ভ্রাতৃত্ব-সাম্য ও মৈত্রী স্থাপনে মহানবীর অবদান by মুফতি এনায়েতুল্লাহ
পৃথিবীতে আল্লাহতায়ালা অসংখ্য নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন নির্দিষ্ট জনপদে, যার যার সম্প্রদায়ের হেদায়েতের জন্য। কিন্তু আল্লাহতায়ালা হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পাঠিয়েছেন রাহমাতুলি্লল আলামিন হিসেবে সারাবিশ্বের সব মানুষ ও প্রাণীর কল্যাণের জন্য এবং সর্বকালের জন্য।
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) আল্লাহতায়ালার খুব প্রিয় বান্দা ছিলেন। তা তাঁকে প্রদত্ত 'হাবিবুল্লাহ' (আল্লাহর প্রিয়) নাম থেকেই বোঝা যায়। তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহ এবং হাবিবুল্লাহ। বিভিন্ন পয়গম্বরের নামে বিভিন্ন বিশেষণ ব্যবহৃত হয়েছে, যেমন_ আদম সফিউল্লাহ, নুহ নবিউল্লাহ, ইবরাহিম খলিলুল্লাহ, ইসমাইল জবিহুল্লাহ, মুসা কালিমুল্লাহ, ঈসা রুহুল্লাহ। পক্ষান্তরে হজরত মোহাম্মদকে (সা.) বলা হয়েছে রাসূলুল্লাহ ও হাবিবুল্লাহ। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) এবং আল্লাহতায়ালার কথা একত্রে স্মরণ করার জন্যই আমাদের কালেমা হচ্ছে, 'লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।' এ কালেমাই হলো হজরত রাসূলুল্লাহর (সা.) মূল দর্শন।
হজরত রাসূলুল্লাহর (সা.) আলাদা কোনো দর্শন ছিল না, ইসলামী দর্শনই ছিল তাঁর দর্শন এবং তা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে লেখা রয়েছে কোরআনে। কোরআন হচ্ছে ইসলামী দর্শন এবং ইসলামী দর্শনই হচ্ছে হজরত রাসূলুল্লাহর (সা.) দর্শন।
ইসলামী দর্শন সম্পর্কে সংক্ষেপে এটুকুই বলা যায় যে, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলে, সবার মধ্যে ভ্রাতৃত্ব, সাম্য, মৈত্রী স্থাপন করা, আর সেটা শুধু মুখে না বলে, সব কাজকর্মে তা প্রমাণ করা। নিরীহ, গরিব, দুস্থ, অসহায়, এতিমদের সাহায্য করা। সমাজের সর্বস্তরে দুর্নীতি দমন করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। এসবই হচ্ছে ইসলামী দর্শন এবং হজরত রাসূলুল্লাহর (সা.) দর্শন। এসব কথা তিনি শুধু মুখেই বলেননি বরং প্রতিটি কাজের মধ্য দিয়ে তিনি নিজের জীবনে তার বাস্তবায়ন করে প্রমাণ রেখে গেছেন।
তাঁর দর্শনের ৩টি বিশেষ দিক ছিল_ হক্কুল্লাহ (আল্লাহর হক), হক্কুল ইবাদ (বান্দার হক) ও রবুবিয়্যাত (খোদায়িত্ব)। ইমান, নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, তাসবিহ-তাহলিল ইত্যাদি হচ্ছে হক্কুল্লাহ। আর বান্দার হক আদায় করা, যেমন_ প্রতিবেশীদের দিকে খেয়াল করা, দুস্থ-অসহায় এতিমদের সাহায্য করা, স্বামী-স্ত্রীর হক আদায় করা, বাবা-মা ও ছেলেমেয়ের হক আদায় করা, এমনকি গৃহপালিত পশুপাখির দিকে খেয়াল রাখা_ এসবই হচ্ছে হক্কুল ইবাদ। হক্কুল্লাহর বরখেলাপ হলে আল্লাহ ইচ্ছা করলে মাফ করে দেবেন কিন্তু হক্কুল ইবাদের বরখেলাপ হলে, ওই বান্দার কাছ থেকেই মাফ নিতে হবে, আল্লাহ সেটা মাফ করবেন না। আল্লাহর জমিনে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করাই হচ্ছে রবুবিয়্যাত বা খোদায়িত্ব অর্থাৎ সবকিছুই আল্লাহর, আমার কিছুই নয়_ এ কথা সবসময় মনে রাখা।
