শিক্ষার সর্বস্তরে ফোকলোর চর্চা by আবদুল ওয়াহাব
ফোকলোর হচ্ছে কোনো ভৌগোলিক পরিমণ্ডলের মানুষের সামাজিক জীবন, ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-চেতনা, সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষা, উচ্ছ্বাস-আত্মরক্ষা-জীবনযুদ্ধ, বিশ্বাস-আচার-ব্যবহার, ঘর-গৃহস্থালি, জয়-পরাজয় সর্বোপরি মানুষের সামগ্রিক জীবনযাপন ও জীবনসংগ্রামের ক্রমাগত মানবিক সংবেদনশীলতার বাঙ্ময় প্রকাশ। এসব কিছুর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ফোকলোরের বস্তুগত উপাদান লোকশিল্পকলা।
অন্যভাবে বলা যায়, ফোকলোর হচ্ছে বৃহত্তর কৃষিজীবী ও বিচিত্র শ্রমজীবী এবং উৎপাদনশীল মানুষ ও সাধারণ মানুষের সংস্কৃতি। কিন্তু জাতীয় শিক্ষানীতিতে এ দেশের উৎপাদনশীল কৃষিজীবী-শ্রমজীবী মানুষের সংস্কৃতি ফোকলোরকে অবহেলা করা হয়েছে। বাংলাদেশসহ সমগ্র বাংলাভাষী অঞ্চল ফোকলোরের উপাদানে সমৃদ্ধ। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ফোকলোরকে বাতাসের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি বলেছেন, 'বাতাস যেমন আমাদের ঘিরে আছে, তেমনি আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে ফোকলোর তথা লোকসাহিত্য। কিন্তু তার কথা আমাদের মনে থাকে না। তা যে বাতাসের মতোই উদার, বাতাসের মতোই সীমাহীন।' নগরজীবনে অভ্যস্ত বা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও ফোকলোরকে জাতীয় শিক্ষাক্রমের অন্তর্ভুক্ত করলে গণসংস্কৃতির প্রতি সামগ্রিক চেতনা বৃদ্ধি পাবে। একই সঙ্গে দেশের অগ্রগতিও ত্বরান্বিত হবে। কারণ বাংলাদেশে বিদ্যমান ধর্মীয় মৌলবাদ ও কূপমণ্ডূকতা অপনয়নের ক্ষেত্রে জাতীয় সংস্কৃতির ভূমিকা সর্বজনস্বীকৃত। এক্ষেত্রে ফোকলোরের গুরুত্ব অধিক। শিক্ষার সর্বস্তরে ফোকলোর চর্চা দেশে বিদ্যমান মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে প্রধান অস্ত্র ও কৌশলরূপে গণ্য হবে।
জাতীয় সংকট উত্তরণে ফোকলোরের ভূমিকা : সাম্প্র্রতিক বাংলাদেশে ধর্মীয় মৌলবাদ এবং কূপমণ্ডূকতা হচ্ছে জাতীয় উন্নতির অন্যতম অন্তরায়। একইভাবে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, মূল্যবোধের অবক্ষয় ও অর্থনৈতিক সংকট বিদ্যমান। ব্যাপকভাবে ফোকলোর চর্চার মাধ্যমে বাংলাদেশ নামক জাতিরাষ্ট্র এসব সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে পাওয়া সম্ভব। দেশের হাজার বছর লালিত ফোকলোর তথা লোকসংস্কৃতি_ লোকধর্ম ও লোকদর্শন চর্চার মাধ্যমে মৌলবাদী ধর্মান্ধতা থেকে সাধারণ মানুষের মুক্তি হতে পারে। উদার-জ্ঞানতত্ত্ব ও মানবিকতার জয়গানের মাধ্যমে এ দেশের লোককবিগণ ধর্মান্ধতা থেকে মুক্তির সাধনায় মানবতার পক্ষে গান গেয়েছেন :'যার যার ধর্ম সেই করে তোমার বলা অকারণ' (লালন),
'মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি_
মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি' (লালন)।
আমাদের জাতীয় অগ্রগতির আরেক সংকট হচ্ছে প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনীতি। ফোকলোর দর্শনে তা থেকে উত্তরণের উপায় রয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, হাজার বছরের এ দেশে বৌদ্ধ, হিন্দু ও মুসলমান রাজাদের রাজনৈতিক আদর্শ কেবল ফোকলোর চর্চার মধ্য দিয়ে একটি অভিন্ন মানবিক সংস্কৃতিতে পরিণত করা সম্ভব। বাংলার হাজার বছরের শাসনকালের মধ্যে নানা অহিংসা-মানবপ্রেম ও মানবতাবাদের উপাদান রয়েছে। বর্তমান বাংলাদেশের সর্বত্র মূল্যবোধের অবক্ষয় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর প্রধান কারণ ফোকলোরের প্রতি অবহেলা। বৃহত্তর পরিসরে ফোকলোর চর্চাকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির মাধ্যমে এ দেশের তরুণ প্রজন্মের মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ করা সম্ভব।
অধিকন্তু বাংলাদেশের জাতীয় উৎপাদনের মূলশক্তি কৃষক-শ্রমিক-পেশাজীবী ও আদিবাসীদের রয়েছে বৈচিত্র্যময় ফোকলোর বা লোকসংস্কৃতি। যে সংস্কৃতির ভেতরে এ জাতিরাষ্ট্রের সমৃদ্ধি ও বৈচিত্র্যময় ইতিহাস এবং ঐতিহ্য নিহিত রয়েছে। তাই বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের পরিচিতির ক্ষেত্রে ফোকলোর চর্চার কোনো বিকল্প নেই। অতএব, অতি শিগগির ফোকলোরকে জাতীয় শিক্ষা কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ফোকলোর বিভাগ অনুমোদন : ময়মনসিংহের ত্রিশালে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে স্থানীয় লোকসংস্কৃতির বলয়ের কথা চিন্তাপূর্বক বিশ্ববিদ্যালয়টিকে সাংস্কৃতিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। যে জন্য ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের গঠনতন্ত্রে ফোকলোর বিভাগটি গুরুত্বের সঙ্গে রাখা হয়েছিল। কিন্তু রহস্যজনকভাবে আজ পর্যন্ত বিভাগটি চালু করা হয়নি।
বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ২০ কোটি। ৩০টি বিশ্ববিদ্যালয় সরকারি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। অথচ দেশের একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯৮ সালের ২ ডিসেম্বর ফোকলোর বিভাগ খোলা হয়েছে। উল্লেখ্য, প্রাথমিকভাবে বিভাগটি কলা অনুষদের আওতাধীন বিবেচনা করা হলেও ফোকলোরে অন্তর্গত নৃতত্ত্ব, জাতিতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রভৃতি বিবেচনায় বিভাগটি সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের অধিভুক্ত করা হয়েছে।
একথা বহু শ্রুত যে, দেশ-বিদেশের বহু পণ্ডিত বলেছেন বাংলাদেশে রয়েছে ফোকলোরের খনি। বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব প্রদান এবং একই সঙ্গে জাতীয় আন্তর্জাতিক গুরুত্ব বিবেচনাপূর্বক নূ্যনতম পক্ষে ১০টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফোকলোর বিভাগ খোলা আবশ্যক। ফোকলোর বিদ্যার পরিধি, ব্যাপ্তি ও সমকালীন প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনায় বিভাগটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশবাসীর কাছে বাঙালি সংস্কৃতিকে আরও বিজ্ঞানমনস্ক, প্রাগ্রসর ও মানবিক চেতনা সমৃদ্ধ করে তোলা সম্ভব হবে। এমনকি এ বিভাগের কার্যক্রম সাংস্কৃতিক আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ও আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখতে সক্ষম হবে। উপর্যুক্ত বিষয়গুলো আন্তরিকভাবে গুরুত্ব দিয়ে প্রথম পর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং পরে ধারাবাহিকভাবে অন্যান্য গণবিশ্ববিদ্যালয়ে ফোকলোর বিভাগ অনুমোদন ও প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারের কাছে সনির্বন্ধ আবেদন করা প্রয়োজন।
ড. আবদুল ওয়াহাব : পরিচালক, পাঠ্যপুস্তক বিভাগ, বাংলা একাডেমী, ঢাকা এবং খণ্ডকালীন শিক্ষক, ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
জাতীয় সংকট উত্তরণে ফোকলোরের ভূমিকা : সাম্প্র্রতিক বাংলাদেশে ধর্মীয় মৌলবাদ এবং কূপমণ্ডূকতা হচ্ছে জাতীয় উন্নতির অন্যতম অন্তরায়। একইভাবে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, মূল্যবোধের অবক্ষয় ও অর্থনৈতিক সংকট বিদ্যমান। ব্যাপকভাবে ফোকলোর চর্চার মাধ্যমে বাংলাদেশ নামক জাতিরাষ্ট্র এসব সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে পাওয়া সম্ভব। দেশের হাজার বছর লালিত ফোকলোর তথা লোকসংস্কৃতি_ লোকধর্ম ও লোকদর্শন চর্চার মাধ্যমে মৌলবাদী ধর্মান্ধতা থেকে সাধারণ মানুষের মুক্তি হতে পারে। উদার-জ্ঞানতত্ত্ব ও মানবিকতার জয়গানের মাধ্যমে এ দেশের লোককবিগণ ধর্মান্ধতা থেকে মুক্তির সাধনায় মানবতার পক্ষে গান গেয়েছেন :'যার যার ধর্ম সেই করে তোমার বলা অকারণ' (লালন),
'মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি_
মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি' (লালন)।
