হিযবুত তাহ্‌রীরের আক্রমণ যে শিক্ষা দেয় by শহিদুল ইসলাম

এক. যুক্তরাষ্ট্র যখন আফগানিস্তানে তালেবানের (জঙ্গি সংগঠন) সঙ্গে আবার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনে কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করেছে, তালেবানও সে সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহ প্রকাশ করে কাতারে লিয়াজোঁ অফিস খুলতে যাচ্ছে এবং পাকিস্তানে জঙ্গিবাদে সমর্থন দেওয়া না-দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে পাকিস্তান বেসামরিক সরকার ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের চলছে মনকষাকষি,


তখন হঠাৎ করেই বাংলাদেশে কেন জঙ্গি-সন্ত্রাসী মুসলিম সংগঠন হিযবুত তাহ্‌রীরের অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা বেড়ে গেল, তা নিয়ে দেশের সর্বস্তরের মানুষ উদ্বিগ্ন। তারা প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১১ সামরিক কর্মকর্তাকে হত্যা করার নীলনকশা প্রণয়ন করেছিল। দেশ আবারও আরেকটা ১৫ আগস্টের পরিণতি থেকে বেঁচে গেল, এতে দেশবাসী স্বস্তি বোধ করছেন। জঙ্গিদের অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জিত না হওয়ার পেছনে সেনাবাহিনীর যে ভূমিকা ছিল, তা তাদের ভাবমূর্তি ও গৌরব অনেক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। একটি গণতান্ত্রিক দেশের সেনাবাহিনীর যে রকম ভূমিকা পালন করা উচিত তাই তারা করেছে। এতে সেনাবাহিনী সমগ্র জাতিকে কৃতজ্ঞতার পাশে আবদ্ধ করেছে। কিন্তু প্রথমেই এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া দরকার, কেন হঠাৎ উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠী এতটা মরিয়া হয়ে উঠল? এর সঙ্গে কী যুদ্ধাপরাধের বিচারের কোনো সম্পর্ক আছে? থাকাটাই স্বাভাবিক। কারণ ইসলাম নিয়ে রাজনীতি করা তাদের ঐক্যসূত্র। তাই জামায়াতের রাজনৈতিক দর্শনের সঙ্গে ওইসব ধর্মান্ধ জঙ্গিদের দর্শনের কোনো পার্থক্য নেই। তবে তারা পশ্চিমা গণতন্ত্রের বিরুদ্ধাচরণ করে, কিন্তু নিজেদের ছেলেমেয়েকে পশ্চিমের দেশগুলোতে পাঠাতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হয় না। তাদের এসব জঙ্গি তৎপরতার একটাই উদ্দেশ্য_ক্ষমতা দখল ও অবৈধ ধন-সম্পদে বলীয়ান হওয়া। এবারের আক্রমণ নস্যাৎ হয়ে যাওয়ার পর বেশ কিছু প্রশ্ন ও সম্ভাবনার কথা মানুষের চিন্তাকে আচ্ছন্ন করেছে। তা হলো জঙ্গিবাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের মাধ্যমে তাদের ক্ষমতায় যাওয়া অসম্ভব। এ দেশের মানুষ মূলত ধর্মভীরু। কিন্তু তারা কোনোভাবেই ধর্মান্ধ নয়। ১৯৫৪ সালের নির্বাচন থেকে গত নির্বাচনে তা প্রমাণিত হয়েছে। তাই তারা মরিয়া হয়ে উঠেছে ১৯৭৫ সালের মতো হত্যা-ক্যুর মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করতে। কিন্তু আমাদের সেনাবাহিনীর সদর্থক ভূমিকা প্রমাণ করেছে যে কেবল দেশবাসীই নয়, সেনাবাহিনীর বেশির ভাগ সদস্য ধর্মভীরু, সন্দেহ নেই, কিন্তু তারা কোনোমতেই ধর্মান্ধ নয়। এবার সেনাবাহিনীর তৎপরতায় গণতন্ত্র রক্ষা পাওয়ায় সেটাই প্রমাণিত হলো।
দুই. ২৪ জানুয়ারি ২০১২ সমকালের ব্যানার হেডের প্রধান খবরটি ছিল 'হিযবুত তাহ্‌রীরের নেপথ্য নেতৃত্বে দশ নেতা।' ওই খবরটি পড়লে দেখা যায় হিযবুত তাহ্‌রীরের নেতৃত্বের আসনে যাঁরা বসে আছেন, তাঁরা সবাই উচ্চশিক্ষিত। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক থেকে শুরু করে বাংলাদেশের দুটি নামকরা হাসপাতালের দুজন ডাক্তার ও দুজন ব্যবসায়ী হিযবুত তাহ্‌রীরের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এ ছাড়া কারাগারে আটক আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক মহিউদ্দিন ও ড. সৈয়দ গোলাম মাওলা। ওই ১০ নেতা ছাড়াও আরো যাঁদের নাম ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সবাই শিক্ষিত। উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উত্থানের ইতিহাস পড়লে একই সত্যের প্রমাণ পাওয়া যায়। উপমহাদেশে ইসলামী জাতীয়তাবাদের বীজ রোপণ করেছিলেন স্যার সৈয়দ আহমেদ, যিনি আলীগড় কলেজ স্থাপন করে উপমহাদেশের মুসলমানদের পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন। আলীগড় কলেজ, পরে সেটা বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। সেখান থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে যাঁরা বের হয়ে আসেন, তাঁদের বেশির ভাগই দ্বিজাতিতত্ত্বে বিশ্বাস করতেন। এ দেশে মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাবাদ ও মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদের জনক তাঁরাই। তাঁদেরই উত্তরসূরি আজকের এসব ধর্মান্ধ জঙ্গিগোষ্ঠী। তাঁরা নিজেদের ইসলামের খেদমতগার বলে দাবি করেন। পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেন। কেউ কেউ আবার পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের রাস্তা ধরে ক্ষমতায় যাওয়ার লোভ সংবরণ করতে পারেন না। সব ধর্মে আজও ধর্মান্ধতা-মৌলবাদী চিন্তাভাবনা আছে। কিন্তু অন্য ধর্মে জঙ্গিবাদের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের চিন্তা করে না। ক্ষমতা দখলের আইনত সিদ্ধ বুর্জোয়া পদ্ধতিই অনুসরণ করে। কেবল মুসলমানদের মধ্যে ক্ষমতা দখলের সেই মধ্যযুগীয় ধারাটি আজও স্পষ্ট। আমাদের দেশ বিগত ৪০ বছরের মধ্যে ১৫ বছর সরাসরি সামরিক শাসনে পর্যুদস্ত হয়েছিল। আর সামরিক স্বৈরশাসকরা সব সময় প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার বিরোধিতা করে এবং ধর্মকে ব্যবহার করে তাদের অবৈধ ক্ষমতা দখলকে জায়েজ করার কাজে। যার অবশ্যম্ভাবী ফল হলো ধর্মান্ধতা ও মৌলবাদের অবাধ বিস্তার। পাকিস্তান তার এক জ্বলন্ত উদাহরণ। বাংলাদেশেও জিয়াউর রহমানের অবৈধ ক্ষমতা দখলের পর এ দেশে ধর্মান্ধ-জঙ্গিবাদীরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। রাষ্ট্র তাদের পেছনে ছিল। আজ যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হওয়ার পর জামায়াতে ইসলামীর প্রথম সারির নেতারা, বিশেষ করে গোলাম আযমের গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাঁরা প্রমাদ গুনতে থাকেন। যেভাবেই হোক তাঁদের বাঁচাতে হবে। তাঁদের বাঁচানোর পথ একটিই। তা হলো বর্তমান সরকারকে সরানো এবং তাঁদের প্রতি সহানুভূতিশীল একটি সরকার গঠন। সম্ভবত সে কারণেই শেখ হাসিনার ওপর বারবার আঘাত আসছে। তাঁদের এসব ক্রীড়া ও কার্যক্রম বন্ধ করতেই হবে। প্রশ্ন উঠছে_হিযবুত তাহ্‌রীর একটি নিষিদ্ধ জঙ্গিগোষ্ঠী, তারা গোপনে এসব তৎপরতা কিভাবে চালাচ্ছে? এখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো ফাঁকফোকর আছে কি না, খতিয়ে দেখতে হবে। তারা যথেষ্ট তৎপর এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তার পরও... কথা থেকে যায়। গত ২২ জানুয়ারি একই সঙ্গে ৪১টি থানা আক্রমণের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু তা আগেই ফাঁস হয়ে যায়। তাই তারা সেটা করতে পারেনি। কিন্তু আগামী রাতে যে পারবে না, সে গ্যারান্টি কে দেবে?
তিন. এবার সেনাপ্রধানের গত বৃহস্পতিবারের সংবাদ সম্মেলন সম্পর্কে কিছু কথা বলতে হয়। রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আরো ১১ আর্মি অফিসার তাঁদের হিট লিস্টে থাকাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং তাৎপর্যপূর্ণ। জন্মের পর থেকে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীই ছিল ধর্মান্ধতা ও উগ্রবাদের প্রতীক। আজও তার ব্যত্যয় হয়নি। আমাদের পাকিস্তানি অভিজ্ঞতা বলে দ্বিজাতিতত্ত্বের আদর্শে গড়ে ওঠা পাকিস্তান সেনাবাহিনী আর জঙ্গিবাদ অনেকটাই সমার্থক। তাই দেশ স্বাধীন হলে আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে যে সেনাবাহিনী পাই, তা পাকিস্তানের সেই সেনাবাহিনীরই বাঙালি অংশ, যারা দ্বিজাতিতাত্তি্বক পাকিস্তানি ভাবাদর্শেই গঠিত। যদিও তারা মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ করে তাদেরই এককালের সহকর্মী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করেছিল, কিন্তু তাদের অনেকেরই মনে দ্বিজাতিতত্ত্বের রেশ রয়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। তদুপরি ১৫ আগস্টের বিয়োগান্ত ঘটনার পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করে প্রথমেই আঘাত হানেন গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের ওপর। প্রমাণিত হয়, জিয়াউর রহমানের মধ্যে পাকিস্তানি ভাবাদর্শ জ্বলন্ত ছিল। এরশাদ এসে একইভাবে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করে সেনাবাহিনীকে পাকিস্তানি ভাবাদর্শে উজ্জীবিত করেন। তাই ডিসেম্বরের হিযবুত তাহ্‌রীরের আক্রমণ নস্যাৎ হয়ে গেলেও একটা সত্য প্রতিষ্ঠা পায়। তা হলো আমাদের আজকের সেনাবাহিনী সত্তরের সেনাবাহিনী নয়। আজকের সেনাবাহিনী মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ। তাই হিযবুত তাহ্‌রীরের আক্রমণের শিকার শেখ হাসিনা ও জিল্লুর রহমানের সঙ্গে তাদের হিট লিস্টে ছিলেন ১১ ঊর্ধ্বতন সেনা অফিসার। এটা সেনাবাহিনীর ইমেজকে অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের সেনাবাহিনী যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ভাস্বর, তার প্রমাণ পাওয়া যায় বৃহস্পতিবারের সেনাপ্রধানের সংবাদ সম্মেলনে। ওই সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, 'একদল ধর্মান্ধ জুনিয়র অফিসারের সাহায্যে গণতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটাতে চেয়েছিল।' সেনাপ্রধান লে. জে. মাইনুল আরো স্পষ্টভাবে বলেন, 'আমরা সবাই ধর্মভীরু। ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ হলো প্রত্যেকে তার নিজ নিজ ধর্ম বিশ্বাস অনুসরণ করবে কিন্তু কেউ অন্যের ধর্ম বিশ্বাসের ওপর কোনো রকম আক্রমণ করবে না।' সেনাপ্রধানের কথায় প্রমাণিত হয়, আমাদের সেনাবাহিনী আজ আর সত্তরের দশকে দাঁড়িয়ে নেই। জিয়া প্রথমেই যে ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর বেয়নেট চালিয়েছিলেন, আজকের সেনাপ্রধান সেই ধর্মনিরপেক্ষতাকেই উঁচুতে তুলে ধরছেন। স্বাধীনতার একটি প্রধান স্তম্ভ ধর্মনিরপেক্ষতা বা ইহজাগতিকতা। আজ পরিষ্কার হলো, কেন ধর্মান্ধ জঙ্গিরা সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করতে চেয়েছিল। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এ কথা জেনে নিশ্চয়ই আনন্দিত হবে। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত মত হলো সেনাবাহিনীর সব রকমের রাজনীতির ঊর্ধ্বে থাকা উচিত। তারা হিযবুত তাহ্‌রীরের ষড়যন্ত্র বানচাল করে দিয়ে বিরাট দেশাত্মবোধক কাজ করেছে। সেজন্য দেশবাসী তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। এটাই সেনাবাহিনীর কাজ। দেশ ও রাষ্ট্রের বিপদের সময় তারা ঐক্যবদ্ধ থাকবে_এটাই সবার কাম্য। রাজনীতির জগৎ রাজনীতিবিদদের সামলাতে দিন। সেনাবাহিনীকে সেখানে জড়ানো উচিত হবে না। তিনি যে 'ধর্মপ্রাণ', ধর্মপরায়ণ ও ধর্মভীরুর সঙ্গে ধর্মীয় গোঁড়ামি, ধর্মান্ধতা এবং ধর্ম ব্যবসার পার্থক্য স্পষ্ট করে তুলেছেন, তা একজন খাঁটি মুসলমানের মতো কাজ করেছেন। কিন্তু প্রথম অংশের মানুষ যে কখন, কী জন্য দ্বিতীয় অংশের মানুষে পরিণত হতে পারে, তা বলা যায় না। সে অভিজ্ঞতাও আমাদের আছে। তাই বলছিলাম, সেনাপ্রধান আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের মানুষের মনের কথাই বলেছেন, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু আবারও বলছি, সেনাবাহিনীকে সব রাজনৈতিক ভাবাদর্শের বাইরে রাখা দেশের জন্য মঙ্গলজনক। আমরা এত দিন জানতাম না যে আমাদের সেনাবাহিনী বিগত ৪০ বছরে স্বাধীনতার চেতনায় অনেকটাই উদ্বুদ্ধ হয়েছে, কিন্তু আমাদের শত্রুরা তা আগে থেকেই জানে। আর জানে বলেই ১১ আর্মি অফিসার তাদের হত্যার তালিকায় স্থান পেয়েছেন। যেকোনো সময় তাঁরা সবাই কিংবা কেউ কেউ হাসিনা বা জিল্লুর রহমানের সঙ্গে নিহত হতে পারেন। সেনাবাহিনী সম্পর্কে এত দিন একটা ভ্রান্ত ধারণা দেশবাসীর মনে বাসা বেঁধেছিল, ওই ঘটনায় তা দূর হলো। ডিসেম্বরের ক্যুর পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ায় দেশবাসী যেমন আনন্দিত, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় স্নাত আমাদের সেনাবাহিনী সম্পর্কে দেশবাসী আজ গর্বিত।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক

No comments

Powered by Blogger.