হজরত রাসূলুল্লাহর (সা.) দর্শনে দাস-দাসী ও প্রভুদের মধ্যে, সাদা-কালোর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তাঁর বিবেচনায় তাকওয়াই হচ্ছে (আল্লাহর প্রতি ভয়) মানুষের যোগ্যতার একমাত্র মাপকাঠি। সুতরাং তিনি কোনো লোক আরব কি অনারব, কালো কী সাদা_ সেদিকে মোটেই গুরুত্ব আরোপ করেননি। বিচার-আচারের ব্যাপারে তিনি এতটা কঠোর ও নিষ্ঠাবান ছিলেন যে, তাঁর দরবারে মুসলিম-অমুসলিমে কোনো ভেদাভেদ ছিল না। একবার এক অমুসলিম তাঁর দরবারে বিচার চেয়ে এক বিখ্যাত মুসলিমের বিরুদ্ধে রায় পেয়ে যায়। ন্যায়বিচারের খাতিরেই হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) অমুসলিমের পক্ষে রায়টি দিয়েছিলেন। আল্লাহর মহিমা বোঝা বড় দায়! রায় পেয়ে ওই অমুসলিম এতটা খুুশি হয়ে যায় যে, সঙ্গে সঙ্গে সে ইসলাম কবুল করে নেয়।
৬২২ খ্রিস্টাব্দে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার পর সেখানে তিনি একটি আদর্শ, কল্যাণমুখী, ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করেন এবং এ নবগঠিত ইসলামী রাষ্ট্রে মুসলমান, খ্রিস্টান ও ইহুদির মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের জন্য একটি চুক্তি সম্পাদনের গুরুত্ব উপলব্ধি করেন এবং সব ধর্মের, সব গোত্রের সবাইকে একত্রিত করে, সবাইকে সমঅধিকার দিয়ে, সর্বসম্মতিক্রমে যে চুক্তিটি সম্পাদন করেন, তা-ই 'মদিনার সনদ' নামে পরিচিত এবং এ সনদই হচ্ছে সারাবিশ্বের প্রথম লিখিত ম্যাগনাকার্টা।
লিখতে গেলে এমন অসংখ্য ঘটনা লেখা যাবে। এসব ঘটনা হাদিস ও সিরাতের কিতাবে অত্যন্ত বিস্তারিতভাবে বিবৃত হয়েছে। তা থেকে একটি উদাহরণ দিয়ে লেখাটি শেষ করছি।
'হুদায়বিয়ার সন্ধি' ষষ্ঠ হিজরিতে সম্পন্ন হয়েছিল এবং সাহাবাদের কাছে এটা এত অপমানকর মনে হয়েছিল যে, কেউ এটি সহজভাবে মেনে নিতে পারছিলেন না। কেননা এতে আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদের সঙ্গে সন্ধিটি সম্পন্ন হচ্ছে বলে লিখতে হচ্ছিল। 'রাসূলুল্লাহ' শব্দ নিয়ে মক্কার মুশরিকদের ছিল প্রবল আপত্তি। তাই শব্দটিই কেটে দিতে হয়েছিল, যা কাটতে কোনো মুসলমান রাজি ছিলেন না। শেষে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজের হাতে শব্দটি কেটে দেন এবং সন্ধিটি স্বাক্ষরিত হয়। এ সন্ধির প্রতি হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। কেননা তাঁর দিব্যদৃষ্টি দেখতে পাচ্ছিল যে, এ সন্ধিই হবে মুসলমানদের জন্য কল্যাণের সন্ধি, এ সন্ধিই হবে মুসলমানদের বিজয়ের সন্ধি। সত্যিকারেই এ সন্ধি স্থাপনের দুই বছরের মধ্যে অষ্টম হিজরিতে মক্কা বিজয় সম্ভব হয়েছিল।
muftianaet@gmail.com
হজরত রাসূলুল্লাহর (সা.) আলাদা কোনো দর্শন ছিল না, ইসলামী দর্শনই ছিল তাঁর দর্শন এবং তা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে লেখা রয়েছে কোরআনে। কোরআন হচ্ছে ইসলামী দর্শন এবং ইসলামী দর্শনই হচ্ছে হজরত রাসূলুল্লাহর (সা.) দর্শন।
ইসলামী দর্শন সম্পর্কে সংক্ষেপে এটুকুই বলা যায় যে, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলে, সবার মধ্যে ভ্রাতৃত্ব, সাম্য, মৈত্রী স্থাপন করা, আর সেটা শুধু মুখে না বলে, সব কাজকর্মে তা প্রমাণ করা। নিরীহ, গরিব, দুস্থ, অসহায়, এতিমদের সাহায্য করা। সমাজের সর্বস্তরে দুর্নীতি দমন করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। এসবই হচ্ছে ইসলামী দর্শন এবং হজরত রাসূলুল্লাহর (সা.) দর্শন। এসব কথা তিনি শুধু মুখেই বলেননি বরং প্রতিটি কাজের মধ্য দিয়ে তিনি নিজের জীবনে তার বাস্তবায়ন করে প্রমাণ রেখে গেছেন।
