অভিমতঃ একটি সম্পাদকীয়ঃ কিছু কথা by অধ্যাপক আবদুল জব্বার খান
গত ১৪ নভেম্বর ২০০৯ তারিখের দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় ‘আমার দেশ চালিয়ে যাচ্ছে, চালিয়ে যাবে’ শীর্ষক সম্পাদকীয়টি পাঠের পর একজন পাঠক হিসেবে আমার প্রতিক্রিয়া তুলে ধরার জন্যই আমার এই উপস্থাপনা। দৈনিক আমার দেশ-এ লেখা প্রকাশের এটাই আমার প্রথম প্রচেষ্টা। আমি অকপটে স্বীকার করছি, আমি ওই পত্রিকাটির নিয়মিত পাঠক বা গ্রাহক কোনোটাই নই।
কেবল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে বসে পত্রিকা ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে এটা আমার হাতে এসে গেলে একটু-আধটু নেড়েচেড়ে দেখি মাত্র। আমি নিয়মিত গ্রাহক হিসেবে যে পত্রিকাটি এখন বাসায় রাখি সেটি নয়াদিগন্ত। তবে বছর কয়েক আগে পর্যন্ত যে পত্রিকাটি তার জন্মলগ্ন থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে আমার ঘরে রেখেছি গ্রাহক ও পাঠক হিসেবে সেটি দৈনিক সংবাদ। সংবাদ যে কোন ঘরানার পত্রিকা আশা করি তা আমার দেশ’র পাঠকদের অজানা নয়। তবে সেই ঘরানার লোক না হয়েও সংবাদ-এ যে আমার লেখা ছাপানো হতো তার কারণ ওই পত্রিকার প্রাণপুরুষ প্রয়াত সন্তোষ গুপ্ত যিনি অনিরুদ্ধ নামে ওই পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখতেন। গত শতাব্দীর আশির দশকের মাঝামাঝি ওই ঘরানার ভিন্ন লাইনের একটি লেখা—‘স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ’ শিরোনামে ওই পত্রিকায় প্রকাশ পেলে আমি ওই পত্রিকার অনেক লেখক-পাঠকের সাঁড়াশি আক্রমণের শিকার হই। আমিও সে সবের একটি কড়া জবাব লিখে সন্তোষ বাবুর কাছে ধরনা দেই। তিনি প্রথমেই এসব তর্ক-বিতর্কের মধ্যে যেতে গররাজি হয়ে আমাকে ফিরে যেতে বলেন। আমি তাকে বলি একবার যখন আমার লেখা ছাপিয়ে আমাকে তর্কবিতর্কের মধ্যে ফেলে দিয়েছেন তখন আমাকে সে সবের একটা জবাব দেয়ার সুযোগ দিতেই হবে, নইলে কিসের নিরপেক্ষ পত্রিকার বড়াই করেন। যা হোক অনেক কথা কাটাকাটির পর তিনি সেটা গ্রহণ করেন এবং সংবাদে প্রকাশও করেন। তখন থেকেই ওই পত্রিকার দ্বার আমার জন্য মোটামুটি খুলে গেল। সে সবের অনেকই আমি এখন আর খুঁজে পাচ্ছি না। তবে হাতের কাছে যে দু’একটা পাচ্ছি তা থেকে একটা যা সংবাদের ৩১.৭.২০০২ তারিখের সম্পাদকীয় পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছে তার পাত্তা দিলাম। সম্ভব হলে আমার দেশ’র পাঠকদের একটু কষ্ট স্বীকার করে দেখে নিতে বলি। তাহলে আমি যতই ক্ষুদে লেখক হই না কেন আমার চিন্তাধারার একটা সম্যক পরিচিতি তারা পেয়ে যাবেন।এখন আমি কালেভদ্রে মাসে, দু-মাসে এক-আধটা লেখা পাঠাই দৈনিক নয়াদিগন্তে এবং সেগুলোর সব কটিই সেখানে প্রকাশ পায়। ওই পত্রিকায় আমার এ পর্যন্ত শেষ লেখাটি প্রকাশ পেয়েছে ২৩.৮.