সদরে অন্দরে-জালে আটকান শিক্ষা ভবনের বোয়াল মাছগুলো by মোস্তফা হোসেইন
শিক্ষা এখন বাণিজ্যসম্ভার! আঁতকে উঠতে পারেন অনেকেই। এমন কথাও বলতে হয়? প্রশ্নও করতে পারেন কেউ কেউ। অথচ বাস্তবতা তার চেয়েও খারাপ। এই বাণিজ্যের মধ্যে লুকিয়ে আছে ঘুষ-দুর্নীতি-জোচ্চুরির মতো জঘন্য সব কাণ্ডকারখানা। নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধের বালাই নেই শিক্ষাব্যবস্থার অনেক স্থানেই। তার মধ্যে শিক্ষা ভবন অন্যতম। ইট-কাঠ-পাথর নামের যে জড় পদার্থ, সেই জড় পদার্থও নাকি এখানে হাঁ করে থাকে ঘুষের আশায়।
যত পায় তত চায়_এমনই অভিযোগ রয়েছে শিক্ষা ভবনসহ একাধিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। কিন্তু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঢোকার সময়ই যেখানে দুর্নীতির সবক নিতে হয়, সেই প্রতিষ্ঠানে কি কখনো দুর্নীতিবিরোধী নৈতিকতা শিক্ষা দেওয়া সম্ভব? প্রশ্নটি আমাকে বিদ্ধ করেছে, যখন একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ও পেশায় একজন চিকিৎসক স্পষ্ট বললেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষক নিয়োগ করার সময় চাকরিপ্রার্থীর কাছ থেকে অর্থ আদায় করতে বাধ্য। তিনি হিসাব দিলেন, কিভাবে কোন কারণে ওই শিক্ষকের কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ করতে হয়। তাঁর কথা, একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ করতে হলে শিক্ষা ভবনে ধরনা দিতে হয়। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিতে হয় এবং এমপিওভুক্তি বিষয়েও সরকারি দপ্তরের অনুমোদন আনতে হয়। যদি প্রথম বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার পর যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না যায়, তাহলে দ্বিতীয়বার বিজ্ঞাপন প্রকাশ করতে হয় পত্রিকায়। কখনো কখনো এই বিজ্ঞাপন তিন বা তারও বেশি সময়ও প্রকাশ করতে হয়। এটা নিয়ম। এই নিয়ম রক্ষার জন্য যে অর্থের প্রয়োজন হয়, তা আসবে কোথা থেকে? সেই অর্থও না হয় সংস্থান করা গেল। কিন্তু এটাই যদি একমাত্র ব্যয় হতো তাহলেও কোনো কথা ছিল না। প্রথমেই আসে এমপিওভুক্তির বিষয়টি। এমপিওবিষয়ক জটিলতা কাটানোর জন্য শিক্ষা ভবনে গেলে ৩০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত চোখ বুজে দিয়ে আসতে হয়। যে শিক্ষককে নিয়োগ দিতে হচ্ছে, সেই নিয়োগপ্রক্রিয়ার মধ্যেই প্রাসঙ্গিক ব্যয়গুলো ধরে নিতে হয় বাধ্য হয়ে। সাক্ষাৎকার ও নিয়োগ পরীক্ষায় ভালোভাবে উত্তীর্ণ হওয়ার পরও কোনো যোগ্য শিক্ষক চাকরি লাভ করতে পারছেন না অনেক সময়। সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে অর্থ। একটি বেসরকারি কলেজের অধ্যক্ষ তাঁর কলেজে শিক্ষক নিয়োগ করার সময় যে পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন তার বর্ণনা দিলেন। বললেন, সাক্ষাৎকারে যিনি প্রথম হয়েছেন তাঁকে ডাকা হলো। জানতে চাওয়া হলো পদায়ন থেকে শুরু করে আনুষঙ্গিক ব্যয় নির্বাহের জন্য ৩০ হাজার টাকার প্রয়োজন। প্রার্থী কি সেই টাকা প্রদান করতে প্রস্তুত? যদি তিনি প্রস্তুত না হন তাহলে সাক্ষাৎকারে যিনি দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছেন তাঁকেই নিয়োগ দিতে যাবেন তাঁরা। তাঁর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জীববিজ্ঞানের একজন প্রভাষক নিয়োগ করতে গিয়ে তাই বাধ্য হয়ে ৩০ হাজার টাকা নিতে হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই শিক্ষক চাকরিলাভের পর বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরত চাইবেন_এটাই তো স্বাভাবিক। আর যে শিক্ষকের মাথায় অর্থ বিনিয়োগের চিন্তা থাকে, তিনি কি যথাযথ শিক্ষা দেওয়ার চিন্তা করতে পারেন? এই শিক্ষকের পক্ষে কি শ্রেণীকক্ষে গিয়ে নৈতিকতা সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া সম্ভব হবে? এই দুর্নীতি এখন ওপেন সিক্রেট। আর তার গোড়াটা হচ্ছে শিক্ষা ভবন।
