শেকড়ের ডাক-নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র ও সুন্দরবন by ফরহাদ মাহমুদ
বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (পিডিবি) এবং ভারতের ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার করপোরেশন (এনটিপিসি) সম্প্রতি একটি বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের চুক্তি সই করেছে। ১৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন, যা বাংলাদেশের বর্তমান চাহিদার এক-পঞ্চমাংশ, কয়লাভিত্তিক এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি স্থাপিত হবে বাগেরহাটের রামপাল উপজেলায়। এতে ব্যয় হবে ১৫০ কোটি ডলার এবং এটি ২০১৫ সাল নাগাদ উৎপাদনে যেতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে।
কিন্তু পরিবেশবাদীরা বলছেন, রামপালে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হলে আমাদের অহংকার এবং বিশ্ব ঐতিহ্যের সুন্দরবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যদিও পিডিবি বলছে, এতে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা নেই। কারণ সুন্দরবন থেকে কেন্দ্রটির দূরত্ব হবে ১৪ কিলোমিটার এবং মূল সুন্দরবন বা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট থেকে এর দূরত্ব হবে ৭০ কিলোমিটার। গভীর সমুদ্র বন্দর আকরাম পয়েন্ট থেকে ৯০ কিলোমিটার, প্রস্তাবিত খানজাহান আলী বিমানবন্দর থেকে ১২ কিলোমিটার এবং খুলনা শহর থেকে ২৩ কিলোমিটার দক্ষিণে। মংলাভিত্তিক সামগ্রিক উন্নয়ন পরিকল্পনার সঙ্গে সংগতি রেখেই এটি করা হয়েছে। তদুপরি এখানে আমদানি করা উন্নতমানের কয়লা ব্যবহার করা হবে, যেগুলোর দূষণের মাত্রা অনেক কম। তা সত্ত্বেও দেশের ১২ জন বিশিষ্ট নাগরিক যে বিবৃতি দিয়েছেন, তাকে আমরা গুরুত্ব না দিয়ে পারছি না। তাঁরা বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর সরকারি উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও বিদ্যুৎকেন্দ্রের স্থান পুনর্নির্বাচনের অনুরোধ জানিয়েছেন। তাঁরা দাবি করেছেন, এখানে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হলে সুন্দরবনের অবশ্যই ক্ষতি হবে। বিবৃতিদাতাদের মধ্যে আছেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালক সুলতানা কামাল, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রেসিডেন্ট প্রফেসর আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল, গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে মহিউদ্দিন, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি বা বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ান হাসান, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ বা টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রমুখ। তাঁদের এ আপত্তির কারণগুলোও সরকারকে অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে।
বাংলাদেশ বর্তমানে গুরুতর বিদ্যুৎ সংকটে রয়েছে। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বহু বাড়ি দীর্ঘদিন ধরে নির্মিত হয়ে পড়ে আছে, বিদ্যুৎ সংযোগ পাচ্ছে না। বিদ্যুতের অভাবে বহু শিল্প-কারখানা স্থাপিত হতে পারছে না। শীতকাল বলে আমরা হয়তো প্রতিদিনের বিদ্যুৎ সংকট খুব একটা অনুভব করতে পারছি না। কিন্তু মার্চ-এপ্রিল থেকেই তা আমরা বুঝতে শুরু করব। জুন-জুলাইয়ে প্রতি ঘণ্টায় লোডশেডিংয়ে জনজীবন চরম দুর্ভোগের শিকার হবে- তা প্রায় নিশ্চিত। যদিও সরকারের দাবি অনুযায়ী, গত তিন বছরে দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় তিন হাজার মেগাওয়াট। অন্যদিকে পুরনো কেন্দ্রগুলোর উৎপাদনক্ষমতা কিছুটা হ্রাসও পেয়েছে। বাড়তি বিদ্যুতের