আমাদের জাতীয় অগ্রগতির আরেক সংকট হচ্ছে প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনীতি। ফোকলোর দর্শনে তা থেকে উত্তরণের উপায় রয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, হাজার বছরের এ দেশে বৌদ্ধ, হিন্দু ও মুসলমান রাজাদের রাজনৈতিক আদর্শ কেবল ফোকলোর চর্চার মধ্য দিয়ে একটি অভিন্ন মানবিক সংস্কৃতিতে পরিণত করা সম্ভব। বাংলার হাজার বছরের শাসনকালের মধ্যে নানা অহিংসা-মানবপ্রেম ও মানবতাবাদের উপাদান রয়েছে। বর্তমান বাংলাদেশের সর্বত্র মূল্যবোধের অবক্ষয় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর প্রধান কারণ ফোকলোরের প্রতি অবহেলা। বৃহত্তর পরিসরে ফোকলোর চর্চাকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির মাধ্যমে এ দেশের তরুণ প্রজন্মের মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ করা সম্ভব।
অধিকন্তু বাংলাদেশের জাতীয় উৎপাদনের মূলশক্তি কৃষক-শ্রমিক-পেশাজীবী ও আদিবাসীদের রয়েছে বৈচিত্র্যময় ফোকলোর বা লোকসংস্কৃতি। যে সংস্কৃতির ভেতরে এ জাতিরাষ্ট্রের সমৃদ্ধি ও বৈচিত্র্যময় ইতিহাস এবং ঐতিহ্য নিহিত রয়েছে। তাই বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের পরিচিতির ক্ষেত্রে ফোকলোর চর্চার কোনো বিকল্প নেই। অতএব, অতি শিগগির ফোকলোরকে জাতীয় শিক্ষা কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ফোকলোর বিভাগ অনুমোদন : ময়মনসিংহের ত্রিশালে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে স্থানীয় লোকসংস্কৃতির বলয়ের কথা চিন্তাপূর্বক বিশ্ববিদ্যালয়টিকে সাংস্কৃতিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। যে জন্য ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের গঠনতন্ত্রে ফোকলোর বিভাগটি গুরুত্বের সঙ্গে রাখা হয়েছিল। কিন্তু রহস্যজনকভাবে আজ পর্যন্ত বিভাগটি চালু করা হয়নি।
বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ২০ কোটি। ৩০টি বিশ্ববিদ্যালয় সরকারি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। অথচ দেশের একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯৮ সালের ২ ডিসেম্বর ফোকলোর বিভাগ খোলা হয়েছে। উল্লেখ্য, প্রাথমিকভাবে বিভাগটি কলা অনুষদের আওতাধীন বিবেচনা করা হলেও ফোকলোরে অন্তর্গত নৃতত্ত্ব, জাতিতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রভৃতি বিবেচনায় বিভাগটি সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের অধিভুক্ত করা হয়েছে।
একথা বহু শ্রুত যে, দেশ-বিদেশের বহু পণ্ডিত বলেছেন বাংলাদেশে রয়েছে ফোকলোরের খনি। বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব প্রদান এবং একই সঙ্গে জাতীয় আন্তর্জাতিক গুরুত্ব বিবেচনাপূর্বক নূ্যনতম পক্ষে ১০টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফোকলোর বিভাগ খোলা আবশ্যক। ফোকলোর বিদ্যার পরিধি, ব্যাপ্তি ও সমকালীন প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনায় বিভাগটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশবাসীর কাছে বাঙালি সংস্কৃতিকে আরও বিজ্ঞানমনস্ক, প্রাগ্রসর ও মানবিক চেতনা সমৃদ্ধ করে তোলা সম্ভব হবে। এমনকি এ বিভাগের কার্যক্রম সাংস্কৃতিক আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ও আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখতে সক্ষম হবে। উপর্যুক্ত বিষয়গুলো আন্তরিকভাবে গুরুত্ব দিয়ে প্রথম পর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং পরে ধারাবাহিকভাবে অন্যান্য গণবিশ্ববিদ্যালয়ে ফোকলোর বিভাগ অনুমোদন ও প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারের কাছে সনির্বন্ধ আবেদন করা প্রয়োজন।
ড. আবদুল ওয়াহাব : পরিচালক, পাঠ্যপুস্তক বিভাগ, বাংলা একাডেমী, ঢাকা এবং খণ্ডকালীন শিক্ষক, ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
No comments