যাত্রাশিল্পে আসুক এক ফুটন্ত সকাল by মিলন কান্তি দে

দীর্ঘদিন অনিশ্চয়তার আবর্তে ডুবে থাকা যাত্রাশিল্পে একটু একটু করে সুবাতাস বইছে। এর শুভসূচনা দেখা গিয়েছিল বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শেষ দিকে। ২০০৭ সালে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রচুর যাত্রা অনুষ্ঠানের অনুমতি দেওয়া হয়, যা নিকট অতীতে কখনোই দেখা যায়নি। এর পরের বছর ২০০৮ সালে সাবেক শিশু, মহিলা ও সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে যাত্রার জন্য একটি নীতিমালা তৈরির কাজ শুরু হয়।


অবশ্য যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে এর আগে উপদেষ্টাকে যাত্রাশিল্পের বিভিন্ন সমস্যার স্থায়ী সমাধানে একটি স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছিল। তারই সূত্র ধরে যাত্রানীতি প্রণয়নের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
বর্তমান সরকারের আমলে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে নীতিমালাসংক্রান্ত বেশ কয়েকটি আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, নীতিমালা এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। নীতিমালা ছাড়া যাত্রাকে অন্যভাবেও পৃষ্ঠপোষকতা করছে সরকার। গত অর্থবছরে সংস্কৃতির বিভিন্ন মাধ্যমের উন্নয়নে সরকারি বরাদ্দ যাত্রাশিল্পের ভাগ্যেও জোটে। বর্তমান অর্থবছরেও বরাদ্দের কোটায় যাত্রাকে রাখা হয়েছে। বাংলাদেশে ৪০ বছরের মধ্যে এই প্রথম অবহেলিত একটি লোকশিল্প সরকারি আনুকূল্য পাচ্ছে। কিন্তু লজ্জায় মাথা নুয়ে যায়, যখন দেখি যাত্রার নামে চলছে অশোভন, স্বেচ্ছাচার এবং বিকৃত রুচির নগ্ন প্রতিযোগিতা। একটি জাতীয় দৈনিকে দেখলাম, চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাট মেলায় যাত্রা অনুষ্ঠানের অনুমতি নিয়ে অবাধে চালানো হচ্ছে অশ্লীল নৃত্যগীত। দর্শকরা যাত্রা দেখতে গিয়ে হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছে। শুধু কানসাট নয়, ঝিনাইদহ জেলার শেখপাড়ায়, পাবনার দুবলারচরে, কুষ্টিয়া জেলার গ্রামেগঞ্জে, যেখানে যাত্রার প্যান্ডেল তৈরি হয়েছে, সর্বত্রই অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ছে সংক্রামক ব্যাধির মতো। এগুলো বন্ধের জন্য যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদ বারবার দাবি জানিয়ে আসছে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনে। কিন্তু প্রতিকার কিছুই হচ্ছে না। তাহলে কি এসব কিছু হচ্ছে প্রশাসনের ছত্রছায়ায়! দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, প্রশাসনের এক শ্রেণীর কর্মকর্তা এবং স্থানীয় প্রভাবশালীদের যোগসাজশে বিকৃত রুচির প্রদর্শকরা অশ্লীলতা আমদানি করে যাত্রার বারোটা বাজাচ্ছে। এর সঙ্গে প্রকৃত পেশাদার যাত্রাশিল্পীদের কোনো যোগাযোগ নেই। বরং এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে যাত্রাশিল্পীরা মাঝেমধ্যে হেনস্তা হচ্ছেন প্রদর্শক বা নায়েক পার্টির হাতে। কিন্তু এমনটি আর চলতে দেওয়া যায় না। ঐতিহ্যবাহী যাত্রাকে যারা কলুষিত করছে, তাদের প্রতিহত করতে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে যাত্রাদলের মালিক এবং শিল্পী-কলাকুশলীদের। এরই মধ্যে যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদ দাবি জানিয়েছে, অশ্লীলতা বন্ধের জন্য টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। জেলা ও পুলিশ প্রশাসন কঠোর হলে যাত্রায় অশ্লীলতা অনেকটা কমে আসবে। সরকার যখন একটি নীতিমালা তৈরির কাজ প্রায় শেষ করে এনেছে এবং যাত্রাশিল্পে অর্থ বরাদ্দ দিচ্ছে, সেই সময় যাত্রার ঐতিহ্যগত আবেদন ক্ষুণ্ন করা হলে তা সবার জন্যই অকল্যাণকর।
এই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতি ঠেকাতে হলে অসাধু, মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের নিশ্চিহ্ন করতে হবে। যাত্রার নামে যারা জুয়া চালায়, 'প্রিন্সেস' নাচায়, তাদের কোনোক্রমেই ছাড় দেওয়া চলবে না। সরকার এই শিল্পের দিকে সুদৃষ্টি দিয়েছে, সেই উপলব্ধি থেকে শিল্পটাকে সাজাতে হবে। অপসংস্কৃতির জোয়ারে যাত্রাকে যারা অন্ধকারে ঢেকে রাখতে চায়, তাদের প্রতিহত করতে হবে। তাহলেই যাত্রামঞ্চে আসবে উদীয়মান সূর্যের প্রথম স্নিগ্ধ আলো, এক ফুটন্ত সকাল।

No comments

Powered by Blogger.