তাঁর দর্শনের ৩টি বিশেষ দিক ছিল_ হক্কুল্লাহ (আল্লাহর হক), হক্কুল ইবাদ (বান্দার হক) ও রবুবিয়্যাত (খোদায়িত্ব)। ইমান, নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, তাসবিহ-তাহলিল ইত্যাদি হচ্ছে হক্কুল্লাহ। আর বান্দার হক আদায় করা, যেমন_ প্রতিবেশীদের দিকে খেয়াল করা, দুস্থ-অসহায় এতিমদের সাহায্য করা, স্বামী-স্ত্রীর হক আদায় করা, বাবা-মা ও ছেলেমেয়ের হক আদায় করা, এমনকি গৃহপালিত পশুপাখির দিকে খেয়াল রাখা_ এসবই হচ্ছে হক্কুল ইবাদ। হক্কুল্লাহর বরখেলাপ হলে আল্লাহ ইচ্ছা করলে মাফ করে দেবেন কিন্তু হক্কুল ইবাদের বরখেলাপ হলে, ওই বান্দার কাছ থেকেই মাফ নিতে হবে, আল্লাহ সেটা মাফ করবেন না। আল্লাহর জমিনে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করাই হচ্ছে রবুবিয়্যাত বা খোদায়িত্ব অর্থাৎ সবকিছুই আল্লাহর, আমার কিছুই নয়_ এ কথা সবসময় মনে রাখা।
হজরত রাসূলুল্লাহর (সা.) দর্শনে দাস-দাসী ও প্রভুদের মধ্যে, সাদা-কালোর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তাঁর বিবেচনায় তাকওয়াই হচ্ছে (আল্লাহর প্রতি ভয়) মানুষের যোগ্যতার একমাত্র মাপকাঠি। সুতরাং তিনি কোনো লোক আরব কি অনারব, কালো কী সাদা_ সেদিকে মোটেই গুরুত্ব আরোপ করেননি। বিচার-আচারের ব্যাপারে তিনি এতটা কঠোর ও নিষ্ঠাবান ছিলেন যে, তাঁর দরবারে মুসলিম-অমুসলিমে কোনো ভেদাভেদ ছিল না। একবার এক অমুসলিম তাঁর দরবারে বিচার চেয়ে এক বিখ্যাত মুসলিমের বিরুদ্ধে রায় পেয়ে যায়। ন্যায়বিচারের খাতিরেই হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) অমুসলিমের পক্ষে রায়টি দিয়েছিলেন। আল্লাহর মহিমা বোঝা বড় দায়! রায় পেয়ে ওই অমুসলিম এতটা খুুশি হয়ে যায় যে, সঙ্গে সঙ্গে সে ইসলাম কবুল করে নেয়।
৬২২ খ্রিস্টাব্দে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার পর সেখানে তিনি একটি আদর্শ, কল্যাণমুখী, ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করেন এবং এ নবগঠিত ইসলামী রাষ্ট্রে মুসলমান, খ্রিস্টান ও ইহুদির মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের জন্য একটি চুক্তি সম্পাদনের গুরুত্ব উপলব্ধি করেন এবং সব ধর্মের, সব গোত্রের সবাইকে একত্রিত করে, সবাইকে সমঅধিকার দিয়ে, সর্বসম্মতিক্রমে যে চুক্তিটি সম্পাদন করেন, তা-ই 'মদিনার সনদ' নামে পরিচিত এবং এ সনদই হচ্ছে সারাবিশ্বের প্রথম লিখিত ম্যাগনাকার্টা।
লিখতে গেলে এমন অসংখ্য ঘটনা লেখা যাবে। এসব ঘটনা হাদিস ও সিরাতের কিতাবে অত্যন্ত বিস্তারিতভাবে বিবৃত হয়েছে। তা থেকে একটি উদাহরণ দিয়ে লেখাটি শেষ করছি।
'হুদায়বিয়ার সন্ধি' ষষ্ঠ হিজরিতে সম্পন্ন হয়েছিল এবং সাহাবাদের কাছে এটা এত অপমানকর মনে হয়েছিল যে, কেউ এটি সহজভাবে মেনে নিতে পারছিলেন না। কেননা এতে আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদের সঙ্গে সন্ধিটি সম্পন্ন হচ্ছে বলে লিখতে হচ্ছিল। 'রাসূলুল্লাহ' শব্দ নিয়ে মক্কার মুশরিকদের ছিল প্রবল আপত্তি। তাই শব্দটিই কেটে দিতে হয়েছিল, যা কাটতে কোনো মুসলমান রাজি ছিলেন না। শেষে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজের হাতে শব্দটি কেটে দেন এবং সন্ধিটি স্বাক্ষরিত হয়। এ সন্ধির প্রতি হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। কেননা তাঁর দিব্যদৃষ্টি দেখতে পাচ্ছিল যে, এ সন্ধিই হবে মুসলমানদের জন্য কল্যাণের সন্ধি, এ সন্ধিই হবে মুসলমানদের বিজয়ের সন্ধি। সত্যিকারেই এ সন্ধি স্থাপনের দুই বছরের মধ্যে অষ্টম হিজরিতে মক্কা বিজয় সম্ভব হয়েছিল।
muftianaet@gmail.com
No comments