ইতিহাস বার বার ফিরে আসে by আলম ফজলুর রহমান
আমার এই লেখার উদ্দেশ্য কাউকে ছোট বা বড় করা নয়। আমার একমাত্র লক্ষ্য হলো আমার কাছে ন্যায় এবং সত্য বলে যা প্রতিভাত হয়েছে তাই সাধারণ্যে প্রকাশ করা। অতএব এর সব দায় আমার। তবে আমার এই লেখায় যদি কেউ আহত হন তবে তা সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত, যার জন্য আগাম ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
সম্প্রতি সমাপ্ত বিডিআর বিদ্রোহের বিতর্কিত সমাধানের জন্য আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ‘ডটার অব পিস’ অভিধায় অভিষিক্ত হয়েছেন দলীয় সমর্থকদের দ্বারা। এমন পুরস্কার তার জন্য অতিসামান্য মনে করি। কারণ, দেশে-বিদেশে এর চেয়ে অনেক বড় ও অতীব উচ্চমানের পুরস্কার তিনি পেয়েছেন। বিডিআর বিদ্রোহের পরে ভারত সরকার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর গণতন্ত্র ও শান্তির জন্য যুগান্তকারী অবদানের জন্য আরও দুটি বিশ্বমানের পুরস্কার তার করকমলে অর্পণের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। সম্ভবত এ মাসেই তিনি তা দিল্লিতে এবং পশ্চিমবাংলায় গ্রহণ করে বাংলাদেশকে ধন্য করবেন। বিডিআর বিদ্রোহে সাতান্নজন আর্মি অফিসার অতীব নিষ্ঠুর ও নৃশংসভাবে নিহত হওয়ার পরে তাদের পরিবার সম্পূর্ণ রূপে ধ্বংস হয়ে এখন দুঃখের অথৈ পাথারে নিমজ্জিত। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘করুণা’ কবিতায় এই অসহায় পরিবারগুলোর গগনবিদারী হাহাকার এবং কান্নার মর্মস্পর্শী সুর শুনতে পাই।
‘সহসা উঠিল শূন্যে বিলাপ কাহার\
স্বর্গে যেন মায়াদেবী করে হাহাকার।’
আমাদের দেশপ্রেমিক সশস্ত্রবাহিনী বিশ্বশান্তি রক্ষায় অবদান রাখতে গিয়ে ইতোমধ্যে অনেক রক্ত দিয়েছে। এর বিনিময়ে বিদেশের অনেক রথী-মহারথী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অনেক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন এবং ভবিষ্যতেও হবেন, এটাই নিয়ম। অন্তত বাংলার প্রবচন তাই বলে। যেমন ‘কষ্ট করে হাঁস ডিম দেয়, খায় দারোগাবাবু।’ এটা কেবল বাংলাদেশের বিষয় নয় বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই কম-বেশি তাই হয়। যেমন ধরুন আমেরিকার সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধে বহু আমেরিকান সৈন্য ইরাক ও আফগানিস্তানে ইতোমধ্যে প্রাণ দিয়েছে, প্রতিদিন দিচ্ছে এবং অদূর ভবিষ্যতেও দেবে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, আমেরিকার এই সৈনিকদের রক্তের ঋণ বিশ্ব পরিশোধ করল প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে অকালীন আগাম বিশ্বশান্তির জন্য ‘নোবেল’ পুরস্কারে ভূষিত করে। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা কী করেছেন জানি না, তবে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিডিআর বিদ্রোহে শাহাদাত্ বরণকারী অফিসারদের মধ্যে একজনের মা এবং অন্য একজনের শাশুড়িকে সংসদ সদস্য মনোনীত করে মহান সংসদে বসার দুর্লভ সুযোগ করে দিয়েছেন; কিন্তু যে বিতর্কিত অবস্থায় বিডিআর বিদ্রোহ দমনে রাজনৈতিক সমাধান দেয়া হয়েছে, এটা প্রায় নিশ্চিত যে যদি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে তবে বিডিআর বিদ্রোহের পুনঃতদন্ত হবে। এ ক্ষেত্রে ওই দুই শাহাদাত্বরণকারী অফিসারের মা এবং শাশুড়ি যদি তদন্তের মুখোমুখি হয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হন তবে আমি প্রায় নিশ্চিতভাবে বলতে পারি তাদের একটি মাত্র জবাব হবে, আর তা হচ্ছে ‘জীবনের প্রতি হুমকি’। কারণ, এই জবাবের সপক্ষে ঐতিহাসিক নজির আমাদের সামনে বিদ্যমান। একটু পেছনে ফিরে যাই। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলেন। আমরা কী দেখলাম! ঢাকা সেনানিবাস থেকে কোনো সেনাবহর বত্রিশ নম্বরে বঙ্গবন্ধুকে রক্ষার জন্য গেল না, আকাশে কোনো বিমান উড়ল না বিদ্রোহীদের আকাশ থেকে গোলাবর্ষণ করে ধ্বংস করার জন্য। যা দেখলাম তা হচ্ছে, বাহিনী প্রধানরা, রেডিও-টিভিতে বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের পক্ষে আনুগত্য প্রকাশ করে বক্তব্য দিচ্ছেন। দেশবাসী ইতোমধ্যেই অবহিত হয়েছেন, তাদের জবাব ছিল একটি আর তা হচ্ছে ‘গানপয়েন্ট’। জীবনের প্রতি হুমকি কিংবা গানপয়েন্ট এসব অন্যদের বেলায় প্রযোজ্য হলেও বাহিনী প্রধানদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হওয়ার তো কথা নয়। কারণ, তারা তো পবিত্র কোরআন ছুঁয়ে শপথ নিয়েছেন জীবনের বিনিময়ে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করবেন। (বাকি অংশ ৭ এর পৃষ্ঠায়)
