শাইখ সিরাজ_ একটি অনুপ্রেরণা by দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষির ভূমিকা এখনও বেশ বড়; যদিও দেশজ আয়ে কৃষির অংশ ক্রমান্বয়ে কমে আসছে। অর্থনৈতিক কাঠামোগত রূপান্তরের এই প্রক্রিয়া দেশের সার্বিক কৃষি খাতে নতুন নতুন সম্ভাবনাময় দিক সৃষ্টি করছে; 'নতুন' কৃষি দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। এ প্রবণতাগুলো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিকাশ, গ্রামীণ উন্নয়ন,


কর্মসংস্থ্থান সৃষ্টি, রফতানি বৃদ্ধি এবং দারিদ্র্য বিমোচনে বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু উন্মেষণশীল এসব প্রবণতাকে যথোপযুক্ত গুরুত্ব সহকারে এবং তথ্য-উপাত্তের সমর্থন দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মকর্তা, গবেষক-বিশ্লেষক, উদ্যোক্তা এবং সচেতন নাগরিকদের দৃষ্টিগোচর করা প্রয়োজন। তা না হলে এসব সম্ভাবনাময় প্রবণতা ব্যাপক ও জোরালোভাবে দাঁড়াতে পারবে না। এ লক্ষ্যে গবেষণা, উদ্ভাবন এবং প্রচার_ এ তিনটি উপাদানের সংযুক্ত ভূমিকা রয়েছে। লক্ষণীয়, এ তিনটি বিষয়ের সমন্বিত চক্রটিকে যথেষ্ট যোগ্যতার সঙ্গে বাংলাদেশে সফলভাবে প্রয়োগ করেছেন শাইখ সিরাজ।
শাইখ সিরাজের কৃষিভিত্তিক অনুষ্ঠানটি দুটি পর্যায়ের ভেতর দিয়ে গেছে। একটি বাংলাদেশ টেলিভিশনে, আরেকটি চ্যানেল আইয়ে। 'মাটি ও মানুষ' ছিল বাংলাদেশ টেলিভিশনের নিজস্ব্ব অনুষ্ঠান, কিন্তু দর্শক এটিকে সব সময় শাইখ সিরাজের অনুষ্ঠান হিসেবেই দেখেছে। শাইখ সিরাজ যখন অনুষ্ঠানটি নতুন আঙ্গিকে 'হৃদয়ে মাটি ও মানুষ' নামে পুনরুজ্জীবিত করলেন, তখন আমরা সবাই উৎসাহিত বোধ করেছি।
আমার মনে পড়ে, সে সময় সরকারের অর্থনৈতিক মূলনীতি ছিল উদারীকরণ, বিরাষ্ট্রীয়করণ এবং ব্যক্তিখাতকরণ। খাদ্য উৎপাদন এবং খাদ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতি ছিল কিছুটা নাজুক_ কৃষক ও কৃষি শ্রমিকদের কষ্ট বাড়ছিল। বিএডিসিসহ কৃষি বিষয়ক অন্য কয়েকটি সরকারি প্রতিষ্ঠান ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে পড়ছিল। অন্যদিকে কৃষি উৎপাদনশীলতা বাড়ার, কৃষির বিভিন্ন উপখাতের বহুমুখীকরণ ও কৃষিপণ্য রফতানির প্রচুর সম্ভাবনাও সৃষ্টি হচ্ছিল। সে সময় জাতির সামনে একটা শক্ত কৃষি প্লাটফর্মের দরকার ছিল। এই প্রয়োজনটি পূরণ করেন শাইখ সিরাজ।
যে গবেষকরা কৃষিনীতি নিয়ে কাজ করেন, যারা বিভিন্ন ধরনের আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি সৃষ্টি করেন, যারা কৃষি সম্প্র্রসারণে যুক্ত থাকেন, প্রচারের জন্য তাদের কোনো কার্যকর জাতীয় প্লাটফর্ম ছিল না। 'হৃদয়ে মাটি ও মানুষ' তাদের ইলেকট্রনিক মিডিয়াভিত্তিক সেই প্লাটফর্মটি তৈরি করে দেয়। সবচেয়ে বড় কথা, এই প্লাটফর্মের ফলে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতিমালা এবং কৃষিনীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মাঠ পর্যায়ের বাস্তবতার সঙ্গে যে পার্থক্যটা রয়েছে_ তা উঠিয়ে আনা সম্ভ্ভব হয়েছে।
বাজার অর্থনীতিতে অনেক ধরনের বিকৃতি থাকে_ যা প্রায়ই সৃষ্টি হয় ভ্রান্তনীতির কারণে। বাজার অস্থিতিশীল থাকলে তা অর্থনীতিতে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা দেয় না। উৎপাদক সবসময় ঠিক দাম পায় না, ভোক্তাও ন্যায্যমূল্যে জিনিসটা পায় না। এ রকম ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় কাজ হলো তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে বাজারে স্বচ্ছতা নিয়ে আসা। উৎপাদন খরচ কত, বাজারমূল্য কী আর প্রকৃত উৎপাদক ঠিকমতো মূল্য পাচ্ছে কিনা_ এসব প্রশ্নের জবাব মেলে, সমাধানও হয় কোনো কোনো সময়। 'হৃদয়ে মাটি ও মানুষ' তাই এ দেশের সার্বিক কৃষি খাতের জন্য একটি কার্যকর 'বাজার প্রভাবক' হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। কৃষি, তথা গ্রামীণ আর্থ-সামাজিক সাম্প্রতিকতম অবস্থা সম্বন্ধে অবহিত থাকার জন্য আমি তাই অনুষ্ঠানটি নিয়মিত দেখার চেষ্টা করি।
তবে শুধু 'হৃদয়ে মাটি ও মানুষ' অনুষ্ঠানটি দিয়ে শাইখ সিরাজের অবদান পরিমাপ করা যাবে না। সেই অবদানটি কিছুটা চ্যানেল আই গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আরও প্রকাশিত হয়েছে। তার সবচেয়ে বড় শক্তি হলো পেশাদারিত্বের সঙ্গে জীবনঘনিষ্ঠতার সমন্বয়। তার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠভাবে মেশার সুযোগ হয়েছে, একসঙ্গে কাজ করার ও সময় কাটানোর সুযোগও হয়েছে। তার ভিত্তিতে আমি বলতে পারি বাংলাদেশের কৃষি খাতের উন্নতির ব্যাপারে এতখানি খ্যাপাভাবে কেউ কাজ করেনি। তার অবদানের সবচেয়ে বড় দিকটি হলো, তিনি বাংলাদেশে উন্নয়ন বিষয়ক গণযোগাযোগকে একটি সুউচ্চ স্থানে স্থাপন করেছেন, উবাবষড়ঢ়সবহঃ ঈড়সসঁহরপধঃরড়হ-কে দেশ গড়ার হাতিয়ারে রূপান্তর করেছেন।
তার যে দিকটি আমাকে সবচেয়ে মুগ্ধ করে, তা হলো তিনি যেভাবে গ্রামের মানুষের সঙ্গে মিশে গিয়ে যে কোনো বিষয়কে বের করে নিয়ে আসেন। নিষ্ঠা আর পেশাদারিত্বের এ এক অপূর্ব সমন্বয়। আমার মনে হয়, বাংলাদেশে উন্নয়ন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে তার অবদান বহুদিন স্মরিত হবে। শাইখ সিরাজের ব্যক্তিত্ব থেকে আগামী প্রজন্ম অনুপ্রেরণা পাবে। তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা।

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য : অর্থনীতিবিদ সম্মানিত ফেলো, সিপিডি

No comments

Powered by Blogger.