ব্যক্তি পরিবর্তনের চেয়ে নীতিগত সংস্কার জরুরি-প্রশাসন by আলতাফ পারভেজ

যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের 'পদত্যাগ' দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল নাগরিক সমাজের একটি অংশ। সড়ক দুর্ঘটনায় চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও সাংবাদিক-চিত্রগ্রাহক মিশুক মুনীরের মৃত্যুতে সৃষ্ট গভীর বেদনা থেকেই ওই বিক্ষোভের সূচনা।


তবে যোগাযোগ অবকাঠামোর ব্যবস্থাপনা ও বিকাশ সাধনে সংশিল্গষ্ট মন্ত্রী ও সরকারের ধারাবাহিক নিষ্ক্রিয়তায় দেশব্যাপী যে হতাশা তৈরি হয়েছে সেটাই এ বিক্ষোভে মূল জ্বালানি হিসেবে কাজ করেছে। এ বিবেচনায় বলা যায়, যোগাযোগমন্ত্রী সম্পর্কে নাগরিক সমাজের চলতি বিক্ষোভ আসলে সরকারের জন্য একটি সতর্কবার্তা এবং অন্য মন্ত্রীদেরও সক্রিয় হওয়ার সর্বশেষ আহ্বান হয়তো।
সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে প্রতিদিনই মানুষ মরছে। সামান্য কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে রাস্তায় মৃতদের মধ্যে গরিব মানুষের সংখ্যাই বেশি। ফলে আমাদের উদ্বেগ যোগাযোগমন্ত্রীর 'পদত্যাগে'র সংকীর্ণ গণ্ডিতে আবদ্ধ না থেকে গণপরিবহন ব্যবস্থার নীতিগত সংস্কারের দিকে ধাবিত হলেই সবার জন্য লাভজনক হতো। সৈয়দ আবুল হোসেন যদি সত্যি পদত্যাগ করে ফেলেন এবং দুর্ঘটনা প্রতিরোধে প্রতিবাদী সমাজ যদি তখন থেমে যায় তা হলে সেটা হবে এ বছরের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা।
বাংলাদেশের সড়ক ব্যবস্থাপনায় আজকে যে নৈরাজ্য তা একদিনে হয়নি এবং এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনাও নয়। আমাদের পুরো গণপরিবহন ব্যবস্থাই ভুল পরিকল্পনার অন্ধ গলিতে দিকভ্রান্ত। নৌ-পরিবহন ও রেল যোগাযোগকে অবহেলা এবং সংকোচনের মধ্য দিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে পরিবেশ ও সভ্যতা বিধ্বংসী রাস্তানির্ভর এক যোগাযোগ ব্যবস্থা কায়েম হয়েছে বাংলাদেশে গত চার দশকে। 'যোগাযোগ ব্যবস্থা মানেই রাস্তা, পরিবহন মানেই প্রাইভেট মোটরগাড়ি'_ এরূপ এক আরামদায়ক ফর্মুলায় শহুরে সমাজ অন্ধ হয়েছিল বরাবর। এখনও তাই আছে। মিশুক মুনীর ও তারেক মাসুদের আত্মদান সেই অন্ধত্বের প্রতিও এক ধরনের দূরবর্তী আঘাত বৈকি। কিন্তু নাগরিক বুদ্ধিজীবিতা সেই শহীদী বার্তার মর্মোদ্ধার করতে পারল কতটা?
