শিক্ষা অধিকার-দেশে দেশে শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ by জোবাইদা নাসরীন
যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও চিলি এখন আন্দোলনের দেশ—ভৌগোলিকতার ব্যবধান কমে এখন মতাদর্শিক লড়াইয়ে অবস্থান করছে এক জায়গায়। এ তিনটি ভূখণ্ডেই লড়ছেন হাজার হাজার শিক্ষার্থী। সবারই অভিন্ন আহ্বান—শিক্ষা সবার জন্য হোক, শুধু ধনীর জন্য নয়। শিক্ষা বাণিজ্যিকীকরণের বিরুদ্ধে তাঁদের এ লড়াই। রাজনৈতিক দুনিয়ার ভূগোল পরিবর্তন হচ্ছে রাতারাতিই।
এ বছরের মে মাসে ২০১১-১২ বাজেট অ্যাক্টের বিরুদ্ধে চিলির শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করেন। ৯ নভেম্বর চিলিয়ান পোর্ট অব ভ্যালপারাইসোতে হাজার হাজার শিক্ষার্থী একত্র হন। সেদিন শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিদল কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করতে যায়। সেদিন প্রায় ১৫ হাজার শিক্ষার্থীর আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার পাঁচ হাজার পুলিশ মোতায়েন করে। আন্দোলনরত ২০ জন শিক্ষার্থীকে পুলিশ আটক করে।
‘উই আর অকুপাই হার্ভার্ড। উই ওয়ান্ট এ ইউনিভার্সিটি ফর দ্য নাইনটি নাইন পারসেন্ট, নট এ করপোরেশন ফর দি ওয়ান পারসেন্ট’—এই স্লোগানকে সামনে রেখে শিক্ষার মানের দিক থেকে বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ের তালিকায় প্রথম স্থান পাওয়া হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সন্ধ্যা সাতটায় হার্ভার্ড ইয়ার্ডে শোভাযাত্রা বের করেন। যদিও ২ নভেম্বর অকল্যান্ডে গণবিস্ফোরণের পর হার্ভার্ডের ৭০ জন শিক্ষার্থী প্রচলিত অর্থশাস্ত্রের ব্যাখ্যা ও শিক্ষা মেনে না নেওয়া এবং সবার জন্য শিক্ষার দাবিতে বিশ্বখ্যাত অর্থনীতির অধ্যাপকদের ক্লাস বর্জনের মধ্য দিয়ে প্রতিবাদ শুরু করেন। ৯ নভেম্বরের শোভাযাত্রায় প্রতিবাদী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল পাঁচ শতাধিক। দ্রোহের আগুন ছড়াচ্ছে সব জায়গায়। একই দাবিতে এর আগেই গত সেপ্টেম্বর মাসেই উত্তাল হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলি ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা। এই অকুপাই এডুকেশনের দাবিতে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্তা ক্রুজ ক্যাম্পাসে ছোট্ট ছোট্ট স্কুলশিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রবীণেরাও নেমে এসেছেন। তাঁদের হাতে লিফলেট, ব্যানার—যাতে লেখা, ‘মানি ফর স্কুলস’, ‘উই ওয়ান্ট ইউনিভার্সিটি ফর দ্য নাইনটি পার্সেন্ট’।
ঠিক একই দিন একই দাবিতেই লল্ডনেও তৈরি হয় সাড়াজাগানো ছাত্রবিক্ষোভ। ইংল্যান্ডের টিভি চ্যানেল, পত্রিকা এবং বাসের আলাপচারিতায়ও স্থান পাচ্ছে একই বিষয়। শুধু শিক্ষার্থীরা নন, অভিভাবকেরাও যাঁর যাঁর অবস্থান থেকে কথা বলছেন। দূরে অবস্থানের কারণে যাঁরা আন্দোলনে যোগ দিতে পারছেন না, তাঁরাও সংহতি প্রকাশ করছেন। যদিও লন্ডনের বাইরে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু শিক্ষার্থী এই বিক্ষোভ সমাবেশে যোগ দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিভিন্ন শ্রেণীকক্ষে পাঠদানের সময় অপেক্ষাকৃত কম বয়সী শিক্ষকেরাও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনায় নিয়ে আসছেন বিষয়টিকে। গত ৯ নভেম্বর মধ্য লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারে যে ছাত্র আন্দোলন হয়, তা অনেকের মধ্যেই বোধের এক নতুন মাত্রা তৈরি করে। টেলিভিশনে সেদিনের আন্দোলনের চিত্র না দেখলে, লন্ডনের পাশের অঞ্চলগুলো থেকে সেই আন্দোলনের তীব্রতা বোঝা কঠিন ছিল। ছোট ছোট বাচ্চাদের হাতে প্ল্যাকার্ড, পোস্টার। তারা সেগুলো নিয়েই নির্ভয়ে ঘুরছে। এ মাসের প্রথম থেকেই দফায় দফায় বিভিন্নভাবে আন্দোলন সংগঠিত হচ্ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাজেট কমানো অর্থাৎ শিক্ষা খাতে বাজেট কমে যাওয়াই এই প্রতিবাদের সূচনা করে। গত বছরের ঠিক এ সময়ই লন্ডনেই শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছিলেন টিউশন ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদে। গত জুনে সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষা খাতে বেসরকারি উদ্যোক্তার আহ্বান, বিশ্ববিদ্যালয়ে বাজেট কমানো এবং ফি বৃদ্ধির ঘোষণা দেওয়া হয়।
শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের বিরুদ্ধে তাঁরা ‘ন্যাশনাল ক্যাম্পেইন অ্যাগেনস্ট ফিস অ্যান্ড কাট’ ব্যানারে যে মোর্চা তৈরি হয়, এর প্রথম উদ্যোগ নেয় অ্যাবেরিস্টুয়াথ বিশ্ববিদ্যালয়। এই মোর্চা তৈরির প্রাক্কালে শিক্ষার্থীরা প্রথমেই বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিজ্ঞানবিষয়ক মন্ত্রী ডেভিড উইলেটসের প্রতি তাঁদের অনাস্থা ঘোষণা করেন। এ বিষয়ে তাঁদের স্মারকলিপিতে স্পষ্টই লেখা ছিল, ‘ইউ আর রং অন টিউশন ফিস, ইউ আর রং অন ফান্ডিং ফিস, ইউ আর রং অন মার্জারস’।
সেই মোর্চারই সফল আয়োজন ছিল ৯ নভেম্বরের বিক্ষোভ। সরকারি সূত্র জানিয়েছে, মিছিলে প্রায় দুই হাজার ৫০০ থেকে তিন হাজার শিক্ষার্থী ছিলেন। কিন্তু আন্দোলনকারীদের দাবি, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল প্রায় ১০ হাজার। সকাল থেকেই ছোটখাটো জমায়েত দুপুর নাগাদ বিক্ষোভে পরিণত হয়। লক্ষ্য ছিল, সেই বিক্ষোভ ওয়াল স্ট্রিটে গিয়ে শেষ হবে। কিন্তু পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের দীর্ঘ তর্কাতর্কি এবং ২৪ জন শিক্ষার্থীর গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে সেটি ট্রাফালগার স্কয়ারেই শেষ হয়। সরকার এই আন্দোলন ঠেকাতে চার শতাধিক পুলিশ মোতায়েন করেছিল। তবে বিক্ষোভকারীরা জোর কণ্ঠে ঘোষণা দিয়েছেন, তাঁরা টিউশন ফি কমাতে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট কাটছাঁট করা থেকে সরকারকে বিরত থাকতে বাধ্য করবে এবং তাঁদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। শিক্ষার্থীরা আরও জানিয়েছেন, তাঁরা আগামী ৩০ নভেম্বর একই দাবিতে ট্রেড ইউনিয়ন এবং স্থানীয় বাজেট কর্তনবিরোধী গ্রুপগুলোর ডাকা বিক্ষোভে একাত্মতা ঘোষণা করবে। এ আন্দোলনের পাশাপাশি ‘ন্যাশনাল ক্যাম্পেইন অ্যাগেনস্ট ফিস অ্যান্ড কাট’-এর নারী শাখা ২৫ নভেম্বর নারীর বিরুদ্ধে সব ধরনের সহিংসতা বিলোপ দিবসে ‘নো টু ফিস, নো টু প্রাইভেটাইজেশন অব এডুকেশন, নো টু সেক্সইজম টু এডুকেশন’—এ দাবিতে সবাইকে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে নামার জন্য অনুরোধ করেছে। তারা বলেছে, সরকারের এই বাজেট কাটছাঁটের সিদ্ধান্ত নারী স্বাধীনতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এই নীতির কারণে একক অভিভাবক যেসব নারী আছেন, তাঁরা তাঁদের মোট আয়ের ১৮ শতাংশ হারাবেন। নার্সারি ও নার্সিং হোম প্রভিশনে কাটছাঁট হওয়ায় পরিবারের বৃদ্ধ সদস্যদের দায়দায়িত্ব নারীদের ওপরই বর্তাবে। এই কর্তনপ্রক্রিয়ায় পড়েছে হিউম্যানিজ টিচিং, যা মূলত নারীরাই পড়াত। এটি ১০০ শতাংশই বাদ হয়েছে।
একই বিষয় নিয়ে বিভিন্ন দেশজুড়ে এত বড় ছাত্রবিক্ষোভ আর কখনো হয়েছে কি না জানি না; তবে আদর্শিক বিশ্বের ধারণা পাল্টে যাচ্ছে তাড়াতাড়ি—এটা বোঝা যাচ্ছে। সারা বিশ্বেই মানুষ সমতার জন্য লড়ছে। বিশ্বজুড়ে অকুপাই এডুকেশন আন্দোলন আমাদের সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে। চিলি, আমেরিকা ও ইংল্যান্ডজুড়ে এই আন্দোলনের ইঙ্গিত দুনিয়া দখল করা পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে এক বড়সড় প্রতিবাদী নড়াচড়া। তবে কি এই শিক্ষার্থীরাই রচনা করতে যাচ্ছেন দুনিয়া পাল্টানোর নতুন ইতিহাস?
জোবাইদা নাসরীন: সহকারী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পিএইচডি গবেষক, ডারহাম ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাজ্য।
zoaidanasreen@gmail.com
No comments