এহেন দুর্নীতির শিকড়-বাকড় নিয়ে বসবাস করেও একজন ভালোমানুষ হিসেবে জনসমর্থন পেয়েছেন, তিনি হলেন শিক্ষামন্ত্রী। কিন্তু তিনি একা আর কী করতে পারেন? লোম বাছতে গিয়ে কম্বল উজাড় করে দেওয়ার জোগাড় হতে পারে এই দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে গেলে। শিক্ষা ভবনে যে হারে এবং যে মাপের দুর্নীতি হয়, তাকে শুধু নরকের সঙ্গেই তুলনা করা চলে। অথচ এই দপ্তরের বড় কর্তা, মাঝারি কর্তাদের সবাই আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেই আসেন। তাঁদের বড় কর্তারা আবার শিক্ষক হিসেবেও সিনিয়র হয়ে থাকেন। দুঃখটা এখানেই। এই ভবনের কর্মকর্তারা এত দ্রুত তাঁদের চেহারা পরিবর্তন করে ফেলেন যে ভাবতেও অবাক লাগে।
এই প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি সম্পর্কে কোনো কিছু খুলে বলার প্রয়োজন হয় না। কাকের মাংস কাকে খায় না বলে যে প্রবাদ আছে, সেটিও এই প্রতিষ্ঠানে এসে মিথ্যা হয়ে যায়। যে শিক্ষক একসময় এই ভবন থেকে অপমানিত হয়েছেন, সেই শিক্ষকই যখন নিজে দায়িত্ব পান তখন চরম দুর্নীতিবাজ বনে যান। অন্যদের অপমান করেন। এই প্রতিষ্ঠান যে কতটা দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়ে আছে, তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া গেছে মন্ত্রীর হস্তক্ষেপের পর। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ গত সপ্তাহে শিক্ষা ভবনে আকস্মিক পরিদর্শনে গিয়ে হাতেনাতে ধরে ফেলেন অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর মনিরুল ইসলামকে। তাৎক্ষণিক সেই মনিরুল ইসলামকে খাগড়ছাড়ি জেলার মানিকছড়ির রানী নীহার দেবী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে বদলি করা হয়। শিক্ষামন্ত্রী আগেও এভাবে শিক্ষা ভবন পরিদর্শন করেছেন। সতর্ক করে দিয়েছেন ঘুষখোরদের। কিন্তু চোরা না শুনে ধর্মের কাহিনী। তাদের কানে যায়নি সেই সতর্কবাণী। এবার মনিরুল ইসলামকে শাস্তিমূলক বদলি করায় কি অপরাধের কোনো হেরফের হবে? একজন অন্যায়কারী শিক্ষা ভবন থেকে খাগড়াছড়ি গেলে কি সংশোধন হয়ে যাবে? তাৎক্ষণিক বিচারে সে যদি দোষী সাব্যস্ত হয়ে থাকে তাহলে রানী নীহার দেবী উচ্চ বিদ্যালয়ে গিয়ে কি সে পরিবেশ নষ্ট করবে না? তাহলে অবস্থাটা কী দাঁড়াল। একজন দুষ্ট লোক অপকর্ম করার জন্য সুবিধা পেয়েই গেল। এখন যেভাবে ঢাকায় বসে দুর্নীতি করেছে, বদলি হওয়ার পর সে হয়তো নতুন জায়গায় গিয়ে তা-ই করবে। সুতরাং বদলিটা তার শাস্তি কিংবা দুর্নীতি কমানোর জন্য কোনো উপকার বয়ে আনবে না।
এই শিক্ষা ভবনে দেশের ৩০ হাজার মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এবতেদায়ি, দাখিল ও আলিম মাদ্রাসার প্রায় ১০ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী-কর্মকর্তা নিয়োজিত। তাঁদের চাকরি-সংক্রান্ত যাবতীয় কাজই করতে হয় এই শিক্ষা ভবন থেকে। এখানে কোনো কাজ করাতে গেলে কেবল ঘুষ দিতে হয় তা-ই নয়, এই ভবনের ভেতরেও কেউ যদি যেতে চান তাহলেও ঘুষ দিতে হয়। ঘুষ ছাড়া আনসারের সদস্যও কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেন না। শিক্ষকদের হয়রানি করার জন্য শিক্ষকদের গোত্রীয়রাই সেখানে ওত পেতে বসে থাকেন। এই বোয়াল মাছগুলো জালে আটকাতে না পারলে শিক্ষামন্ত্রী যত চেষ্টাই করুন না কেন, শিক্ষা বিভাগ থেকে ভূতের আছর দূর করা যাবে না, আর নিরীহ শিক্ষকদেরও শান্তি ফিরে আসবে না।
