পাম তেল চাষের সঙ্কট, উত্তরণ এবং আর্থিক মূল্যায়ন by মোহাম্মদ হাফিজুর রহমান খান
পাম তেল চাষে অগ্রগামী দেশের সংখ্যা খুব সীমিত। এ সীমিতসংখ্যক দেশের সবচেয়ে বড় সুবিধা ভূমির প্রাচুর্য। জনসংখ্যার তুলনায় ভূমির আধিক্য হওয়ায় এখনও মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া পাম চাষে ভূমি বরাদ্দ দিতে সক্ষম হচ্ছে। অপরদিকে যেসব দেশ পাম চাষে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনয়নে জাতীয় প্রকল্প গ্রহণ করেছে, যেমন—পাপুয়া নিউগিনি, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ অন্য দেশগুলোর হাজার হাজার হেক্টর অনাবাদি জমি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।
তাই পাম চাষ খাতে প্রয়োজনীয় জমি বরাদ্দ দেয়া ওইসব দেশের সরকারের জন্য খুব সহজ হচ্ছে। আরও সুবিধা তাদের জন্য জাতীয়ভাবে গৃহীত পদক্ষেপের কারণে স্থানীয় এবং বৈদেশিক বিনিয়োগকারী একটা নিয়ম বিধানের মধ্যে নিশ্চিন্তে বিনিয়োগ করতে পারছে।
বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান পাম চাষের জন্য খুবই অনুকূল; কিন্তু ভূমির প্রাচুর্য মোটেই অনুকূল নয়। খাদ্যদ্রব্য এবং শাকসবজি উত্পাদন খাতে বাংলাদেশের সবটুকু জমিই প্রায় সারাবছর নিয়োজিত থাকে। কোনো কারণে কোনো অঞ্চলে রোপিত ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হলে সারাদেশে ঘাটতির চাপ সৃষ্টি হয়। এহেন অবস্থায় দীর্ঘমেয়াদি প্রধান খাদ্যশস্য ছাড়া অন্য কোনো ফসল চাষে জমি বরাদ্দ পাওয়া বাংলাদেশে সম্ভব নয়। পাহাড়ি এলাকায় কিছু জমি বরাদ্দযোগ্য আছে; কিছু চরাঞ্চল আছে তারও কোনো স্থায়িত্বের নিশ্চয়তা নেই। এরকম বাস্তবতায় বাংলাদেশে পাম তেলের চাষ ব্যাপকতা পাওয়া সম্ভব বলে ভাবা যায় না। তবে বাস্তব অবস্থা বিবেচনা করে যদি কোনো পরিকল্পনা প্রণয়ন করা যায় তাহলে অবস্থাটা কেমন দাঁড়ায়, তা নিয়ে কিছু আলোচনা করব। আমাদের প্রতিষ্ঠান ‘গ্রাম প্রজেক্ট’ শহর এবং গ্রামাঞ্চলভিত্তিক ব্যাপক সমীক্ষা চালিয়েছে, যার সার্বিক ফলাফল আমরা প্রকাশ করেছি ১৪ জানুয়ারি ২০০৯ সংখ্যা, দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা; ‘উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় ফসল পাম তেলের চাষ’ নামক প্রবন্ধে। ওই একই সমীক্ষার নিবিড় পর্যবেক্ষণ ফলাফল নিয়ে আজ আলোচনা করব। আলোচনার শুরুতেই আমাদের পরিষ্কার হওয়া দরকার। বাংলাদেশের মোট বার্ষিক ভোজ্যতেলের চাহিদা কত? আমাদের মোট উত্পাদন ক্ষমতা কত এবং আমদানি-রফতানির চিত্রইবা কীরূপ?
বাংলাদেশে বার্ষিক ভোজ্যতেলের মোট চাহিদা ১.৪ মিলিয়ন টন, সূত্র : বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, সৌজন্য----। দেশীয় মোট উত্পাদন ক্ষমতা-২০০৭/০৮ মোট ১,৮৬,৬০০ টন। মোটামুটি ২ লাখ টন। (একই সূত্র হতে প্রাপ্ত তথ্য) চাহিদা ১৪ লাখ টন, উত্পাদন ২ লাখ টন, ঘাটতি ১২ লাখ টন। এ বিশাল ঘাটতির কথা ভাবতে গেলেই চমকে ওঠতে হয়। আরও একটা পরিসংখ্যান একই সঙ্গে উপস্থাপন করতে চাই। পরিসংখ্যান চার্টটি হুবহু এখানে তুলে দিলাম।
Bangladesh-Population growth, Oils and Fats Imports, 2009-2013
Sources : Population growth, Bangladesh Censas, Protection of Imports-MPOC-Dhaka.
