ছে পোস্টকার্ডের উল্টোপিঠের ছবির মতো। যত পোস্টকার্ড, তত পরিচিতি। বিদেশে যেকোনো পর্যটনের জায়গা ঘুরতে গেলে পোস্টকার্ড অ্যালবাম কিনতে কিনতে হাত ভরে যায়। অথচ বিদেশি পর্যটকেরা বাংলাদেশ ঘুরতে এসে সুন্দরবনের পোস্টকার্ড কিনতে পারে কি না সন্দেহ। সুন্দরবনকে পর্যটকভোগ্য বা ভ্রমণ-উপযোগী করে তোলার জন্য এবং এর ভেতরের ভয়-জাগানিয়া ব্যাপারটাকে তুলে ধরার জন্য বড় অঙ্কের বিনিয়োগ দরকার। বলাবাহুল্য, এ আশকারার কোনো জায়গা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক চালচিত্রে আছে বলে মনে হয় না। দ্বিতীয়ত, ন্যাশন্যাল জিওগ্রাফিক বা অন্যান্য চ্যানেল কর্তৃক তৈরি ছবিগুলোর বেদনা আছে অন্য জায়গায়, বাঘ দেখানো নয়, মানুষ যে বন দখল করে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করছে, সেটি দেখানোয়। বস্তুত কোনো একটা ছবিতে এক জায়গায় এমন কথাও আছে যে রয়েল বেঙ্গল টাইগার প্রজাতিটি খেতে না পেয়ে তাদের স্বাভাবিক শারীরিক আয়তন হারিয়ে ফেলছে। আর বাঘ কর্তৃক নরদেহ শিকারের প্রতিটি ঘটনায় উল্লেখ করা হয়েছে, মানুষ এসে বাঘের রাজ্যে ঢুকে পড়ছে বলে এ দুর্ঘটনাগুলো হচ্ছে। তাই এই ছবিগুলো যখন বিশ্ব চ্যানেলগুলোয় প্রদর্শিত হয়, তখন সুন্দরবন নিয়ে আমাদের অব্যবস্থাপনা ধরা পড়ে।
ভৌগোলিক অবস্থানের সুগমতা ও দুর্গমতা নিয়ে একই কথা বলতে হয়। যোগাযোগ ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা ঠিক থাকলে বাঘের গুহার সামনে গিয়ে বাঘ দেখে নিরাপদে ফিরে আসা যায়। নায়াগ্রা জলপ্রপাতের বিশাল কান্না মানুষ কি কাছে গিয়ে শুনতে পারছে না! আমাদের ক্রিকেটারদের মুখে শুনেছি, জিম্বাবুয়ে গিয়ে তাঁরা ভিক্টোরিয়া ফলস (স্থানীয় ভাষায় ‘মোসোয়া টুন্যা’) দেখে আসতে পারেন। অথচ জিম্বাবুয়ে ও জাম্বিয়ার সীমান্তের মাঝখানে এ জলপ্রপাতটি পৃথিবীর একটি অতিদুর্গম খাঁড়ির মধ্যে অবস্থিত। শুধু তাই নয়, ওই খাঁড়িতে প্রবাহিত জাম্বেসি নদীর ওপর বাঙ্গি জাম্পিং বা পায়ে দড়িবেঁধে লাফ দিয়ে খরস্রোতা নদীর পানির ওপর দুলতে পারার ব্যবস্থাও নাকি আছে! ওই লাফটি দেওয়ার জন্য অবশ্য বুকের কলজের দরকার।
সুন্দরবনে এ ধরনের অভিযাত্রিক হওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। সুন্দরবন খুবই সুন্দর, সেন্ট মার্টিন দ্বীপ বা কক্সবাজারের চেয়ে সুন্দর হয়তো বা, কিন্তু এর যোগাযোগব্যবস্থা খুব দুর্বল এবং এর অপার সৌন্দর্য উপভোগ করার কোনো পর্যটনসুলভ ব্যবস্থাও নেই। অর্থাৎ প্রাকৃতিক কারণে নয়, সুন্দরবন হারল আমাদের উদাসীনতার দোষে।
মোহীত উল আলম: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি, ইউল্যাব, ঢাকা
mohit_13_1952@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.