রাজনীতির বলি তিস্তা-পানি বণ্টন by শেখ রোকন
ছয় দশক আলোচনা ও দরকষাকষির পর তিস্তার পানি বণ্টনে প্রত্যাশিত চুক্তি নিয়ে কলকাতা, ঢাকা ও দিলি্লতে যে নাটকীয়তা তৈরি হলো, তা নিয়ে যত কম বলা যায় ততই মঙ্গল। কেউ যদি বলেন, এই চুক্তি অনিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পর ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফর নিয়ে দুই দেশে যে উদ্দীপনা তৈরি হয়েছিল,
তা পানসে হয়ে গেছে, দোষ দেওয়া যাবে কি? বহুল প্রত্যাশিত এই সফরের আগের শেষ দু'দিন যখন সংবাদমাধ্যমে অনেকের হার্ট 'ব্রেকিং' নিউজ চলছিল, তখন দুই দেশের নেতৃত্বের মানসিক অবস্থা নয়, বহু প্রত্যাশা নিয়ে তাকিয়ে অপেক্ষা করা কোটি কোটি মানুষের মলিন মুখ নয়, প্রতিবেশী দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়ন প্রচেষ্টার ভবিষ্যৎ নয়, মনে পড়ছিল রামস্বামী আইয়ারের কথা।
গত বছর নভেম্বরে ঢাকায় গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকার পানিসম্পদভিত্তিক আঞ্চলিক সহযোগিতা সংক্রান্ত একটি সেমিনারে যোগ দিতে এসেছিলেন ভারতীয় পানি বিশেষজ্ঞ রামস্বামী আর আইয়ার। দক্ষিণ এশিয়ার নদী ও পানি সংক্রান্ত খোঁজখবর যারা রাখেন, তাদের কাছে এই নাম অপরিচিত নয়। আশির দশকে দীর্ঘদিন তিনি ছিলেন ভারতের পানিসম্পদ সচিব। পরে যোগ দিয়েছেন দিলি্লর সেন্টার ফর পলিসিতে। ভারতের প্রথম জাতীয় পানিনীতি প্রণয়নে তিনি ছিলেন মূল খসড়াকারক। বস্তুত গত তিন দশকে পানি ব্যবস্থাপনা, জলবিদ্যুৎ ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে অভিন্ন নদীর পানি বণ্টনে নয়াদিলি্ল যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, তার সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে মি. আইয়ার যুক্ত ছিলেন। বাংলাদেশেও 'বহুবার' এসেছেন। ওই সেমিনারে বক্তব্য দিতে গিয়ে ঠাট্টাচ্ছলে বলছিলেন যে বাংলাদেশে সেটা তার ২৫তম সফর। পানিসম্পদ নিয়ে তার রচিত ও সম্পাদিত বেশ কিছু গ্রন্থ রয়েছে এবং সেগুলো দেশে-বিদেশে যথেষ্ট আদৃত।
পানি বণ্টন সংক্রান্ত দরকষাকষিতে রামস্বামী আইয়ারের তৎপরতা ও কৌশল কখনও কখনও প্রতিবেশী দেশের প্রতিনিধিরা অপছন্দ করেছেন বটে; তার দক্ষতা ও প্রজ্ঞা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। তার আরেকটি দোষ বা গুণ হচ্ছে নিঃশব্দে কাজ করা এবং যথাসাধ্য সংবাদমাধ্যম এড়িয়ে চলা। ফলে সেবার তার বাংলাদেশ সফর ছিল নিভৃতেই। আমন্ত্রণপত্রে নাম দেখে ওই সেমিনারের শীর্ষ আয়োজককে অনুরোধ করেছিলাম একটা অ্যাপয়েন্টমেন্টের ব্যবস্থা করে দিতে। আইয়ার তার দীর্ঘদিনের বন্ধু। বন্ধুর সৌজন্যেই ভোরে দিলি্লর দিকে উড়াল দেওয়ার আগের রাতে ডিনারের পর আমাকে মিনিট দশেক সময় দিয়েছিলেন এই ভারতীয় বিশেষজ্ঞ।
তিস্তাসহ অন্যান্য নদীর পানি বণ্টন, গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তির অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতি, টিপাইমুখ বাঁধ, আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প, হিমালয় অঞ্চলে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প প্রভৃতি বিষয়ে আমি যতটা আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইছিলাম, উত্তরে ততটা আন্তরিকতা ছিল না। তিনি বরং গৎবাঁধা কিছু অফিসিয়াল ভাষ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন। বলছিলেন, অভিন্ন নদীর পানি বণ্টনসহ সব ইস্যুতে ভারত সবসময় আন্তরিক। দুই দেশের মধ্যে দফায় দফায় যে বৈঠক হচ্ছে, আলোচনা চলছে, এমনকি গঙ্গা নিয়ে দুই দফা চুক্তি হয়েছে। ভারত সাড়া না দিলে এগুলো কীভাবে সম্ভব হচ্ছে?
