পরাশক্তি পরম শক্তি নয় by মাহমুদ শামসুল হক
সোভিয়েত ইউনিয়নকে বলা হলো আন্তর্জাতিক কমিউনিজমের মহাতীর্থ। সমাজতন্ত্রের প্রতিভূ তো বটেই। সেই ইউনিয়ন সশব্দে ভেঙে পড়ল ১৯৯০ সালে। কারণ শনাক্ত করে তাত্ত্বিকরা বললেন, সমাজতন্ত্রের গতিপথে মার্কসীয় নীতির প্রয়োগ পদ্ধতিতে গলদ জমেছিল। দেখা দিয়েছিল বিস্তর বিচ্যুতি, বিভ্রান্তি এবং বিকৃতি। সেসব পাপের অনিবার্য প্রায়শ্চিত্ত হচ্ছে ভেঙে পড়া। সিমেন্ট ও বালির অনুপাত ঠিক না থাকলে দালানের অবস্থা যা হয়। পুঁজিবাদ প্রস্তুত ছিল।
যথাসময়ে ভেঙে পড়ার লগ্নে বইয়ে দিয়েছে ঝড়ো হাওয়া। অতঃপর ধূলিসাত্! স্মরণকালের ইতিহাসে সম্ভবত এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক সুনামি। কারণ, সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল অন্যতম পরাশক্তি। পুঁজিবাদের বিপরীতে একমাত্র শক্তপোক্ত সমাজতান্ত্রিক দুর্গ। বিশ্বব্যবস্থাকে বদলে দেয়ার জন্য একটি সুচিন্তিত মতবাদের খুঁটিতে দাঁড়িয়ে ছিল যে দুর্গের ভিত। সেটি ধসে পড়া শুধু পতন নয়, এই পরাভবের মধ্য দিয়ে একটি আদর্শের সংঘবদ্ধ জনপদের অদলবদল হয়েছে, উত্পন্ন হয়েছে একটি অভূতপূর্ব মানবসংহতির বুনিয়াদ। ব্যঙ্গার্থে বলা যায়, মাথা গেছে মুকটসমেত; আমসহ ছালা। সোভিয়েত ইউনিয়নের এই মহাপতনের আগে সমাজতন্ত্র ও ধনতন্ত্রের বিরোধ ছাড়া আর কোনো মৌলিক রাজনৈতিক বিরোধ ছিল না দুনিয়ার কোথাও। যে বিরোধ থেকে উত্থিত হয়েছিল দুই পরাশক্তি—সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র। এখন আমেরিকা একক পরাশক্তি। তার বিপরীতে তলোয়ার বা বর্ম নিয়ে দাঁড়ানোর আপাতত কেউ নেই। ফলে পৃথিবী শক্তির একাধিপত্যে যে ভারসাম্য ছিল তা হারিয়েছে। এমনকি সমাজতন্ত্রের ঘোর শত্রুপক্ষের জন্য তা কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডির জের কতদিন বইতে হবে বিশ্বকে তাও অনিশ্চিত।
বলা যেতে পারে এভাবে—সমাজতন্ত্রের বিগ্রহে প্রাণ প্রতিষ্ঠার আগেই তা বিসর্জিত হলো ভলগা নদীর জলে। বিপ্লবীর ছদ্মবেশে কমিউনিজমের সংস্কারবাদী তথা কপট ব্রাহ্মণরা ঢাক বাজাতে বাজাতে সেই অতল জলে ঝাঁপিয়ে পড়লেন নিজেরাও, যা কিছু অর্জন ছিল সব নিয়ে। সমাজতন্ত্রের এই পূজারীরা কমিউনিস্ট হওয়ার চেয়েও পরাশক্তি হয়ে ওঠার চক্রান্তে লিপ্ত ছিলেন। শক্তিসাধনা করতে গিয়ে প্রায় স্থগিত করে ফেলেছিলেন গুণগত বদলে যাওয়ার কাজ। কোকা-কোলার জন্য লাইন ধরেছিল সোভিয়েত তরুণরা, আর বিকিনি পরে সৈকত-যাত্রা শুরু করেছিল রুশ তরুণীরা। অর্থাত্ পেশি বাড়ছিল কিন্তু অন্ত্রে বড় হচ্ছিল ঘা। মনস্তাত্ত্বিক এই পরাজয়ের ফল হলো ভয়াবহ। আমেরিকার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মারণাস্ত্রের প্রতিযোগিতা, স্পেস-ফ্লাইটের কনটেস্ট, চন্দ্রবিজয়ের খাতে অপচয়ের প্রতিযোগিতা দেখে তখনই প্রমাদ গুনেছিলেন অনেকে—সোভিয়েত ইউনিয়নের এই ইস্পাতকাঠামোতে সৃজনশীল সমাজতন্ত্রের প্রাণবায়ু বেশিদিন বাস করবে না। আমেরিকার আধিপত্যবাদী কৌশল সেখানকার সমাজতন্ত্রী পুরোহিতরা। অথচ সশস্ত্র অবস্থায় আফগানিস্তানে হামলে না পড়লে