আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-৩৮)-স্মৃতির সঞ্জীবনীতে অবগাহন by আলী যাকের

মা একটু ভালো। ফিরে আসছেন শিগগিরই। খবরটা এল একটা পোস্টকার্ডে। আমাদের বাড়িতে টেলিফোন ছিল না। একমাত্র চিঠির মাধ্যমেই যোগাযোগ। তখন আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রীষ্মের ছুটি চলছে। তা ছাড়া সামনে পরীক্ষা। অতএব, বাড়িতেই থাকতাম সারা দিন।


আমার প্রতিদিন সকালের একটা কাজ ছিল হাঁটতে হাঁটতে ফরিদাবাদ পোস্ট অফিসে যাওয়া, কলকাতার চিঠির খোঁজে। কোনো চিঠি থাকলে তো ভালো, নয়তো হাঁটতে হাঁটতে পাড়াময় ঘুরে বেড়ানো এবং সব শেষে ধূপখোলা মাঠের পশ্চিমে আমবাগানের কোনো একটি গাছের নিচু ডালে পা ঝুলিয়ে বসে থাকা। ওই গাছের ডালে বসে অনেক চিন্তাভাবনার কাজগুলো সম্পাদিত হতো। গাছের ডালের চিন্তায় ছিল সর্বাগ্রে প্রেমানুভূতি সম্পর্কে ফ্যান্টাসি রচনা। তারপর খেলাধুলা, কাজকর্ম, পড়াশোনা ইত্যাদি।
হেঁটে বেড়ানো আমার দীর্ঘদিনের অভ্যাস। আমি আমার চেনাজানা সব শহরই চিনেছি, জেনেছি হেঁটে হেঁটেই। এর মধ্যে এই ঢাকা তো আছেই। এ ছাড়া কলকাতা এবং নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটান শহরও আমি হেঁটে হেঁটে জেনেছি। হাঁটাহাঁটির জন্য কলকাতা ছিল আমার অন্যতম প্রিয় শহর। বাহাত্তরে আমার মতোই হাঁটতে ভালোবাসে এমন এক বন্ধুকে নিয়ে পার্ক সার্কাস থেকে সৈয়দ আমির আলী এভিনিউ হয়ে গড়িয়াহাটা মার্কেট। সেখান থেকে রাসবিহারী এভিনিউ হয়ে ভবানীপুর এবং এসপ্লানেড। টালিগঞ্জের পথে পথে ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতাও আমার রয়েছে বিস্তর। তবে কলকাতায় শ্যামবাজারের পাঁচমাথা থেকে কলেজ স্ট্রিট ধরে হ্যারিসন রোডের মোড় পার হয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যাওয়া। মোড় পেরোলেই দুদিকে পুরনো বইয়ের দোকান। সেখান থেকে অনেক মূল্যবান বইপত্র কিনেছি বিভিন্ন সময়ে। আমার সংগ্রহে এখনো লর্ড বায়রনের একটা কাব্যগ্রন্থ আছে। চামড়ায় বাঁধানো সুন্দর বই। জনৈক অরবিন্দ সেন বইটি কিনেছিলেন ১৯০৩ সালে। বইটি হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করলে রোমাঞ্চিত বোধ করি। সবচেয়ে রোমাঞ্চিত হতাম কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দারভাঙা ভবনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে।
বাবার কথা মনে পড়ে। বাবার কাছে বিস্তর গল্প শুনেছি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের। তিনি যখন ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়াশোনা করছেন, শুনেছি তখনকার দিনে বেশির ভাগ ছেলেই ধুতি-শার্ট কিংবা ধুতি-পাঞ্জাবি পরত। বাবার ভাষায় তাঁরও পছন্দের ছিল সাদা টুইলের হাফশার্ট এবং ফরাশডাঙ্গার ধুতি। একটি গল্প বাবার খুব প্রিয় ছিল। এই গল্পটি তাঁর কাছে একাধিকবার শুনেছি। হয়তো আমাদের মতো কিশোর-তরুণদের দেখলে এই গল্পটি বলার লোভ তিনি সংবরণ করতে পারতেন না। তখনকার দিনে, সেই বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে খুব অল্পসংখ্যক মেয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত। বাবার গল্পটি ছিল এ রকম : একবার কলকাতায় প্রচণ্ড বৃষ্টির জন্য দারভাঙা ভবনের সামনে কলেজ স্ট্রিট হাঁটুপানিতে ডুবে যায়। ওই সময় বাবা আর তাঁর বন্ধুরা ধুতি উঠিয়ে মালকোঁচা মেরে রাস্তা পার হওয়ার যখন প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তখন দেখতে পেলেন যে তাঁদের সহপাঠী এক মেয়ে অসহায় দৃষ্টিতে তাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে। ঠিক যত দূর শাড়ি তুলে ওই পানি পার হওয়া যায় শালীনভাবে, তার চেয়ে অনেক উঁচু দিয়ে পানি বইছিল। ছেলেরা সব একে অন্যের দিকে তাকাচ্ছে। হঠাৎ বাবা সব সংস্কার ভেঙে প্রচণ্ড দুঃসাহসে মেয়েটিকে পাঁজাকোলা করে তুলে পানি পার করে রাস্তার অন্য পাড়ে নামিয়ে দেন। মেয়েটি কৃতজ্ঞচিত্তে বাবাকে একটি হাসি উপহার দেয়। বাবা যখন রসিয়ে রসিয়ে তখনকার দিনের এই প্রচণ্ড শিভ্যালরির গল্প আমাদের বলতেন, তখন তাঁর মুখটা উজ্জ্বল হয়ে যেত। এই গল্প বাবার কাছে যতবার শুনেছি, প্রচণ্ড উপভোগ করেছি। এখন মাঝেমধ্যে সন্দেহ হয়, ঘটনাটা কি আদৌ ঘটেছিল? নাকি এটা বাবার সুখ-কল্পনা? ইংরেজিতে যাকে ডরংযভঁষ ঃযরহশরহম বলে। সঙ্গে সঙ্গে মনটা চলে যায় অমোঘ রবীন্দ্রনাথে_'রোজ কত কী ঘটে যাহা তাহা/এমন কেন সত্যি হয় না আহা?' আমরা যা চাই, যা আমাদের পরিপূর্ণতা দেয় কিংবা সব সময়ই উৎফুল্ল করে, তেমন কত কিছুই আমরা জীবনে ঘটেছে বলে ধরে নিই এবং একেক সময়ে সত্য-মিথ্যা কখন যে মিলেমিশে যায়, তা জানতেও পারি না। পরে নিখাদ সত্য থেকে এই কল্পিত সত্যকে আলাদা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
কী বলতে বলতে কোথায় চলে এলাম। যেমন বলছিলাম, একেবারে একা, একা হেঁটে বেড়ানোয় আমি দারুণ আনন্দ পাই। সেটা কলকাতায় হোক কিংবা ঢাকায়, নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটানে হোক কিংবা আমার গ্রাম রতনপুরের মেঠো পথে। সেই অভ্যাসেই হাঁটতে হাঁটতে অনেক অলস ছুটির দুপুর আমার কেটেছে ঢাকার বিভন্ন পথে-ঘাটে কিংবা গলিঘুঁজিতে। মাঝেমধ্যে স্মৃতির পথে সময়ের উল্টো দিকে হাঁটার জন্যও আমি ঢাকার পথে হেঁটেছি। একেবারে বাস্তবিক অর্থেই ডধষশরহম ফড়হি ঃযব সবসড়ৎু ষধহব। এই তো দুই বছর আগে দুর্গাপূজায় অষ্টমীর রাতে গেণ্ডারিয়াপাড়া থেকে শুরু করে পুরান ঢাকার প্রায় সব পূজামণ্ডপ ঘুরে বেড়িয়েছি আমি। সেই রাতে ভীষণ গরম ছিল। আমি ঘেমে একসার, কিন্তু একমুহূর্তের জন্যও আমার শারীরিক ক্লান্তি আমাকে উতলা করতে পারেনি। আমি স্মৃতির সঞ্জীবনীতে অবগাহন করছিলাম যেন মধ্যরাত পর্যন্ত।
(চলবে)

লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.