সুন্দর জীবন নিশ্চিত হোক-সমাজ by রোবায়েত ফেরদৌস
১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস। আর যারপরনাই আশ্চর্য যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ড. মৃদুল কান্তি চক্রবর্তী জাতীয় শোক দিবসেই তার দেহ রাখলেন। তার মৃত্যুর খবর শুনে প্রথমে মনে হয়েছিল সঙ্গীত বিভাগে অতর্কিতে হানা দিয়ে ডাকাতরা কাবু করে ফেলল অধ্যাপক মৃদুল কান্তিকে, যিনি বাংলাদেশের খ্যাতিমান লোকসঙ্গীত শিল্পী;
সঙ্গীত গবেষণা এবং বাংলাদেশের বিদ্যায়তনে সঙ্গীত শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে যিনি রেখেছেন পথিকৃতের ভূমিকা। কিন্তু তার মৃত্যু নেহাত অসুস্থতাজনিত মৃত্যু নয়। তার স্ত্রী এবং এক চিকিৎসক আত্মীয় ডা. শোভনের কাছ থেকে আমরা জেনেছি, ল্যাবএইড হাসপাতালের চিকিৎসকদের অমানবিক আচরণ ও অবহেলায় মারা গেছেন তিনি। ভর্তি করানোর সময় দরকার ছিল ১১ হাজার টাকা। কিন্তু অধ্যাপক মৃদুল কান্তির স্ত্রীর হাতে নগদ ছিল দশ হাজার টাকা। মাত্র এক হাজার টাকা কম থাকায় ল্যাডএইড কর্তৃপক্ষ অধ্যাপক মৃদুল কান্তিকে ভর্তি করতে অস্বীকার করে। তার স্ত্রীর অনুনয়-কাকুতিও কোনো কাজে লাগেনি। বাকি এক হাজার টাকা তাকে ফোন করে বাসা থেকে আনিয়ে নিতে হয়। অধ্যাপক কান্তির জীবন-মৃত্যু যখন সেকেন্ডের কাঁটায় দুলছে, ভর্তির জন্য টান পড়া ১০০ টাকার মাত্র ১০টি নোট আর তথাকথিত আমলাতান্ত্রিক কাগজপত্র ঠিকঠাক করতেই তখন মূল্যবান পঁয়তালি্লশটি মিনিট ব্যয় হয়ে যায় ল্যাবএইডের ফ্লোরে। অধ্যাপক কান্তি ছিলেন দীর্ঘদিনের ডায়াবেটিক পেশেন্ট। কিন্তু তার শরীরের সেই অবস্থাকে বিশেষ বিবেচনায় না এনে নিতান্ত অবহেলায় তার চিকিৎসা শুরু করা হয়। ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে। ডাকাতরা সঙ্গীত বিভাগের বুকে ছুরি মেরে তাদের যা নেওয়ার নিয়ে পালিয়ে গেছে। অথচ কী আশ্চর্য, অধ্যাপক মৃদুল কান্তি চিকিৎসার জন্য ল্যাবএইডের ফটক থেকে হেঁটে ভেতরে ঢুকেছিলেন; কিন্তু বের হন লাশ হয়ে! সর্বস্তরের মানুষের সম্মান জানানোর জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার সামনে যখন অধ্যাপক কান্তির মরদেহ স্থাপন করা হয় তখন গণমাধ্যমের সামনে তার চিকিৎসক আত্মীয় ডা. শোভন ল্যাবএইড হাসপাতালের চিকিৎসকদের অবহেলা, অব্যবস্থাপনা আর অমানবিকতার এক মর্মন্তুদ চিত্র তুলে ধরেন। এ নিয়ে ল্যাবএইড হাসপাতালের বিরুদ্ধে একটি রিট চলছে। আদালত এ বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। আমরা আদালতের কাছ থেকে সুবিচার আশা করছি।
অধ্যাপক কান্তি তার কর্ম আর কীর্তিকে পেছনে ফেলে চলে গেছেন দূরে, বহু দূরে নিঃসীম অসীমে; কিন্তু আমরা যারা এখনও জীবনপ্রদীপের সলতে উস্কে দিয়ে অন্ধকার এ রাষ্ট্রে বাঁচার চেষ্টা করছি তাদের সামনে মৃদুল কান্তির মৃত্যু কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়ে গেছে। আমরা ঠিক ভেবে পাচ্ছি না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামখ্যাত একজন শিক্ষকের চিকিৎসার যদি এই হয় দশা, তবে বাংলাদেশের সাধারণ-গরিব-প্রান্তিক মানুষের চিকিৎসার দুরবস্থা কোন পর্যায়ে বিরাজ করছে! খবরের