সাংঘর্ষিক রাজনীতি এড়াতে হলে কিছু মৌলিক বিষয়ে ঐকমত্য দরকার-ধর নির্ভয় গান by আলী যাকের
কিছু মূল্যবোধ, কিছু আদর্শের ওপর নির্ভর করেই এই দেশটির স্বাধীনতার জন্য ১৯৭১-এ সব মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সেই আদর্শ ছিল যে, এই দেশ হবে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী, গণতান্ত্রিক এবং আবহমান বাঙালির চেতনাসমৃদ্ধ। এসবই হচ্ছে আমাদের জন্মলগ্ন থেকে ধারণ করা কতগুলো মৌলিক বিষয়।
এ বিষয়ে সব রাজনৈতিক দলকে ঐকমত্যে পেঁৗছাতে হবে। তাহলেই কেবল আমরা পরীক্ষা করে দেখতে পারব এই দেশের অগ্রাভিযানে কাদের প্রস্তাবিত ব্যবস্থা বেশি গ্রহণযোগ্য
আজকাল বিভিন্ন আলোচনা কিংবা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে কথামালার প্রদর্শনীতে রাজনীতি নিয়ে বিস্তর কথাবার্তা হয়ে থাকে। বাঙালিরা তো সবসময়ই রাজনীতিস্পৃষ্ট। বস্তুতপক্ষে আমাদের জীবনে রাজনীতি না থাকলে জীবনটা কেমন যেন পানসে হয়ে যায়। আমরা ঢিলেঢালাভাবেও যখন আড্ডায় বসি, তখন গল্প যা দিয়েই শুরু হোক না কেন, ঘুরেফিরে ওই রাজনীতির চর্চাতেই পেঁৗছে যাই আমরা। ওইসব আলোচনা-সমালোচনাতে আমরা নিত্যই কত রাজা-উজির বধ করি। যার কোনো কাজ কি উক্তি পছন্দ হয়, তাকে বাহবা দেই, আবার অপছন্দ হলে সমালোচনার তোড়ে উড়িয়ে দেই। ওইসব সময়ে এমন মনে হয় যেন আমরা রাজনীতি বিষয়টিকে রাজনীতিবিদদের চেয়েও ভালো বুঝি। আমি অবশ্য এ কথা স্বীকার করি যে, আজকের বাংলাদেশে এমন অনেক রাজনীতিবিদ আছেন, যারা রাজনীতির শিক্ষা-দীক্ষা কি প্রজ্ঞায় একেবারে ঈশ্বরের দান_ এমন কথা বলা যাবে না। তবুও একজন মানুষ যখন সার্বক্ষণিকভাবে একটি কাজ দীর্ঘদিন ধরে করতে থাকেন এবং সেই কাজ করতে গিয়ে নিত্যই নানা ধরনের মানুষের সংস্পর্শে আসেন, তখন ওই চর্চার ফলে তাদের রাজনৈতিক জ্ঞান কিছুটা হলেও বৃদ্ধি পায়। তারা রাজনীতির ক্ষেত্রে স্বশিক্ষিত হয়ে ওঠেন। ফলে সবসময় কারণে-অকারণে তাদের তু্চ্ছ-তাচ্ছিল্য করা বোধহয় সঙ্গত নয়। তবুও আমরা বলি। নিত্যই বলি। বুঝি বা না বুঝি, বলায় ক্লান্তি নেই আমাদের। আর সাম্প্রতিককালে গণমাধ্যমগুলোর আগ্রহে এবং আনুকূল্যে আমরা সকলেই প্রায় বড়সড় আকারের একটা জানালা পেয়ে গেছি। সেই জানালা দিয়ে আমরা অহরহ সবার সামনে নিজেদের তুলে ধরছি। বলছি, আমাকে দেখুন। আবার ওই জানালাই আমাদের জন্য আয়না হয়ে উঠছে। সেখানে প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় নিজেদের প্রতিফলিত হতে দেখে আমরা পুলকিত হচ্ছি। শিহরিত হচ্ছি। আরও কথা বলার জন্য, বেশি বেশি কথা বলার জন্য লালায়িত হচ্ছি। আর যত বেশি কথা বলছি, তত অবান্তর কথা বলছি, অর্থর্হীন কথা বলছি। শেষমেশ আমাদের কথা, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, পরিণত