কে তুমি? by আল মাহমুদ
ঋতুচক্রের আবর্তনে শীত এসে জানান দিচ্ছে সে এসেছে। কেবল আমারই কোনো প্রস্তুতি নেই। শীতের পোশাক কে কোথায় রেখে গেছে তাও খুঁজে পেতে বের করতে হবে। আমার অবশ্য তেমন তাড়াহুড়ো নেই, কারণ আমি তো কোথাও বের হই না। বের না হলেও মনটা তো আর ঘরে থাকে না। নানা খবর ও নানা সংবাদে মনটা বহির্মুখী হতে আকুলি-বিকুলি করে।
তবে ঘরই সবচেয়ে নিরাপদ। পায়চারি করে ক্লান্ত হলে বিছানায় কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ি। আমি কোনো স্বপ্ন দেখি না। যেহেতু স্বপ্ন দেখি না সম্ভবত সে কারণেই আমার উপর দুঃস্বপ্নের উত্পাত কম। মাঝে মধ্যে চিন্তা করি। সে চিন্তাও নিজের দেশ ও মাটিকে ঘিরেই। ভাবি আমি তো আর সৃজনশীল কোনো বিষয় উত্থাপনের উপযুক্ত কেউ নই। আমার এত দুর্ভাবনায় পীড়িত হওয়ার আশঙ্কা কেন? পরক্ষণেই মনে হয় এক সময় আমি আমার দেশবাসীকে স্বপ্ন দেখানোর দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলাম। আমি কবি হিসেবে এ দায়িত্ব কখনও এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করিনি।কবিরও সংসার থাকে। সে সংসার এক সময় জমজমাট হলেও শূন্যতাও এর উপর বয়ে যায়। এখন তো আমার বলতে গেলে কেউ নেই। কিছু নেই। ঘরের ভেতর ঘোরাফেরা করে আবার এসে বিছানায় শুয়ে পড়ি। কাউকে কিছু বলি না। এমনিতেই ঘরের সবাই আমাকে সাহায্য করতে উদ্গ্রীব থাকে। আমি অবশ্য এ অবস্থাতে অত্যন্ত লজ্জিত হয়ে কখনো আমি তাদের সাহায্য গ্রহণ করি।
একজন কবির সৃজনশীলতার সম্ভাবনা ফুরিয়ে গেলে সম্ভবত তিনি পড়াশোনা করে সময় অতিবাহিত করেন। আমার দৃষ্টিশক্তি অপরিচ্ছন্ন হয়ে পড়ায় আমি পড়তেও পারি না। সময়কে ধরতেও পারি না; কিন্তু নড়াচড়া তো করতে পারি। সেটাও ঘরের ভেতরে। বাইরে পা দেয়ার সাহস নেই কারণ দুর্ঘটনায় পড়ে আবার পরিবারের জন্য দুর্ভোগ ডেকে আনব।
এহেন অবস্থাটি লিখে বোঝানো যায় না। আমি এক সময় ভাবতাম আমি যখন লিখতে শিখেছি তখন আর চিন্তা কী! কিন্তু এখন দেখছি লিখতে জানাই হলো সব দুর্ভাবনার কারণ।
আমি এখন এমন একজন ব্যক্তি হতে চাই যে কিনা একদা লিখতে জানত; কিন্তু এখন সে শক্তি তার হাতছাড়া হয়ে গেছে; কিন্তু মানুষের অনুভব শক্তি বিচিত্র গতিতে চলে। সে কি যে ভাবে আর কি যে ভাবে না তার হিসাব মিলানো যায় না। এ অবস্থাতেও আমি যে বেঁচে আছি তার কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে দেখতে পাই এক বেগবান ইচ্ছাশক্তি যৌবনকাল থেকে আমার সঙ্গে আত্মীয়তা সৃষ্টি করে আমাকে ঠেলে নিয়ে চলেছে।
এই ঠেলাটা কাল থেকে কালান্তরে কবিদের পৌঁছে দেয়। সব সময় যে যাত্রাটা শুভ হয় তা অবশ্য হয় না। অনেক সময় অশুভ অনিশ্চিত অন্ধকার পথে আমাকে হাত ধরে কেউ নিয়ে গেছে। আমি তার হাসি শুনতে পেয়েছি। হাতের উষ্ণতা অনুভব করেছি; কিন্তু বুঝতে পারিনি এ হলো এক অশুভ অকল্যাণকর টান বা আকর্ষণ।
যা হোক আমি তো থেমে থাকিনি। বলা যায় যে, জীবনের সফর আমি প্রায় শেষ করে এনেছি। যদি কেউ বলেন কোথায় পৌঁছুলেন, তাহলে আমার জবাব হলো আমার তো কোথাও পৌঁছানোর কথা ছিল না। আমার শুধু একটাই কথা ছিল। হাত ধরে নিয়ে গেলে আমি যাব। এই তো আমি এসেছি। কে হাত ধরে এনেছে তার একটা বিবরণ দিতে পারি। তার হাতটা ছিল খুব উর্বর। ঘর্মাক্ত। তার হাসি ছিল ছুরির মতো ধারালো। মাঝে মাঝে সে কথাও বলত। সে কথাগুলো ছিল ঠাট্টায়-মশকরায় উপচেপড়া। আমি সবই সহ্য করেছি; কিন্তু আমি সহ্য করতে পারিনি উপেক্ষণ। যখনই টের পেয়েছি আকর্ষণকারী আমাকে খানিকটা উপেক্ষা করছে, অমনি আমি হাত ঝাড়া দিয়ে তার ঘর্মাক্ত পিচ্ছিল হাত ঝেরে ফেলেছি। তারপর তো আর যাইনি।
এখন কোথায় পৌঁছলাম সেটা আমার বিবেচনার বিষয় নয়। আমি শুধু বলব আমি অবজ্ঞার সঙ্গে পথ চলিনি। অশুভের সঙ্গে আপস করিনি। বরং উত্কণ্ঠার মধ্যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দিশেহারার মতো অপেক্ষা করেছি। আমাকে কে জিজ্ঞেস করে কোথায় পৌঁছেছি?
আমার তো কোথাও পৌঁছানোর প্রতিশ্রুতি ছিল না। আমাকে কেউ এসে হাত ধরে দাঁড়ালেই আমি বলি আমি তো এসেছি। আমি তো এটা কোন কাল, কোন মাস, কোন ঋতু তা বলতে পারব না। আমার পৌঁছানোর কথা ছিল। আমি ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি। কে আমার সঙ্গী হবে? কেউ না। কে আমাকে রাস্তা দেখাবে? কেউ না। কে আমাকে সঙ্গে করে নিজের ঘরে নিয়ে যাবে। প্রশ্নের জবাব তো কেউ না হতে পারে না। নিশ্চয়ই কেউ।
কে তুমি?
লেখক : কবি
No comments