স্মরণঃ ইউসুফ আলী চৌধুরী (মোহন মিয়া) by নূর মোহাম্মদ মিয়া
২৬ নভেম্বর ছিল মরহুম ইউসুফ আলী চৌধুরীর ৩৮তম ইন্তেকালবার্ষিকী। ১৯৩৪ সালে ইউসুফ আলী চৌধুরীর উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক জীবনের শুরু আর ১৯৭১ সালে ২৬ নভেম্বর তার সেই কর্মবহুল জীবনের সমাপ্তি। তখন তার বয়স ২৭/২৮ বছর হবে। ফরিদপুর আঞ্জুমান ইসলামের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মরহুম ইউসুফ আলী চৌধুরী।
মরহুম মৌলভী তমিজউদ্দিন খান ও মোহন মিয়া ছিলেন ফরিদপুরের এ যুগে মুসলিম জাগরণের অগ্রদূত। তত্কালীন কংগ্রেসের আচরণে মরহুম তমিজউদ্দিন খান বাধ্য হলেন কংগ্রেস পরিত্যাগ করতে। তাই তারা বেছে নিলেন এক নতুন পথ। সে পথ হলো অবহেলিত মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করার পথ। সে পথ হলো মুসলমানদের সচেতন করার পথ। ১৯৩৬ সালে ফরিদপুর জেলা মুসলিম ছাত্র সম্মেলনের আয়োজন করা হলো। কাজী নজরুল ইসলাম, গোলাম মোস্তফা ও আব্বাস উদ্দীন এই সম্মেলনে যোগদান করেন। সম্মেলনের আয়োজনের সব অর্থ মোহন মিয়া বহন করলেন। নজরুলকে দাওয়াত করার জন্য তিনি আমাকে কলকাতা নিয়ে গেলেন। মেহমানদের খাওয়া-দাওয়ার ভার সবই তিনি গ্রহণ করলেন। এমনই ছিল তার উদারতা। ফরিদপুরের জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান খান বাহাদুর আলীমুজ্জামান চৌধুরী, সিআইই’র মৃত্যুর পর তিনি নিজেই জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান হতে পারতেন। কিন্তু তমিজউদ্দিন খানকে আপ্রাণ চেষ্টা করে তিনি ফরিদপুর জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান করলেন। মোহন মিয়ার কোনো পদের নেশা ছিল না। তিনি বহু বছর ফরিদপুর জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি চেয়ারম্যান হয়েই ফরিদপুর জেলা বোর্ডের দুটি বেড করেছিলেন ফরিদপুর যাত্রা হোম হাসপাতালে। ফরিদপুরের একজন প্রতিভাশালী ছাত্রের সর্বপ্রথম চিকিত্সা হলো এই বেডে। আল্লাহ তাকে এমন ভাগ্য দান করেন, গভর্নর থেকে রাস্তার কুলি পর্যন্ত তাকে দেখত সম্মানের চোখে। ন্যায় কথা বলতে তিনি কখনও ভয় করতেন না। বঙ্গীয় ব্যবস্থাপনা পরিষদের সদস্য হিসেবে তার ছিল তুলনাবিহীন প্রভাব। সব মন্ত্রীই তাকে দেখতেন অতি সম্মানের চোখে। মন্ত্রিত্ব ভাঙা-গড়ার অধিকার যেন ছিল ‘মোহন মিয়ারই’। ছোট একটি দ্বিতল বাড়িতে তিনি তার জীবনের শেষ দিনগুলো কাটিয়েছেন। মৃত্যুর পর সেই ৮১নং মাহুতটুলীতে তার মরদেহ করাচি থেকে এনে রাখা হয়। রাজনীতি ক্ষেত্রে নূরুল আমিন সাহেবের সঙ্গে তার মতানৈক্য হওয়ার পর থেকে তিনি ভিন্ন দল গঠন করেন। পরে আবার দেশের স্বার্থসংরক্ষণের জন্য সব নেতাকে ও রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে তিনি ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি গঠন করেন। সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান যখন রাউন্ড টেবিল সম্মেলন আহ্বান করেন তখন তিনি তার দল নিয়ে রাওয়ালপিণ্ডিতে যান। তিনি সরকারিভাবে এ সম্মেলনে অবশ্য যোগদান করেননি। তার জীবনের বিশেষ করে ক’টি লক্ষ্য ছিল। পাকিস্তানের এ অংশের স্বার্থ বিশেষ করে মুসলমানদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হোক—এটি তিনি কিছুতেই বরদাশত করতে পারতেন না। তত্কালীন গভর্নর মোনায়েম খানের সঙ্গে তার ভীষণ মতানৈক্য ছিল এবং এর ফলে তাকে নানাভাবে বিব্রত হতে হয়। তদানীন্তন সরকার তাকে বিভিন্ন উপায়ে ক্ষতিগ্রস্ত করতে চেষ্টা করে। কিন্তু মোহন মিয়া কখনও অন্যায়ের কাছে নতি স্বীকার করেননি। জীবনের প্রথম থেকে শেষদিন পর্যন্ত তিনি দুর্দম সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন। তিনি জীবনে কখনও আত্মবিশ্বাস হারাননি। আল্লাহর ওপর ছিল তার বড় তাওয়াক্কাল এবং আল্লাহ তাকে ইজ্জতের সঙ্গে এই পার্থিব জগত থেকে তুলে নিয়েছেন। বাংলাদেশের ভাঙা-গড়ার ইতিহাসে মোহন মিয়ার অবদান ছিল অপরিসীম।
No comments