একটি মার্জনা প্রস্তাব-রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় by এসএম আব্রাহাম লিংকন

কিছুদিন আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের তিনজন তরুণ শিক্ষককে বহিষ্কার করা হয়েছে। এই বহিষ্কার নিয়ে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা একক বা যৌথভাবে বিভিন্ন পত্রিকায় ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন, যা সংবাদপত্রের সুবাদে ব্রাত্যজনরাও জানেন। একসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষক বহিষ্কার হওয়া সম্ভবত দেশের মধ্যে প্রথম। অপরাধ প্রমাণিত হলে অপরাধীর শাস্তির বিধান করা ন্যায় ও নৈতিকতার সঙ্গে যুক্ত।


বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক বলে তারা আইনের ঊধর্ে্ব নন। আমাদের দেশে শাস্তির উদ্দেশ্য নিয়ে অপরাধ বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতবিরোধ থাকলেও অপরাধীর কৃত অপরাধকে পরিত্রাণ দেওয়ার কোনো বিধান তারা রচনা করেননি। আইনে উলি্লখিত শাস্তি প্রদত্ত হতে হবে এটি নীতি বিজ্ঞান, কিন্তু শাস্তি যখন প্রাপ্য থাকে না অথচ শাস্তি দেওয়া হয়, কিংবা অপরাধের ধরন যখন তিরস্কৃত হওয়ার মতো অথচ সাজা হয়েছে হস্ত কর্তন, তখন সংশ্লিষ্ট বিচারকের বিচারিক যোগ্যতা ও বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে সমালোচনার সুযোগ থাকে। আমরা জানি, আমাদের দেশে প্রচলিত শাস্তির নানা ধরন আছে। অপরাধের মাত্রাভেদে অপরাধীকে সাজা দেওয়া হয়। আইনে অপরাধের সাজার মাত্রা নির্ধারণের কারণে কোনো বিচারক যেন মনগড়া সাজা না দেন। অর্থাৎ যিনি চুরি করেছেন তিনি যেন চুরির অপরাধের জন্য বর্ণিত সাজাই পান। অপরাধী যতই মন্দ হোন তাকে চুরির অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যাবে না। এখানে 'মৃত্যুদণ্ড না দেওয়াই' ন্যায়বিচার।
আমরা পত্রিকায় দেখেছি, নাট্যকলা বিভাগের তদানীন্তন সভাপতি দেশের প্রথিতযশা শিক্ষক ও সংস্কৃতি সংগঠক অধ্যাপক মলয় ভৌমিকের বিরুদ্ধে একদল শিক্ষক আন্দোলন করেছিলেন। তার বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের শুরু থেকে অভিযোগ ছিল, তিনি ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক, তিনি কেন নাট্যকলায়? যদিও মনে করি যারা এখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করছেন তাদের চেয়ে তিনি কম প্রাজ্ঞ নন। তিনি উপাচার্য হওয়ার মতো যোগ্যতা রাখেন। নাট্যকলা বিভাগে বর্তমানে যেসব শিক্ষক আছেন তাদের স্কুলে পাঠ শুরুর অনেক আগ থেকেই তিনি নাট্যকলা বিষয়ে প্রাজ্ঞ ছিলেন। যে কারণেই হোক অধ্যাপক মলয় ভৌমিকের সঙ্গে নাট্যকলা বিভাগের সহকর্মীদের মতান্তর হচ্ছিল, যা এক পর্যায়ে আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে উগ্র রূপ নেয়, আন্দোলনকারীরা তার অফিসে তালা দেয়। এক পর্যায়ে ওই আন্দোলনে নাট্যকলা বিভাগের ছাত্রছাত্রীরাও শামিল হন। ছাত্ররা আন্দোলনে যোগ দেওয়ার পর পরিস্থিতি গুরুতর আকার ধারণ করলে শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মলয় ভৌমিক বিভাগীয় প্রধানের পদ থেকে পদত্যাগ করে মহানুভবতার পরিচয় দেন। পদত্যাগে বিষয়টির সাময়িক ফয়সালা হলেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ঘটনার বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি করে এবং তাদের তদন্ত চলমান। তদন্ত শেষের আগেই নাট্যকলা বিভাগের তিন শিক্ষককে বহিষ্কার করা বিচার শুরুর আগে দণ্ড প্রদানের শামিল। পত্রিকান্তরে দেখা যায়, সে