সোভিয়েত ইউনিয়নের কোনোই ক্ষতি হতো না। জোর করে মুরিদ বানানোর জন্য সেখানে অসম যুদ্ধে লিপ্ত হলো সে দেশের সাঁজোয়া বাহিনী। ফলাফল রক্তপাত, আফগানিস্তানে বিপরীত শক্তির অদম্য পাগড়ির উত্থান। বলপ্রয়োগের বিরুদ্ধে এভাবেই মানুষ রুখে দাঁড়ায়। সোভিয়েত নেতৃত্ব আরেক ধাক্কা খেয়েছিল ‘আফগান বিজয়’-এর অনেক আগেই। ১৯৬৮ সালে চেকোশ্লোভাকিয়ায় সমাজতান্ত্রিক সতীত্ব রক্ষা করতে সোভিয়েত সামরিক অভিযানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় সে দেশের সাধারণ মানুষ। চারজন যুবতী এবং একজন যুবক ন্যাংটো হয়ে নেচেছিল সমবেত দর্শকদের সামনে। আগুন দিয়েছিল সোভিয়েত পতাকায়, তাও আবার জাতিসংঘ কার্যালয়ের সামনে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন বিশ্ববাসীর দুঃখের কারণ হয়ে উঠেছে অন্য কারণে। তা হলো, এর অবর্তমানে বিশ্ব এখন একক সিংহের ‘টেরিটরি’। সেই সিংহের নাম আমেরিকা। যে সিংহ বা একক পরাশক্তির ভয়ে কম্পমান কিংবা প্রতিবাদে মুখর এখন দুনিয়ার নানা দেশ ও সম্প্রদায়। ‘জয়ঢাকের ভোদাই’ গোছের মোসাহেবের সংখ্যাও অবশ্য একেবারে কম নেই। যাই হোক, আমেরিকার গা থেকে কথিত গণতন্ত্রের আস্তিন একদম খসে পড়েছে আফগানিস্তান ও ইরাকে থাবা দেয়ার পর। সম্প্রতি ‘মুসলিম মৌলবাদ’ নামের এক বিকট তত্ত্ব দাঁড় করেছেন সে দেশের কূটনীতিকরা এবং বলছেন, গণতন্ত্রকে সারা দুনিয়ায় তাজা করতে হলে এই মৌলবাদকে নির্মূল করতে হবে। প্রথমে টুইন টাওয়ার ধ্বংসের তাদের কথিত নায়ক লাদেনকে ধরার অজুহাতে সশস্ত্র আফগান-যাত্রা। কিন্তু ইরাকের বেলায় কোনো যুক্তি ছিল না। ইরাক তো মৌলবাদী নয়। সেখানে বহুবিবাহ নিষিদ্ধ, নারীর সমান অধিকার স্বীকৃত, আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত। অতঃপর ছুঁতা—ইরাক ‘গণতন্ত্রী’ দুনিয়াকে আঘাত করতে রাসায়নিক অস্ত্রে শান দিচ্ছে। কিন্তু প্রমাণ হলো, অভিযোগ ভিত্তিহীন। আরেক অজুহাত, সাদ্দাম স্বৈরাচারী, গণতন্ত্রের দুশমন। তাকে উত্খাত করে বিশ্বশান্তির বিহিত করতে হবে। কিন্তু ‘গণতন্ত্রের ঋষি’ আমেরিকা আগে এবং এখনও ঢের স্বৈরাচারের একনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে বিরাজমান। পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ কি ‘চারী’ ছিলেন? সবশেষে সুকুমার রায়ের ভাষায় ‘হাতে রইল পেন্সিল’। অর্থাত্ ইরাকের তেল, অতঃপর সেই গল্পের নেকড়ের মতো—‘তুই না বকলেও তোর বাপ বকেছিল’ বলে আমেরিকা থাবা বিঁধাল ইরাকে। এভাবে গণতন্ত্রের তলোয়ার হাতে আমেরিকা ব্যস্ত বিশ্বশাসনে। অন্য দেশের সার্বভৌমত্বকে শ্রদ্ধা করার মেজাজ তাদের আছে কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন অনেকে। যদি তাই হয়, তো সাধারণ বিশ্ববাসীর প্রতিবাদ ছাড়া কিইবা করার আছে? আমেরিকা নিশ্চয়ই তার নীতি বদলাবে, না হলে পাল্টা কোনো বিশ্বব্যবস্থার সম্ভাবনার কথা বিশ্বাস করতেই পারে তার শত্রুপক্ষ। তবে আপাতত একটি শিক্ষা তো আমেরিকা সেভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ঘটনা থেকে নিতেই পারে যে, পরাশক্তি মানে পরম শক্তি নয়।
No comments