বলা হয়, বাংলাদেশ নদীর দেশ। এ রকম একটি দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় এত মানুষের মৃত্যু হয় কেন? এত মানুষ রাস্তায় মরে কেন? আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা কেন রাস্তানির্ভর হলো? নৌপথে যাত্রী মৃত্যুর হার সড়ক পথের এক-চতুর্থাংশ হওয়া সত্ত্বেও মানুষ এখনও সড়কপথকেই বেছে নিচ্ছে যাতায়াতের জন্য। গত চার দশকে এডিবি আর বিশ্বব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকায় মনোজাগতিক এই পক্ষপাত তৈরি হয়েছে। আমাদের পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থাও যোগাযোগ ব্যবস্থার এই মনোবিকারে আটকে গেছে। যে এমপি রাস্তা ও ব্রিজ বেশি বানাতে পারছেন না, দ্বিতীয় দফায় নির্বাচিত হতে ব্যর্থ হচ্ছেন তিনি। যে কারণে এমপিদের কর্মকালের সর্বাধিক সময় কাটছে এলজিইডিতে।
অন্যদিকে গত দশকের প্রথম ছয় বছরে জাতীয় বাজেটে অভ্যন্তরীণ নৌ খাতে উন্নয়ন বরাদ্দ ছিল জাতীয় উন্নয়ন বাজেটের ০.৮২ থেকে ৬.৭৯ শতাংশ পর্যন্ত। নৌপথের প্রতি এই প্রাতিষ্ঠানিক অবহেলা পুরোদস্তুর পরিকল্পিত। সব সরকারই এটা করেছে। কিন্তু কখনও আমাদের নাগরিক সমাজ, বুদ্ধিজীবীরা, থিঙ্কট্যাঙ্কগুলো এ পরিকল্পিত ধ্বংসলীলার প্রতিবাদ করেনি। যে কারণে দেখা যায়, ১৯৬০ সালে এ দেশে যেখানে নৌপথ ছিল ১২ হাজার মাইল, ১৯৯৮ সালে তা দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজার মাইলেরও কমে।
উল্টোদিকে স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী সময়ে পাকা সড়ক যেখানে ছিল আড়াই হাজার মাইলের মতো, সেটা এখন উন্নীত হয়েছে ২৫ হাজার মাইলে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সড়ক সাম্রাজ্য বাড়াতে নদী-নালা-জলাশয় নির্মমভাবে ভরাট করে ফেলা হয়েছে। সড়কপথ বাড়ালে নৌপথ কমাতে হবে এটাই স্বাভাবিক। অস্বাস্থ্যকর, অর্থনীতি বিধ্বংসী সেই পথই বারবার বেছে নিয়েছে রাজনৈতিক সরকারগুলো। নিচু নিচু ব্রিজগুলো নৌ-যোগাযোগকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে।
সংশিল্গষ্টরা হয়তো জানেন, চট্টগ্রাম থেকে ২০ ফুটের একটি কনটেইনার সড়কপথে ঢাকা আনতে খরচ ছয় হাজার টাকা, রেলপথে ১ হাজার ২০০ টাকা আর নৌপথে ৬০০ টাকা। কিন্তু তারপরও ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কপথ চার লেন করার জন্যই জাতীয় তাগিদ। আজ ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়ক চার লেন হতে বিলম্বের কারণে সরকারের ব্যর্থতা খুব বড় হয়ে সবার চোখে পড়ছে। কিন্তু বাংলাদেশের কোনো গণমাধ্যম, কোনো অর্থনীতিবিদ কখনোই অতীতে প্রশ্ন তোলেননি, কেন মেঘনা সেতুতে রেললাইন বসানো হলো না? কেবল এই একটি সিদ্ধান্তে বৃহত্তর নোয়াখালী, কুমিল্লার মানুষের যোগাযোগ খরচ ও সময় অর্ধেক হয়ে যেতে পারত।
