আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-৬১)-স্বাধীন হতে হলে একটি যুদ্ধ অনিবার্য by আলী যাকের

আমরা আসলেই পাকিস্তানিদের মনমানসিকতা জানতাম না। তাদের চিন্তাধারার সঙ্গে আমাদের চিন্তাধারার বিস্তর ফারাক ছিল। পাকিস্তানি সামন্তবাদী সমাজ স্পষ্টতই দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। সামন্ত প্রভুরা সাধারণ মানুষকে মানুষ বলেই গণ্য করত না। বস্তুতপক্ষে এখনো করে না। অথচ বাংলাদেশের সমাজে একজন মানুষ যত ওপরেই উঠুন না কেন, তার শরীরের ত্বক ঘষলেই ভেতর থেকে বাংলার মাটির সোঁদা গন্ধ বেরিয়ে আসে।


তা সত্ত্বেও এই বিভাজিত দুই জাতি কী করে একটি দেশের অন্তর্গত হলো, কেবল একটি ধর্মের ভিত্তিতে, সেটি বুঝতে এখনো আমি অপারগ। পাকিস্তানের স্রষ্টা জিন্নাহ্ সাহেব সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার অনেক বাইরে বাস করতেন। তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল বিলেতি সাহেব-সুবাদের সঙ্গে অথবা ভারতীয় জমিদার নন্দনদের সঙ্গে। অতএব, তিনি সহজেই সমাদৃত হয়েছিলেন অবাঙালি আশরাফ শ্রেণীর মুসলমানদের দ্বারা। কিন্তু বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ জিন্নাহর মনমানসিকতা কখনোই বুঝত না। তাদের বাংলাদেশের মুসলমান সামন্ত প্রভুরা বুঝিয়েছিল যে তোমরা যদি পাকিস্তানের পক্ষে ভোট প্রদান করো, তাহলে হিন্দু জমিদাররা এই ভূখণ্ড থেকে বিতাড়িত হবে এবং ফলে তোমরা সবাই জমিদার হয়ে যাবে। বেচারা খেটে খাওয়া কৃষক শ্রেণী, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, 'শুধু দুটি অন্ন খুঁটি কোনোমতে কষ্টক্লিষ্ট প্রাণ/রেখে দেয় বাঁচাইয়া। সে অন্ন যখন কেহ কাড়ে,/সে প্রাণে আঘাত দেয়, গর্বান্ধ নিষ্ঠুর অত্যাচারে,/নাহি জানে কার দ্বারে দাঁড়াইবে বিচারের আশে,/দরিদ্রের ভগবানে বারেক ডাকিয়া দীর্ঘশ্বাসে/মরে সে নীরবে।' অতএব, গণভোট যখন এলো, তারা দল বেঁধে গিয়ে পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দিল। এর পরপরই ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্ট আমরা পূর্ব পাকিস্তান হয়ে গেলাম। ১৯৪৮_এই আপামর সাধারণ বাঙালি মুসলমানরা আবিষ্কার করল যে পাকিস্তানে তাদের ভাগ্যোন্নয়ন তো হয়ইনি বরং তাদের আজন্ম লালিত সংস্কৃতিকে পাকিস্তানিরা কেড়ে নিতে চাচ্ছে। ভাষার ওপর আক্রমণ দিয়ে এই দুরভিসন্ধির সূচনা। '৭১-এ এসে তখন প্রায় সব বাঙালি বুঝে গেছে, পাকিস্তানের সঙ্গে একসঙ্গে থাকা আর সম্ভব নয়। আমরা কয়েকজন বন্ধু নানা তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়ে এই আন্দোলনে আমাদের ভূমিকা সম্পর্কে একটি ঐকমত্যে পেঁৗছানোর চেষ্টা করতাম। তত দিনে আমরা সবাই বুঝে গেছি, পাকিস্তানিরা সহজে আমাদের দেশ ছেড়ে চলে যাবে না। ওদের কাছ থেকে স্বাধীন হতে হলে একটি যুদ্ধ অনিবার্য। বঙ্গবন্ধু বলেছেন, 'তোমাদের যার যা আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকবা।' কিন্তু আমাদের কীই-বা আছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী বিশ্বের সেরা অস্ত্র দ্বারা সজ্জিত এবং এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয়, তারা মানুষ মারতে দ্বিধা করে না। অতএব, তাদের সঙ্গে সম্মুখ সমরে যেতে হলে আমাদেরও অস্ত্রের দরকার। তখনকার ওই তরুণ মাথায় কিছুতেই ভাবতে পারি না কিভাবে এই অস্ত্র সংগ্রহ সম্ভব।
