'কিউসেক দৃষ্টিভঙ্গি' বনাম তিস্তার নদী-ব্যাকরণ-পানি বণ্টন by পাভেল পার্থ

বাংলাদেশের শহুরে রাজনৈতিক পরিসরে চলতি সময়ের এক মুখ্য বাহাসের বিষয় 'তিস্তা চুক্তি'। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সাম্প্র্রতিক বাংলাদেশ সফর এবং এর সফলতা-ব্যর্থতার প্রসঙ্গে বারবার তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে পারস্পরিক বাদানুবাদ চরমে পেঁৗছেছে। এমনকি ভারতও তিস্তাকে ঘিরে তার রাজনৈতিক বাহাস সচল রেখেছে। সবাই ঐতিহাসিক তিস্তা নদীকে কেটে ছিঁড়ে টুকরো করতে চাইছে।


রক্তাক্ত নদীর লাশের ভাগ নিয়েই ভারত-বাংলাদেশের যাবতীয় রাজনৈতিক দেনদরবার। কোনো রাষ্ট্র কিংবা রাষ্ট্রের কোনো বৃহত্তর রাজনৈতিক দলই নদীটিকে আর তার নিজের মতো আস্ত রাখতে চাইছে না। রাষ্ট্রশাসকরা তিস্তার জলপ্রবাহের কত ভাগ ছিনিয়ে নেবেন তা নিয়ে ক্ষমতার লড়াই তুঙ্গে। এখন পর্যন্ত উভয় রাষ্ট্রই তিস্তার দৃষ্টিতে নয়, বরং রাষ্ট্রের দুর্বৃত্ত ক্ষমতার দেনদরবার থেকেই 'তিস্তা চুক্তিকে' দেখছে। তিস্তা অববাহিকার বাংলাদেশ ও ভারতের নিম্নবর্গের তিস্তা-জীবন থেকে তথাকথিত 'তিস্তা চুক্তির' আখ্যান রচিত হয়নি। প্রতিবেশীয় রাজনৈতিক জায়গা থেকে নদীকে এভাবে রাষ্ট্র-ক্ষমতার গায়ের জোরে ভাগ-বিভাগ করাকে নদীর ওপর সহিংসতা হিসেবেই পাঠ করা হয়। এটি নদীর ওপর ঐতিহাসিক রাষ্ট্রীয় জুলুম। বাঁধ, উন্নয়ন প্রকল্প, বিদ্যুৎ প্রকল্প, অবকাঠামো, জলশাসন কি জল-ভাগ করে কোনো নদীকে কেটে কেটে টুকরো টুকরো করার ভেতর দিয়ে কোনোভাবেই কোনো ধরনের প্রতিবেশীয় ন্যায্যতা নিশ্চিত হয় না। পাহাড় ও বনভূমির জরায়ুতে জলপ্রবাহের জন্ম হয়। তারপর তা ছড়া, ঝিরি, ঝরনা, খাল, নদ-নদী কত নামে, কত পরিচয়ে উজান থেকে ভাটিতে তার জটিল জীবনগাথা মেলে ধরে। কেবল তিস্তা চুক্তি নয়, নদী বিষয়ক কোনো চুক্তির ক্ষেত্রেই নদীর এ ঐতিহাসিক জীবনধারা ও নদী-দর্শনকে আমলে নেওয়া হয় না। কত কিউসেক জল কে ব্যবহার করবে তা নিয়েই দেনদরবার চলে। নদী তার নিয়মে উজান থেকে ভাটিতে গড়িয়ে যাবে। এখানে কোনো ব্যক্তি কি রাষ্ট্র কোনোভাবেই নদীর ওপর একক কর্তৃত্ব ও বলপ্রয়োগ করতে পারে না। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে নদীর ওপর এমনি প্রশ্নহীন অনিবার্য রাষ্ট্রীয় আঘাত ও নিপীড়ন আমরা দেখে আসছি। তিস্তা নদীর জলপ্রবাহকে 'কিউসেক দৃষ্টিভঙ্গিতে' না দেখে, এর প্রবাহিত জীবন আখ্যানকে বিবেচনা করে বাংলাদেশ ও ভারতের উচিত তিস্তার ওপর রাষ্ট্রীয় ন্যায়পরায়ণতা নিশ্চিত করা।
তিস্তা নদীর জলধারাকে বাংলাদেশ ও ভারতের ক্ষমতাসীন রাজনীতিকরা আটচলি্লশ-বায়ান্ন কি পঞ্চাশ-পঞ্চাশ অনুপাতে ভাগ করতে সোচ্চার। পঞ্চাশ-পঞ্চাশ অনুপাতকে জলপ্রবাহের সমান ভাগ দেখিয়ে বলা হচ্ছে 'পানি বণ্টনের ন্যায্য হিস্যা'। একটি জলজ্যান্ত নদীকে তার আপন গতিপথ থেকে সরিয়ে এভাবে ভাগ-বিভাগের রাজনীতিতে স্পষ্ট হয়েছে, তিস্তাকে কেউই বাঁচতে দিতে চান না। তিস্তা নিয়ে সাম্প্রতিক এই ভাগ-বিভাগের বিতণ্ডায় একটি গল্পের কথাই মনে পড়ে যাচ্ছে বারবার। একবার দুই নারী এক শিশুকে উভয়েই নিজের সন্তান বলে দাবি করেন। বিচারকের কাছে যাওয়ার পর বলা হয়, সন্তানটিকে কেটে সমান দুই টুকরো করা হবে। তারপর দুই নারীকে দুই টুকরো দিয়ে দেওয়া হবে। নারীদের একজন এতে সম্মতি দেন এবং তিনি শিশুটির মাথাসহ শরীরের ওপরের অংশ দাবি করেন। কিন্তু দ্বিতীয় নারী বিচারকের এই নৃশংস পন্থাকে অস্বীকার করে শিশুটিকে না কেটে প্রথম নারীকেই দিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করেন। বিচারক বুঝতে পারেন, শিশুটির সত্যিকার মা কোনজন। তিস্তা নদী ভারত ও বাংলাদেশ উভয় রাষ্ট্রের সন্তান। রাষ্ট্রের দায়িত্ব তার সন্তানের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। মনমোহন সিং কি শেখ হাসিনার ভেতর তিস্তার প্রতি সেই সাহস ও ভালোবাসা জাগ্রত হোক, যেখানে তিস্তাকে টুকরো না করে তার আপন গতিধারা নিশ্চিত করবে উভয় রাষ্ট্র। ভারতের জলপাইগুড়ির গজলডোবা ও বাংলাদেশের নীলফামারীর ডালিয়ায় বাঁধ ও ব্যারাজ চালু রেখে তিস্তার নিজস্ব সত্তাকে নিয়ন্ত্রিত করার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কারণ নদীকে নিয়ন্ত্রণ করার এ মানসিকতাই 'কিউসেক দৃষ্টিভঙ্গির' জন্ম দিয়েছে। যেখান থেকে কোনো রাষ্ট্রই সরে এসে তিস্তার নদী-ব্যাকরণের সঙ্গে শামিল হতে পারছে না।
বিভিন্ন নামের ও নানান গড়নের অসংখ্য জলধারার সম্মিলিত তিস্তাতে বছরের প্রায় সময়ই কমবেশি প্রবাহ থাকে। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের তিস্তা প্লাবন সমভূমি কৃষি প্রতিবেশ অঞ্চলের কৃষি ও জনজীবন এই তিস্তা স্রোতধারার ওপরই বেঁচেবর্তে আছে। দেশের মোট শস্যভূমির ১৪ ভাগ এই তিস্তা প্লাবন কৃষি প্রতিবেশ অঞ্চলের অন্তর্গত, যেখানে দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮.৫ ভাগ মানুষের বসতি। ভারত ও বাংলাদেশ উভয় রাষ্ট্র উন্নয়নের নাম করে মূলত করপোরেট বাণিজ্য মুনাফা লুটতেই দুই দেশের তিস্তাবাসীকে অগ্রাহ্য ও জলধারাকে রক্তাক্ত করে নদীর সারা শরীরজুড়ে বাঁধ ও ব্যারাজ তৈরি করেছে। যেহেতু তিস্তা ভারত থেকে উৎপন্ন হয়ে এসেছে, তাই উজানের রাষ্ট্র হিসেবে ভারত অপরাপর অভিন্ন নদীর মতো তিস্তার পানিও প্রত্যাহার ও শাসন করছে তার ইচ্ছামতো। শুষ্ক মৌসুমে ভারত ধরে রাখছে পানি আর বর্ষায় ছেড়ে দিচ্ছে। পানির অভাবে তিস্তা অববাহিকা শীতকালে আরও পানিশূন্য খরাগ্রস্ত এবং বর্ষাতে বন্যায় তলিয়ে যাচ্ছে। অভিন্ন তিস্তা নদীর পানি নিয়ে ভারতের এই অন্যায়-অবিচার বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলকে আরও মঙ্গা-দুর্যোগের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, পাশাপাশি নদী-প্রতিবেশও হয়ে পড়ছে ছিন্নভিন্ন। ১৯৭২ সালে গঠিত ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশন অভিন্ন তিস্তা বিষয়ে চলতি সময় পর্যন্ত তেমন কোনো নদী-জীবনবান্ধব রাজনৈতিক উদ্যোগ নেয়নি। যারা তিস্তার জলপ্রবাহকে কিউসেকের মাপে কেটে টুকরো টুকরো করে রক্তাক্ত করতে চাইছেন, তাদের এমন অন্যায় ব্যাটাগিরি করার এখতিয়ার কেউ দেয়নি। রাষ্ট্রের 'কিউসেক দৃষ্টিভঙ্গি' নয়, তিস্তার চোখেই তিস্তা চুক্তি করতে হবে ভারত ও বাংলাদেশকে। কোনো রাষ্ট্রই তিস্তার উজান থেকে ভাটির জীবনে কোনো ধরনের বলপ্রয়োগ ও কর্তৃত্ব তৈরি করবে না_ এমন অঙ্গীকার করেই রচিত হোক তিস্তা চুক্তির ন্যায়পরায়ণতার ব্যাকরণ।

পাভেল পার্থ :গবেষক
animistbangla@yahoo.com
 

No comments

Powered by Blogger.