নৌপথের মতোই রেলওয়ের প্রতিও পদ্ধতিগতভাবে সচেতন অবহেলা ঘটেছে গত চার দশকে। ১৯৭০ সালে স্বাধীনতার সময় পূর্ববাংলায় রেলওয়ে স্টেশন ছিল ৪৭০টি, ২০১০-এ হয়েছে ৪৪০টি। ইঞ্জিন ছিল ৪৮৬টি, এখন হয়েছে ২৮৬টি। সে সময় বগি ছিল ১৬৪৩টি, এখন আছে ১৫০৯টি। অথচ একই সময়ে জনসংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। যে নীতিনির্ধারকরা সচেতনভাবে রেলওয়েকে ধ্বংস করার কাজ করে গেছেন তাদের কাছে সোচ্চার কণ্ঠে আমরা প্রশ্ন করতে পারেনি, একটি মিটার গেজ মালবাহী ট্রেন যদি ২১০টি পাঁচ টনি ট্রাকের সমপরিমাণ মালপত্র পরিবহন করতে পারে তা হলে ঢাকা-চট্টগ্রাম বা অন্যত্র সড়কপথে পরিবহনের জন্য দেশকে এত বিনিয়োগ করতে হবে কেন? প্রতি বছর সড়ক নির্মাণ ও মেরামত খাতে ব্যয় প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। এ বিপুল বাজেট আমাদের প্রকৌশল প্রশাসনকে নষ্ট করেছে, দুর্নীতিগ্রস্ত ঠিকাদারি অর্থনীতির জন্ম দিয়েছে এবং সর্বোপরি আমাদের রাজনীতিকে ভয়ঙ্কর রকমে কলুষিত করেছে।
এখনও রেলওয়েতে একজন যাত্রীর কিলোমিটারপ্রতি খরচ ৫০ পয়সার নিচে; সড়কপথে যা দ্বিগুণ। একই পরিমাণ ট্রাফিক ইউনিট পরিবহনে ট্রেনের চেয়ে ট্রাক ৩০ গুণ বেশি পরিবেশ দূষণ করছে। তারপরও আমরা ওই পথেই যাচ্ছি। আবার পরিবেশ বিপর্যয়জনিত ক্ষয়ক্ষতি লাঘবের জন্য বিদেশি রাষ্ট্রের কাছে 'ক্ষতিপূরণ তহবিল'ও দাবি করছি!
বেসরকারিকরণের পটভূমি হিসেবে রেলওয়ের ব্যবস্থাপনা এ মুহূর্তে এতই খারাপ করা হয়েছে যে, কেবল গত বছর বিভিন্ন রুটে ৪০৩ দফা ট্রেন চলাচলে বিঘ্ন ঘটেছে। আজও ২০টি জেলায় কোনো ট্রেন যোগাযোগ গড়ে তুলতে পারেনি স্বাধীন বাংলাদেশ। নৌপথের মতোই রেলওয়ের বাজেটও ক্রমাগত কমানো হয়েছে। অথচ যোগাযোগ ক্ষেত্রে বিনিয়োগের ওপর সরকারি তরফে কস্ট রিকভারি হচ্ছে রোডে টাকাপ্রতি ৩৫ পয়সা এবং রেলওয়ের ক্ষেত্রে টাকাপ্রতি ৬৫ পয়সা। পার্শ্ববর্তী ভারতেও রেলওয়ে নিয়ে পৃথক একটি মন্ত্রণালয় রয়েছে। আমরা সেরূপ গুরুত্ব দিতে নারাজ।
আজ দুর্ঘটনা প্রবণতার জন্য যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের গাফিলতি ও দুর্নীতিকে দায়ী করা হচ্ছে। পুরোই সত্য তা। কিন্তু পাশাপাশি এও সত্য, যোগাযোগ কাঠামোকে আমরা যেভাবে গড়েছি তাতে দুর্ঘটনার আধিক্যই নিয়তি। ২০০৩ সালে রেলওয়েতে দুর্ঘটনায় মারা গেছে ২৮ জন। আর সড়ক খাতে ওই বছর মারা গিয়েছিল ২৭৫২ জন। এরূপ ব্যবধান কখনোই কমানো যাবে না। কিন্তু যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে সড়কের চেয়ে রেলওয়েকে গুরুত্ব ও বিস্তৃতি দেওয়ার দাবি কোথায়? রেলওয়ের একজন চালক জানালেন, মাত্র ৪০টি ইঞ্জিন এবং ১০০টি বগি বাড়ানো হলে দেশের মানুষকে ঈদে বাড়িতে যাওয়ার জন্য চিন্তা করতে হতো না। পরিবহন ব্যবসায়ী রাজনীতিবিদদের বাধা ডিঙিয়ে এ কথাটি প্রধানমন্ত্রীকে বোঝানোর উৎকৃষ্ট সময় এসেছে আজ।

আলতাফ পারভেজ : লেখক ও গবেষক
altafparvez@yahoo.com
 

No comments

Powered by Blogger.