হচ্ছে 'অর্থহারা ভাবে ভরা ভাষা'য়। কথায় কথা বাড়ছে। তাতে করে সমাজের বিশেষ কিছু আসছে যাচ্ছে না। কিন্তু ফল্গুধারার মতো কথার প্রস্রবণ হয়েই চলেছে। কথা চলছে তো কথা চলুক! পছন্দ হলে যারা শুনতে চান তারা শুনবেন। আর যারা শুনতে বা দেখতে চান না, তারা কান, চোখ বন্ধ করে রাখুন। যার যেমন অভিরুচি। তাহলে কথা বলা চলুক। চলতে থাকুক। তবে একটি কথা। কথা যদি বলতেই হয় তাহলে ভেবেচিন্তে, বিচার-বিশেল্গষণ করে কথা বলা ভালো।
সম্প্রতি আমরা সবাই আমাদের দেশে সংঘর্ষের রাজনীতি কিংবা রাজনীতিতে সংঘর্ষ নিয়ে বড়ই বিচলিত আছি। এ বিষয়ে নানা স্তরের নানা জন, অধিকাংশই নামিদামি ব্যক্তি, নানারকম কথা বলছেন। তবে লক্ষ্য করা সম্ভব হবে যে, সকলেই একটি বিষয়ে জোর দিচ্ছেন খুব। আর তা হলো নানা মত, নানা পথের রাজনীতির মধ্যে বোঝাপড়ার মাধ্যমে একটি ঐকমত্যে পেঁৗছানো দরকার আর কালবিলম্ব না করে। নয়তো সর্বনাশ অনিবার্য। এমত ধারণার সঙ্গে কারও দ্বিমত থাকার কথা নয়। আমরা সকলেই মনে করি যে, সংঘর্ষ আমাদের জন্য কোনো সুফল বয়ে আনবে না। অতএব, একটি টেবিলের দু'পাশে বসে সাংঘর্ষিক দুটি মতকে ঐকমত্যে পেঁৗছাতেই হবে। এখানে এসেই একটু হোঁচট খেলাম। পেঁৗছাতে তো হবে, কিন্তু পেঁৗছব কীভাবে? দুই মতধারী দু'জনের অবস্থান যদি দুই মেরুতে হয়, তাহলে পেঁৗছানো দুষ্কর বৈকি। এই কারণেই যারা কথা বলেন কিংবা কথা বলতে ভালোবাসেন তাদের একটু ভেবে দেখা দরকার যে, এই দুই ভিন্নমতাবলম্বীকে দুই মেরু থেকে কী করে বিষুবরেখার ওপর নিয়ে আসা যায়। সেটা কেবল তখনই সম্ভব যখন বৈরী দুই মতের প্রত্যেকেই সামান্য কিছু ছাড় দিতে রাজি থাকেন। যেমন জাতীয় সংসদে কোন আসনে কয়জন বসবেন সেটা বড় কথা নয়, যে আসনে যিনিই বসুন, তিনি সংসদের কাজে কতটুকু অবদান রাখছেন, সেটিই মোদ্দা কথা। তো আসন হারানোর শোকে যদি সংসদে যাওয়াই বন্ধ করে দেওয়া হয়, তাহলে সংসদকে কার্যকর রাখা কীভাবে সম্ভব? কিন্তু আমরা দেখি যে, কিছু কিছু রাজনীতিবিদদের জন্য জাতীয় সংসদের চেয়ে সেই সংসদের আসবাবপত্র যেমন, আসন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দেয়। যারা রাজনীতি নিয়ে কথাবার্তা বলেন তাদের কাছে আমাদের অনুরোধ যে, তারা যেন বিষয়টি আরেকটু সূক্ষ্মভাবে বিচার-বিশেল্গষণ করেন। এই যে সংসদের আসন নিয়ে বিতর্ক কিংবা জনপথে জনসভা কেন করতে দেওয়া হচ্ছে না, তাই নিয়ে গোসা, এসব কিন্তু বাহুল্য কথা। আসল কথা হলো, যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা। তুমি যাই বলো না কেন, ভালো কি মন্দ, আমার সিদ্ধান্ত, আমি তোমার কথা শুনব না। অতএব, তেলে-জলে কখনই মিশ খাবে না। আমার নিবেদন, আমাদের বুদ্ধিজীবীদের কাছে, রাজনীতিবিদদের কাছে এবং গণমাধ্যমগুলোর কাছে যে, কেবল কথা না বলে কথার সারবত্তা সম্বন্ধে একটু সচেতন হওয়ার সময় বোধহয় এসে গেছে। প্রথমেই রাজনীতির সঙ্গে সংশিল্গষ্ট সবাইকে কতগুলো মৌলিক বিষয়ে একমত হতে হবে। কেবল তাহলেই ঐকমত্যের চেষ্টা চালানো সম্ভব।