প্রায় পুরোটাই এসেছে ছোট ছোট রেন্টাল পাওয়ার স্টেশন থেকে এবং এগুলো চলে আমদানি করা জ্বালানি তেল দিয়ে। আর এসবের ইউনিটপ্রতি উৎপাদন খরচও অনেক বেশি। প্রতি ইউনিট ১৩ টাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করে গ্রাহকের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে সাড়ে চার টাকায়। ফলে জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতে সরকারকে প্রচুর ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। আর তাতে বিশাল চাপ পড়েছে দেশের অর্থনীতির ওপর। তাই নাজেহাল অর্থনীতি রক্ষায় এবং ভর্তুকির পরিমাণ কমাতে সরকারকে দফায় দফায় জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা প্রায় সবাই স্বীকার করছেন, বড় ও সাশ্রয়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন ছাড়া জোড়াতালির রেন্টাল পাওয়ার দিয়ে বেশি দিন সংকট মোকাবিলা করা যাবে না। বরং এতে নতুন নতুন সংকটের সৃষ্টি হবে এবং তা হিতে বিপরীত হতে পারে।
সরকার অবশ্য গত নভেম্বর মাসে রাশিয়ার সঙ্গে দুটি নতুন পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের চুক্তি সই করেছে। যদি সব কিছু ঠিকঠাক মতো সম্পন্ন হয়, তাহলে ২০১৬ কিংবা ২০১৭ সালে ১০০০ মেগাওয়াট এবং ২০১৮ সালে আরো ১০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন হবে পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্প দুটি থেকে। কিন্তু পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন নিয়েও পরিবেশবাদীদের যথেষ্ট আপত্তি রয়েছে। এ নিয়েও আমরা অনেক প্রতিবাদ ও ভিন্নমত দেখতে পেয়েছি। এর আগে চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলায় আরেকটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেখানেও প্রবল প্রতিরোধের মুখোমুখি হতে হয়েছিল সরকারকে। সেই প্রকল্পটি এখন হিমাগারে চাপা পড়ে আছে। এখন আরেকটি বিকল্প ছিল গ্যাসভিত্তিক বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা। কিন্তু আমাদের সেই গ্যাসও ফুরিয়ে আসছে। ইতিমধ্যে সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্রে উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। গ্যাসভিত্তিক অনেক শিল্প-কারখানাই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। মাঝেমধ্যেই বন্ধ রাখতে হচ্ছে গ্যাসভিত্তিক সার কারখানা। বাড়িঘরে সংযোগ প্রদান বন্ধ রাখা হয়েছে। যাদের সংযোগ আছে, তারাও ঠিকমতো গ্যাস পাচ্ছে না। এ অবস্থায় গ্যাসভিত্তিক নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রও স্থাপন করা সম্ভব নয়।
১২ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির মতে, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে প্রধান ক্ষতিকর দিকগুলোর মধ্যে রয়েছে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও কয়লার ছাই নির্গত হওয়া এবং নদীর পানি দূষণ। এর ফলে সুন্দরবনের প্রাণী ও উদ্ভিদের ক্ষতি হতে পারে। যে প্রাথমিক পরিবেশ মূল্যায়ন রিপোর্টের ভিত্তিতে সরকার স্থান নির্বাচন করেছে, সেই রিপোর্টের যথার্থতা নিয়েও তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু তাঁদের বিবৃতিতে সুন্দরবনের প্রতি বাংলার মানুষের স্বাভাবিক আবেগের যে বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখতে পাই, সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে সুন্দরবনের জন্য এটি কতটা ক্ষতিকর হতে পারে- সে রকম কোনো ধারণা আমরা পাই না। আমাদের জানা মতে, সুন্দরবনের নিকটবর্তী এলাকায়, এমনকি বাফার জোনেও বহু ইটখোলা রয়েছে এবং এর প্রায় সবই কয়লা পোড়ায় এবং সেসব কয়লা অত্যন্ত নিম্নমানের, যেগুলোর