বাহিনী প্রধানরা কি তা করেছেন? যদি না করে থাকেন তবে সংসদ সদস্য ফজলুল করিম সেলিমের দাবির সঙ্গে আমি একমত পোষণ করি। তবে কেবল ওই সময়ের সেনাপ্রধানকে এককভাবে দায়ী করা সঠিক বিচার হবে না। তবে একজন ব্যক্তি যিনি কর্নেল জামিল বত্রিশ নম্বরে পৌঁছে বঙ্গবন্ধুকে রক্ষার একটা শেষ প্রচেষ্টা করতে গিয়ে বিদ্রোহীদের দ্বারা নিহত হন। আজও তাকে এই নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগের জন্য কোনো পুরস্কারে পুরস্কৃত করা হয়েছে বলে শুনিনি। এটাই নিয়ম। ওই যে বাংলার প্রবচন ‘ডিম খায় দারোগাবাবু’। কেউ না কেউ তো ডিম খাচ্ছেন। এই ডিম কে কখন কীভাবে খেয়েছেন তার একটা ঐতিহাসিক মূল্যায়ন হওয়া বাঞ্ছনীয় মনে করি। ইতিহাসের সিঁড়ি বেয়ে একটু নিচে নেমে দেখা যাক কী দেখা যায়!
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে নিহত হলেন। ওই সময় সেনাপ্রধান জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। নিহত হলেন সেক্টর কমান্ডার চব্বিশ পদাতিক ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং জেনারেল মঞ্জুর। তদন্তে সম্ভবত বলা হলো তিনি এনকাউন্টারে সৈনিকদের গুলিতে নিহত হয়েছেন। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে বলা হলো জেনারেল মঞ্জুরের শরীরে কোথাও গুলির আঘাতের চিহ্ন নেই। কেবল মাথার পেছনে একটি গুলির আঘাত রয়েছে এবং তাতেই তার মৃত্যু হয়েছে। সৈনিকদের এনকাউন্টারে মৃত্যু হলে তো জেনারেল মঞ্জুরের শরীরে শত শত গুলির আঘাত থাকার কথা ছিল। সম্ভবত বারোজন মুক্তিযোদ্ধা খেতাবপ্রাপ্ত অফিসারকে অতীব পৈশাচিকভাবে নির্যাতন করে নিষ্ঠুরভাবে প্রায় একটা প্রহসনের বিচার করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মেরে ফেলা হলো। ডজন ডজন মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে চাকরিচ্যুত করা হলো, জেলে পোড়া হলো। পদোন্নতি বঞ্চিত করা হলো বেছে বেছে মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের। এর পরেও যে কিছুসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা অফিসার বিশেষ করে সেনাবাহিনীতে বেঁচে-বর্তে ছিলেন তার প্রায় সবাইকে গানফোডার হিসেবে পোস্টিং দেয়া হলো পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে। রাষ্ট্রপতি হলেন জেনারেল এরশাদ। আমরা হতবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম মহান মুক্তিযুদ্ধের উপপ্রধান সেনাপতি এয়ার ভাইস মার্শাল একে খোন্দকার সতীর্থ মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের রক্তের উপরে পা দিয়ে এবং ওইসব মুক্তিযোদ্ধা অফিসারের পরিবার-পরিজনদের হাহাকারকে পদদলিত করে স্বৈরাচারী রাষ্ট্রপতি জেনারেল এরশাদের মন্ত্রিসভাকে আলোকিত করেছেন তার পরিকল্পনামন্ত্রী হিসেবে। কাকতালীয় হলেও সত্য, এখন স্বাধীনতার সপক্ষের মহাজোটের সরকারের বড় অংশীদার জেনারেল এরশাদ। ভাবতে অবাক লাগে বর্তমান সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রীও হলেন সেই একই ব্যক্তি মহান মুক্তিযুদ্ধের উপপ্রধান সেনাপতি এয়ার ভাইস মার্শাল একে খোন্দকার। জেনারেল এরশাদের সময়ে যেভাবে ঠিক একইভাবে সমানে ডিম খেয়ে যাচ্ছেন। তবে ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত আলাদা। যদি জিজ্ঞেস করেন এরশাদ মন্ত্রিসভায় কেন যোগ দিয়েছিলেন? জবাব পাবেন, দেশকে ‘মার্শাল ল’ মুক্ত করে গণতন্ত্রে ফিরিয়ে আনতে অবদান রাখতে। যদি বলেন মহাজোট সরকারের মন্ত্রী কেন হয়েছেন? উত্তর হবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়ন, বাহাত্তরের সংবিধানে দেশকে ফিরিয়ে নেয়া, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ জনগণকে উপহার দেয়া এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাংলার মাটিতে নিশ্চিত করে দেশকে কলঙ্কমুক্ত করা। সংসদ সদস্য ফজলুল করিম সেলিম যাই বলুন, জেনারেল শফিউল্লাহ তো আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও আওয়ামী লীগ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন, এ কথা তো সত্য। এএমএ মুহিত এরশাদ সরকারের অর্থমন্ত্রী, বর্তমানেও অর্থমন্ত্রী। জনাব এইচটি ইমাম খোন্দকার মোস্তাকের শপথ অনুষ্ঠান আয়োজন করেও বর্তমান সরকারের মাননীয় উপদেষ্টা। জিজ্ঞেস করুন, উত্তর একটাই, হয় গণতন্ত্রকে মার্শাল ল’ মুক্ত করা অথবা গানপয়েন্ট থিওরি। মজার ব্যাপার হচ্ছে এরা কখনও কপটভাবে জনসভায়, কখনও মিডিয়ায় নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা, অন্যকে দোষারোপ বা হার স্বীকার করেন জনরোষ থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য, উদ্দেশ্য গদি দখলে রেখে রাজভোগ খাওয়া।
যেমন করেছিলেন ভরত জনরোষ থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য, যার বর্ণনা আমরা রামায়ণে পাই। আপনারা ভালো জানেন কৈকেয়ীর ষড়যন্ত্রে অতীব জনপ্রিয় যুবরাজ অযোধ্যার সিংহাসনের প্রথম উত্তরাধিকারী রাম চৌদ্দ বছরের জন্য বনবাসে গেলে কৈকেয়ী পুত্র ভরত অযোধ্যার রাজা হন। রামের বনবাসে ওই সময় অযোধ্যার আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা রোষে ফেটে পড়ে। তারা রামের কাছে মিনতি জানাতে থাকে অন্যায় ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে অযোধ্যার সিংহাসনে বসতে; কিন্তু পিতৃভক্ত রাম পিতৃ প্রতিজ্ঞা রক্ষায় অযোধ্যাবাসীদের দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে চৌদ্দ বছরের জন্য ভাই লক্ষ্মণসহ বনবাসে চলে গেলে জনরোষ এসে পড়ে ভরতের উপর। এই জনরোষ থেকে নিজেকে রক্ষা করার কৌশল হিসেবে ভরত অযোধ্যার সিংহাসনে না বসে সিংহাসনে রামের খড়ম জোড়া সযত্নে স্থাপন করে নিজে সিংহাসনের পাদদেশে বসে অশ্রুসজল নয়নে বিলাপ করে বলতে থাকেন, দাদা স্বর্গ দাদা মর্ত আমি কেউ নই। দাদার খড়ম সিংহাসনে স্থাপন করেছি আমি দাদার অপেক্ষায়, সিংহাসনের পাদদেশে চৌদ্দ বছর অপেক্ষা করব, আপনারা শান্ত হোন। কী চমত্কার কৌশলে ভরত অযোধ্যার জনগণকে বিভ্রান্ত করে নিজেকে জনরোষ থেকে রক্ষাই শুধু করলেন না, মা-পুতে মিলে দীর্ঘ চৌদ্দ বছর অযোধ্যার রাজভোগ খেলেন। বর্তমানের কলিযুগে ঠিক একই কৌশলে জেনারেল এরশাদ এবং খোন্দকার মোশতাকের সৈনিকরা বঙ্গবন্ধুর সৈনিকে পরিণত হয়ে সমানে বাংলার রাজভোগ কীভাবে খেয়ে যাচ্ছেন তা তো আপনারা নিজেরাই দেখছেন।
পরিশেষে কিছু স্পর্শকাতর বিষয়ে সবার নির্মোহ ও নির্দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সুবিবেচনার দাবি রেখে এই লেখার সমাপ্তি টানব। আপনারা জানেন মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের সহযোগী হিসেবে রাজাকার, আল-বদর ও আল-শামস সৃষ্টি করে। স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাজয় বরণ করে পাকিস্তানি বাহিনী বাংলাদেশ ছেড়ে চলে গেছে আটত্রিশ বছর আগে; কিন্তু জাতি কি ভারমুক্ত হতে পেরেছে? পারেনি, বরং সংঘাত আর বিভেদের আশঙ্কা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়তো একদিন হবে। এই বিচারের পরে জাতি সংঘাতমুক্ত হয়ে জাতীয় ঐক্য অর্জন করতে সক্ষম হবে? আলামত দেখে তো তা মনে হয় না। ইতোমধ্যে মুক্তিযুদ্ধের ব্যানারে প্রজন্ম একাত্তর, প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ এবং প্রজন্ম বুদ্ধিজীবীর মতো আবির্ভূত সংগঠনগুলোকে জাতীয় আপসরফা বা জাতীয় ঐক্য অর্জনের চেয়ে একান্তভাবে জাতীয় বিভেদ ও সংঘাতে অবদান রাখার জন্যই যেন ভবিষ্যতের জন্য তৈরি করা হচ্ছে। এটা শুভ লক্ষণ নয়। এরই মধ্যে সেক্টর কমান্ডার ফোরাম থেকে সম্ভবত প্রতিটি বধ্যভূমিতে ঘৃণাস্তম্ভ স্থাপনের ডাক এবং দাবি জানানো হয়েছে। এই ঘৃণাস্তম্ভগুলোতে আগামী প্রজন্ম থু থু নিক্ষেপ করে স্বাধীনতা বিরোধীদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করবে। এতে করে নাকি জাতি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হবে। আমি মনে করি এবং এটাই শাশ্বত যে, ঘৃণা ঘৃণার জন্ম দেয় প্রেমের জন্ম দেয় না। আমরা আমাদের ভবিষ্যত্ প্রজন্মকে অন্যকে ঘৃণা করার শিক্ষা কেন দেব? বরং তাদের শিক্ষা দেব প্রেম এবং ক্ষমার মাহাত্ম্য। মাননীয় সেক্টর কমান্ডাররা সবাই সামরিক বাহিনীর সদস্য। তাদের সমীপে আমার করজোড় নিবেদন, ট্যাকটিসের ভুল সংশোধন করা যায় কিন্তু স্ট্রাটেজিক ভুল শোধরানো যায় না। জাতিকে এই ভুলের জন্য চরম মাশুল দিতে হয় আগত কালে। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পরে এ দেশে কোনো স্বাধীনতা বিরোধী জীবিত থাকবে না। থাকবে তাদের প্রজন্ম। ঘৃণাস্তম্ভের থু থু তো গিয়ে পড়বে এই প্রজন্মের মুখে। এতে করে ঘৃণা এবং বিভেদের পাহাড় রচিত হবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। এতে লাভবান হবে আমাদের শত্রুরা যারা অমিত সম্ভাবনার দেশ বাংলাদেশকে শতধা বিভক্ত ও বিভাজিত করে দুর্বল এবং অভ্যন্তরীণ সংঘাতে নিমজ্জমান রেখে অনন্তকাল শোষণ করতে চায়। মাননীয় সেক্টর কমান্ডাররা আপনারা এ দেশের গর্ব। আপনারা দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। আপনারা মনের অজান্তেই ঘৃণাস্তম্ভের মতো জাতিকে শোষণের একটি মোক্ষম হাতিয়ার আমাদের শত্রুর হাতে তুলে দিচ্ছেন না তো? তদুপরি পূর্বপুরুষের পাপ ও ভুলের মাশুল উত্তর প্রজন্ম বহন করবে কেন? এমন ধারণা ইসলাম ধর্মসম্মত নয়। পবিত্র কোরআনের স্পষ্ট নির্দেশ একে অন্যের পাপ বহন করবে না।
সব শেষে সবার কাছে, সব প্রজন্মের কাছে আমার একান্ত ও সনির্বন্ধ নিবেদন, আজ থেকে সব প্রজন্মের পরিচয় হোক ‘প্রজন্ম বাংলাদেশ’।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ রাইফেলস বাহিনী প্রধানরা কি তা করেছেন? যদি না করে থাকেন তবে সংসদ সদস্য ফজলুল করিম সেলিমের দাবির সঙ্গে আমি একমত পোষণ করি। তবে কেবল ওই সময়ের সেনাপ্রধানকে এককভাবে দায়ী করা সঠিক বিচার হবে না। একজন ব্যক্তি যিনি কর্নেল জামিল বত্রিশ নম্বরে পৌঁছে বঙ্গবন্ধুকে রক্ষার একটা শেষ প্রচেষ্টা করতে গিয়ে বিদ্রোহীদের দ্বারা নিহত হন। আজও তাকে এই নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগের জন্য কোনো পুরস্কারে পুরস্কৃত করা হয়েছে বলে শুনিনি। এটাই নিয়ম। ওই যে বাংলার প্রবচন ‘ডিম খায় দারোগাবাবু’। কেউ না কেউ তো ডিম খাচ্ছেন। এই ডিম কে কখন কীভাবে খেয়েছেন তার একটা ঐতিহাসিক মূল্যায়ন হওয়া বাঞ্ছনীয় মনে করি। ইতিহাসের সিঁড়ি বেয়ে একটু নিচে নেমে দেখা যাক কী দেখা যায়!
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে নিহত হলেন। ওই সময় সেনাপ্রধান জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। নিহত হলেন সেক্টর কমান্ডার চব্বিশ পদাতিক ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং মেজর জেনারেল মঞ্জুর। তদন্তে সম্ভবত বলা হলো তিনি এনকাউন্টারে সৈনিকদের গুলিতে নিহত হয়েছেন। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে বলা হলো মেজর জেনারেল মঞ্জুরের শরীরে কোথাও গুলির আঘাতের চিহ্ন নেই। কেবল মাথার পেছনে একটি গুলির আঘাত রয়েছে এবং তাতেই তার মৃত্যু হয়েছে। সৈনিকদের এনকাউন্টারে মৃত্যু হলে তো মঞ্জুরের শরীরে শত শত গুলির আঘাত থাকার কথা ছিল। সম্ভবত বারোজন মুক্তিযোদ্ধা খেতাবপ্রাপ্ত অফিসারকে অতীব পৈশাচিকভাবে নির্যাতন করে নিষ্ঠুরভাবে প্রায় একটা প্রহসনের বিচার করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মেরে ফেলা হলো। ডজন ডজন মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে চাকরিচ্যুত করা হলো, জেলে পোরা হলো। পদোন্নতিবঞ্চিত করা হলো বেছে বেছে মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের। এর পরেও যে কিছুসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা অফিসার বিশেষ করে সেনাবাহিনীতে বেঁচে-বর্তে ছিলেন তার প্রায় সবাইকে গানফোডার হিসেবে পোস্টিং দেয়া হলো পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে। রাষ্ট্রপতি হলেন জেনারেল এরশাদ। আমরা হতবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম মহান মুক্তিযুদ্ধের উপপ্রধান সেনাপতি এয়ার ভাইস মার্শাল একে খোন্দকার সতীর্থ মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের রক্তের উপরে পা দিয়ে এবং ওইসব মুক্তিযোদ্ধা অফিসারের পরিবার-পরিজনদের হাহাকারকে পদদলিত করে স্বৈরাচারী রাষ্ট্রপতি জেনারেল এরশাদের মন্ত্রিসভাকে আলোকিত করেছেন তার পরিকল্পনামন্ত্রী হিসেবে। কাকতালীয় হলেও সত্য, এখন স্বাধীনতার সপক্ষের মহাজোটের সরকারের বড় অংশীদার জেনারেল এরশাদ। ভাবতে অবাক লাগে বর্তমান সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রীও হলেন সেই একই ব্যক্তি মহান মুক্তিযুদ্ধের উপপ্রধান সেনাপতি এয়ার ভাইস মার্শাল একে খোন্দকার। জেনারেল এরশাদের সময়ে যেভাবে ঠিক একইভাবে সমানে ডিম খেয়ে যাচ্ছেন। তবে ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত আলাদা। যদি জিজ্ঞেস করেন এরশাদ মন্ত্রিসভায় কেন যোগ দিয়েছিলেন? জবাব
‘সহসা উঠিল শূন্যে বিলাপ কাহার\
স্বর্গে যেন মায়াদেবী করে হাহাকার।’
আমাদের দেশপ্রেমিক সশস্ত্রবাহিনী বিশ্বশান্তি রক্ষায় অবদান রাখতে গিয়ে ইতোমধ্যে অনেক রক্ত দিয়েছে। এর বিনিময়ে বিদেশের অনেক রথী-মহারথী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অনেক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন এবং ভবিষ্যতেও হবেন, এটাই নিয়ম। অন্তত বাংলার প্রবচন তাই বলে। যেমন ‘কষ্ট করে হাঁস ডিম দেয়, খায় দারোগাবাবু।’ এটা কেবল বাংলাদেশের বিষয় নয় বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই কম-বেশি তাই হয়। যেমন ধরুন আমেরিকার সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধে বহু আমেরিকান সৈন্য ইরাক ও আফগানিস্তানে ইতোমধ্যে প্রাণ দিয়েছে, প্রতিদিন দিচ্ছে এবং অদূর ভবিষ্যতেও দেবে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, আমেরিকার এই সৈনিকদের রক্তের ঋণ বিশ্ব পরিশোধ করল প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে অকালীন আগাম বিশ্বশান্তির জন্য ‘নোবেল’ পুরস্কারে ভূষিত করে। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা কী করেছেন জানি না, তবে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিডিআর বিদ্রোহে শাহাদাত্ বরণকারী অফিসারদের মধ্যে একজনের মা এবং অন্য একজনের শাশুড়িকে সংসদ সদস্য মনোনীত করে মহান সংসদে বসার দুর্লভ সুযোগ করে দিয়েছেন; কিন্তু যে বিতর্কিত অবস্থায় বিডিআর বিদ্রোহ দমনে রাজনৈতিক সমাধান দেয়া হয়েছে, এটা প্রায় নিশ্চিত যে যদি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে তবে বিডিআর বিদ্রোহের পুনঃতদন্ত হবে। এ ক্ষেত্রে ওই দুই শাহাদাত্বরণকারী অফিসারের মা এবং শাশুড়ি যদি তদন্তের মুখোমুখি হয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হন তবে আমি প্রায় নিশ্চিতভাবে বলতে পারি তাদের একটি মাত্র জবাব হবে, আর তা হচ্ছে ‘জীবনের প্রতি হুমকি’। কারণ, এই জবাবের সপক্ষে ঐতিহাসিক নজির আমাদের সামনে বিদ্যমান। একটু পেছনে ফিরে যাই। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলেন। আমরা কী দেখলাম! ঢাকা সেনানিবাস থেকে কোনো সেনাবহর বত্রিশ নম্বরে বঙ্গবন্ধুকে রক্ষার জন্য গেল না, আকাশে কোনো বিমান উড়ল না বিদ্রোহীদের আকাশ থেকে গোলাবর্ষণ করে ধ্বংস করার জন্য। যা দেখলাম তা হচ্ছে, বাহিনী প্রধানরা, রেডিও-টিভিতে বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের পক্ষে আনুগত্য প্রকাশ করে বক্তব্য দিচ্ছেন। দেশবাসী ইতোমধ্যেই অবহিত হয়েছেন, তাদের জবাব ছিল একটি আর তা হচ্ছে ‘গানপয়েন্ট’। জীবনের প্রতি হুমকি কিংবা গানপয়েন্ট এসব অন্যদের বেলায় প্রযোজ্য হলেও বাহিনী প্রধানদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হওয়ার তো কথা নয়। কারণ, তারা তো পবিত্র কোরআন ছুঁয়ে শপথ নিয়েছেন জীবনের বিনিময়ে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করবেন। (বাকি অংশ ৭ এর পৃষ্ঠায়)
বাহিনী প্রধানরা কি তা করেছেন? যদি না করে থাকেন তবে সংসদ সদস্য ফজলুল করিম সেলিমের দাবির সঙ্গে আমি একমত পোষণ করি। তবে কেবল ওই সময়ের সেনাপ্রধানকে এককভাবে দায়ী করা সঠিক বিচার হবে না। তবে একজন ব্যক্তি যিনি কর্নেল জামিল বত্রিশ নম্বরে পৌঁছে বঙ্গবন্ধুকে রক্ষার একটা শেষ প্রচেষ্টা করতে গিয়ে বিদ্রোহীদের দ্বারা নিহত হন। আজও তাকে এই নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগের জন্য কোনো পুরস্কারে পুরস্কৃত করা হয়েছে বলে শুনিনি। এটাই নিয়ম। ওই যে বাংলার প্রবচন ‘ডিম খায় দারোগাবাবু’। কেউ না কেউ তো ডিম খাচ্ছেন। এই ডিম কে কখন কীভাবে খেয়েছেন তার একটা ঐতিহাসিক মূল্যায়ন হওয়া বাঞ্ছনীয় মনে করি। ইতিহাসের সিঁড়ি বেয়ে একটু নিচে নেমে দেখা যাক কী দেখা যায়!
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে নিহত হলেন। ওই সময় সেনাপ্রধান জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। নিহত হলেন সেক্টর কমান্ডার চব্বিশ পদাতিক ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং জেনারেল মঞ্জুর। তদন্তে সম্ভবত বলা হলো তিনি এনকাউন্টারে সৈনিকদের গুলিতে নিহত হয়েছেন। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে বলা হলো জেনারেল মঞ্জুরের শরীরে কোথাও গুলির আঘাতের চিহ্ন নেই। কেবল মাথার পেছনে একটি গুলির আঘাত রয়েছে এবং তাতেই তার মৃত্যু হয়েছে। সৈনিকদের এনকাউন্টারে মৃত্যু হলে তো জেনারেল মঞ্জুরের শরীরে শত শত গুলির আঘাত থাকার কথা ছিল। সম্ভবত বারোজন মুক্তিযোদ্ধা খেতাবপ্রাপ্ত অফিসারকে অতীব পৈশাচিকভাবে নির্যাতন করে নিষ্ঠুরভাবে প্রায় একটা প্রহসনের বিচার করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মেরে ফেলা হলো। ডজন ডজন মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে চাকরিচ্যুত করা হলো, জেলে পোড়া হলো। পদোন্নতি বঞ্চিত করা হলো বেছে বেছে মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের। এর পরেও যে কিছুসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা অফিসার বিশেষ করে সেনাবাহিনীতে বেঁচে-বর্তে ছিলেন তার প্রায় সবাইকে গানফোডার হিসেবে পোস্টিং দেয়া হলো পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে। রাষ্ট্রপতি হলেন জেনারেল এরশাদ। আমরা হতবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম মহান মুক্তিযুদ্ধের উপপ্রধান সেনাপতি এয়ার ভাইস মার্শাল একে খোন্দকার সতীর্থ মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের রক্তের উপরে পা দিয়ে এবং ওইসব মুক্তিযোদ্ধা অফিসারের পরিবার-পরিজনদের হাহাকারকে পদদলিত করে স্বৈরাচারী রাষ্ট্রপতি জেনারেল এরশাদের মন্ত্রিসভাকে আলোকিত করেছেন তার পরিকল্পনামন্ত্রী হিসেবে। কাকতালীয় হলেও সত্য, এখন স্বাধীনতার সপক্ষের মহাজোটের সরকারের বড় অংশীদার জেনারেল এরশাদ। ভাবতে অবাক লাগে বর্তমান সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রীও হলেন সেই একই ব্যক্তি মহান মুক্তিযুদ্ধের উপপ্রধান সেনাপতি এয়ার ভাইস মার্শাল একে খোন্দকার। জেনারেল এরশাদের সময়ে যেভাবে ঠিক একইভাবে সমানে ডিম খেয়ে যাচ্ছেন। তবে ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত আলাদা। যদি জিজ্ঞেস করেন এরশাদ মন্ত্রিসভায় কেন যোগ দিয়েছিলেন? জবাব পাবেন, দেশকে ‘মার্শাল ল’ মুক্ত করে গণতন্ত্রে ফিরিয়ে আনতে অবদান রাখতে। যদি বলেন মহাজোট সরকারের মন্ত্রী কেন হয়েছেন? উত্তর হবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়ন, বাহাত্তরের সংবিধানে দেশকে ফিরিয়ে নেয়া, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ জনগণকে উপহার দেয়া এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাংলার মাটিতে নিশ্চিত করে দেশকে কলঙ্কমুক্ত করা। সংসদ সদস্য ফজলুল করিম সেলিম যাই বলুন, জেনারেল শফিউল্লাহ তো আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও আওয়ামী লীগ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন, এ কথা তো সত্য। এএমএ মুহিত এরশাদ সরকারের অর্থমন্ত্রী, বর্তমানেও অর্থমন্ত্রী। জনাব এইচটি ইমাম খোন্দকার মোস্তাকের শপথ অনুষ্ঠান আয়োজন করেও বর্তমান সরকারের মাননীয় উপদেষ্টা। জিজ্ঞেস করুন, উত্তর একটাই, হয় গণতন্ত্রকে মার্শাল ল’ মুক্ত করা অথবা গানপয়েন্ট থিওরি। মজার ব্যাপার হচ্ছে এরা কখনও কপটভাবে জনসভায়, কখনও মিডিয়ায় নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা, অন্যকে দোষারোপ বা হার স্বীকার করেন জনরোষ থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য, উদ্দেশ্য গদি দখলে রেখে রাজভোগ খাওয়া।
যেমন করেছিলেন ভরত জনরোষ থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য, যার বর্ণনা আমরা রামায়ণে পাই। আপনারা ভালো জানেন কৈকেয়ীর ষড়যন্ত্রে অতীব জনপ্রিয় যুবরাজ অযোধ্যার সিংহাসনের প্রথম উত্তরাধিকারী রাম চৌদ্দ বছরের জন্য বনবাসে গেলে কৈকেয়ী পুত্র ভরত অযোধ্যার রাজা হন। রামের বনবাসে ওই সময় অযোধ্যার আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা রোষে ফেটে পড়ে। তারা রামের কাছে মিনতি জানাতে থাকে অন্যায় ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে অযোধ্যার সিংহাসনে বসতে; কিন্তু পিতৃভক্ত রাম পিতৃ প্রতিজ্ঞা রক্ষায় অযোধ্যাবাসীদের দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে চৌদ্দ বছরের জন্য ভাই লক্ষ্মণসহ বনবাসে চলে গেলে জনরোষ এসে পড়ে ভরতের উপর। এই জনরোষ থেকে নিজেকে রক্ষা করার কৌশল হিসেবে ভরত অযোধ্যার সিংহাসনে না বসে সিংহাসনে রামের খড়ম জোড়া সযত্নে স্থাপন করে নিজে সিংহাসনের পাদদেশে বসে অশ্রুসজল নয়নে বিলাপ করে বলতে থাকেন, দাদা স্বর্গ দাদা মর্ত আমি কেউ নই। দাদার খড়ম সিংহাসনে স্থাপন করেছি আমি দাদার অপেক্ষায়, সিংহাসনের পাদদেশে চৌদ্দ বছর অপেক্ষা করব, আপনারা শান্ত হোন। কী চমত্কার কৌশলে ভরত অযোধ্যার জনগণকে বিভ্রান্ত করে নিজেকে জনরোষ থেকে রক্ষাই শুধু করলেন না, মা-পুতে মিলে দীর্ঘ চৌদ্দ বছর অযোধ্যার রাজভোগ খেলেন। বর্তমানের কলিযুগে ঠিক একই কৌশলে জেনারেল এরশাদ এবং খোন্দকার মোশতাকের সৈনিকরা বঙ্গবন্ধুর সৈনিকে পরিণত হয়ে সমানে বাংলার রাজভোগ কীভাবে খেয়ে যাচ্ছেন তা তো আপনারা নিজেরাই দেখছেন।
পরিশেষে কিছু স্পর্শকাতর বিষয়ে সবার নির্মোহ ও নির্দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সুবিবেচনার দাবি রেখে এই লেখার সমাপ্তি টানব। আপনারা জানেন মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের সহযোগী হিসেবে রাজাকার, আল-বদর ও আল-শামস সৃষ্টি করে। স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাজয় বরণ করে পাকিস্তানি বাহিনী বাংলাদেশ ছেড়ে চলে গেছে আটত্রিশ বছর আগে; কিন্তু জাতি কি ভারমুক্ত হতে পেরেছে? পারেনি, বরং সংঘাত আর বিভেদের আশঙ্কা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়তো একদিন হবে। এই বিচারের পরে জাতি সংঘাতমুক্ত হয়ে জাতীয় ঐক্য অর্জন করতে সক্ষম হবে? আলামত দেখে তো তা মনে হয় না। ইতোমধ্যে মুক্তিযুদ্ধের ব্যানারে প্রজন্ম একাত্তর, প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ এবং প্রজন্ম বুদ্ধিজীবীর মতো আবির্ভূত সংগঠনগুলোকে জাতীয় আপসরফা বা জাতীয় ঐক্য অর্জনের চেয়ে একান্তভাবে জাতীয় বিভেদ ও সংঘাতে অবদান রাখার জন্যই যেন ভবিষ্যতের জন্য তৈরি করা হচ্ছে। এটা শুভ লক্ষণ নয়। এরই মধ্যে সেক্টর কমান্ডার ফোরাম থেকে সম্ভবত প্রতিটি বধ্যভূমিতে ঘৃণাস্তম্ভ স্থাপনের ডাক এবং দাবি জানানো হয়েছে। এই ঘৃণাস্তম্ভগুলোতে আগামী প্রজন্ম থু থু নিক্ষেপ করে স্বাধীনতা বিরোধীদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করবে। এতে করে নাকি জাতি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হবে। আমি মনে করি এবং এটাই শাশ্বত যে, ঘৃণা ঘৃণার জন্ম দেয় প্রেমের জন্ম দেয় না। আমরা আমাদের ভবিষ্যত্ প্রজন্মকে অন্যকে ঘৃণা করার শিক্ষা কেন দেব? বরং তাদের শিক্ষা দেব প্রেম এবং ক্ষমার মাহাত্ম্য। মাননীয় সেক্টর কমান্ডাররা সবাই সামরিক বাহিনীর সদস্য। তাদের সমীপে আমার করজোড় নিবেদন, ট্যাকটিসের ভুল সংশোধন করা যায় কিন্তু স্ট্রাটেজিক ভুল শোধরানো যায় না। জাতিকে এই ভুলের জন্য চরম মাশুল দিতে হয় আগত কালে। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পরে এ দেশে কোনো স্বাধীনতা বিরোধী জীবিত থাকবে না। থাকবে তাদের প্রজন্ম। ঘৃণাস্তম্ভের থু থু তো গিয়ে পড়বে এই প্রজন্মের মুখে। এতে করে ঘৃণা এবং বিভেদের পাহাড় রচিত হবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। এতে লাভবান হবে আমাদের শত্রুরা যারা অমিত সম্ভাবনার দেশ বাংলাদেশকে শতধা বিভক্ত ও বিভাজিত করে দুর্বল এবং অভ্যন্তরীণ সংঘাতে নিমজ্জমান রেখে অনন্তকাল শোষণ করতে চায়। মাননীয় সেক্টর কমান্ডাররা আপনারা এ দেশের গর্ব। আপনারা দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। আপনারা মনের অজান্তেই ঘৃণাস্তম্ভের মতো জাতিকে শোষণের একটি মোক্ষম হাতিয়ার আমাদের শত্রুর হাতে তুলে দিচ্ছেন না তো? তদুপরি পূর্বপুরুষের পাপ ও ভুলের মাশুল উত্তর প্রজন্ম বহন করবে কেন? এমন ধারণা ইসলাম ধর্মসম্মত নয়। পবিত্র কোরআনের স্পষ্ট নির্দেশ একে অন্যের পাপ বহন করবে না।
সব শেষে সবার কাছে, সব প্রজন্মের কাছে আমার একান্ত ও সনির্বন্ধ নিবেদন, আজ থেকে সব প্রজন্মের পরিচয় হোক ‘প্রজন্ম বাংলাদেশ’।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ রাইফেলস বাহিনী প্রধানরা কি তা করেছেন? যদি না করে থাকেন তবে সংসদ সদস্য ফজলুল করিম সেলিমের দাবির সঙ্গে আমি একমত পোষণ করি। তবে কেবল ওই সময়ের সেনাপ্রধানকে এককভাবে দায়ী করা সঠিক বিচার হবে না। একজন ব্যক্তি যিনি কর্নেল জামিল বত্রিশ নম্বরে পৌঁছে বঙ্গবন্ধুকে রক্ষার একটা শেষ প্রচেষ্টা করতে গিয়ে বিদ্রোহীদের দ্বারা নিহত হন। আজও তাকে এই নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগের জন্য কোনো পুরস্কারে পুরস্কৃত করা হয়েছে বলে শুনিনি। এটাই নিয়ম। ওই যে বাংলার প্রবচন ‘ডিম খায় দারোগাবাবু’। কেউ না কেউ তো ডিম খাচ্ছেন। এই ডিম কে কখন কীভাবে খেয়েছেন তার একটা ঐতিহাসিক মূল্যায়ন হওয়া বাঞ্ছনীয় মনে করি। ইতিহাসের সিঁড়ি বেয়ে একটু নিচে নেমে দেখা যাক কী দেখা যায়!
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে নিহত হলেন। ওই সময় সেনাপ্রধান জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। নিহত হলেন সেক্টর কমান্ডার চব্বিশ পদাতিক ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং মেজর জেনারেল মঞ্জুর। তদন্তে সম্ভবত বলা হলো তিনি এনকাউন্টারে সৈনিকদের গুলিতে নিহত হয়েছেন। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে বলা হলো মেজর জেনারেল মঞ্জুরের শরীরে কোথাও গুলির আঘাতের চিহ্ন নেই। কেবল মাথার পেছনে একটি গুলির আঘাত রয়েছে এবং তাতেই তার মৃত্যু হয়েছে। সৈনিকদের এনকাউন্টারে মৃত্যু হলে তো মঞ্জুরের শরীরে শত শত গুলির আঘাত থাকার কথা ছিল। সম্ভবত বারোজন মুক্তিযোদ্ধা খেতাবপ্রাপ্ত অফিসারকে অতীব পৈশাচিকভাবে নির্যাতন করে নিষ্ঠুরভাবে প্রায় একটা প্রহসনের বিচার করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মেরে ফেলা হলো। ডজন ডজন মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে চাকরিচ্যুত করা হলো, জেলে পোরা হলো। পদোন্নতিবঞ্চিত করা হলো বেছে বেছে মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের। এর পরেও যে কিছুসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা অফিসার বিশেষ করে সেনাবাহিনীতে বেঁচে-বর্তে ছিলেন তার প্রায় সবাইকে গানফোডার হিসেবে পোস্টিং দেয়া হলো পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে। রাষ্ট্রপতি হলেন জেনারেল এরশাদ। আমরা হতবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম মহান মুক্তিযুদ্ধের উপপ্রধান সেনাপতি এয়ার ভাইস মার্শাল একে খোন্দকার সতীর্থ মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের রক্তের উপরে পা দিয়ে এবং ওইসব মুক্তিযোদ্ধা অফিসারের পরিবার-পরিজনদের হাহাকারকে পদদলিত করে স্বৈরাচারী রাষ্ট্রপতি জেনারেল এরশাদের মন্ত্রিসভাকে আলোকিত করেছেন তার পরিকল্পনামন্ত্রী হিসেবে। কাকতালীয় হলেও সত্য, এখন স্বাধীনতার সপক্ষের মহাজোটের সরকারের বড় অংশীদার জেনারেল এরশাদ। ভাবতে অবাক লাগে বর্তমান সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রীও হলেন সেই একই ব্যক্তি মহান মুক্তিযুদ্ধের উপপ্রধান সেনাপতি এয়ার ভাইস মার্শাল একে খোন্দকার। জেনারেল এরশাদের সময়ে যেভাবে ঠিক একইভাবে সমানে ডিম খেয়ে যাচ্ছেন। তবে ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত আলাদা। যদি জিজ্ঞেস করেন এরশাদ মন্ত্রিসভায় কেন যোগ দিয়েছিলেন? জবাব
No comments