প্রসঙ্গত আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি থেকে দু'একটি দৃষ্টান্ত এখানে হাজির করতে চাই। আমরা সকলেই জানি যে, ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে একটি যুদ্ধ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্বাধীনতা লাভ করেছিল। সেই যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মার্কিন দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি জর্জ ওয়াশিংটন। আজকের আমেরিকায় সব বর্ণের এবং মতের রাজনীতিবিদই এ কথা নিদ্বর্িধায় স্বীকার করেন যে, জর্জ ওয়াশিংটন ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার প্রতীক। এক কথায়, তিনি ওই দেশটির পিতৃপ্রতিম। এ নিয়ে রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে কোনো বাহাস নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়েছিল একটি ঘোষণাপত্র রচনার মাধ্যমে। যাকে ইংরেজিতে বলা হয় ইউনিল্যাটারেল ডিক্লারেশন অব ইনডিপেন্ডেন্স। এই ঘোষণাপত্রটিকে ওই দেশের সব মতাবলম্বী রাজনীতিবিদই মেনে চলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেই সূচনা সময় থেকেই একটি সংবিধান দ্বারা পরিচালিত। এই সংবিধানের অস্তিত্ব এবং ক্ষমতা সম্বন্ধে কোনো দলেরই দ্বিমত নেই। এ ধরনের আরও একাধিক মৌলিক বিষয়ে যত রাজনৈতিক বিতর্কই থাকুক না কেন, কারও কোনো দ্বিমত পোষণ করতে শোনা যায় না।
এবারে আমাদের পাশের রাষ্ট্র ভারতের দিকে দৃষ্টি ফেরাই। আমরা সকলেই জানি যে, মধ্যমপন্থি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে সেখানকার স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল। আমরা এও জানি যে, মহাত্মা গান্ধী সে দেশের জাতির পিতা। পরবর্তীকালে কংগ্রেসের সঙ্গে বামপন্থি সাম্যবাদীদের এবং উগ্র ডানপন্থি হিন্দুবাদীদের বিস্তর মতপার্থক্য আমরা দেখতে পাই। এমনকি উগ্র ডানপন্থিদের ষড়যন্ত্রেই মহাত্মা গান্ধীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সেই ডানপন্থিদেরই প্রতিভূ ভারতের আজকের রাজনৈতিক দল বিজেপি। বিজেপি যখন ক্ষমতায় ছিল এবং সেই দলের নেতা অটল বিহারি বাজপেয়ি যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখনও আমরা টেলিভিশনে দেখেছি যে, জাতির উদ্দেশে বক্তৃতারত বাজপেয়ির পেছনের দেয়ালে ঝুলছে মহাত্মা গান্ধীর আবক্ষ চিত্র। পাকিস্তানে ঠিক একইভাবে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ছবিও আমরা দেখতে পাই। কেননা সেখানে সবাই বিশ্বাস করে যে, তিনিই ছিলেন পাকিস্তান নামক