ঢাকা সিটি করপোরেশন-দ্বিখণ্ডিত ঢাকা, একটি অনভিপ্রেত সিদ্ধান্ত by আবদুল মান্নান
ঐতিহাসিক রাজধানী ঢাকা নাকি দুই ভাগ হবে। দুই ভাগ মানে এই রাজধানীকে দুটি সিটি করপোরেশনের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হবে। মন্ত্রিপরিষদের সভায় এমন সিদ্ধান্ত হয়েছে। এখন আইন পাস করা বাকি। সত্যি সত্যি তা যদি হয়, তা হবে এক অভূতপূর্ব তাজ্জব ব্যাপার! কারণ কোনো একটি রাজধানী কেন, কোনো বড় শহরকেও এযাবৎ দুই ফালি করতে তেমন একটা দেখা যায়নি, বরং প্রশাসনের সুবিধার্থে দুটি আলাদা শহরকে একসঙ্গে করার নজির আছে।
চোখের সামনে উদাহরণ, দক্ষিণ ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের রাজধানী হায়দরাবাদ আর সেকান্দরাবাদ। ভারত যখন স্বাধীন হয়, তখন দিল্লি বলতে আজকের পুরোনো দিল্লিই বোঝাত; যদিও নতুন দিল্লির গোড়াপত্তন হয় ১৯১১ সালে। ১৯৩১ সালে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী হিসেবে এর উদ্বোধন হয়। নতুন দিল্লিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ভারতের কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক অবকাঠামো। সঙ্গে এসেছে আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা। সব মিলিয়ে ভারতের রাজধানী দিল্লি। তামাম দিল্লির জনসংখ্যা এক কোটি ৯০ লাখ। দিল্লি শাসন করার জন্য কোনো সিটি করপোরেশন নেই; আছে একটি মিনি সরকার, যার নাম সিটি গভর্নমেন্ট। বর্তমানে এর মুখ্যমন্ত্রী শিলা দীক্ষিত।
ফিরে আসি আমাদের প্রিয় রাজধানী ৪০০ বছরের পুরোনো (রাজধানী হিসেবে) এই ঢাকা শহরে। এই শহরে প্রথম পা রেখেছিলাম ১৯৫৬ সালের ২২ মার্চ। পরদিন পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবস। সে কারণেই তারিখটা ৫৫ বছর পরেও মনে আছে। চট্টগ্রাম থেকে বাবার সঙ্গে দুপুরের গ্রিন অ্যারো ট্রেনযোগে রাত আটটা নাগাদ যখন ঢাকার ফুলবাড়িয়া স্টেশনে পৌঁছি, তখন সে কী এক রোমাঞ্চ! তা এখন বোঝানো যাবে না।
ঢাকা তখন প্রাদেশিক রাজধানী। ১৫ বছরের ব্যবধানে ১৯৭১ সালে প্রাদেশিক রাজধানী থেকে একেবারে একটি স্বাধীন দেশের রাজধানী। অনেকটা এক লাফে পঞ্চম শ্রেণী থেকে দশম ক্লাসে প্রমোশন আর কি। চাপটা অবশ্যই একটু বেশি। সইতে পারল না আমাদের প্রিয় রাজধানী। জাপানে স্কুলের শিশুরা পড়ালেখার চাপ সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করে। ঢাকার মতো একটি শহর তো আর আত্মহত্যা করতে পারে না। তবে সবাই মিলে তাকে হত্যা করতে পারে। রাজধানী ঢাকার ক্ষেত্রেও অনেকটা তা-ই হয়েছে। সরকারি, বেসরকারি এবং ব্যক্তির সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মোটামুটি আমাদের এই রাজধানী ঢাকাকে পুরোপুরি হত্যা করতে না পারলেও তাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে পাঠাতে সক্ষম হয়েছি।
সরকারকে কারা যেন বুদ্ধি দিয়েছে, শহরটাকে দুই ভাগ করলে এটিকে এখনো নাকি বাঁচানো যাবে। একটি কথা না বললেই নয়, যদিও আমি নিশ্চিত, তা শুনলে অনেকে আমার ওপর বেজায় অখুশি হবেন। এই সরকারকে সলাপরামর্শ দেওয়ার জন্য বেশ কজন জাঁদরেল বেতনভুক পরামর্শদাতা আছেন, তবে তাঁদের কারও কারও কাণ্ডকারখানা দেখলে মনে হয়, তাঁদের অনেক কর্মকাণ্ডই শুধু সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য। শুধু তাঁরা যে সরকারকে বেকায়দায় ফেলেন, তা তো নয়, সঙ্গে এই সরকারের যাঁরা শুভাকাঙ্ক্ষী, তাঁদেরও বেকায়দায় ফেলেন। এই শুভাকাঙ্ক্ষীদের মধ্যে আছেন একেবারেই সাধারণ মানুষ, যাঁরা মনে করেন আওয়ামী লীগ সরকারের নানা দোষত্রুটি থাকলেও