দূষণমাত্রা অনেক বেশি। সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে মংলা বন্দরে আসা প্রতিটি জাহাজ ও ইঞ্জিনচালিত নৌকা প্রচুর কার্বন ডাই-অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইডসহ অনেক ক্ষতিকর গ্যাস নির্গমন করছে। সুন্দরবনের অভ্যন্তরে ক্রমেই মানুষের বসতি বাড়ছে, বিচরণও বাড়ছে। মাছধরা কিংবা হোগলাপাতা সংগ্রহকারী নৌকাগুলোর বেশির ভাগই এখন ইঞ্জিনচালিত এবং ডিজেল ব্যবহারকারী, যেগুলো থেকে প্রচুর হাইড্রোকার্বন নির্গত হচ্ছে এবং শুধু বাতাস নয়, পানিও দূষণ করছে। সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বিবিসিকে বলেছেন, পশুর নদীর ওপর যদি এটি অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে, তাহলে সুন্দরবনে পানির অভাব হতে পারে, যা বনের জন্য ক্ষতিকর হবে। আমরা জানি না, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে অতিরিক্ত পানি ব্যবহার করতে হয় কি না। ভৈরব নদের তীরে খুলনার গোয়ালমারা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি অনেক আগে থেকেই চলে আসছে। কিন্তু এর কারণে নদীর পানি কমে যাওয়ার কোনো তথ্য আজ পর্যন্ত আমরা পাইনি।
তাই বলে আমরা রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন সমর্থনও করছি না। যদি সম্ভব হয়, এটি আরো ২০ থেকে ২৫ কিলোমিটার ভাটিতে সরিয়ে নিলে আমাদের গর্বের সুন্দরবন নিয়ে যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, তা অনেকটাই কমে যাবে। বিষয়টি সরকারের গুরুত্ব দিয়ে ভাবা উচিত। আবার যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত না নিয়ে যেকোনো উদ্যোগের বিরোধিতায় নেমে পড়াটাকেও খুব ভালো মনে করতে পারছি না। দেশ এগিয়ে নিতে হলে, শিল্প-কারখানা বাড়াতে হলে, বেকারত্বের অবসান ঘটাতে হলে ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা আমাদের মেটাতেই হবে। কিন্তু যেখানে উদ্যোগ, সেখানেই বিরোধিতা হলে যেকোনো উদ্যোগই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যে ১২ জন বিশিষ্ট নাগরিক বিবৃতি দিয়েছেন, তাঁদের প্রতি যথেষ্ট পরিমাণে শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, তাঁরা কেউই সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞ নন। আমরা আশা করব, তড়িৎ কৌশল, পরিবেশ রসায়নবিদ কিংবা সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা এ ব্যাপারে তাঁদের মূল্যবান মতামত দেবেন। এ ব্যাপারে যে ধোঁয়াশা বিরাজ করছে, তা কাটাতে সহায়তা করবেন। সর্বোপরি এ উদ্যোগ যদি সুন্দরবনের জন্য ব্যাপক ক্ষতিকর হয়, তাহলে আমাদের আগেভাগেই সেখান থেকে সরে আসা উচিত হবে। অন্যথায় চরম বিদ্যুৎ সংকটের এই দেশে গৃহীত উদ্যোগ বাধাগ্রস্ত না করাটাই যৌক্তিক হবে।
আমাদের মনে আছে, কিছুদিন আগে কয়েকটি এনজিও জাহাজভাঙা শিল্পের বিরোধিতায় উঠেপড়ে লেগেছিল। আজকে জাহাজভাঙা শিল্প আমাদের অর্থনীতির একটি বড় খুঁটি। দেশের নির্মাণশিল্পে প্রতিবছর যে পরিমাণ রডের প্রয়োজন হয়, এই শিল্প না থাকলে তা আমাদের কয়েকগুণ দাম দিয়ে কিনতে হতো। অবকাঠামো উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়ত। আজকে শুধু জাহাজভাঙা নয়, জাহাজ নির্মাণ এবং তা রপ্তানি করে বাংলাদেশ বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। এই শিল্পে প্রচুর বেকার যুবকের কর্মসংস্থান হয়েছে। হ্যাঁ, আমরা যেটা দাবি করতে পারি, তা হচ্ছে, এই শিল্পের শ্রমিকদের যে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে, তা কমাতে হবে। এর ফলে যে পরিবেশদূষণ হচ্ছে, তা হ্রাস করার এবং বিকাশমান একটি শিল্পকে সহযোগিতা করার জন্য প্রয়োজনে রাষ্ট্রীয়ভাবে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে।
বাংলাদেশে পরিবেশের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হচ্ছে অতিরিক্ত ও অদক্ষ জনসংখ্যা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, কুসংস্কার ইত্যাদি। প্রতিবছর যে পরিমাণে বন ধ্বংস হচ্ছে, তা রোধ করা না গেলে ভবিষ্যতে এ দেশে বসবাস করাই কঠিন হয়ে পড়বে। গভীর ও ঘন বনের প্রাণী যেমন হারিয়ে যাচ্ছে, তার চেয়েও বেশি হারে কমছে লোকালয় সংশ্লিষ্ট বনের পশুপাখি। আর বন ধ্বংস হলে বা গাছপালা কমে গেলে স্বাভাবিকভাবেই বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের ঘনত্ব বাড়তে থাকে। এসব সমস্যার সমাধানে আমাদের পরিবেশবাদীদের অনেক বেশি সক্রিয় হতে হবে। দেশের শিল্পায়ন ও উন্নয়ন প্রচেষ্টার বিরোধিতাই পরিবেশবাদীদের একমাত্র কাজ হতে পারে না। আমরা তো মনে করি, ভারতের বিতর্কিত টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে যৌথ সমীক্ষার পর যদি দেখা যায়, বাংলাদেশের জন্য তা খুব বেশি ক্ষতিকর হবে না, তাহলে আমরা টিপাইমুখ জলবিদ্যুৎকেন্দ্রে অংশীদার হতে পারি। কিন্তু আগে যৌথ সমীক্ষা হতেই হবে এবং যথেষ্ট তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে আমাদের পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে হবে।
[লেখাটির ব্যাপারে কারো ভিন্নমত, প্রতিক্রিয়া কিংবা পরিপূরক কিছু বলার থাকলে তা কালের কণ্ঠের ঠিকানায় লিখে পাঠাতে পারেন। - বি. স.]
বাংলাদেশ বর্তমানে গুরুতর বিদ্যুৎ সংকটে রয়েছে। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বহু বাড়ি দীর্ঘদিন ধরে নির্মিত হয়ে পড়ে আছে, বিদ্যুৎ সংযোগ পাচ্ছে না। বিদ্যুতের অভাবে বহু শিল্প-কারখানা স্থাপিত হতে পারছে না। শীতকাল বলে আমরা হয়তো প্রতিদিনের বিদ্যুৎ সংকট খুব একটা অনুভব করতে পারছি না। কিন্তু মার্চ-এপ্রিল থেকেই তা আমরা বুঝতে শুরু করব। জুন-জুলাইয়ে প্রতি ঘণ্টায় লোডশেডিংয়ে জনজীবন চরম দুর্ভোগের শিকার হবে- তা প্রায় নিশ্চিত। যদিও সরকারের দাবি অনুযায়ী, গত তিন বছরে দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় তিন হাজার মেগাওয়াট। অন্যদিকে পুরনো কেন্দ্রগুলোর উৎপাদনক্ষমতা কিছুটা হ্রাসও পেয়েছে। বাড়তি বিদ্যুতের প্রায় পুরোটাই এসেছে ছোট ছোট রেন্টাল পাওয়ার স্টেশন থেকে এবং এগুলো চলে আমদানি করা জ্বালানি তেল দিয়ে। আর এসবের ইউনিটপ্রতি উৎপাদন খরচও অনেক বেশি। প্রতি ইউনিট ১৩ টাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করে গ্রাহকের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে সাড়ে চার টাকায়। ফলে জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতে সরকারকে প্রচুর ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। আর তাতে বিশাল চাপ পড়েছে দেশের অর্থনীতির ওপর। তাই নাজেহাল অর্থনীতি রক্ষায় এবং ভর্তুকির পরিমাণ কমাতে সরকারকে দফায় দফায় জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা প্রায় সবাই স্বীকার করছেন, বড় ও সাশ্রয়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন ছাড়া জোড়াতালির রেন্টাল পাওয়ার দিয়ে বেশি দিন সংকট মোকাবিলা করা যাবে না। বরং এতে নতুন নতুন সংকটের সৃষ্টি হবে এবং তা হিতে বিপরীত হতে পারে।
সরকার অবশ্য গত নভেম্বর মাসে রাশিয়ার সঙ্গে দুটি নতুন পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের চুক্তি সই করেছে। যদি সব কিছু ঠিকঠাক মতো সম্পন্ন হয়, তাহলে ২০১৬ কিংবা ২০১৭ সালে ১০০০ মেগাওয়াট এবং ২০১৮ সালে আরো ১০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন হবে পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্প দুটি থেকে। কিন্তু পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন নিয়েও পরিবেশবাদীদের যথেষ্ট আপত্তি রয়েছে। এ নিয়েও আমরা অনেক প্রতিবাদ ও ভিন্নমত দেখতে পেয়েছি। এর আগে চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলায় আরেকটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেখানেও প্রবল প্রতিরোধের মুখোমুখি হতে হয়েছিল সরকারকে। সেই প্রকল্পটি এখন হিমাগারে চাপা পড়ে আছে। এখন আরেকটি বিকল্প ছিল গ্যাসভিত্তিক বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা। কিন্তু আমাদের সেই গ্যাসও ফুরিয়ে আসছে। ইতিমধ্যে সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্রে উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। গ্যাসভিত্তিক অনেক শিল্প-কারখানাই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। মাঝেমধ্যেই বন্ধ রাখতে হচ্ছে গ্যাসভিত্তিক সার কারখানা। বাড়িঘরে সংযোগ প্রদান বন্ধ রাখা হয়েছে। যাদের সংযোগ আছে, তারাও ঠিকমতো গ্যাস পাচ্ছে না। এ অবস্থায় গ্যাসভিত্তিক নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রও স্থাপন করা সম্ভব নয়।
১২ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির মতে, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে প্রধান ক্ষতিকর দিকগুলোর মধ্যে রয়েছে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও কয়লার ছাই নির্গত হওয়া এবং নদীর পানি দূষণ। এর ফলে সুন্দরবনের প্রাণী ও উদ্ভিদের ক্ষতি হতে পারে। যে প্রাথমিক পরিবেশ মূল্যায়ন রিপোর্টের ভিত্তিতে সরকার স্থান নির্বাচন করেছে, সেই রিপোর্টের যথার্থতা নিয়েও তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু তাঁদের বিবৃতিতে সুন্দরবনের প্রতি বাংলার মানুষের স্বাভাবিক আবেগের যে বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখতে পাই, সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে সুন্দরবনের জন্য এটি কতটা ক্ষতিকর হতে পারে- সে রকম কোনো ধারণা আমরা পাই না। আমাদের জানা মতে, সুন্দরবনের নিকটবর্তী এলাকায়, এমনকি বাফার জোনেও বহু ইটখোলা রয়েছে এবং এর প্রায় সবই কয়লা পোড়ায় এবং সেসব কয়লা অত্যন্ত নিম্নমানের, যেগুলোর দূষণমাত্রা অনেক বেশি। সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে মংলা বন্দরে আসা প্রতিটি জাহাজ ও ইঞ্জিনচালিত নৌকা প্রচুর কার্বন ডাই-অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইডসহ অনেক ক্ষতিকর গ্যাস নির্গমন করছে। সুন্দরবনের অভ্যন্তরে ক্রমেই মানুষের বসতি বাড়ছে, বিচরণও বাড়ছে। মাছধরা কিংবা হোগলাপাতা সংগ্রহকারী নৌকাগুলোর বেশির ভাগই এখন ইঞ্জিনচালিত এবং ডিজেল ব্যবহারকারী, যেগুলো থেকে প্রচুর হাইড্রোকার্বন নির্গত হচ্ছে এবং শুধু বাতাস নয়, পানিও দূষণ করছে। সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বিবিসিকে বলেছেন, পশুর নদীর ওপর যদি এটি অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে, তাহলে সুন্দরবনে পানির অভাব হতে পারে, যা বনের জন্য ক্ষতিকর হবে। আমরা জানি না, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে অতিরিক্ত পানি ব্যবহার করতে হয় কি না। ভৈরব নদের তীরে খুলনার গোয়ালমারা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি অনেক আগে থেকেই চলে আসছে। কিন্তু এর কারণে নদীর পানি কমে যাওয়ার কোনো তথ্য আজ পর্যন্ত আমরা পাইনি।