(Courtesy : Global Oils and Fats Business Magazine Vol-16. issue-2 (April-June, 2009)
আগামী দিনগুলোতে আমাদের জনসংখ্যা, ভোজ্যতেলের চাহিদা এবং আমদানির পরিমাণ যে ক্রমেই বাড়তে থাকবে তা ওই পরিসংখ্যানটির দিকে দৃষ্টি দিলেই পরিষ্কার বোঝা যায়। অথচ আমাদের নিজস্ব উত্পাদন ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধির কোনো পরিসংখ্যান আমাদের হাতে নেই, বরং বিগত দিনের সঙ্গে তুলনা করলে আমাদের নিজস্ব উত্পাদন ক্রমেই হ্রাস পাওয়ারই ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এমতাবস্থায় আমদানি হ্রাস এবং নিজস্ব উত্পাদন বৃদ্ধির কোনো বাস্তবধর্মী প্রকল্প জাতীয় প্রকল্প হিসেবে গৃহীত হওয়া উচিত। সরকারি ব্যয় খাত খতিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে কত হাজার হাজার কোটি টাকা ভোজ্যতেল আমদানিতে সরকারকে ব্যয় করতে হয়।
আন্তর্জাতিক বাজারে সবচেয়ে কম মূল্যের ভোজ্যতেল পাম তেল, যার মোটামুটি মূল্য ৭০০ ডলার প্রতি টন। আমাদের মোট আমদানির ৭৭ শতাংশই পামতেল, আর মাত্র ২০ ভাগ সয়াবিন তেল। এ অবস্থায় গড় মূল্য ৭০০ ডলার প্রতি টন ধরলে ১২ লাখ ৭০০ ডলার=৮৪ কোটি ডলার। প্রতিবছর সরকারের ব্যয় প্রায় একশ’ কোটি ডলার অত্যন্ত মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা। এই যন্ত্রণাদায়ক ব্যয়ভার থেকে সরকারের মুক্তি পাওয়ার উপায় প্রণয়নেই আমরা নিয়োজিত আছি।
রাষ্ট্রীয় বহু সিদ্ধান্ত জনগণের জন্য যেমন ঐচ্ছিক থাকে, আবার বহু সিদ্ধান্ত বাধ্যতামূলক থাকে। বাস্তবতা হচ্ছে, ঐচ্ছিক তো নয়ই বাধ্যতামূলক বহু সিদ্ধান্ত শতভাগ বাস্তবায়ন অনেকটা দুরূহ আমাদের দেশে। প্রাথমিক শিক্ষা সবার জন্য বাধ্যতামূলক হওয়া সত্ত্বেও তা শতভাগে উন্নীত হওয়ার পথে বহু প্রতিবন্ধকতার মোকাবিলা করতে হচ্ছে। বিনামূল্যে বই, নগদ অর্থ সহায়তাসহ বহু প্রণোদনামূলক ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও মসৃণভাবে তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। সঙ্গত কিছু কারণ থাকলেও পরিকল্পিতভাবে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে মূল প্রকল্পকে। তাই ভোজ্যতেলে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের প্রকল্প প্রথমত বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত। দ্বিতীয়ত, অন্যান্য প্রকল্প বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করে ভুল-ত্রুটি শুধরে বাস্তবায়ন প্রকল্প এগিয়ে নেয়া উচিত।
আমরা এর আগের প্রবন্ধে বলেছিলাম (১৪ জানুয়ারি ২০০৯ দৈনিক আমার দেশ) আমাদের ভূমি সঙ্কটের কারণে বিশেষ কিছু প্রতিষ্ঠানে পাম তেলের চারা রোপণের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। এবার বিস্তারিত বর্ণনার চেষ্টা করব। গ্রাম ও শহরাঞ্চলে অবস্থানগত বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। আমরা আগে শহরাঞ্চলের কথা বলব। আমাদের শহরাঞ্চলে জেলা, বিভাগীয় এবং কেন্দ্রীয় অফিস অথবা দফতরগুলোর অবস্থান। প্রতিটি দফতরের নির্মিত ভবন, নির্মিতব্য ভবনের নকশা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দফতরের মধ্যে চলাচলের রাস্তার ধারে সীমানা প্রাচীরের ধার দিয়ে বহু পাম তেলের চারা রোপণের সুযোগ রয়েছে। শোভাবর্ধনের জন্য ওই সব প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ পাম চারাই রোপণ করেছেন, কিন্তু তেল উত্পাদনক্ষম পাম চারা সেগুলো নয়। তেল উত্পাদনের পাম গাছ একই সঙ্গে শোভাবর্ধনের কাজ যেমন করতে পারে, ভোজ্যতেলও তেমনি উত্পাদন করতে পারে। পুলিশ লাইন, ক্যান্টনমেন্ট, আনসার ক্যাম্প, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং শহরের বহু বাড়ি রয়েছে যেখানে অনেক প্রজাতির শৌখিন গাছ রয়েছে, তার সঙ্গে দুটো পাম গাছ রাখা এমন কঠিন কিছু নয়। শুধু সিটি কর্পোরেশন ও নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ উত্সাহটা তৈরি করে দেবে।