mhussain_71@yahoo.com
এহেন দুর্নীতির শিকড়-বাকড় নিয়ে বসবাস করেও একজন ভালোমানুষ হিসেবে জনসমর্থন পেয়েছেন, তিনি হলেন শিক্ষামন্ত্রী। কিন্তু তিনি একা আর কী করতে পারেন? লোম বাছতে গিয়ে কম্বল উজাড় করে দেওয়ার জোগাড় হতে পারে এই দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে গেলে। শিক্ষা ভবনে যে হারে এবং যে মাপের দুর্নীতি হয়, তাকে শুধু নরকের সঙ্গেই তুলনা করা চলে। অথচ এই দপ্তরের বড় কর্তা, মাঝারি কর্তাদের সবাই আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেই আসেন। তাঁদের বড় কর্তারা আবার শিক্ষক হিসেবেও সিনিয়র হয়ে থাকেন। দুঃখটা এখানেই। এই ভবনের কর্মকর্তারা এত দ্রুত তাঁদের চেহারা পরিবর্তন করে ফেলেন যে ভাবতেও অবাক লাগে।
এই প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি সম্পর্কে কোনো কিছু খুলে বলার প্রয়োজন হয় না। কাকের মাংস কাকে খায় না বলে যে প্রবাদ আছে, সেটিও এই প্রতিষ্ঠানে এসে মিথ্যা হয়ে যায়। যে শিক্ষক একসময় এই ভবন থেকে অপমানিত হয়েছেন, সেই শিক্ষকই যখন নিজে দায়িত্ব পান তখন চরম দুর্নীতিবাজ বনে যান। অন্যদের অপমান করেন। এই প্রতিষ্ঠান যে কতটা দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়ে আছে, তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া গেছে মন্ত্রীর হস্তক্ষেপের পর। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ গত সপ্তাহে শিক্ষা ভবনে আকস্মিক পরিদর্শনে গিয়ে হাতেনাতে ধরে ফেলেন অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর মনিরুল ইসলামকে। তাৎক্ষণিক সেই মনিরুল ইসলামকে খাগড়ছাড়ি জেলার মানিকছড়ির রানী নীহার দেবী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে বদলি করা হয়। শিক্ষামন্ত্রী আগেও এভাবে শিক্ষা ভবন পরিদর্শন করেছেন। সতর্ক করে দিয়েছেন ঘুষখোরদের। কিন্তু চোরা না শুনে ধর্মের কাহিনী। তাদের কানে যায়নি সেই সতর্কবাণী। এবার মনিরুল ইসলামকে শাস্তিমূলক বদলি করায় কি অপরাধের কোনো হেরফের হবে? একজন অন্যায়কারী শিক্ষা ভবন থেকে খাগড়াছড়ি গেলে কি সংশোধন হয়ে যাবে? তাৎক্ষণিক বিচারে সে যদি দোষী সাব্যস্ত হয়ে থাকে তাহলে রানী নীহার দেবী উচ্চ বিদ্যালয়ে গিয়ে কি সে পরিবেশ নষ্ট করবে না? তাহলে অবস্থাটা কী দাঁড়াল। একজন দুষ্ট লোক অপকর্ম করার জন্য সুবিধা পেয়েই গেল। এখন যেভাবে ঢাকায় বসে দুর্নীতি করেছে, বদলি হওয়ার পর সে হয়তো নতুন জায়গায় গিয়ে তা-ই করবে। সুতরাং বদলিটা তার শাস্তি কিংবা দুর্নীতি কমানোর জন্য কোনো উপকার বয়ে আনবে না।
এই শিক্ষা ভবনে দেশের ৩০ হাজার মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এবতেদায়ি, দাখিল ও আলিম মাদ্রাসার প্রায় ১০ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী-কর্মকর্তা নিয়োজিত। তাঁদের চাকরি-সংক্রান্ত যাবতীয় কাজই করতে হয় এই শিক্ষা ভবন থেকে। এখানে কোনো কাজ করাতে গেলে কেবল ঘুষ দিতে হয় তা-ই নয়, এই ভবনের ভেতরেও কেউ যদি যেতে চান তাহলেও ঘুষ দিতে হয়। ঘুষ ছাড়া আনসারের সদস্যও কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেন না। শিক্ষকদের হয়রানি করার জন্য শিক্ষকদের গোত্রীয়রাই সেখানে ওত পেতে বসে থাকেন। এই বোয়াল মাছগুলো জালে আটকাতে না পারলে শিক্ষামন্ত্রী যত চেষ্টাই করুন না কেন, শিক্ষা বিভাগ থেকে ভূতের আছর দূর করা যাবে না, আর নিরীহ শিক্ষকদেরও শান্তি ফিরে আসবে না।
mhussain_71@yahoo.com
No comments