তাই বলে আমরা রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন সমর্থনও করছি না। যদি সম্ভব হয়, এটি আরো ২০ থেকে ২৫ কিলোমিটার ভাটিতে সরিয়ে নিলে আমাদের গর্বের সুন্দরবন নিয়ে যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, তা অনেকটাই কমে যাবে। বিষয়টি সরকারের গুরুত্ব দিয়ে ভাবা উচিত। আবার যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত না নিয়ে যেকোনো উদ্যোগের বিরোধিতায় নেমে পড়াটাকেও খুব ভালো মনে করতে পারছি না। দেশ এগিয়ে নিতে হলে, শিল্প-কারখানা বাড়াতে হলে, বেকারত্বের অবসান ঘটাতে হলে ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা আমাদের মেটাতেই হবে। কিন্তু যেখানে উদ্যোগ, সেখানেই বিরোধিতা হলে যেকোনো উদ্যোগই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যে ১২ জন বিশিষ্ট নাগরিক বিবৃতি দিয়েছেন, তাঁদের প্রতি যথেষ্ট পরিমাণে শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, তাঁরা কেউই সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞ নন। আমরা আশা করব, তড়িৎ কৌশল, পরিবেশ রসায়নবিদ কিংবা সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা এ ব্যাপারে তাঁদের মূল্যবান মতামত দেবেন। এ ব্যাপারে যে ধোঁয়াশা বিরাজ করছে, তা কাটাতে সহায়তা করবেন। সর্বোপরি এ উদ্যোগ যদি সুন্দরবনের জন্য ব্যাপক ক্ষতিকর হয়, তাহলে আমাদের আগেভাগেই সেখান থেকে সরে আসা উচিত হবে। অন্যথায় চরম বিদ্যুৎ সংকটের এই দেশে গৃহীত উদ্যোগ বাধাগ্রস্ত না করাটাই যৌক্তিক হবে।
আমাদের মনে আছে, কিছুদিন আগে কয়েকটি এনজিও জাহাজভাঙা শিল্পের বিরোধিতায় উঠেপড়ে লেগেছিল। আজকে জাহাজভাঙা শিল্প আমাদের অর্থনীতির একটি বড় খুঁটি। দেশের নির্মাণশিল্পে প্রতিবছর যে পরিমাণ রডের প্রয়োজন হয়, এই শিল্প না থাকলে তা আমাদের কয়েকগুণ দাম দিয়ে কিনতে হতো। অবকাঠামো উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়ত। আজকে শুধু জাহাজভাঙা নয়, জাহাজ নির্মাণ এবং তা রপ্তানি করে বাংলাদেশ বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। এই শিল্পে প্রচুর বেকার যুবকের কর্মসংস্থান হয়েছে। হ্যাঁ, আমরা যেটা দাবি করতে পারি, তা হচ্ছে, এই শিল্পের শ্রমিকদের যে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে, তা কমাতে হবে। এর ফলে যে পরিবেশদূষণ হচ্ছে, তা হ্রাস করার এবং বিকাশমান একটি শিল্পকে সহযোগিতা করার জন্য প্রয়োজনে রাষ্ট্রীয়ভাবে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে।
বাংলাদেশে পরিবেশের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হচ্ছে অতিরিক্ত ও অদক্ষ জনসংখ্যা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, কুসংস্কার ইত্যাদি। প্রতিবছর যে পরিমাণে বন ধ্বংস হচ্ছে, তা রোধ করা না গেলে ভবিষ্যতে এ দেশে বসবাস করাই কঠিন হয়ে পড়বে। গভীর ও ঘন বনের প্রাণী যেমন হারিয়ে যাচ্ছে, তার চেয়েও বেশি হারে কমছে লোকালয় সংশ্লিষ্ট বনের পশুপাখি। আর বন ধ্বংস হলে বা গাছপালা কমে গেলে স্বাভাবিকভাবেই বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের ঘনত্ব বাড়তে থাকে। এসব সমস্যার সমাধানে আমাদের পরিবেশবাদীদের অনেক বেশি সক্রিয় হতে হবে। দেশের শিল্পায়ন ও উন্নয়ন প্রচেষ্টার বিরোধিতাই পরিবেশবাদীদের একমাত্র কাজ হতে পারে না। আমরা তো মনে করি, ভারতের বিতর্কিত টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে যৌথ সমীক্ষার পর যদি দেখা যায়, বাংলাদেশের জন্য তা খুব বেশি ক্ষতিকর হবে না, তাহলে আমরা টিপাইমুখ জলবিদ্যুৎকেন্দ্রে অংশীদার হতে পারি। কিন্তু আগে যৌথ সমীক্ষা হতেই হবে এবং যথেষ্ট তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে আমাদের পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে হবে।
[লেখাটির ব্যাপারে কারো ভিন্নমত, প্রতিক্রিয়া কিংবা পরিপূরক কিছু বলার থাকলে তা কালের কণ্ঠের ঠিকানায় লিখে পাঠাতে পারেন। - বি. স.]
No comments