কাগজে আমরা দেখেছি, ইবনে সিনা হাসপাতালকে শিশু হত্যার জন্য দায়ী করা হচ্ছে। আদালতে এ নিয়ে মামলা চলছে। সরকারি হাসপাতালে ডাক্তার তার দায়িত্বে ঠিকমতো থাকছেন না, মানুষ কার্যত কোনো সুচিকিৎসা সেখানে পাচ্ছে না। আর বেসরকারি ক্লিনিকগুলো চিকিৎসার নামে রমরমা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। জীবনের চাইতে মুনাফা আর সেবার চাইতে অর্থগৃধ্নু সেখানে প্রধান ও প্রবল। আমরা দেখছি হতদরিদ্র মানুষের কিডনি, লিভারসহ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি-ব্যবসার সঙ্গে দালালচক্র আর ক্লিনিকগুলো কীভাবে জড়িত হয়ে দেদার ব্যবসা করে যাচ্ছে!
দেশে আইন আছে, বিচার আছে, সংসদ আছে। তাদের চোখের সামনেই বছরের পর বছর এই ঘৃণ্য আর অমানবিক ব্যবসা তার পসার বিস্তার করে চলেছে। এ কেমনতর রাষ্ট্র, যেখানে অভাবের তাড়নায় লুট হয়ে যাচ্ছে মূল্যবান শরীর! দরিদ্র প্রান্তিক মানুষের কিডনি পাচারে জড়িত এক শ্রেণীর প্রতারক তাদের ব্যবসা এমনকি দেশের বাইরে পর্যন্ত বিস্তৃত করেছে। তবে কি এই রাষ্ট্র চা, চামড়া, গার্মেন্ট পণ্যের মতো কিডনি-লিভারকেও রফতানিযোগ্য পণ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে চায়_ প্রশ্ন রইল রাষ্ট্রপক্ষের কাছে।
মানুষ কি কেবল অচিকিৎসা-অপচিকিৎসায় মারা যাচ্ছে? সমস্যা কি কেবল হাসাপতাল-ক্লিনিকে? আমরা ক্ষোভের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, রাষ্ট্রের সর্বত্র চলছে বিশৃঙ্খলা। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিশৃঙ্খলার বড় নমুনা এর বিশৃঙ্খল সড়ক। গেল ১৩ আগস্ট মানিকগঞ্জে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষককে আমরা হারিয়েছি। ওই দুর্ঘটনায় সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক শিক্ষক ও বাংলাদেশের আধুনিক সম্প্রচার সাংবাদিকতার অন্যতম পথিকৃৎ মিশুক মুনীর এবং খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদসহ পাঁচজন নিহত হন। বাংলাদেশে কয়েক বছরে সড়ক দুর্ঘটনা জ্যামিতিক হারে বেড়েছে। প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় আমরা হারাচ্ছি প্রিয়জনদের। একটি মৃত্যু একটি পরিবারের সারা জীবনের কান্না। কোনো কোনো মৃত্যু পুরো দেশের জন্যই অপূরণীয় ক্ষতি। এর আগে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪২ শিশু নিহত হয়। আমরা মনে করি, এগুলো নিছক দুর্ঘটনা নয়। সড়ক ও পরিবহন খাতে দীর্ঘ অব্যবস্থাপনা, সীমাহীন দুর্নীতি, ত্রুটিপূর্ণ ও অবৈজ্ঞানিক সড়ক নির্মাণ, সর্বোপরি কর্তৃপক্ষের জবাবদিহিতার অভাব আজকের বাংলাদেশকে পৃথিবীর অন্যতম প্রধান দুর্ঘটনাকবলিত রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। তাই আমাদের প্রতীতি, বাংলাদেশে দুর্ঘটনার নামে আসলে প্রতিদিন হাসপাতাল কিংবা সড়কে নিরীহ মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। সদ্যোজাত শিশু থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, রিকশা শ্রমিক থেকে বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্রকার_ কেউই এ হত্যাযজ্ঞ থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। আমরা