তাদের বিকল্প তো অন্য কোনো দল বা জোট হতে পারে না। আরেকদল আছেন যাঁরা সরকার এবং আওয়ামী লীগের গঠনমূলক সমালোচনা করেন, নানা পরামর্শ দেন এবং প্রত্যাশা করেন, সময় থাকতে সরকার তাদের ভুল-ত্রুটিগুলো শুধরে নেবে এবং তাদের চলার পথটা নিষ্কণ্টক করবে। এই শেষের দলে আছেন নারায়ণগঞ্জের স্বনামখ্যাত শামীম ওসমানের ভাষায় কবরে দুই পা দেওয়া লোকজন এবং মেনন-সেননরা আর কিছু বামপন্থী। তবে একটা কথা না বললেই নয়, যাঁরাই সরকারকে বাইরে থেকে পরামর্শ দেন, তাঁদের বেশির ভাগই নিঃস্বার্থভাবেই দেন। তবে সরকার এসব পরামর্শ সব সময় যে ভালোভাবে নেয়, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। ইদানীং নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের কথা উঠলেই অবধারিতভাবে বিগত সময়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরাজিত মেয়র পদপ্রার্থী এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর কথা এসে যায়। মহিউদ্দিন চৌধুরীর শোচনীয় পরাজয়ের পেছনে তাঁর নিজস্ব অবদান না যতটুকু, এর চেয়ে বেশি অবদান তাঁকে ঘিরে থাকা তাঁর স্তাবকেরা। এ স্তাবকদের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা ছিল, কে কত বড় চাটুকার হতে পারে। এখন কিন্তু তাঁর ধারে-কাছে তাদের অধিকাংশই নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কে অনেকের ধারণা, তাঁর চার পাশের একটা অদৃশ্য বলয় তাঁকে অনেকটা জনবিচ্ছিন্ন করে ফেলতে সক্ষম হয়েছে এবং মাঠের বাস্তব পরিস্থিতিটা বুঝতে দিচ্ছে না।
ফিরে আসি রাজধানী ঢাকাকে দুই ভাগ করার বিষয় প্রসঙ্গে। বলা হচ্ছে, বর্তমান ঢাকার পরিধি এবং জনসংখ্যার চাপ অত্যধিক বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ ঢাকা সিটি করপোরেশনের একার পক্ষে রাজধানীর সব নাগরিককে তাদের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। দুই ভাগ করলে তা সম্ভব হবে। এ ধারণা বলতে গেল কল্পনাপ্রসূত। কলকাতা, মুম্বাই, ব্যাংকক, টোকিও, লন্ডন, নিউইয়র্ক, প্যারিস, করাচি ইত্যাদি শহর ঢাকা থেকে অনেক বড় ও প্রাচীন। দিল্লির কথা আগেই বলেছি। এর কোনো একটি শহরকেও কেউ কখনো দুই ভাগ করার কথা চিন্তা করেনি। তারা চেষ্টা করেছে, কীভাবে একটি বড় শহরের জন্য আরও দক্ষ প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলা যায়। একটি আধুনিক নগরে নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বলতে বোঝায় সহনীয় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, পর্যাপ্ত পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস সরবরাহব্যবস্থার নিশ্চিতকরণ। শহরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন তো রাখতেই হবে। রাজধানী হলে তো কথাই নেই। যানজটমুক্ত সড়ক একেবারেই অপরিহার্য। পয়োনিষ্কাশন-ব্যবস্থা অপ্রতুল হলে সেই শহর আর বসবাসের উপযোগী থাকে না। চাই নাগরিকদের জন্য খোলা জায়গা আর বিনোদনের ব্যবস্থা। ভালো মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তো অবশ্যই থাকতে হবে। উন্নত স্বাস্থ্যব্যবস্থা ছাড়া দেশের রাজধানী থাক, কোনো আধুনিক শহরও চিন্তা করা যায় না।
এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী যখন স্তাবক বা চাটুকার পরিবেষ্টিত হননি, তখন তিনি অনেক মননশীল ও আধুনিক চিন্তা করতে পারতেন। চট্টগ্রাম ঢাকার তুলনায় অনেক ছোট শহর, তবে এর অর্থনৈতিক দিক বিবেচনা করে এই প্রাচীন বন্দর নগরের গুরুত্ব ঢাকার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। মহিউদ্দিন চৌধুরী প্রথমবার মেয়র নির্বাচিত হন ১৯৯৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। তখন খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনকাল। প্রায় ১৬ হাজার ভোটে পরাজিত করেছিলেন খালেদা জিয়ার কৃপাধন্য তাঁর মনোনীত মেয়র পদপ্রার্থী মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিনকে। নির্বাচনে জিতেই মহিউদ্দিন চৌধুরী দাবি উত্থাপন করেছিলেন, চট্টগ্রামের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ নগরকে দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করতে হলে প্রচলিত সিটি করপোরেশনের পরিবর্তে একটি নগর সরকার বা সিটি গভর্নমেন্ট গঠন করতে হবে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের কথা বাদই দিলাম, এই উপমহাদেশের দিল্লি-করাচিতেই এমন সরকার আছে। সেই সরকারের যিনি প্রধান, কোথাও তিনি মুখ্যমন্ত্রী আবার কোথাও গভর্নর বা মেয়র বা সিটি মেয়র। তাঁর মন্ত্রিসভায় যাঁরা থাকেন, তাঁরা নির্বাচিতও হতে পারেন অথবা হতে পারেন কোনো বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের মনোনীত ব্যক্তি। দেশের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মতো সেই সরকারের যারা ‘মন্ত্রী’ থাকেন, তাঁদের প্রধান দায়িত্ব থাকে নাগরিক পরিষেবাগুলোর পর্যাপ্ত জোগান দেওয়া। অনেক শহরে পুলিশ প্রশাসন এবং ওই এলাকার সেনাবাহিনী এই নগর সরকারের অধীনে থাকে (নিউইয়র্ক)। কোনো কোনো শহরে নগর সরকারের অধীনে কেন্দ্রীয় সরকার মনোনীত একজন গভর্নর থাকেন (দিল্লির লে. গভর্নর)। তিনি অনেকটা মুরব্বির মতো কাজ করেন। কাজের সুবিধার্থে একটি নগর সরকার ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের অংশ হিসেবে নগরে একাধিক মিউনিসিপ্যালিটি গঠন করতে পারেন। তবে এর সবাইকে জবাবদিহি করতে হবে নগর সরকারের কাছে। মহিউদ্দিন চৌধুরীর এমন একটা সৃজনশীল ধারণার জোরালো সমর্থন দিয়েছিলেন সেই সময়ের ঢাকার মেয়র মোহাম্মদ হানিফ। দুজন মিলে অনেক চেষ্টা-তদবির করেও তাঁদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের তেমন কিছু করতে পারেননি। কারণ তা করতে গেলে অনেকের স্বার্থের ক্ষতি হবে।
১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর শেখ হাসিনা সরকার গঠন করলে মনে করা হয়েছিল, মহিউদ্দিন চৌধুরীর এই বাস্তবসম্মত প্রস্তাবটির একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান হবে। প্রথম দিকে একটি সিদ্ধান্ত হয়েছিল, যেহেতু প্রস্তাবটির বাস্তবায়ন একটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, তাই একটি নিয়মিত বিরতি দিয়ে নগরের বিভিন্ন সেবাদানকারী সংস্থাগুলোকে নিয়ে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী বিভিন্ন সিটি করপোরেশনে সমন্বয় সভা করবেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে মেয়র এই সভায় সভাপতিত্ব করবেন। ওই সময়ের স্থানীয় সরকারমন্ত্রী, বর্তমানে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সভাপতিত্বে এ রকম দু-একটি সভা হলেও নগরের মেয়রের সভাপতিত্বে সভা ডাকা হলে তাতে বিভিন্ন সেবাদানকারী সংস্থার প্রধানেরা না এসে তাঁদের নিম্ন স্তরের কোনো একজন কর্মকর্তাকে পাঠিয়ে দিতেন। শেষতক এসব সভা সময় নষ্ট ছাড়া নগরকে আর কিছুই উপহার দিতে পারেনি। ২০০৫ সালের চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রাক্কালে মেয়র পদপ্রার্থী মহিউদ্দিন চৌধুরী আবার তাঁর স্বপ্ন নগর সরকার বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেন, কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি।
