সফর ও সম্মেলন নিয়ে ব্যস্ত প্রধানমন্ত্রীঃ লাভালাভের বিবেচনা প্রত্যাশিত
প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল সম্প্রতি বিভিন্ন দেশ সফর করলেও আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের প্রভাব বলয় বাড়ছে না। একাধিক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও বয়ে আনছে না কোনো লাগসই ফলাফল। বিগত এপ্রিল মাস থেকে এ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী বহু সদস্যের প্রতিনিধিদলসহ মধ্যপ্রাচ্যের একাধিক দেশ ও ইতালি সফর করেছেন।
বিশেষত তার সৌদি আরব সফর ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আশা করা গিয়েছিল, বর্তমানে সৌদি আরবে কর্মরত বাংলাদেশী শ্রমিকরা যেসব কঠিন সমস্যার মোকাবিলা করছেন, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর সফরে তার একটি স্থায়ী সুরাহা হবে। কিন্তু সেক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত কোনো আশার আলো দেখা দেয়নি। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, যথাযথ কূটনৈতিক তত্পরতার অভাবে এ সমস্যাটির কোনো কিনারা হচ্ছে না। ফলে জনশক্তি রফতানির ক্ষেত্রে যে অভিঘাত সৃষ্টি হয়েছে, তা থেকে উত্তরণের উপায় এখন পর্যন্ত রয়ে গেছে অস্পষ্ট, অনিশ্চিত। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যান্য দায়িত্বশীল কর্মকর্তার সফরের ফলাফল যে হতাশাব্যঞ্জক, তাতে আর সংশয় থাকে না।গত জানুয়ারিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ ৫০ জন সফরসঙ্গী নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ওমরাহ পালনের উদ্দেশ্যে সৌদি আরব যান। এ সফরের অন্যান্য উদ্দেশ্য ছিল সেখানে কর্মরত কয়েক লাখ বাংলাদেশী শ্রমিকের চাকরির অনুমতি বা ‘আকামা’ বিষয়ক জটিলতার নিরসন। উল্লেখ্য, সৌদি সরকার গত ১০ এপ্রিল আকামা পরিবর্তনের সুযোগ দিলে পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ বিভিন্ন দেশ এ সুযোগ নিতে সক্ষম হয়। কিন্তু এ থেকে বঞ্চিত হন বাংলাদেশী শ্রমিকরা। অথচ সে সময় আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, আকামা অপরিবর্তিত রেখেই চাকরি বদলের আশ্বাস দিয়েছেন সৌদি বাদশাহ। সৌদি আরবে এখন বাংলাদেশী শ্রমিকরা এক কোম্পানির চাকরি নিয়ে অন্য কোম্পানিতে কাজ করতে পারেন না। এই সঙ্কটের মুখে শেষ পর্যন্ত তাদের নির্দিষ্ট কোম্পানির চাকরির মেয়াদ শেষে ফিরে আসতে হয় দেশে। কিন্তু সৌদি বাদশাহর বরাত দিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে আশার বাণী শুনিয়েছিলেন, তা এখনও কার্যকর হয়নি। ফলে অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি এবং উদ্ভূত এ সমস্যার মুখে বছরে প্রায় ৪০ হাজার শ্রমিককে ফিরে আসতে হচ্ছে দেশে। সে ধারা এখনও অব্যাহত। এ অবস্থায় বলা যেতেই পারে প্রধানমন্ত্রীর এ সফর প্রত্যাশা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
এদিকে সরকারের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েও বিদেশে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশন ও বাণিজ্যিক উইংগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রফতানি আয়ের টার্গেট পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে বলে জানা গেছে। অভিযোগ আছে, মিশন কর্মকর্তারা বিদেশে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছেন। এই প্রেক্ষাপটে সার্বিক অবস্থা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, জাতীয় অর্থনীতির অন্যতম দিক জনশক্তি ও পণ্য রফতানি উভয় ক্ষেত্রই বিস্তর সঙ্কটের সম্মুখীন। এর মূলে রয়েছে যথাযথ কূটনৈতিক তত্পরতার অভাব। প্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরের মাধ্যমেও তাতে কোনো ইতিবাচক মাত্রা যোগ হয়নি।
বিশাল প্রতিনিধিদলসহ প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন সম্মেলনে যোগদান নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কারণ এর আগেও প্রধানমন্ত্রী যেসব সম্মেলনে যোগদান করেছেন, অভিজ্ঞ মহলের মতে সেখানে তার নিজের উপস্থিতি অপরিহার্য ছিল না। উল্লেখ্য, বিগত জুলাই মাসে মিসরে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের শীর্ষ সম্মেলনে ১১০টি দেশের প্রতিনিধি যোগ দিলেও সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানের সংখ্যা ছিল মাত্র অর্ধেক। গত ১০ অক্টোবর সুইডেনের জলবায়ু সম্মেলনে, ১৬ নভেম্বর ইতালিতে খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সম্মেলনেও সরকারপ্রধানের যোগদান করা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না বলে মনে করেন অনেকে। বর্তমানে ত্রিনিদাদ ও টোবাগোতে আয়োজিত কমনওয়েলথ সম্মেলন প্রসঙ্গেও একই কথা প্রযোজ্য। এই প্রেক্ষাপটে বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে, এসব সফর ও সম্মেলনের মাধ্যমে কূটনৈতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের প্রভাব এবং জনশক্তি রফতানি ও পণ্য রফতানির মতো আর্থিক খাতে কোনো উন্নয়ন ঘটেছে কিনা। যদি এর জবাব ইতিবাচক হয়, তাহলে আর কোনো কথাই থাকে না। না হলে এর লাভালাভের বিবেচনা সরকারপ্রধানই করবেন—এটাই প্রত্যাশা।
No comments