ভারত-বাংলাদেশের অভিন্ন নদী নিয়ে যে সামান্য জ্ঞান-বুদ্ধি হয়েছে, তা সম্বল করে এই বিশেষজ্ঞকে পাল্টা জিজ্ঞাসা করেছিলাম_ পানি বণ্টন ইস্যুতে দুই দেশের বিভিন্ন পর্যায়ে এত যোগাযোগ, বৈঠক, আলোচনা হয়েছে; তারপরও বিষয়টি দশকের পর দশক ঝুলে থাকছে কেন? কোথায় প্রতিবন্ধকতা? কয়েক দশকের চেষ্টায় কেবল একটি নদীর পানি বণ্টন (হোক অসন্তোষজনক) চুক্তি সম্ভব হয়েছে। বাকি ৫৩ নদীর ব্যাপার সুরাহা করতে আরও কত দশক লাগবে? রামস্বামী আইয়ার বেশ কিছুক্ষণ চুপ করেছিলেন। তারপর যা বলেছিলেন, তা এখনও স্পষ্ট মনে আছে। 'এটা আসলে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ব্যাপার। যখন দুই দেশে রাজনৈতিক সম্পর্ক খারাপ ছিল কিংবা খুব ভালো ছিল না, তখন দেখা গেছে পানি বণ্টনসহ দ্বিপক্ষীয় সব ইস্যুরই সমাধান কঠিন। আবার যখন রাজনৈতিক সম্পর্ক ভালো হয়েছে, দ্বিপক্ষীয় সব সমস্যার সমাধান সহজ হয়েছে। রাজনৈতিক সুসম্পর্কই দুই দেশের পানি সংকট সমাধানের চাবিকাঠি। আপনি দেখবেন, ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পরপরই গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি সম্ভব হয়েছিল। তিনি আবার ক্ষমতায় এসেছেন, এখন তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা সঠিকপথে এগোচ্ছে।'
বস্তুত কেবল মি আইয়ার নন, এমন কথা বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞদেরও কেউ কেউ বলে আসছেন। বিশেষ করে শ্রদ্ধেয় বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত। আজ থেকে আধা যুগ আগে, তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে যখন উত্তর দিগন্তে কিছুই স্পষ্ট নয়; তিনি বলেছিলেন, সীমান্তের উভয় পাশের রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়া তিস্তার পানি পাওয়া যাবে না। তারপর তার কাছে আরও বহুবার শুনেছি, বাংলাদেশ ও ভারতের অভিন্ন নদীর পানি বণ্টনের ইস্যু কারিগরি নয়, রাজনৈতিক। রাজনৈতিক নেতৃত্ব আন্তরিক হলে পানি ভাগাভাগির কারিগরি সমাধান মোটেই কঠিন নয়। কিন্তু একই কথা যখন রামস্বামীর মতো কেউ বলেন, তখন তার তাৎপর্য ভিন্ন।
অভিন্ন নদীর পানি ভাগাভাগী তো বটেই, অভিন্ন ইতিহাস ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকার হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে বাণিজ্য, যোগাযোগ প্রভৃতি সম্পর্কের ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি হচ্ছে না কেন, এ জন্য বরাবরই ভারতীয় আমলাতন্ত্রকে দায়ী করা হয়ে থাকে। বলা হয়, রাজনৈতিক নেতৃত্ব সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহী; আমলাতন্ত্রই তা ঠেকিয়ে রাখে। কিন্তু ভারতীয় ডাকসাইটে আমলা বলছেন, মূল চাবি রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতে। মনমোহন সিংয়ের দু'দিনের ঢাকা সফরের ডামাডোলের মধ্যে তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে যা যা হলো, তাতে কি মি. আইয়ারের বক্তব্যের সারবত্তাই প্রমাণ হলো না? প্রায় ছয় দশক ধরে যে তিস্তার ব্যাপারে আলোচনায় কোনো অগ্রগতি ছিল না; সীমান্তেও উভয় পাশে রাজনৈতিক সদিচ্ছার কারণে মাত্র আড়াই বছরের মাথায় তা আলোর মুখ দেখছিল। আবার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণেই তো বিপত্তি দেখা দিল।
শেষ কয়েকদিনের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। তিস্তার পানি কী অনুপাতে দুই দেশের মধ্যে বণ্টন হচ্ছে, তা নিশ্চিত জানা না গেলেও সবাই আশাবাদী ছিল যে চুক্তি হচ্ছে। প্রায় ছয় দশকের দরকষাকষির পর শেষ পর্যন্ত ১৫ বছরের অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তিতে উপনীত হওয়ার কাছাকাছি পেঁৗছেছিল দুই প্রতিবেশী। সিকিম থেকে তুষার টোপর মাথায় দিয়ে যে নয়নাভিরাম নদী আবহমানকাল থেকে আপন মনে সবুজ সমতলে এসে মিশত, বাঁধ ও ব্যারাজের কারণে তা গত তিন দশকে নিজের মতো বহমান থাকেনি। আশা করা হচ্ছিল, 'শুভেচ্ছা কূটনীতির' ফলে বিলম্বে হলেও এই চুক্তির পর ধীরে ধীরে আগের মতো বইতে শুরু করবে তিস্তা। বাংলাদেশ থেকে যদিও পানির হিস্যা নিয়ে বিভিন্ন মহলে শঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গের প্রতিক্রিয়া প্রমাণ করেছিল যে ঢাকা বঞ্চিত হচ্ছিল না। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে সদিচ্ছা ও আন্তরিকতার প্রমাণ দিতেই যেন তিস্তার পানি বণ্টনের ক্ষেত্রে ছাড় দিয়েছিল নয়াদিলি্ল। কিন্তু ভারতের কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ শরিক তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী এবং তিস্তা অববাহিকার বড় ভূখণ্ড পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চাপেই শেষ পর্যন্ত পিছু হটে মনমোহন সরকার।
মনমোহন সিংয়ের সফরের আগে আগে এমনও প্রত্যাশা করা হচ্ছিল যে তিস্তা সমস্যার সমাধান তো বটেই; পানি-সহযোগিতার নতুন যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে প্রতিবেশী দুই দেশ। পানি বণ্টনের পাশাপাশি অভিন্ন অর্ধশতাধিক নদীকে কেন্দ্র করে নৌ-পরিবহন, জলবিদ্যুৎ, বন্যা পূর্বাভাস ও নিয়ন্ত্রণ, দূষণ রোধ, সীমান্ত ভাঙন ব্যবস্থাপনা, ড্রেজিং, সেচ_ এসব ক্ষেত্রে যৌথ উদ্যোগ নতুন মাত্রা পাবে সামনের দিনগুলোতে। শোনা যাচ্ছিল, অভিন্ন নানা ইস্যুতে বাংলাদেশের আন্তরিকতা স্পষ্ট হওয়ায় দুই দেশের পানি-সহযোগিতার ক্ষেত্রে ভারতীয় আমলাতন্ত্রেও সূচিত হয়েছে গুণগত পরিবর্তন। কিন্তু রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে ফাঁক রেখে যে কারিগরি সমাধান সম্ভব নয়, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তির মুখে চুক্তির উদ্যোগ ভেস্তে যাওয়ার মধ্য দিয়ে সেটাই আরেকবার প্রমাণ হলো মাত্র।
শেখ রোকন : সাংবাদিক ও গবেষক
skrokon@gmail.com
গত বছর নভেম্বরে ঢাকায় গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকার পানিসম্পদভিত্তিক আঞ্চলিক সহযোগিতা সংক্রান্ত একটি সেমিনারে যোগ দিতে এসেছিলেন ভারতীয় পানি বিশেষজ্ঞ রামস্বামী আর আইয়ার। দক্ষিণ এশিয়ার নদী ও পানি সংক্রান্ত খোঁজখবর যারা রাখেন, তাদের কাছে এই নাম অপরিচিত নয়। আশির দশকে দীর্ঘদিন তিনি ছিলেন ভারতের পানিসম্পদ সচিব। পরে যোগ দিয়েছেন দিলি্লর সেন্টার ফর পলিসিতে। ভারতের প্রথম জাতীয় পানিনীতি প্রণয়নে তিনি ছিলেন মূল খসড়াকারক। বস্তুত গত তিন দশকে পানি ব্যবস্থাপনা, জলবিদ্যুৎ ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে অভিন্ন নদীর পানি বণ্টনে নয়াদিলি্ল যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, তার সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে মি. আইয়ার যুক্ত ছিলেন। বাংলাদেশেও 'বহুবার' এসেছেন। ওই সেমিনারে বক্তব্য দিতে গিয়ে ঠাট্টাচ্ছলে বলছিলেন যে বাংলাদেশে সেটা তার ২৫তম সফর। পানিসম্পদ নিয়ে তার রচিত ও সম্পাদিত বেশ কিছু গ্রন্থ রয়েছে এবং সেগুলো দেশে-বিদেশে যথেষ্ট আদৃত।
পানি বণ্টন সংক্রান্ত দরকষাকষিতে রামস্বামী আইয়ারের তৎপরতা ও কৌশল কখনও কখনও প্রতিবেশী দেশের প্রতিনিধিরা অপছন্দ করেছেন বটে; তার দক্ষতা ও প্রজ্ঞা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। তার আরেকটি দোষ বা গুণ হচ্ছে নিঃশব্দে কাজ করা এবং যথাসাধ্য সংবাদমাধ্যম এড়িয়ে চলা। ফলে সেবার তার বাংলাদেশ সফর ছিল নিভৃতেই। আমন্ত্রণপত্রে নাম দেখে ওই সেমিনারের শীর্ষ আয়োজককে অনুরোধ করেছিলাম একটা অ্যাপয়েন্টমেন্টের ব্যবস্থা করে দিতে। আইয়ার তার দীর্ঘদিনের বন্ধু। বন্ধুর সৌজন্যেই ভোরে দিলি্লর দিকে উড়াল দেওয়ার আগের রাতে ডিনারের পর আমাকে মিনিট দশেক সময় দিয়েছিলেন এই ভারতীয় বিশেষজ্ঞ।
তিস্তাসহ অন্যান্য নদীর পানি বণ্টন, গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তির অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতি, টিপাইমুখ বাঁধ, আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প, হিমালয় অঞ্চলে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প প্রভৃতি বিষয়ে আমি যতটা আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইছিলাম, উত্তরে ততটা আন্তরিকতা ছিল না। তিনি বরং গৎবাঁধা কিছু অফিসিয়াল ভাষ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন। বলছিলেন, অভিন্ন নদীর পানি বণ্টনসহ সব ইস্যুতে ভারত সবসময় আন্তরিক। দুই দেশের মধ্যে দফায় দফায় যে বৈঠক হচ্ছে, আলোচনা চলছে, এমনকি গঙ্গা নিয়ে দুই দফা চুক্তি হয়েছে। ভারত সাড়া না দিলে এগুলো কীভাবে সম্ভব হচ্ছে?
ভারত-বাংলাদেশের অভিন্ন নদী নিয়ে যে সামান্য জ্ঞান-বুদ্ধি হয়েছে, তা সম্বল করে এই বিশেষজ্ঞকে পাল্টা জিজ্ঞাসা করেছিলাম_ পানি বণ্টন ইস্যুতে দুই দেশের বিভিন্ন পর্যায়ে এত যোগাযোগ, বৈঠক, আলোচনা হয়েছে; তারপরও বিষয়টি দশকের পর দশক ঝুলে থাকছে কেন? কোথায় প্রতিবন্ধকতা? কয়েক দশকের চেষ্টায় কেবল একটি নদীর পানি বণ্টন (হোক অসন্তোষজনক) চুক্তি সম্ভব হয়েছে। বাকি ৫৩ নদীর ব্যাপার সুরাহা করতে আরও কত দশক লাগবে? রামস্বামী আইয়ার বেশ কিছুক্ষণ চুপ করেছিলেন। তারপর যা বলেছিলেন, তা এখনও স্পষ্ট মনে আছে। 'এটা আসলে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ব্যাপার। যখন দুই দেশে রাজনৈতিক সম্পর্ক খারাপ ছিল কিংবা খুব ভালো ছিল না, তখন দেখা গেছে পানি বণ্টনসহ দ্বিপক্ষীয় সব ইস্যুরই সমাধান কঠিন। আবার যখন রাজনৈতিক সম্পর্ক ভালো হয়েছে, দ্বিপক্ষীয় সব সমস্যার সমাধান সহজ হয়েছে। রাজনৈতিক সুসম্পর্কই দুই দেশের পানি সংকট সমাধানের চাবিকাঠি। আপনি দেখবেন, ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পরপরই গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি সম্ভব হয়েছিল। তিনি আবার ক্ষমতায় এসেছেন, এখন তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা সঠিকপথে এগোচ্ছে।'
বস্তুত কেবল মি আইয়ার নন, এমন কথা বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞদেরও কেউ কেউ বলে আসছেন। বিশেষ করে শ্রদ্ধেয় বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত। আজ থেকে আধা যুগ আগে, তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে যখন উত্তর দিগন্তে কিছুই স্পষ্ট নয়; তিনি বলেছিলেন, সীমান্তের উভয় পাশের রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়া তিস্তার পানি পাওয়া যাবে না। তারপর তার কাছে আরও বহুবার শুনেছি, বাংলাদেশ ও ভারতের অভিন্ন নদীর পানি বণ্টনের ইস্যু কারিগরি নয়, রাজনৈতিক। রাজনৈতিক নেতৃত্ব আন্তরিক হলে পানি ভাগাভাগির কারিগরি সমাধান মোটেই কঠিন নয়। কিন্তু একই কথা যখন রামস্বামীর মতো কেউ বলেন, তখন তার তাৎপর্য ভিন্ন।
অভিন্ন নদীর পানি ভাগাভাগী তো বটেই, অভিন্ন ইতিহাস ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকার হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে বাণিজ্য, যোগাযোগ প্রভৃতি সম্পর্কের ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি হচ্ছে না কেন, এ জন্য বরাবরই ভারতীয় আমলাতন্ত্রকে দায়ী করা হয়ে থাকে। বলা হয়, রাজনৈতিক নেতৃত্ব সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহী; আমলাতন্ত্রই তা ঠেকিয়ে রাখে। কিন্তু ভারতীয় ডাকসাইটে আমলা বলছেন, মূল চাবি রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতে। মনমোহন সিংয়ের দু'দিনের ঢাকা সফরের ডামাডোলের মধ্যে তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে যা যা হলো, তাতে কি মি. আইয়ারের বক্তব্যের সারবত্তাই প্রমাণ হলো না? প্রায় ছয় দশক ধরে যে তিস্তার ব্যাপারে আলোচনায় কোনো অগ্রগতি ছিল না; সীমান্তেও উভয় পাশে রাজনৈতিক সদিচ্ছার কারণে মাত্র আড়াই বছরের মাথায় তা আলোর মুখ দেখছিল। আবার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণেই তো বিপত্তি দেখা দিল।
শেষ কয়েকদিনের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। তিস্তার পানি কী অনুপাতে দুই দেশের মধ্যে বণ্টন হচ্ছে, তা নিশ্চিত জানা না গেলেও সবাই আশাবাদী ছিল যে চুক্তি হচ্ছে। প্রায় ছয় দশকের দরকষাকষির পর শেষ পর্যন্ত ১৫ বছরের অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তিতে উপনীত হওয়ার কাছাকাছি পেঁৗছেছিল দুই প্রতিবেশী। সিকিম থেকে তুষার টোপর মাথায় দিয়ে যে নয়নাভিরাম নদী আবহমানকাল থেকে আপন মনে সবুজ সমতলে এসে মিশত, বাঁধ ও ব্যারাজের কারণে তা গত তিন দশকে নিজের মতো বহমান থাকেনি। আশা করা হচ্ছিল, 'শুভেচ্ছা কূটনীতির' ফলে বিলম্বে হলেও এই চুক্তির পর ধীরে ধীরে আগের মতো বইতে শুরু করবে তিস্তা। বাংলাদেশ থেকে যদিও পানির হিস্যা নিয়ে বিভিন্ন মহলে শঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গের প্রতিক্রিয়া প্রমাণ করেছিল যে ঢাকা বঞ্চিত হচ্ছিল না। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে সদিচ্ছা ও আন্তরিকতার প্রমাণ দিতেই যেন তিস্তার পানি বণ্টনের ক্ষেত্রে ছাড় দিয়েছিল নয়াদিলি্ল। কিন্তু ভারতের কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ শরিক তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী এবং তিস্তা অববাহিকার বড় ভূখণ্ড পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চাপেই শেষ পর্যন্ত পিছু হটে মনমোহন সরকার।
মনমোহন সিংয়ের সফরের আগে আগে এমনও প্রত্যাশা করা হচ্ছিল যে তিস্তা সমস্যার সমাধান তো বটেই; পানি-সহযোগিতার নতুন যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে প্রতিবেশী দুই দেশ। পানি বণ্টনের পাশাপাশি অভিন্ন অর্ধশতাধিক নদীকে কেন্দ্র করে নৌ-পরিবহন, জলবিদ্যুৎ, বন্যা পূর্বাভাস ও নিয়ন্ত্রণ, দূষণ রোধ, সীমান্ত ভাঙন ব্যবস্থাপনা, ড্রেজিং, সেচ_ এসব ক্ষেত্রে যৌথ উদ্যোগ নতুন মাত্রা পাবে সামনের দিনগুলোতে। শোনা যাচ্ছিল, অভিন্ন নানা ইস্যুতে বাংলাদেশের আন্তরিকতা স্পষ্ট হওয়ায় দুই দেশের পানি-সহযোগিতার ক্ষেত্রে ভারতীয় আমলাতন্ত্রেও সূচিত হয়েছে গুণগত পরিবর্তন। কিন্তু রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে ফাঁক রেখে যে কারিগরি সমাধান সম্ভব নয়, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তির মুখে চুক্তির উদ্যোগ ভেস্তে যাওয়ার মধ্য দিয়ে সেটাই আরেকবার প্রমাণ হলো মাত্র।
শেখ রোকন : সাংবাদিক ও গবেষক
skrokon@gmail.com
No comments