ঢাকা সিটি করপোরেশনের বর্তমান মেয়র সাদেক হোসেন খোকা নির্বাচিত হয়েছেন প্রায় সাড়ে আট বছর আগে। নির্বাচন কমিশন একাধিকবার উদ্যোগ নিয়েছে এই নির্বাচন করার। সরকারের সবুজ সংকেত না পাওয়ায় তা সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে এল রাজধানীকে দ্বিখণ্ডিত করার অভিনব সিদ্ধান্ত। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচন দিলে অখণ্ড ঢাকা সিটি করপোরেশন মেয়র পদে সরকারি দলের প্রার্থী জয়ী না-ও হতে পারেন। তা যদি সত্যি হয়, তাহলে দ্বিখণ্ডিত করলেও সরকারি দলের প্রার্থী বিজয়ী হবেন, এর নিশ্চয়তা কী? অখণ্ড সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জয়ী হওয়ার মতো সরকারি দলে বেশ কিছু যোগ্য প্রার্থী ছিলেন। তাঁরা এখন সংসদ সদস্য। আর যাঁরা মনে করছেন তাঁরা সরকারি দলের আশীর্বাদ নিয়ে নির্বাচন করবেন, তাঁদের অবস্থাও যে মহিউদ্দিন চৌধুরী বা শামীম ওসমানের মতো হবে না, এর কি কোনো নিশ্চয়তা আছে?
একটা কথা আগেও বলেছি, আবারও বলি, একেবারে দলীয় সমর্থকদের ভোট দিয়ে কোনো প্রার্থীর পক্ষে কোনো নির্বাচনে জয়ী হওয়ার দিন শেষ। এখন একটি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ভোটার দলনিরপেক্ষ এবং আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে তারা অনেক বেশি সচেতন। সেটি চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রমাণিত সত্য। বর্তমান সরকারের একটা কৌশলগত ভুল ছিল, সময়মতো ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন না দেওয়া। সেই ভুল শুধরানোর পন্থা করপোরেশনকে দ্বিখণ্ডিত করে নয়; তা করতে হলে সব সেবাদানকারী সংস্থা যেমন—ওয়াসা, ডেসকো, রাজউক, তিতাস গ্যাস ইত্যাদিকেও ভাগ করতে হবে, যা বাস্তবসম্মত নয়। পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার একাধিক পন্থার মধ্যে হতে পারে, রাজধানী ঢাকাকে একটি নগর সরকারের অধীনে এনে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া। আমার এই পরামর্শ সরকার গ্রহণ করবে, তা তেমন মনে করি না। কারণ, সরকারকে পরামর্শ দেওয়ার বাঘা বাঘা পরামর্শদাতা আছেন। বিনা খরচায় পরামর্শ সবাই ভালোভাবে নেয় না। তার পরও একজন সাধারণ নাগরিক এবং বর্তমান সরকারের একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে এই সামান্য পরামর্শটুকু না দিলে নিজেকে অপরাধী মনে হতো, তাই দেওয়া।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
ফিরে আসি আমাদের প্রিয় রাজধানী ৪০০ বছরের পুরোনো (রাজধানী হিসেবে) এই ঢাকা শহরে। এই শহরে প্রথম পা রেখেছিলাম ১৯৫৬ সালের ২২ মার্চ। পরদিন পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবস। সে কারণেই তারিখটা ৫৫ বছর পরেও মনে আছে। চট্টগ্রাম থেকে বাবার সঙ্গে দুপুরের গ্রিন অ্যারো ট্রেনযোগে রাত আটটা নাগাদ যখন ঢাকার ফুলবাড়িয়া স্টেশনে পৌঁছি, তখন সে কী এক রোমাঞ্চ! তা এখন বোঝানো যাবে না।
ঢাকা তখন প্রাদেশিক রাজধানী। ১৫ বছরের ব্যবধানে ১৯৭১ সালে প্রাদেশিক রাজধানী থেকে একেবারে একটি স্বাধীন দেশের রাজধানী। অনেকটা এক লাফে পঞ্চম শ্রেণী থেকে দশম ক্লাসে প্রমোশন আর কি। চাপটা অবশ্যই একটু বেশি। সইতে পারল না আমাদের প্রিয় রাজধানী। জাপানে স্কুলের শিশুরা পড়ালেখার চাপ সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করে। ঢাকার মতো একটি শহর তো আর আত্মহত্যা করতে পারে না। তবে সবাই মিলে তাকে হত্যা করতে পারে। রাজধানী ঢাকার ক্ষেত্রেও অনেকটা তা-ই হয়েছে। সরকারি, বেসরকারি এবং ব্যক্তির সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মোটামুটি আমাদের এই রাজধানী ঢাকাকে পুরোপুরি হত্যা করতে না পারলেও তাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে পাঠাতে সক্ষম হয়েছি।