০৯ তারিখে। কাজেই ওই পত্রিকার পাঠকদের কাছে আমার মতো একজন ক্ষুদে লেখকেরও একটা পরিচিতি থাকলেও থাকতে পারে। আসলে এখন আমি বয়সের ভারে ন্যুব্জ এবং স্বাস্থ্যও ভালো যাচ্ছে না, ৮০ ছুঁই ছুঁই করছে। এসব কাজে তেমন আর মন দিতে পারি না। তবে ওই পত্রিকায় যারা নিয়মিত কলাম লিখে থাকেন তাদের সবারই লেখক পরিচিতি আমার কাছে দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট। তাদের মধ্যে যারা সাহসিকতায় এবং স্পষ্টবাদিতায় নির্ভয় তাদেরই একজন হলেন আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। নয়াদিগন্তে তার কলাম আমি নিয়মিত পাঠ করি।
এতক্ষণ ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়ার মতো অনেক কথাই বলে এলাম। এখন আসল কথায় আসা যাক। আমার দেশ পত্রিকাটির আমি নিয়মিত পাঠক না হলেও পত্রিকাটি সম্পর্কে আমার জানাশোনা পত্রিকাটি প্রকাশের অনেক আগে থেকেই। আমার দেশ প্রকাশের অনেক আগেই একটি টিম পত্রিকার বিষয় প্রচারের জন্য রাজশাহী এসেছিল। টিমটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও একটি আলোচনাচক্রের আয়োজন করে আর ঘটনাচক্রে আমাকেই সেই চক্রে সভাপতিত্ব করতে হয়। ১৪ আগস্ট সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাবে অবস্থানকালে সামনের টেবিলে দু-চারটা দৈনিক পত্রিকা থেকে হাতের কাছেরটা টেনে নিয়ে দেখি সেটি আমার দেশ। পাতা উল্টাতে গিয়ে সম্পাদকীয়র শিরোনাম দেখে আমার মন আকৃষ্ট হলো। সেটি আমাদের বর্তমান স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকুকে নিয়ে। তিনি আমার বিশেষ পরিচিত এক ব্যক্তি, যদিও বা তার এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর আমার সঙ্গে যোগাযোগ একেবারে শূন্য। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করাকালে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের আগেপিছে দু’বছর করে মোট প্রায় পাঁচ বছর টুকু সাহেব বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন্নাহ হলের (বর্তমান নাম শেরেবাংলা হল) আবাসিক ছাত্র ছিলেন আর আমি ছিলাম সেখানকার খেলাধুলা বিষয়ের ভারপ্রাপ্ত হাউস টিউটর। টুকু সাহেব ছিলেন হলের সাঁতারু দলের অধিনায়ক। অধিনায়ক হিসেবে তিনি ওহঃবত্ ঐধষষ ও ওহঃবত্ টহরাবত্ংরঃু সাঁতার ও ওয়াটার পোলো প্রতিযোগিতায় হলের জন্য বেশ কয়েকটি পুরস্কার আনিয়ে দেন। উল্লিখিত সম্পাদকীয়টিতে তার সংশ্লিষ্টতার বিষয় দেখতে পেয়ে আমি সেটি আগ্রহ ভরে পড়ে দেখি। ক’দিন আগে প্রতিমন্ত্রী এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ‘বিগত বিএনপি জোট সরকারের আমলে বিদেশ থেকে চোরাই পথে আসা অস্ত্রই এখন গ্রেফতারকৃত আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী ও সন্ত্রাসীদের হাতে’ পড়ায় দেশে সন্ত্রাস ও অরাজকতার সৃষ্টি হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন। মাত্র কয়েক মাস আগে তার নিজের দফতরের পূর্ণমন্ত্রী কী একটা ঘটনায় ঠিক এ ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়ায় প্রশ্নকর্তাকে একই ধরনের জবাব দেয়ায় অনেকের সমালোচনার মুখে পড়েন এবং প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে সতর্ক সংকেতও পান। বিষয়টি বোধ হয় প্রতিমন্ত্রীর জানা ছিল না—তাহলে কি আর তিনি এরকম মন্তব্য করতেন? কিন্তু কথা হচ্ছে যারা নিজেদের মন্ত্রণালয়ের তথ্যাদি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবহিত নন তারা দেশের খবরাখবর ঠিকমত রাখবেন কি করে। এ ধরনের মন্তব্য যারা বর্তমান মন্ত্রিসভা সম্পর্কে হালকা সমালোচনা করেন, যেমন এটা হলো শিক্ষানবিশী বা কচিকাঁচার আসরের মতো মন্ত্রিসভা তাদের হাতকেই শক্ত করবে। কথা প্রসঙ্গে বলতে হয় মন্ত্রিসভা গঠনের কিছুদিন পরই আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একটা ঘরোয়া বৈঠকে কথা চলাকালে প্রসঙ্গক্রমে বাফার স্টেট কথাটা উঠে এলে মন্ত্রী তা বুঝতে না পেরে উপস্থিত সবাইকে জিজ্ঞেস করেন, সেটা আবার কী। অথচ সবারই তো জানা আছে স্কুলে শিক্ষকরা শব্দটি সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের ইতিহাস ও ভূগোলে পাঠদানকালে সম্যক সবক দিয়ে থাকেন। মন্ত্রী মহোদয় এমপি নির্বাচিত বা মন্ত্রিসভায় স্থান পাওয়ার পূর্বপর্যন্ত দেশের রাজনীতিতে বা এমনকি তার নিজ পেশাতেও (চিকিত্সক) জনগণের কাছে তেমন পরিচিত ছিলেন না। মন্ত্রিসভায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত হওয়ায় আমি তো ধরে নিয়েছিলাম তিনি ইতিহাস বা রাষ্ট্রবিজ্ঞান বা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়ে বিশেষ জ্ঞানসম্পন্ন কেউকেটা একজন হবেন। নইলে আওয়ামী লীগের মতো বহু জ্ঞানী-গুণি ব্যক্তিতে ভরা একটা দল থেকে মন্ত্রিসভায় স্থান পাওয়া (তাও আবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী)-তো কোনো সহজ ব্যাপার নয়। নেতা-নেত্রীদের এরকম বেফাঁস কথাবার্তা বা হঠকারিতা দলকে কতটা বেকায়দায় ফেলে, তার আরও একটা প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো ২০০৪ সালে সংসদে বিরোধী দলে থাকাকালে এপ্রিল-মে মাসে সরকারি দলকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়ার কথা ঘোষণা এবং সময়সীমা ৩০ এপ্রিল বেঁধে দিয়ে ট্রাম্প কার্ডের খেলার মতো। তখন দলের সাধারণ সম্পাদক পদে ছিলেন আবদুল জলিল সাহেব। এখন তিনি রাজনীতির খেলায় দলে একেবারে কোণঠাসা। অথচ এই দলটির জন্য তার ত্যাগ ও তিতিক্ষা কোনোদিন ভুলবার নয়। জলিল সাহেব আর আমি একই গ্রামের ছেলে এবং একই স্কুলে পাঠ গ্রহণ করেছি। তিনি বিত্তবান পিতার একমাত্র পুত্র। সোনার চামচ মুখে নিয়েই ধরায় আগমন করেছেন। বয়সে আমার ৭/৮ বছরের ছোট হবেন। আমরা উত্তরাঞ্চলের জনগণ মনে করতাম এই অঞ্চল থেকে যদি নিকট ভবিষ্যতে কেউ সরকার প্রধানের পদটি অলঙ্কৃত করতে পারেন তবে সেটা একমাত্র তিনিই। কিন্তু হায় উত্তরাঞ্চলের মানুষের সব আশার ফানুস চুপসে গেল। ট্রাম্প কার্ডের সর্বনাশা খেলায় দলের একেবারে লেজেগোবরে অবস্থা। সব দোষ যেন জলিল সাহেবের। পত্রপত্রিকায় একমাস ধরে জলিল সাহেবকে ধিক্কার দিয়ে অবিরাম লেখা চলল। আমিও তখন ‘জলিল সাহেব আপনি বোকা বানালেন কাকে, মশা মারতে গালে চড়’ শিরোনামে সংবাদে (১৮.৫.০৪) তারিখে দু’কলম লিখেছিলাম। তখন দলনেত্রীই তাকে অভয় বাণী আর জনগণকে ভুয়া আশ্বাস দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিলেন এই বলে যে, ট্রাম্প কার্ড ব্যর্থ হয়নি এটি একটি চলমান খেলা (ঙহ মড়রহম চত্ড়পবংং)।
এবারে আবার আসল কথায় ফিরে এসে লেখাটির ইতি টানি। শিরোনামে প্রতিমন্ত্রী মহোদয়ের বাক্য চয়ন যে শোভন সীমাবহির্ভূত তা বলাই বাহুল্য। ‘গলা চিনলাম’ বা ‘চালিয়ে যান’ শব্দগুলোকে প্রতিমন্ত্রীর বাক্যালাপের ধরনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে যে কোনো পাঠকের কাছে তা ঈযধষষবহমরহম বা হুমকি-ধমকি বলে মনে হবে, তাতে সন্দেহ নেই। তা তিনি বুঝেই বলুন আর না বুঝেই বলুন আর নিজেকে যতই নিরীহ মানুষ বলে জাহির করুন না কেন। উল্লিখিত শব্দগুলো তার বাক্যালাপের ভঙ্গির সঙ্গে এক করে দেখলে ভাবে-ভঙ্গিতে পুরো বাক্যটি যেভাবে দাঁড়ায়, সেটি হলো—আপনি চালিয়ে যান, আপনার গলা চিনে রাখলাম, দেখি কতদূর এগুতে পারেন। তা আপনি ভাগ্যবান যে আল্লাহ্ আপনাকে ক্ষমতা দিয়েছেন অমন তেজে কথা বলার। তবে এ কথাও সবার মনে রাখা উচিত যে, আল্লাহ্তায়ালা ক্ষমতা বা ইজ্জত দেন, সেই ক্ষমতাকে অন্য দশ বান্দার মঙ্গলে লাগাবার জন্য। অকারণ হুমকি-ধামকি দেয়ার জন্য নয়। যিনি যত ঊর্ধ্বে ওঠেন তার উচিত এই বোধকে তত বেশি জাগ্রত রাখা। ঝযধশবংঢ়বধত্ব-এর একটি গীতিনাট্যের ভাষা হলো ওঃ রং হরপব ঃড় ঢ়ড়ংংবং ঃযব ংঃত্বহমঃয ড়ভ ধ ষরড়হ, নঁঃ রঃ রং ধ ঃুত্ধহহু ঃড় ঁংব ঃযধঃ ংঃত্বহমঃয ষরশব ধ ষরড়হ. আমি দুঃখিত এবং তারও বেশি লজ্জিত যে, আমার এক সময়ের অতি প্রিয় ছাত্রটি এই বোধটিকে ধরে রাখতে পারেননি। শিক্ষকের কোনো ছাত্র জ্ঞানে-বিদ্যায় এবং গুণে তার চেয়েও অনেক বড় হলে শিক্ষকই সবচেয়ে বেশি আনন্দ পান ও গর্ববোধ করেন। আমার জ্যেষ্ঠ সন্তানের বয়স তার বয়সেরই কাছাকাছি হবে। সেই সুবাদে আমি দোয়া করি, যে দায়ভার সমাজ তার উপর চাপিয়েছে, তিনি সুনাম ও যোগ্যতার সঙ্গে যেন তা বহন করতে সক্ষম হন এবং উত্তরোত্তর আরও উঁচু উন্নতির সোপানে ওঠেন। আল্লাহ্তায়ালা তাকে যেন সঠিক দিকনির্দেশনা ও হেদায়েত দান করেন। আমীন।
লেখক : সাবেক কোষাধ্যক্ষ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
No comments