সময় আন্দোলনে বিভাগীয় অনেক শিক্ষকই ছিলেন কিন্তু চাকরিচ্যুত হন শুধু তিনজন। এখানে অন্য যারা আন্দোলন বা নেপথ্যচারী ছিলেন তারা শাস্তির অন্তর্ভুুক্ত হননি। অপরাধী সে মূল নেপথ্যচারী আর সহযোগী যেটিই হোক সে অপরাধীই। অংশগ্রহণের মাত্রা অনুযায়ী তার শাস্তি নিবেদিত হবে। কিন্তু পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী অন্য শিক্ষক ও ছাত্রদের বিষয় বেমালুম এড়ানো হয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, যে অ্যাডহক শিক্ষকমণ্ডলী আন্দোলন করেছেন অধ্যাপক মলয় ভৌমিকের বিরুদ্ধে তাদের কথা বলার মতো অধিকার ছিল কি-না? হয়তো শিক্ষক হিসেবে তারা একেবারেই নবীন, উপরন্তু অ্যাডহকভিত্তিক চাকরি। চাকরির শর্ত অনুযায়ী অস্থায়ী শিক্ষককে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনো কারণ দর্শানো ছাড়াই পত্রপাঠ বিতাড়িত করতে পারে কিন্তু বিষয়টি কতটুকু ন্যায়সঙ্গত? একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক স্থায়ী হওয়ার পর প্রতিবাদ করার অধিকার পাবেন, স্থায়ীকরণের আগে যত অনাচারই হোক তিনি বোবা বধির থাকবেন_ বিষয়টি কি ন্যায়সঙ্গত? বিষয়টি কি এ রকম_ স্থায়ীকরণের আগে অ্যাডহক শিক্ষকরা নাবালক, তাদের গণতন্ত্র থাকবে না, ভোট থাকবে না? অ্যাডহক শিক্ষকরা যে বিষয়ের শিক্ষক সে বিষয়ে যোগ্যতা প্রমাণের জন্য পর্যবেক্ষণে তারা থাকতে পারেন কিন্তু তাদের মতপ্রকাশে বিরত রাখা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত? কতটুকু গণতান্ত্রিক? অধ্যাপক মলয় ভৌমিক, সেলিম রেজা নিউটনরা এই তো সেদিন মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দীনদের গণতন্ত্র হরণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতেই সাজানো মামলায় সাজা খাটলেন। তবে কি মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দীনদের বোবাকরণ পদ্ধতি সঠিক ছিল?
আমার নিবন্ধের উদ্দেশ্য ভালো-মন্দ পদ্ধতির বিচার নয়। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে অনেকটা নিশ্চিত হয়েছি, তিনজন শিক্ষকের সাজা 'কৃতকর্মের চেয়ে বেশি' হয়েছে, অনেকে মনে করেন এও এক ধরনের ষড়যন্ত্র। তিনজন শিক্ষককে যে সাজা দেওয়া হয়েছে, তার জাস্টিফিকেশন নিয়ে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় তো বটেই, এমনকি খোদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কেউ বলছেন, লঘু অপরাধে গুরুদণ্ড। আবার কেউ কেউ উদ্বেগ প্রকাশ করছেন রুমে তালা লাগানোর অভিযোগে তিনজন শিক্ষকের বহিষ্কার ভবিষ্যতের জন্য কাল হবে। ভবিষ্যতে এটি প্রগতিশীলদের বধ করতে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হবে। কেউ কেউ বলছেন, এই তরুণ শিক্ষকরা তিরস্কৃত হতে পারতেন। অস্থায়ী হিসেবে আরও পর্যবেক্ষণে থাকতে পারতেন। কারও কারও মতে, অপরাধ আর ভুল এক নয়। এ তিনজন তরুণ শিক্ষক হয়তো ভুল করেছেন। তাদের প্রতিবাদের ভাষা রূঢ় হওয়ায় আমরা অপরাধ বিবেচনা করছি। তবে অধিকাংশের মতে, জড়িতরা সবাই শাস্তির আওতাভুক্ত হয়নি। মলয় ভৌমিক বিদায় নিলে যাদের লাভ তারা নিরাপদ থাকল। এ দেশে নেপথ্যচারীরা সবসময় ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকেন, এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র হিসেবে প্রত্যাশা_ এই বর্তমান কর্তৃপক্ষের দ্বারা যেন একটি মন্দ উদাহরণ তৈরি না হয়।

এসএম আব্রাহাম লিংকন : রাবির সাবেক সিনেটর ও রাকসু নেতা, আইনজীবী
lincoln_bd@yahoo.com
 

No comments

Powered by Blogger.