এমন সময় আমাদের এক পরিচিতজন বললেন, তাঁর এক বন্ধু আছে, যিনি হাতবোমা তৈরি করতে সিদ্ধহস্ত। আমরা মহা উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। সবাই চাঁদা তুলে এ উদ্যোগ গ্রহণে সহায়তা করলাম। কিছুদিনের মধ্যে বোমা তৈরি হয়ে আমাদের হাতে এলো। তারপর মগবাজারের রেলক্রসিংয়ের অদূরে হাতিরঝিলের ওখানে রাতের অন্ধকারে বোমাগুলো ছুড়ে তার শক্তি পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখি একটিও ফুটছে না। ভগ্নহৃদয়ে যখন সায়েন্স অ্যানেক্স বিল্ডিংয়ের ১১৯ নম্বর ঘরে ফিরলাম তখন সেই বোমা প্রস্তুতকারী যুবক আমাদের বললেন, তিনি আমাদের জন্য বড় ধরনের এক্সপ্লোসিভ তৈরি করে দিতে পারেন। নেগেটিভ ও পজিটিভ তারের ঘর্ষণের মাধ্যমে যেটা ফাটানো সম্ভব এবং যাতে পাকিস্তানি ট্যাংক উড়িয়ে দেওয়া যায়। আমরা আবার চাঁদা তুলে তাঁকে ওই এঙ্প্লোসিভ তৈরির কাজে নিযুক্ত করলাম। তিনি কিছুদিনের মধ্যেই এক্সপ্লোসিভটি রাতের অন্ধকারে আমাদের হাতে তুলে দিলেন। তখন গোটা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা অত্যন্ত গরম হয়ে উঠেছে। শহীদ মিনারে দেশাত্মবোধক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলছে বৈকি, কিন্তু প্রত্যেকের মনেই আসন্ন বিপদের ছায়া বসে গেছে। ওই রাতেরই ১২-১টা হবে, আমরা সবাই মিলে আমার সেই আধভাঙা ফক্স ওয়াগন গাড়িতে ফুলার রোডে একটি জায়গায় একটি পরিত্যক্ত পানির ট্যাংক খুঁজে পেলাম। ইস্পাতের তৈরি ওই পানির ট্যাংক দিয়ে ব্যারিকেড রচনা করা হয়েছে। আমরা চুপিসারে ওই পানির ট্যাংকের ভেতরে এক্সপ্লোসিভটি স্থাপন করলাম। তারপর তার দুটি নিয়ে দূরে চলে গেলাম। গাড়িটিও সরিয়ে নেওয়া হলো। তারের নেগেটিভ ও পজিটিভের ঘর্ষণে বিকট শব্দে এক্সপ্লোসিভটি ফাটল। আমরা কাছে এসে দেখলাম, পানির ট্যাংকটি ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। আমাদের মনে আনন্দ আর ধরে না। শিগগিরই পাকিস্তানিদের শায়েস্তা করা যাবে, এই ভেবে আমরা আহ্লাদে আটখানা।
দেখতে দেখতে সময় গড়িয়ে চলল। বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গুলিতে নিরস্ত্র বাঙালি নিহত হতে লাগল অবলীলায়। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সারা বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে অসহযোগ তখন তীব্র আকার ধারণ করেছে। একেক সময় মনে হতো এক্ষুনি ঝাঁপিয়ে পড়ি যেখানেই পাকিস্তানি আর্মির দেখা পাই। বাংলাদেশের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়ার সব পরিবহন ব্যবস্থা অনিয়মিত হয়ে পড়ল। এমনি এক দিনে ওয়াহিদ ভাই, প্রয়াত রবীন্দ্রসংগীত বিশেষজ্ঞ ওয়াহিদুল হক, আমাদের আড্ডায় এসে বললেন যে সন্জীদা আপা আটকা পড়েছেন রংপুর কারমাইকেল কলেজে। তিনি তখন সেখানকার অধ্যাপক। যেহেতু পরিবহন ব্যবস্থার এই অবস্থা, আমরা কিছু করতে পারি কি না? আমরা ঠিক করলাম, আমার ওই আধভাঙা গাড়ি নিয়েই রংপুরে যাব।
(চলবে...)

লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.