যে কেউ যে কোনো দিন এর নির্মম শিকার হয়ে যেতে পারি। আর কেবল সড়ক দুর্ঘটনা বা ক্লিনিকে ভুল চিকিৎসার শিকার হয়ে নয়; এ রাষ্ট্রে র্যাবের ক্রসফায়ারে নিরীহ লিমন পা হারাচ্ছে, পুলিশের চাপাতি পঙ্গু করে দিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র কাদেরকে, নোয়াখালীতে পুলিশ গণপিটুনিতে হত্যার উদ্দেশ্যে নির্দোষ মিলনকে তুলে দিচ্ছে উচ্ছৃঙ্খল গ্রুপের কাছে, পুলিশের অবহেলায় গণপিটুনিতে হত্যা করা হচ্ছে ছয় তরুণ প্রাণকে কিংবা ফতোয়ার শিকার হয়ে প্রতিদিন নারীকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হচ্ছে। এ তালিকা দীর্ঘতর! আমরা যে কেউ যে কোনো দিন রাষ্ট্রীয় এ অব্যবস্থার শিকার হয়ে নিহত হয়ে যেতে পারি!
আমরা মনে করি, যে কোনো সভ্য রাষ্ট্রের জন্য এটা লজ্জার। কোনো বিবেকবান মানুষই এ অবস্থা মেনে নিতে পারে না। আপনারা জানেন, যে কোনো সভ্য রাষ্ট্রে দুর্ঘটনা বা অব্যবস্থাপনা ঘটলে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তাব্যক্তি তার দায় স্বীকার করেন। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মৌল বৈশিষ্ট্য হলো, প্রশাসনের সর্বত্র জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করা। দুঃখজনক যে, হাসপাতাল, সড়ক, পরিবহনসহ বিভিন্ন সেক্টরে দীর্ঘ অব্যবস্থাপনার কারণে বাংলাদেশে দিনের পর দিন মানুষ নিহত হচ্ছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত এর কোনো প্রতিকার, প্রতিবিধান বা দায় স্বীকারের কোনো নজির স্থাপিত হয়নি। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তাব্যক্তিদের সবাই কেবল একে অন্যের কাঁধে দোষ চাপানোর নিম্ন-সাংস্কৃতিক রুচির পরিচয়ই দিয়ে গেছেন। এ অভিযোগ থেকে বর্তমান বা অতীতের কোনো সরকারই মুক্ত নয়। আমরা মনে করি, এ অবস্থা চলতে দেওয়া যায় না। প্রতিবাদ-আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা এ অবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করতে চেয়েছি। প্রতিবাদ না করলে প্রতিদিন আমাদের লাশ হয়ে ঘরে ফিরতে হবে। আন্দোলন-প্রতিবাদের মাধ্যমেই_ আমাদের প্রতীতি, রাষ্ট্রে জবাবদিহিতার কাঠামো তৈরির শুভ সূচনা হবে। এই দেশের রাজনীতিবিদরা ঘুমিয়ে আছেন। আমরা তাদের ঘুম ভাঙাতে চাই। এ কারণেই আমরা বিভিন্ন পর্যায়ে অহিংস ও শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদী কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমাদের দাবি একটাই :রাষ্ট্রকে মানুষের সুন্দর জীবন আর স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।
রোবায়েত ফেরদৌস :সহযোগী অধ্যাপক গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, খণ্ডকালীন শিক্ষক, সঙ্গীত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
robaet.ferdous@gmail.com