সরকারকে কারা যেন বুদ্ধি দিয়েছে, শহরটাকে দুই ভাগ করলে এটিকে এখনো নাকি বাঁচানো যাবে। একটি কথা না বললেই নয়, যদিও আমি নিশ্চিত, তা শুনলে অনেকে আমার ওপর বেজায় অখুশি হবেন। এই সরকারকে সলাপরামর্শ দেওয়ার জন্য বেশ কজন জাঁদরেল বেতনভুক পরামর্শদাতা আছেন, তবে তাঁদের কারও কারও কাণ্ডকারখানা দেখলে মনে হয়, তাঁদের অনেক কর্মকাণ্ডই শুধু সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য। শুধু তাঁরা যে সরকারকে বেকায়দায় ফেলেন, তা তো নয়, সঙ্গে এই সরকারের যাঁরা শুভাকাঙ্ক্ষী, তাঁদেরও বেকায়দায় ফেলেন। এই শুভাকাঙ্ক্ষীদের মধ্যে আছেন একেবারেই সাধারণ মানুষ, যাঁরা মনে করেন আওয়ামী লীগ সরকারের নানা দোষত্রুটি থাকলেও তাদের বিকল্প তো অন্য কোনো দল বা জোট হতে পারে না। আরেকদল আছেন যাঁরা সরকার এবং আওয়ামী লীগের গঠনমূলক সমালোচনা করেন, নানা পরামর্শ দেন এবং প্রত্যাশা করেন, সময় থাকতে সরকার তাদের ভুল-ত্রুটিগুলো শুধরে নেবে এবং তাদের চলার পথটা নিষ্কণ্টক করবে। এই শেষের দলে আছেন নারায়ণগঞ্জের স্বনামখ্যাত শামীম ওসমানের ভাষায় কবরে দুই পা দেওয়া লোকজন এবং মেনন-সেননরা আর কিছু বামপন্থী। তবে একটা কথা না বললেই নয়, যাঁরাই সরকারকে বাইরে থেকে পরামর্শ দেন, তাঁদের বেশির ভাগই নিঃস্বার্থভাবেই দেন। তবে সরকার এসব পরামর্শ সব সময় যে ভালোভাবে নেয়, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। ইদানীং নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের কথা উঠলেই অবধারিতভাবে বিগত সময়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরাজিত মেয়র পদপ্রার্থী এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর কথা এসে যায়। মহিউদ্দিন চৌধুরীর শোচনীয় পরাজয়ের পেছনে তাঁর নিজস্ব অবদান না যতটুকু, এর চেয়ে বেশি অবদান তাঁকে ঘিরে থাকা তাঁর স্তাবকেরা। এ স্তাবকদের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা ছিল, কে কত বড় চাটুকার হতে পারে। এখন কিন্তু তাঁর ধারে-কাছে তাদের অধিকাংশই নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কে অনেকের ধারণা, তাঁর চার পাশের একটা অদৃশ্য বলয় তাঁকে অনেকটা জনবিচ্ছিন্ন করে ফেলতে সক্ষম হয়েছে এবং মাঠের বাস্তব পরিস্থিতিটা বুঝতে দিচ্ছে না।
ফিরে আসি রাজধানী ঢাকাকে দুই ভাগ করার বিষয় প্রসঙ্গে। বলা হচ্ছে, বর্তমান ঢাকার পরিধি এবং জনসংখ্যার চাপ অত্যধিক বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ ঢাকা সিটি করপোরেশনের একার পক্ষে রাজধানীর সব নাগরিককে তাদের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। দুই ভাগ করলে তা সম্ভব হবে। এ ধারণা বলতে গেল কল্পনাপ্রসূত। কলকাতা, মুম্বাই, ব্যাংকক, টোকিও, লন্ডন, নিউইয়র্ক, প্যারিস, করাচি ইত্যাদি শহর ঢাকা থেকে অনেক বড় ও প্রাচীন। দিল্লির কথা আগেই বলেছি। এর কোনো একটি শহরকেও কেউ কখনো দুই ভাগ করার কথা চিন্তা করেনি। তারা চেষ্টা করেছে, কীভাবে একটি বড় শহরের জন্য আরও দক্ষ প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলা যায়। একটি আধুনিক নগরে নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বলতে বোঝায় সহনীয় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, পর্যাপ্ত পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস সরবরাহব্যবস্থার নিশ্চিতকরণ। শহরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন তো রাখতেই হবে। রাজধানী হলে তো কথাই নেই। যানজটমুক্ত সড়ক একেবারেই অপরিহার্য। পয়োনিষ্কাশন-ব্যবস্থা অপ্রতুল হলে সেই শহর আর বসবাসের উপযোগী থাকে না। চাই নাগরিকদের জন্য খোলা জায়গা আর বিনোদনের ব্যবস্থা। ভালো মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তো অবশ্যই থাকতে হবে। উন্নত স্বাস্থ্যব্যবস্থা ছাড়া দেশের রাজধানী থাক, কোনো আধুনিক শহরও চিন্তা করা যায় না।
এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী যখন স্তাবক বা চাটুকার পরিবেষ্টিত হননি, তখন তিনি অনেক মননশীল ও আধুনিক চিন্তা করতে পারতেন। চট্টগ্রাম ঢাকার তুলনায় অনেক ছোট শহর, তবে এর অর্থনৈতিক দিক বিবেচনা করে এই প্রাচীন বন্দর নগরের গুরুত্ব ঢাকার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। মহিউদ্দিন চৌধুরী প্রথমবার মেয়র নির্বাচিত হন ১৯৯৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। তখন খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনকাল। প্রায় ১৬ হাজার ভোটে পরাজিত করেছিলেন খালেদা জিয়ার কৃপাধন্য তাঁর মনোনীত মেয়র পদপ্রার্থী মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিনকে। নির্বাচনে জিতেই মহিউদ্দিন চৌধুরী দাবি উত্থাপন করেছিলেন, চট্টগ্রামের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ নগরকে দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করতে হলে প্রচলিত সিটি করপোরেশনের পরিবর্তে একটি নগর সরকার বা সিটি গভর্নমেন্ট গঠন করতে হবে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের কথা বাদই দিলাম, এই উপমহাদেশের দিল্লি-করাচিতেই এমন সরকার আছে। সেই সরকারের যিনি প্রধান, কোথাও তিনি মুখ্যমন্ত্রী আবার কোথাও গভর্নর বা মেয়র বা সিটি মেয়র। তাঁর মন্ত্রিসভায় যাঁরা থাকেন, তাঁরা নির্বাচিতও হতে পারেন অথবা হতে পারেন কোনো বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের মনোনীত ব্যক্তি। দেশের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মতো সেই সরকারের যারা ‘মন্ত্রী’ থাকেন, তাঁদের প্রধান দায়িত্ব থাকে নাগরিক পরিষেবাগুলোর পর্যাপ্ত জোগান দেওয়া। অনেক শহরে পুলিশ প্রশাসন এবং ওই এলাকার সেনাবাহিনী এই নগর সরকারের অধীনে থাকে (নিউইয়র্ক)। কোনো কোনো শহরে নগর সরকারের অধীনে কেন্দ্রীয় সরকার মনোনীত একজন গভর্নর থাকেন (দিল্লির লে. গভর্নর)। তিনি অনেকটা মুরব্বির মতো কাজ করেন। কাজের সুবিধার্থে একটি নগর সরকার ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের অংশ হিসেবে নগরে একাধিক মিউনিসিপ্যালিটি গঠন করতে পারেন। তবে এর সবাইকে জবাবদিহি করতে হবে নগর সরকারের কাছে। মহিউদ্দিন চৌধুরীর এমন একটা সৃজনশীল ধারণার জোরালো সমর্থন দিয়েছিলেন সেই সময়ের ঢাকার মেয়র মোহাম্মদ হানিফ। দুজন মিলে অনেক চেষ্টা-তদবির করেও তাঁদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের তেমন কিছু করতে পারেননি। কারণ তা করতে গেলে অনেকের স্বার্থের ক্ষতি হবে।