দেশটির জাতির পিতা। আমাদের এখানে, এই দুর্ভাগা দেশে ১৯৭৫ সালে কতিপয় দুষ্কৃতকরী উর্দিধারীর চক্রান্তে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যা করার পর যে রাজনীতি চালু করা হয় তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পৃক্ত সব মৌলিক বিষয়গুলোকে দিব্যি মুছে ফেলে দেন। তারা আজও বঙ্গবন্ধুকে স্বীকৃতি দেন না, তারা ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় পঠিত বাংলাদেশের ইউনিল্যাটারেল ডিক্লারেশন অব ইনডিপেন্ডেন্সকে মানেন না। তারা যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধার শেষ উচ্চারিত স্লোগান 'জয় বাংলা'কে অবলীলায় অস্বীকার করেন।
কিছু মূল্যবোধ, কিছু আদর্শের ওপর নির্ভর করেই এই দেশটির স্বাধীনতার জন্য ১৯৭১-এ সব মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সেই আদর্শ ছিল যে, এই দেশ হবে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী, গণতান্ত্রিক এবং আবহমান বাঙালির চেতনাসমৃদ্ধ। এসবই হচ্ছে আমাদের জন্মলগ্ন থেকে ধারণ করা কতগুলো মৌলিক বিষয়। এ বিষয়ে সব রাজনৈতিক দলকে ঐকমত্যে পেঁৗছাতে হবে। তাহলেই কেবল আমরা পরীক্ষা করে দেখতে পারব এই দেশের অগ্রাভিযানে কাদের প্রস্তাবিত ব্যবস্থা বেশি গ্রহণযোগ্য। কিন্তু যারা এই দেশের মূল আদর্শকেই পরিহার করেন এবং প্রয়োজনে প্রতিহত করেন, তারা কী করে এ দেশের কল্যাণ কামনা করতে পারেন? আমার আবেদন সকলের কাছে যে, এই বিষয়টি সম্বন্ধে আপনারা বলুন, আপনাদের কথা আমরা সবাই শুনব। নয়তো সংঘর্ষের পথ আরও প্রশস্ত হবে। ক্রমে আমরা হয়তো এই দেশটিকে আর চিনতেই পারব না।
আলী যাকের :সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
আজকাল বিভিন্ন আলোচনা কিংবা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে কথামালার প্রদর্শনীতে রাজনীতি নিয়ে বিস্তর কথাবার্তা হয়ে থাকে। বাঙালিরা তো সবসময়ই রাজনীতিস্পৃষ্ট। বস্তুতপক্ষে আমাদের জীবনে রাজনীতি না থাকলে জীবনটা কেমন যেন পানসে হয়ে যায়। আমরা ঢিলেঢালাভাবেও যখন আড্ডায় বসি, তখন গল্প যা দিয়েই শুরু হোক না কেন, ঘুরেফিরে ওই রাজনীতির চর্চাতেই পেঁৗছে যাই আমরা। ওইসব আলোচনা-সমালোচনাতে আমরা নিত্যই কত রাজা-উজির বধ করি। যার কোনো কাজ কি উক্তি পছন্দ হয়, তাকে বাহবা দেই, আবার অপছন্দ হলে সমালোচনার তোড়ে উড়িয়ে দেই। ওইসব সময়ে এমন মনে হয় যেন আমরা রাজনীতি বিষয়টিকে রাজনীতিবিদদের চেয়েও ভালো বুঝি। আমি অবশ্য এ কথা স্বীকার করি যে, আজকের বাংলাদেশে এমন অনেক রাজনীতিবিদ আছেন, যারা রাজনীতির শিক্ষা-দীক্ষা কি প্রজ্ঞায় একেবারে ঈশ্বরের দান_ এমন কথা বলা যাবে না। তবুও একজন মানুষ যখন সার্বক্ষণিকভাবে একটি কাজ দীর্ঘদিন ধরে করতে থাকেন এবং সেই কাজ করতে গিয়ে নিত্যই নানা ধরনের মানুষের সংস্পর্শে আসেন, তখন ওই চর্চার ফলে তাদের রাজনৈতিক জ্ঞান কিছুটা হলেও বৃদ্ধি পায়। তারা রাজনীতির ক্ষেত্রে স্বশিক্ষিত হয়ে ওঠেন। ফলে সবসময় কারণে-অকারণে তাদের তু্চ্ছ-তাচ্ছিল্য করা বোধহয় সঙ্গত নয়। তবুও আমরা বলি। নিত্যই বলি। বুঝি বা না বুঝি, বলায় ক্লান্তি নেই আমাদের। আর সাম্প্রতিককালে গণমাধ্যমগুলোর আগ্রহে এবং আনুকূল্যে আমরা সকলেই প্রায় বড়সড় আকারের একটা জানালা পেয়ে গেছি। সেই জানালা দিয়ে আমরা অহরহ সবার সামনে নিজেদের তুলে ধরছি। বলছি, আমাকে দেখুন। আবার ওই জানালাই আমাদের জন্য আয়না হয়ে উঠছে। সেখানে প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় নিজেদের প্রতিফলিত হতে দেখে আমরা পুলকিত হচ্ছি। শিহরিত হচ্ছি। আরও কথা বলার জন্য, বেশি বেশি কথা বলার জন্য লালায়িত হচ্ছি। আর যত বেশি কথা বলছি, তত অবান্তর কথা বলছি, অর্থর্হীন কথা বলছি। শেষমেশ আমাদের কথা, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, পরিণত হচ্ছে 'অর্থহারা ভাবে ভরা ভাষা'য়। কথায় কথা বাড়ছে। তাতে করে সমাজের বিশেষ কিছু আসছে যাচ্ছে না। কিন্তু ফল্গুধারার মতো কথার প্রস্রবণ হয়েই চলেছে। কথা চলছে তো কথা চলুক! পছন্দ হলে যারা শুনতে চান তারা শুনবেন। আর যারা শুনতে বা দেখতে চান না, তারা কান, চোখ বন্ধ করে রাখুন। যার যেমন অভিরুচি। তাহলে কথা বলা চলুক। চলতে থাকুক। তবে একটি কথা। কথা যদি বলতেই হয় তাহলে ভেবেচিন্তে, বিচার-বিশেল্গষণ করে কথা বলা ভালো।
সম্প্রতি আমরা সবাই আমাদের দেশে সংঘর্ষের রাজনীতি কিংবা রাজনীতিতে সংঘর্ষ নিয়ে বড়ই বিচলিত আছি। এ বিষয়ে নানা স্তরের নানা জন, অধিকাংশই নামিদামি ব্যক্তি, নানারকম কথা বলছেন। তবে লক্ষ্য করা সম্ভব হবে যে, সকলেই একটি বিষয়ে জোর দিচ্ছেন খুব। আর তা হলো নানা মত, নানা পথের রাজনীতির মধ্যে বোঝাপড়ার মাধ্যমে একটি ঐকমত্যে পেঁৗছানো দরকার আর কালবিলম্ব না করে। নয়তো সর্বনাশ অনিবার্য। এমত ধারণার সঙ্গে কারও দ্বিমত থাকার কথা নয়। আমরা সকলেই মনে করি যে, সংঘর্ষ আমাদের জন্য কোনো সুফল বয়ে আনবে না। অতএব, একটি টেবিলের দু'পাশে বসে সাংঘর্ষিক দুটি মতকে ঐকমত্যে পেঁৗছাতেই হবে। এখানে এসেই একটু হোঁচট খেলাম। পেঁৗছাতে তো হবে, কিন্তু পেঁৗছব কীভাবে? দুই মতধারী দু'জনের অবস্থান যদি দুই মেরুতে হয়, তাহলে পেঁৗছানো দুষ্কর বৈকি। এই কারণেই যারা কথা বলেন কিংবা কথা বলতে ভালোবাসেন তাদের একটু ভেবে দেখা দরকার যে, এই দুই ভিন্নমতাবলম্বীকে দুই মেরু থেকে কী করে বিষুবরেখার ওপর নিয়ে আসা যায়। সেটা কেবল তখনই সম্ভব যখন বৈরী দুই মতের প্রত্যেকেই সামান্য কিছু ছাড় দিতে রাজি থাকেন। যেমন জাতীয় সংসদে কোন আসনে কয়জন বসবেন সেটা বড় কথা নয়, যে আসনে যিনিই বসুন, তিনি সংসদের কাজে কতটুকু অবদান রাখছেন, সেটিই মোদ্দা কথা। তো আসন হারানোর শোকে যদি সংসদে যাওয়াই বন্ধ করে দেওয়া হয়, তাহলে সংসদকে কার্যকর রাখা কীভাবে সম্ভব? কিন্তু আমরা দেখি যে, কিছু কিছু রাজনীতিবিদদের জন্য জাতীয় সংসদের চেয়ে সেই সংসদের আসবাবপত্র যেমন, আসন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দেয়। যারা রাজনীতি নিয়ে কথাবার্তা বলেন তাদের কাছে আমাদের অনুরোধ যে, তারা যেন বিষয়টি আরেকটু সূক্ষ্মভাবে বিচার-বিশেল্গষণ করেন। এই যে সংসদের আসন নিয়ে বিতর্ক কিংবা জনপথে জনসভা কেন করতে দেওয়া হচ্ছে না, তাই নিয়ে গোসা, এসব কিন্তু বাহুল্য কথা। আসল কথা হলো, যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা। তুমি যাই বলো না কেন, ভালো কি মন্দ, আমার সিদ্ধান্ত, আমি তোমার কথা শুনব না। অতএব, তেলে-জলে কখনই মিশ খাবে না। আমার নিবেদন, আমাদের বুদ্ধিজীবীদের কাছে, রাজনীতিবিদদের কাছে এবং গণমাধ্যমগুলোর কাছে যে, কেবল কথা না বলে কথার সারবত্তা সম্বন্ধে একটু সচেতন হওয়ার সময় বোধহয় এসে গেছে। প্রথমেই রাজনীতির সঙ্গে সংশিল্গষ্ট সবাইকে কতগুলো মৌলিক বিষয়ে একমত হতে হবে। কেবল তাহলেই ঐকমত্যের চেষ্টা চালানো সম্ভব।
প্রসঙ্গত আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি থেকে দু'একটি দৃষ্টান্ত এখানে হাজির করতে চাই। আমরা সকলেই জানি যে, ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে একটি যুদ্ধ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্বাধীনতা লাভ করেছিল। সেই যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মার্কিন দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি জর্জ ওয়াশিংটন। আজকের আমেরিকায় সব বর্ণের এবং মতের রাজনীতিবিদই এ কথা নিদ্বর্িধায় স্বীকার করেন যে, জর্জ ওয়াশিংটন ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার প্রতীক। এক কথায়, তিনি ওই দেশটির পিতৃপ্রতিম। এ নিয়ে রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে কোনো বাহাস নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়েছিল একটি ঘোষণাপত্র রচনার মাধ্যমে। যাকে ইংরেজিতে বলা হয় ইউনিল্যাটারেল ডিক্লারেশন অব ইনডিপেন্ডেন্স। এই ঘোষণাপত্রটিকে ওই দেশের সব মতাবলম্বী রাজনীতিবিদই মেনে চলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেই সূচনা সময় থেকেই একটি সংবিধান দ্বারা পরিচালিত। এই সংবিধানের অস্তিত্ব এবং ক্ষমতা সম্বন্ধে কোনো দলেরই দ্বিমত নেই। এ ধরনের আরও একাধিক মৌলিক বিষয়ে যত রাজনৈতিক বিতর্কই থাকুক না কেন, কারও কোনো দ্বিমত পোষণ করতে শোনা যায় না।
এবারে আমাদের পাশের রাষ্ট্র ভারতের দিকে দৃষ্টি ফেরাই। আমরা সকলেই জানি যে, মধ্যমপন্থি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে সেখানকার স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল। আমরা এও জানি যে, মহাত্মা গান্ধী সে দেশের জাতির পিতা। পরবর্তীকালে কংগ্রেসের সঙ্গে বামপন্থি সাম্যবাদীদের এবং উগ্র ডানপন্থি হিন্দুবাদীদের বিস্তর মতপার্থক্য আমরা দেখতে পাই। এমনকি উগ্র ডানপন্থিদের ষড়যন্ত্রেই মহাত্মা গান্ধীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সেই ডানপন্থিদেরই প্রতিভূ ভারতের আজকের রাজনৈতিক দল বিজেপি। বিজেপি যখন ক্ষমতায় ছিল এবং সেই দলের নেতা অটল বিহারি বাজপেয়ি যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখনও আমরা টেলিভিশনে দেখেছি যে, জাতির উদ্দেশে বক্তৃতারত বাজপেয়ির পেছনের দেয়ালে ঝুলছে মহাত্মা গান্ধীর আবক্ষ চিত্র। পাকিস্তানে ঠিক একইভাবে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ছবিও আমরা দেখতে পাই। কেননা সেখানে সবাই বিশ্বাস করে যে, তিনিই ছিলেন পাকিস্তান নামক দেশটির জাতির পিতা। আমাদের এখানে, এই দুর্ভাগা দেশে ১৯৭৫ সালে কতিপয় দুষ্কৃতকরী উর্দিধারীর চক্রান্তে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যা করার পর যে রাজনীতি চালু করা হয় তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পৃক্ত সব মৌলিক বিষয়গুলোকে দিব্যি মুছে ফেলে দেন। তারা আজও বঙ্গবন্ধুকে স্বীকৃতি দেন না, তারা ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় পঠিত বাংলাদেশের ইউনিল্যাটারেল ডিক্লারেশন অব ইনডিপেন্ডেন্সকে মানেন না। তারা যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধার শেষ উচ্চারিত স্লোগান 'জয় বাংলা'কে অবলীলায় অস্বীকার করেন।
কিছু মূল্যবোধ, কিছু আদর্শের ওপর নির্ভর করেই এই দেশটির স্বাধীনতার জন্য ১৯৭১-এ সব মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সেই আদর্শ ছিল যে, এই দেশ হবে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী, গণতান্ত্রিক এবং আবহমান বাঙালির চেতনাসমৃদ্ধ। এসবই হচ্ছে আমাদের জন্মলগ্ন থেকে ধারণ করা কতগুলো মৌলিক বিষয়। এ বিষয়ে সব রাজনৈতিক দলকে ঐকমত্যে পেঁৗছাতে হবে। তাহলেই কেবল আমরা পরীক্ষা করে দেখতে পারব এই দেশের অগ্রাভিযানে কাদের প্রস্তাবিত ব্যবস্থা বেশি গ্রহণযোগ্য। কিন্তু যারা এই দেশের মূল আদর্শকেই পরিহার করেন এবং প্রয়োজনে প্রতিহত করেন, তারা কী করে এ দেশের কল্যাণ কামনা করতে পারেন? আমার আবেদন সকলের কাছে যে, এই বিষয়টি সম্বন্ধে আপনারা বলুন, আপনাদের কথা আমরা সবাই শুনব। নয়তো সংঘর্ষের পথ আরও প্রশস্ত হবে। ক্রমে আমরা হয়তো এই দেশটিকে আর চিনতেই পারব না।
আলী যাকের :সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments