যুগের বাণী-ভারত-বাংলাদেশ মিত্রতার দার্শনিক ভিত্তির খোঁজে by মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী
পড়ছিলাম ১৯৭৩ সালে কলকাতায় প্রকাশিত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জি পি ভট্টাচার্যের লেখা 'রেনেসাঁ অ্যান্ড ফ্রিডম মুভমেন্ট ইন বাংলাদেশ' নামের বইটি। অধ্যাপক ভট্টাচার্য তাঁর বইটির প্রথম অধ্যায়ের শিরোনাম দিয়েছেন 'পাকিস্তান_এ সেক্যুলার ডিমান্ড' অর্থাৎ 'পাকিস্তান_একটি লোকায়ত বা ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কহীন দাবি'; এবং শিরোনামটির সমর্থনে তিনি বিস্তর ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্ত উল্লেখ করেছেন।
তাঁর মতে, ভারতীয় লোকায়ত জাতীয়তার ওপর হিন্দুয়ানি রং চড়ান বিপিনচন্দ্র পাল, অরবিন্দ ঘোষ প্রমুখ নেতা, যার জের ধরে গণপতি উৎসব, শিবাজি উৎসব এবং গান্ধীর রামরাজ্য ভারতের মুসলমানদের কংগ্রেসের প্রতি বিমুখ করে তোলে। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারেরও একই অভিমত যে 'পর্যায়ক্রমে জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতসারে সমগ্র ভারতে জাতীয়তার ওপর গভীরভাবে হিন্দুত্বের ছাপ ফেলে।' আসল সত্যটি হচ্ছে, অখণ্ড ভারতে শাসন-ক্ষমতায় মুসলিম লীগের নেতারা যে নড়বড়ে জায়গা পাবেন, সে তুলনায় পাকাপোক্ত জায়গা পাওয়ার স্বার্থে তাঁরা পাকিস্তান রাষ্ট্রের দাবি তুলেছিলেন এবং একটি মুসলিম রাষ্ট্র ও একটি ইসলামী রাষ্ট্রের মধ্যে যে বিস্তর তফাত, সেটা বরাবর তাঁদের উপলব্ধিতে ছিল, যার সমর্থনে অধ্যাপক ভট্টাচার্য তাঁর বইটিতে ১৯৩৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মুসলিম ইউনিভার্সিটি ইউনিয়ন সম্মেলনে জিন্নাহর দেওয়া বক্তৃতা থেকে একটি উদ্ধৃতি দিয়েছেন সেটা এই_'মুসলিম লীগ প্রতিক্রিয়াশীল মুসলমানদের থেকে আপনাদের মুক্তি দিয়েছে।...এই প্রতিষ্ঠানটি নিশ্চিতভাবে অনাকাঙ্ক্ষিত মৌলভী ও মওলানাদের থেকে আপনাদের মুক্ত করেছে।'
তাহলে পরবর্তীকালে পাকিস্তান কেন একটি বিশৃঙ্খল রাষ্ট্রে পরিণত হলো, যার জের এখনো দেখা যাচ্ছে। মুসলমানরা কখনো একটি জাতি নয় এবং কোরআনে কোথাও মুসলমানদের একই কওম বা জাতিভুক্ত বলা হয়নি। পাকিস্তান রাষ্ট্রের গোড়ার গলদ এখানেই। পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হয়েছিল বাঙালিসহ কয়েকটি জাতি মিলে এবং সেটা না মেনে জিন্নাহ পাকিস্তান নামে একটি অবাস্তব জাতি গঠনের প্রস্তাব দেন এবং তাঁর মৃত্যুর পর পাকিস্তান রাষ্ট্রটি জোড়াতালি দিয়ে টিকিয়ে রেখে পশ্চিমাদের ঔপনিবেশিক শোষণ করার স্বার্থে ইসলামী রাষ্ট্রের কাঠামোর প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশের একাত্তরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ যেমন ওই ঔপনিবেশিক শোষণ থেকে মুক্ত হওয়ার লড়াই, তেমনি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের কাঠামো ভেঙে স্বাধীন হওয়ারও লড়াই। ১৯৪৯ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সঠিক কথাটি বলেছিলেন। 'আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোনো আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব কথা। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি-দাড়িতে ঢাকার জো-টি নেই।'
এই ঐতিহাসিক যুক্তিযুক্ত কারণে ১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রপরিচালনার নীতিসমূহের মধ্যে সেক্যুলার অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষতা একটি নীতি হিসেবে সনি্নবেশিত হয় এবং নীতিটি ধোঁয়াশা না রেখে সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদে সেটার সংজ্ঞা দেওয়া হয়, যার উদ্ধৃতি এই_'১২. ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা। ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাস্তবায়নের জন্য (ক) সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা, (খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদাদান, (গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার, (ঘ) কোনো বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর নিপীড়ন বিলোপ করা হইবে।' বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সংবিধান প্রণেতারা এখানেই থেমে যাননি; এবং কেন থেমে যাননি, সেটার কারণ জানা যাবে নিম্নে উদ্ধৃত বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতায়, তাঁরা সংবিধানে দেওয়া মৌলিক অধিকারগুলোর একটি সংগঠনের স্বাধীনতাসংক্রান্ত ৩৮ অনুচ্ছেদে একটি শর্ত জুড়ে দিয়েছিলেন, যার উদ্ধৃতি এই_'তবে শর্ত থাকে যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসম্পন্ন বা লক্ষ্যানুসারী কোনো সাম্প্রদায়িক সমিতি বা সংঘ কিংবা অনুরূপ উদ্দেশ্যসম্পন্ন বা লক্ষ্যানুসারী ধর্মীয় নামযুক্ত বা ধর্মভিত্তিক অন্য কোনো সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার বা তাহার সদস্য হইবার বা অন্য কোনো প্রকারে তাহার তৎপরতায় অংশগ্রহণ করিবার অধিকার কোনো ব্যক্তির থাকিবে না।'
এখন ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে খসড়া সংবিধান অনুমোদন উপলক্ষে উপরোক্ত ১২ অনুচ্ছেদ ও ৩৮ অনুচ্ছেদের শর্তটি সংবিধানে সনি্নবেশিত করার পক্ষে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ভাষণের অংশটুকুর উদ্ধৃতি দিচ্ছি_'ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাত কোটি মানুষের ধর্মকর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না এবং করব না। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রে কারো নেই। হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালন করবে, কারো বাধা দেওয়ার ক্ষমতা নেই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে, খ্রিস্টানরা তাদের ধর্ম করবে, তাদের কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হলো এই যে ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। ২৫ বছর আমরা দেখেছি ধর্মের নামে জুয়াচুরি, ধর্মের নামে শোষণ, ধর্মের নামে বেইমানি, ধর্মের নামে অত্যাচার, খুন, ব্যভিচার_এই বাংলাদেশের মাটিতে এসব চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কেউ বলে যে ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে, আমি বলব ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছি। কেউ যদি বলে গণতান্ত্রিক মৌলিক অধিকার নেই, আমি বলব, সাড়ে সাত কোটি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে যদি গুটিকয়েক লোকের অধিকার হরণ করতে হয়, তা করতেই হবে।'
অতঃপর ১৯৭৫ সালে ভারতের লোকসভা কর্তৃক ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনায় রাষ্ট্রের পরিচয় বাক্যে 'সেক্যুলার' শব্দটি সংবিধান সংশোধনপূর্বক সংযুক্ত করা হয়। পরবর্তীকালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট তাদের একটি রায়ে ভারতের সংবিধানে সনি্নবেশিত সেক্যুলারিজম শব্দটির বিশদ ব্যাখ্যা দিয়ে তার মূল বৈশিষ্ট্যগুলো নির্দিষ্ট করেন। বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলার কারণে ভারতের যে রাজ্যগুলোতে বিজেপি বা ভারতীয় জনতা পার্টির নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভা ক্ষমতায় ছিল, সেগুলোর মন্ত্রিসভা বাতিল করে কেন্দ্রীয় শাসনে আনার রাষ্ট্রপতির আদেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে মোকদ্দমাটি উত্থাপিত হয়। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে এই সিদ্ধান্ত দেওয়া হয় যে বাবরি মসজিদ ভাঙার ঘটনাটি সংবিধানে নির্দিষ্ট সেক্যুলারিজমের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হেতু ওই রাজ্যগুলো কেন্দ্রীয় শাসনাধীনে নেওয়ার আদেশটি সংবিধানসম্মত। রায়টিতে বলা হয় যে সেক্যুলারিজম কোনো ধর্মকে প্রাধান্য দেয় না এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসম্পন্ন ধর্মের ব্যবহার বারিত করে। পড়ুন, অল ইন্ডিয়া রিপোর্টার্স, ১৯৬৪, সুপ্রিম কোর্ট, পৃষ্ঠা ১৯১৮।
প্রিয় পাঠক, আশা করি, আপনি আমার সঙ্গে একমত হবেন যে ভারত-বাংলাদেশ মিত্রতার দার্শনিক ভিত্তির খোঁজ পাওয়া গেছে এবং সেটি হচ্ছে সেক্যুলারিজম, যার সঠিক অর্থ লোকায়ত মানসিকতা এবং যেটাকে আমরা ধর্মনিরপেক্ষতা বলে থাকি, যদিও শব্দটি নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি করা যায়_এই আশঙ্কাটি মনে রেখে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী একজন মানুষকে সজ্জন ও যুক্তিশীল করে, যেটি সুশৃঙ্খল সমাজ ও মৈত্রীবন্ধন গড়ার সুদৃঢ় ভিত্তি। একমাত্র একজন যুক্তিশীল মানুষই বলতে পারেন রবীন্দ্রনাথের ভাষায়_'আমি চোখ মেললুম আকাশে_/জ্বলে উঠল আলো/পুবে পশ্চিমে।'
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি,
আপিল বিভাগ, সুপ্রিম কোর্ট
তাহলে পরবর্তীকালে পাকিস্তান কেন একটি বিশৃঙ্খল রাষ্ট্রে পরিণত হলো, যার জের এখনো দেখা যাচ্ছে। মুসলমানরা কখনো একটি জাতি নয় এবং কোরআনে কোথাও মুসলমানদের একই কওম বা জাতিভুক্ত বলা হয়নি। পাকিস্তান রাষ্ট্রের গোড়ার গলদ এখানেই। পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হয়েছিল বাঙালিসহ কয়েকটি জাতি মিলে এবং সেটা না মেনে জিন্নাহ পাকিস্তান নামে একটি অবাস্তব জাতি গঠনের প্রস্তাব দেন এবং তাঁর মৃত্যুর পর পাকিস্তান রাষ্ট্রটি জোড়াতালি দিয়ে টিকিয়ে রেখে পশ্চিমাদের ঔপনিবেশিক শোষণ করার স্বার্থে ইসলামী রাষ্ট্রের কাঠামোর প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশের একাত্তরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ যেমন ওই ঔপনিবেশিক শোষণ থেকে মুক্ত হওয়ার লড়াই, তেমনি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের কাঠামো ভেঙে স্বাধীন হওয়ারও লড়াই। ১৯৪৯ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সঠিক কথাটি বলেছিলেন। 'আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোনো আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব কথা। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি-দাড়িতে ঢাকার জো-টি নেই।'
এই ঐতিহাসিক যুক্তিযুক্ত কারণে ১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রপরিচালনার নীতিসমূহের মধ্যে সেক্যুলার অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষতা একটি নীতি হিসেবে সনি্নবেশিত হয় এবং নীতিটি ধোঁয়াশা না রেখে সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদে সেটার সংজ্ঞা দেওয়া হয়, যার উদ্ধৃতি এই_'১২. ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা। ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাস্তবায়নের জন্য (ক) সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা, (খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদাদান, (গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার, (ঘ) কোনো বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর নিপীড়ন বিলোপ করা হইবে।' বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সংবিধান প্রণেতারা এখানেই থেমে যাননি; এবং কেন থেমে যাননি, সেটার কারণ জানা যাবে নিম্নে উদ্ধৃত বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতায়, তাঁরা সংবিধানে দেওয়া মৌলিক অধিকারগুলোর একটি সংগঠনের স্বাধীনতাসংক্রান্ত ৩৮ অনুচ্ছেদে একটি শর্ত জুড়ে দিয়েছিলেন, যার উদ্ধৃতি এই_'তবে শর্ত থাকে যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসম্পন্ন বা লক্ষ্যানুসারী কোনো সাম্প্রদায়িক সমিতি বা সংঘ কিংবা অনুরূপ উদ্দেশ্যসম্পন্ন বা লক্ষ্যানুসারী ধর্মীয় নামযুক্ত বা ধর্মভিত্তিক অন্য কোনো সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার বা তাহার সদস্য হইবার বা অন্য কোনো প্রকারে তাহার তৎপরতায় অংশগ্রহণ করিবার অধিকার কোনো ব্যক্তির থাকিবে না।'
এখন ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে খসড়া সংবিধান অনুমোদন উপলক্ষে উপরোক্ত ১২ অনুচ্ছেদ ও ৩৮ অনুচ্ছেদের শর্তটি সংবিধানে সনি্নবেশিত করার পক্ষে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ভাষণের অংশটুকুর উদ্ধৃতি দিচ্ছি_'ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাত কোটি মানুষের ধর্মকর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না এবং করব না। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রে কারো নেই। হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালন করবে, কারো বাধা দেওয়ার ক্ষমতা নেই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে, খ্রিস্টানরা তাদের ধর্ম করবে, তাদের কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হলো এই যে ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। ২৫ বছর আমরা দেখেছি ধর্মের নামে জুয়াচুরি, ধর্মের নামে শোষণ, ধর্মের নামে বেইমানি, ধর্মের নামে অত্যাচার, খুন, ব্যভিচার_এই বাংলাদেশের মাটিতে এসব চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কেউ বলে যে ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে, আমি বলব ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছি। কেউ যদি বলে গণতান্ত্রিক মৌলিক অধিকার নেই, আমি বলব, সাড়ে সাত কোটি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে যদি গুটিকয়েক লোকের অধিকার হরণ করতে হয়, তা করতেই হবে।'
অতঃপর ১৯৭৫ সালে ভারতের লোকসভা কর্তৃক ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনায় রাষ্ট্রের পরিচয় বাক্যে 'সেক্যুলার' শব্দটি সংবিধান সংশোধনপূর্বক সংযুক্ত করা হয়। পরবর্তীকালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট তাদের একটি রায়ে ভারতের সংবিধানে সনি্নবেশিত সেক্যুলারিজম শব্দটির বিশদ ব্যাখ্যা দিয়ে তার মূল বৈশিষ্ট্যগুলো নির্দিষ্ট করেন। বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলার কারণে ভারতের যে রাজ্যগুলোতে বিজেপি বা ভারতীয় জনতা পার্টির নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভা ক্ষমতায় ছিল, সেগুলোর মন্ত্রিসভা বাতিল করে কেন্দ্রীয় শাসনে আনার রাষ্ট্রপতির আদেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে মোকদ্দমাটি উত্থাপিত হয়। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে এই সিদ্ধান্ত দেওয়া হয় যে বাবরি মসজিদ ভাঙার ঘটনাটি সংবিধানে নির্দিষ্ট সেক্যুলারিজমের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হেতু ওই রাজ্যগুলো কেন্দ্রীয় শাসনাধীনে নেওয়ার আদেশটি সংবিধানসম্মত। রায়টিতে বলা হয় যে সেক্যুলারিজম কোনো ধর্মকে প্রাধান্য দেয় না এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসম্পন্ন ধর্মের ব্যবহার বারিত করে। পড়ুন, অল ইন্ডিয়া রিপোর্টার্স, ১৯৬৪, সুপ্রিম কোর্ট, পৃষ্ঠা ১৯১৮।
প্রিয় পাঠক, আশা করি, আপনি আমার সঙ্গে একমত হবেন যে ভারত-বাংলাদেশ মিত্রতার দার্শনিক ভিত্তির খোঁজ পাওয়া গেছে এবং সেটি হচ্ছে সেক্যুলারিজম, যার সঠিক অর্থ লোকায়ত মানসিকতা এবং যেটাকে আমরা ধর্মনিরপেক্ষতা বলে থাকি, যদিও শব্দটি নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি করা যায়_এই আশঙ্কাটি মনে রেখে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী একজন মানুষকে সজ্জন ও যুক্তিশীল করে, যেটি সুশৃঙ্খল সমাজ ও মৈত্রীবন্ধন গড়ার সুদৃঢ় ভিত্তি। একমাত্র একজন যুক্তিশীল মানুষই বলতে পারেন রবীন্দ্রনাথের ভাষায়_'আমি চোখ মেললুম আকাশে_/জ্বলে উঠল আলো/পুবে পশ্চিমে।'
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি,
আপিল বিভাগ, সুপ্রিম কোর্ট
No comments