গ্রামাঞ্চলের অন্যতম বিশ্বস্ত পেশার মানুষ শিক্ষক-শিক্ষিকার কথা অন্যান্য পেশার মানুষের তুলনায় বেশি গ্রহণ করে থাকে সাধারণ মানুষ। তাই গ্রামাঞ্চলে আন্দোলনের সূচনা হবে শিক্ষক এবং তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে। একটি উপজেলায় বহু ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই ধরন অনুযায়ী থানা শিক্ষা কর্মকর্তা টিএনও, উপজেলা চেয়ারম্যান ও এসপি সাহেবের কাছে জবাবদিহিতার দায়ে দায়বদ্ধ। তাই উল্লিখিত ব্যক্তিবর্গ পদ্ধতিগত বাধ্যবাধকতার আওতায় ওইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পাম তেলের চারা রোপণের আন্দোলনের সূচনা করতে পারেন। আন্দোলনের সূচনা হবে নিম্নরূপ। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের জন্য ১০ থেকে ৫০টি পাম গাছ লাগানো বাধ্যতামূলক তাদের নিজস্ব ক্যাম্পাসের জন্য। প্রত্যেক শিক্ষক-কর্মচারী কমপক্ষে ২টি করে গাছ লাগাবেন, নিজ বাড়িতে নিজ পরিবারের জন্য। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী কমিটির সব সদস্য কমপক্ষে ২টি করে পাম গাছ লাগাবেন, তাদের নিজ পরিবারের জন্য। অবশ্যই তা বাধ্যবাধকতার আওতায় হতে হবে।
তবে প্রথম পর্বে ঐচ্ছিক একটি পর্ব থাকবে—ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের দ্বারা তাদের অভিভাবকদের উদ্বুদ্ধ করে ১০, ১৫, ২০ অথবা ২৫টি পরিবারকে পরিবারপ্রতি অন্তত ২টি পাম গাছের চারা রোপণে উত্সাহিত করা। দ্বিতীয় পর্বে এ পদক্ষেপটিকে বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। দুটি পর্ব সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারলে আপনাআপনি জনগণের মধ্যে একটা চেতনা তৈরি হবে এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাম চারা রোপণ প্রক্রিয়া চলতে থাকবে।
বাংলাদেশে মোট পরিবারের সংখ্যা মোটামুটি ৪ কোটি। পরিবারপ্রতি গড়ে ২টি পাম গাছের চারা রোপণ নিশ্চিত করতে পারলে মোট ৮ কোটি গাছ হয়। একটি পাম গাছের উত্পাদিত তেল আমাদের দেশে ৪/৫ জনের একটি পরিবারের সারা বছরের ভোজ্য তেলের চাহিদা পূরণে সক্ষম। এমন অবস্থায় আমাদের ঘরের আঙ্গিনায় দুটো করে পাম গাছ রোপণ করলে দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা পূরণ সম্ভব। প্রয়োজন শুধু কার্যকরী এবং ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণ।
বাংলাদেশ রেলওয়ের অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, সিটি কর্পোরেশন এবং বরেন্দ্র উন্নয়ন প্রকল্প এলাকা, পাটকল, কাপড়কল, চিনিকল, ব্যক্তি মালিকানা হোক অথবা সরকারি হোক—এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোর অনেক জমি অকেজো পড়ে রয়েছে, যেখানে পাম তেলের চাষ করলে শুধু জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখাই হবে না, প্রতিষ্ঠানগুলোও আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার বড় সুযোগ পাবে।
লেখক : পরিচালক, পাম প্রজেক্ট, মালোপাড়া, রাজশাহী
No comments