অধ্যাপক কান্তি তার কর্ম আর কীর্তিকে পেছনে ফেলে চলে গেছেন দূরে, বহু দূরে নিঃসীম অসীমে; কিন্তু আমরা যারা এখনও জীবনপ্রদীপের সলতে উস্কে দিয়ে অন্ধকার এ রাষ্ট্রে বাঁচার চেষ্টা করছি তাদের সামনে মৃদুল কান্তির মৃত্যু কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়ে গেছে। আমরা ঠিক ভেবে পাচ্ছি না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামখ্যাত একজন শিক্ষকের চিকিৎসার যদি এই হয় দশা, তবে বাংলাদেশের সাধারণ-গরিব-প্রান্তিক মানুষের চিকিৎসার দুরবস্থা কোন পর্যায়ে বিরাজ করছে! খবরের কাগজে আমরা দেখেছি, ইবনে সিনা হাসপাতালকে শিশু হত্যার জন্য দায়ী করা হচ্ছে। আদালতে এ নিয়ে মামলা চলছে। সরকারি হাসপাতালে ডাক্তার তার দায়িত্বে ঠিকমতো থাকছেন না, মানুষ কার্যত কোনো সুচিকিৎসা সেখানে পাচ্ছে না। আর বেসরকারি ক্লিনিকগুলো চিকিৎসার নামে রমরমা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। জীবনের চাইতে মুনাফা আর সেবার চাইতে অর্থগৃধ্নু সেখানে প্রধান ও প্রবল। আমরা দেখছি হতদরিদ্র মানুষের কিডনি, লিভারসহ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি-ব্যবসার সঙ্গে দালালচক্র আর ক্লিনিকগুলো কীভাবে জড়িত হয়ে দেদার ব্যবসা করে যাচ্ছে!
দেশে আইন আছে, বিচার আছে, সংসদ আছে। তাদের চোখের সামনেই বছরের পর বছর এই ঘৃণ্য আর অমানবিক ব্যবসা তার পসার বিস্তার করে চলেছে। এ কেমনতর রাষ্ট্র, যেখানে অভাবের তাড়নায় লুট হয়ে যাচ্ছে মূল্যবান শরীর! দরিদ্র প্রান্তিক মানুষের কিডনি পাচারে জড়িত এক শ্রেণীর প্রতারক তাদের ব্যবসা এমনকি দেশের বাইরে পর্যন্ত বিস্তৃত করেছে। তবে কি এই রাষ্ট্র চা, চামড়া, গার্মেন্ট পণ্যের মতো কিডনি-লিভারকেও রফতানিযোগ্য পণ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে চায়_ প্রশ্ন রইল রাষ্ট্রপক্ষের কাছে।
মানুষ কি কেবল অচিকিৎসা-অপচিকিৎসায় মারা যাচ্ছে? সমস্যা কি কেবল হাসাপতাল-ক্লিনিকে? আমরা ক্ষোভের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, রাষ্ট্রের সর্বত্র চলছে বিশৃঙ্খলা। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিশৃঙ্খলার বড় নমুনা এর বিশৃঙ্খল সড়ক। গেল ১৩ আগস্ট মানিকগঞ্জে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষককে আমরা হারিয়েছি। ওই দুর্ঘটনায় সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক শিক্ষক ও বাংলাদেশের আধুনিক সম্প্রচার সাংবাদিকতার অন্যতম পথিকৃৎ মিশুক মুনীর এবং খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদসহ পাঁচজন নিহত হন। বাংলাদেশে কয়েক বছরে সড়ক দুর্ঘটনা জ্যামিতিক হারে বেড়েছে। প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় আমরা হারাচ্ছি প্রিয়জনদের। একটি মৃত্যু একটি পরিবারের সারা জীবনের কান্না। কোনো কোনো মৃত্যু পুরো দেশের জন্যই অপূরণীয় ক্ষতি। এর আগে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪২ শিশু নিহত হয়। আমরা মনে করি, এগুলো নিছক দুর্ঘটনা নয়। সড়ক ও পরিবহন খাতে দীর্ঘ অব্যবস্থাপনা, সীমাহীন দুর্নীতি, ত্রুটিপূর্ণ ও অবৈজ্ঞানিক সড়ক নির্মাণ, সর্বোপরি কর্তৃপক্ষের জবাবদিহিতার অভাব আজকের বাংলাদেশকে পৃথিবীর অন্যতম প্রধান দুর্ঘটনাকবলিত রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। তাই আমাদের প্রতীতি, বাংলাদেশে দুর্ঘটনার নামে আসলে প্রতিদিন হাসপাতাল কিংবা সড়কে নিরীহ মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। সদ্যোজাত শিশু থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, রিকশা শ্রমিক থেকে বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্রকার_ কেউই এ হত্যাযজ্ঞ থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। আমরা যে কেউ যে কোনো দিন এর নির্মম শিকার হয়ে যেতে পারি। আর কেবল সড়ক দুর্ঘটনা বা ক্লিনিকে ভুল চিকিৎসার শিকার হয়ে নয়; এ রাষ্ট্রে র্যাবের ক্রসফায়ারে নিরীহ লিমন পা হারাচ্ছে, পুলিশের চাপাতি পঙ্গু করে দিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র কাদেরকে, নোয়াখালীতে পুলিশ গণপিটুনিতে হত্যার উদ্দেশ্যে নির্দোষ মিলনকে তুলে দিচ্ছে উচ্ছৃঙ্খল গ্রুপের কাছে, পুলিশের অবহেলায় গণপিটুনিতে হত্যা করা হচ্ছে ছয় তরুণ প্রাণকে কিংবা ফতোয়ার শিকার হয়ে প্রতিদিন নারীকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হচ্ছে। এ তালিকা দীর্ঘতর! আমরা যে কেউ যে কোনো দিন রাষ্ট্রীয় এ অব্যবস্থার শিকার হয়ে নিহত হয়ে যেতে পারি!
আমরা মনে করি, যে কোনো সভ্য রাষ্ট্রের জন্য এটা লজ্জার। কোনো বিবেকবান মানুষই এ অবস্থা মেনে নিতে পারে না। আপনারা জানেন, যে কোনো সভ্য রাষ্ট্রে দুর্ঘটনা বা অব্যবস্থাপনা ঘটলে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তাব্যক্তি তার দায় স্বীকার করেন। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মৌল বৈশিষ্ট্য হলো, প্রশাসনের সর্বত্র জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করা। দুঃখজনক যে, হাসপাতাল, সড়ক, পরিবহনসহ বিভিন্ন সেক্টরে দীর্ঘ অব্যবস্থাপনার কারণে বাংলাদেশে দিনের পর দিন মানুষ নিহত হচ্ছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত এর কোনো প্রতিকার, প্রতিবিধান বা দায় স্বীকারের কোনো নজির স্থাপিত হয়নি। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তাব্যক্তিদের সবাই কেবল একে অন্যের কাঁধে দোষ চাপানোর নিম্ন-সাংস্কৃতিক রুচির পরিচয়ই দিয়ে গেছেন। এ অভিযোগ থেকে বর্তমান বা অতীতের কোনো সরকারই মুক্ত নয়। আমরা মনে করি, এ অবস্থা চলতে দেওয়া যায় না। প্রতিবাদ-আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা এ অবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করতে চেয়েছি। প্রতিবাদ না করলে প্রতিদিন আমাদের লাশ হয়ে ঘরে ফিরতে হবে। আন্দোলন-প্রতিবাদের মাধ্যমেই_ আমাদের প্রতীতি, রাষ্ট্রে জবাবদিহিতার কাঠামো তৈরির শুভ সূচনা হবে। এই দেশের রাজনীতিবিদরা ঘুমিয়ে আছেন। আমরা তাদের ঘুম ভাঙাতে চাই। এ কারণেই আমরা বিভিন্ন পর্যায়ে অহিংস ও শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদী কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমাদের দাবি একটাই :রাষ্ট্রকে মানুষের সুন্দর জীবন আর স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।
রোবায়েত ফেরদৌস :সহযোগী অধ্যাপক গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, খণ্ডকালীন শিক্ষক, সঙ্গীত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
robaet.ferdous@gmail.com
No comments