১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর শেখ হাসিনা সরকার গঠন করলে মনে করা হয়েছিল, মহিউদ্দিন চৌধুরীর এই বাস্তবসম্মত প্রস্তাবটির একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান হবে। প্রথম দিকে একটি সিদ্ধান্ত হয়েছিল, যেহেতু প্রস্তাবটির বাস্তবায়ন একটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, তাই একটি নিয়মিত বিরতি দিয়ে নগরের বিভিন্ন সেবাদানকারী সংস্থাগুলোকে নিয়ে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী বিভিন্ন সিটি করপোরেশনে সমন্বয় সভা করবেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে মেয়র এই সভায় সভাপতিত্ব করবেন। ওই সময়ের স্থানীয় সরকারমন্ত্রী, বর্তমানে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সভাপতিত্বে এ রকম দু-একটি সভা হলেও নগরের মেয়রের সভাপতিত্বে সভা ডাকা হলে তাতে বিভিন্ন সেবাদানকারী সংস্থার প্রধানেরা না এসে তাঁদের নিম্ন স্তরের কোনো একজন কর্মকর্তাকে পাঠিয়ে দিতেন। শেষতক এসব সভা সময় নষ্ট ছাড়া নগরকে আর কিছুই উপহার দিতে পারেনি। ২০০৫ সালের চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রাক্কালে মেয়র পদপ্রার্থী মহিউদ্দিন চৌধুরী আবার তাঁর স্বপ্ন নগর সরকার বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেন, কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি।
ঢাকা সিটি করপোরেশনের বর্তমান মেয়র সাদেক হোসেন খোকা নির্বাচিত হয়েছেন প্রায় সাড়ে আট বছর আগে। নির্বাচন কমিশন একাধিকবার উদ্যোগ নিয়েছে এই নির্বাচন করার। সরকারের সবুজ সংকেত না পাওয়ায় তা সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে এল রাজধানীকে দ্বিখণ্ডিত করার অভিনব সিদ্ধান্ত। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচন দিলে অখণ্ড ঢাকা সিটি করপোরেশন মেয়র পদে সরকারি দলের প্রার্থী জয়ী না-ও হতে পারেন। তা যদি সত্যি হয়, তাহলে দ্বিখণ্ডিত করলেও সরকারি দলের প্রার্থী বিজয়ী হবেন, এর নিশ্চয়তা কী? অখণ্ড সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জয়ী হওয়ার মতো সরকারি দলে বেশ কিছু যোগ্য প্রার্থী ছিলেন। তাঁরা এখন সংসদ সদস্য। আর যাঁরা মনে করছেন তাঁরা সরকারি দলের আশীর্বাদ নিয়ে নির্বাচন করবেন, তাঁদের অবস্থাও যে মহিউদ্দিন চৌধুরী বা শামীম ওসমানের মতো হবে না, এর কি কোনো নিশ্চয়তা আছে?
একটা কথা আগেও বলেছি, আবারও বলি, একেবারে দলীয় সমর্থকদের ভোট দিয়ে কোনো প্রার্থীর পক্ষে কোনো নির্বাচনে জয়ী হওয়ার দিন শেষ। এখন একটি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ভোটার দলনিরপেক্ষ এবং আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে তারা অনেক বেশি সচেতন। সেটি চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রমাণিত সত্য। বর্তমান সরকারের একটা কৌশলগত ভুল ছিল, সময়মতো ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন না দেওয়া। সেই ভুল শুধরানোর পন্থা করপোরেশনকে দ্বিখণ্ডিত করে নয়; তা করতে হলে সব সেবাদানকারী সংস্থা যেমন—ওয়াসা, ডেসকো, রাজউক, তিতাস গ্যাস ইত্যাদিকেও ভাগ করতে হবে, যা বাস্তবসম্মত নয়। পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার একাধিক পন্থার মধ্যে হতে পারে, রাজধানী ঢাকাকে একটি নগর সরকারের অধীনে এনে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া। আমার এই পরামর্শ সরকার গ্রহণ করবে, তা তেমন মনে করি না। কারণ, সরকারকে পরামর্শ দেওয়ার বাঘা বাঘা পরামর্শদাতা আছেন। বিনা খরচায় পরামর্শ সবাই ভালোভাবে নেয় না। তার পরও একজন সাধারণ নাগরিক এবং বর্তমান সরকারের একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে এই সামান্য পরামর্শটুকু না দিলে নিজেকে অপরাধী মনে হতো, তাই দেওয়া।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments