রথ দেখা এবং কলাবেচা by সঞ্জীব চৌধুরী
সপ্তাহ দুয়ের কিছু বেশি হয় চিকিত্সার জন্য ভারতে কয়েকদিন কাটিয়ে দেশে ফিরেছি। শুধু কলকাতা গিয়েছি এবং চিকিত্সা নিয়েছি বললে পুরোটা বলা হবে না। এবারের ভারত সফরে আমি বুদ্ধগয়ায় গিয়েছিলাম। সেই সুযোগে একদিন গয়ায় গিয়ে বাবাসহ প্রয়াত আত্মীয়-স্বজনের আত্মার শান্তি প্রত্যাশায় পিণ্ড দিয়ে এসেছি।
বুদ্ধগয়ায় যাওয়ার প্রেরণা যুগিয়েছিলেন আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী ভদন্ত শুদ্ধানন্দ মহাথের। তিনি বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের সভাপতি এবং ঢাকাস্থ ধর্মরাজিক বৌদ্ধ মহাবিহারের অধ্যক্ষ। বুদ্ধগয়ায় ভারত সরকার বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘকে একখণ্ড জমি দিয়েছে। জমিটি হস্তান্তরের সময় ছিল নিচু জলাভূমি। দেশ-বিদেশের নানাজনের দানের টাকায় এ জলাভূমি ভরাট করা হয়েছে। নির্মিত হয়েছে সুন্দর হলঘর। সেখানে স্থাপিত হয়েছে বুদ্ধমূর্তি। এখনও অনেক কাজ বাকি। তবে প্রাচীরবেষ্টিত বাংলাদেশ টেম্পল এখনই দৃষ্টি আকর্ষণ করছে তীর্থযাত্রী ও পর্যটকদের। প্রতিবছর এই মন্দিরে প্রতিটি বৌদ্ধ পার্বণ সাড়ম্বরে উদযাপিত হয়। এসব অনুষ্ঠানের মধ্যে কঠিন চীবরদান উত্সব হয় সবচেয়ে বর্ণাঢ্য। এবছর বাংলাদেশ টেম্পলে এ উত্সবের তারিখ নির্ধারিত হয়েছিল ২৯ অক্টোবর। সে উপলক্ষে আমার বুদ্ধগয়ায় যাওয়া।যাত্রীসেবায় নিবেদিত শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসটি ছাড়লো এক ঘণ্টা দেরি করে। যাত্রী মোট ৫ জন। জানলাম ভিসার কড়াকড়ির জন্য যাত্রীর সংখ্যা কমে গেছে। আমার দেশ-এর বেনাপোল প্রতিনিধি রিপনের উষ্ণ আতিথেয়তা ও সহযোগিতায় আপ্লুত হয়ে ঠিকমত সীমান্ত পার হওয়া গেল। কিন্তু ওপারে নির্ধারিত বাসটির কিছুদূর (অন্তত ৮ কিলোমিটার) গিয়ে আবার ফিরে আসা, আমাদের অন্য বাসে তুলে দেয়া, পথে পথে অনেক ঝগড়াঝাটি ইত্যাদি পেরিয়ে যখন নির্ধারিত স্থানে (নিউমার্কেটের পেছনটায়) বাস থেকে নামলাম তখন ভারতীয় সময় অনুসারে বেশ রাত হয়ে গেছে।
পরদিন রাজধানী এক্সপ্রেস ট্রেনে হাওড়া থেকে গয়ায় যাওয়া ছিল মুগ্ধ হওয়ার মতো স্মৃতি। হাওড়া স্টেশনে গিয়ে দেখি শুদ্ধানন্দ মহাথেরসহ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের কয়েকজন নেতৃস্থানীয় সদস্যও একই ট্রেনে গয়ায় যাচ্ছেন। ট্রেন ছাড়ার পর তিন দফায় খাবার পরিবেশিত হলো। প্রথম দফায় হরেক রকম স্ন্যাক্সসহ চা অথবা কফি, দ্বিতীয় দফায় টোস্ট আর স্যুপ পরিপাকযন্ত্রকে সক্রিয় করার জন্য এবং তৃতীয় দফায় রাজসিক ডিনার। এদের সার্ভিস এত চমত্কার যে, দূরপাল্লার বিমান যাত্রাকেও হার মানায়। আমার বার্থের পাশে স্থান হয়েছিল কৈশোরোত্তীর্ণ এক অবাঙালি ভারতীয় দম্পতির। তারা পারিপার্শ্বিকতাকে উপেক্ষা করে আদরে-সোহাগে পরস্পর এমন মগ্ন হয়ে পড়েছিলেন যে, মনে হচ্ছিল চোখের সামনে হিন্দি সিরিয়াল দেখছি। আমাদের যাত্রা নির্বিঘ্ন ও আরামপ্রদ হলেও ঘণ্টাখানেক বিলম্বিত হয়েছিল স্বাভাবিকের চেয়ে। পরে জেনেছি, ওই দিন ভুবনেশ্বর থেকে দিল্লিগামী রাজধানী এক্সপ্রেসটিতে মাওবাদীদের হামলা হয়েছিল। মাওবাদীরা রেললাইনের ওপর বড় গাছ ফেলে চালককে গাড়ি থামাতে বাধ্য করে। এর ফলে সৃষ্ট অচলাবস্থার পরোক্ষ প্রভাব পড়েছিল আমাদের রেলগাড়ির ওপর। তারপরও যাত্রা হলো শেষ। আমরা পা রাখলাম গয়া স্টেশনে। সেখানে বাংলাদেশ টেম্পলের আবাসিক ভিক্ষুরা অপেক্ষা করছিলেন। তাদের সঙ্গে দেখা না হওয়ায় আমি এবং আরও একজন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। তারপরও আমাদের চলন্ত অটোরিকশা থামানোর জন্য একদল ছিনতাইকারীর ব্যর্থ চেষ্টার বিষয়টি বাদ দিলে আমরা সে রাতে নিরাপদেই বুদ্ধগয়ায় পৌঁছে বাংলাদেশ টেম্পল সংলগ্ন এক হোটেলে উঠতে পেরেছিলাম।
বুদ্ধগয়া সারাবিশ্বে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অত্যন্ত পবিত্র তীর্থস্থান। রাজপুত্র সিদ্ধার্থ গৌতম মানুষের কষ্ট দেখে বিচলিত হয়ে সত্য অনুধাবনের জন্য একা বেরিয়ে পড়েছিলেন রাজপ্রাসাদ ছেড়ে। বছরের পর বছর তিনি নানা স্থানে ঘুরেছেন, সাধনা করেছেন। অবশেষে এখানে এসে নীরঞ্জনা নদীর তীরে এক অশ্বত্থ গাছের নিচে তিনি ধ্যানস্থ হন এবং বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে গভীর রাতে সত্যের সন্ধান পান। পরমজ্ঞান অর্থাত্ বোধি অর্জন করেছিলেন বলে তিনি হয়ে গেলেন বুদ্ধ। যে গাছের নিচে বসে তিনি বোধিলাভ করেছিলেন সেটাকে বলা হয় বোধিবৃক্ষ। আড়াই হাজার বছর আগের সেই বোধিবৃক্ষটি এখন নেই। তবে একই জায়গায় রোপিত এবং বেড়ে ওঠা বর্তমান বোধিবৃক্ষটিও অনেক প্রাচীন। এই বোধিবৃক্ষ ঘেঁষে অবস্থিত মহাবোধি মন্দির। সম্রাট অশোকের আমলে নির্মিত প্রাচীন মন্দিরটি কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। তবে সেই একই আদলে গড়ে তোলা হয়েছে নতুন মন্দিরটি। আমি ২৮ অক্টোবর সকাল বেলা যখন মহাবোধি মন্দিরে পৌঁছি তখন বিভিন্ন দেশের তীর্থযাত্রীর সমাবেশে পূর্ণ ছিল মন্দির চত্বর। মূল মন্দিরে ঢুকে আমার মনে পড়ে গেল, নিরাকার পরমব্রহ্মে বিশ্বাসী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই মন্দিরে এসে বুদ্ধমূর্তির সামনে প্রণত হয়েছিলেন। বুদ্ধবন্দনা করে নীরবে দাঁড়িয়ে ছিলাম কিছুক্ষণ। সেখান থেকে বেরিয়ে মন্দির ঘুরে গিয়ে বসলাম বোধিবৃক্ষের সামনে। বিভিন্ন দেশের আরো কয়েকজন তীর্থযাত্রী সেখানে নীরবে উপবিষ্ট ছিলেন। সেখানে বসে আমি যেন কেমন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেলাম। মানব কল্যাণে মহাকারুণিক বুদ্ধের কঠোর সাধনাস্থলে আমি বসে আছি। ‘সকল সত্তা সুখী হোক’—বুদ্ধের এই অমীয় বাণী ছাড়া আর সবকিছু সে সময় আমার কাছে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছিল। কতক্ষণ এভাবে ছিলাম জানি না। আমার ঘোর ভাঙল কর্কশভাবে মোবাইল ফোন বেজে ওঠায়। চোখ মেলে দেখি বোধিবৃক্ষের নিচে বুদ্ধপূজা চলছে। সামনে বসে আছেন কয়েকজন ভক্ত। যে ভিক্ষু অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করছেন তিনি নিজের মোবাইল ফোনটি সঙ্গে আনতে ভুলেননি। সেটার আওয়াজই আমাদের সচেতন করে তুলেছিল ইহজগত সম্পর্কে।
পরদিন বাংলাদেশ টেম্পলে কঠিন চীবরদান উত্সবে ছিল উপচেপড়া ভিড়। বুদ্ধগয়া এখন এক সমৃদ্ধ তীর্থ স্থান এবং পর্যটন কেন্দ্র। ভারত সরকারের কাছ থেকে জমি ইজারা নিয়ে প্রায় প্রতিটি বৌদ্ধ প্রধানদেশ এখানে মন্দির নির্মাণ করেছে। প্রতিটি মন্দির কমপ্লেক্সে আছে তীর্থযাত্রীদের থাকার সুবিধা। পাশাপাশি আছে বিভিন্ন মানের আবাসিক হোটেল। বুদ্ধগয়ার আবহাওয়া চরমভাবাপন্ন। তাই শরত্ থেকে বসন্তকাল পর্যন্ত পর্যটকদের আগমন ঘটে বেশি। অন্যসময় গরমের জ্বালায় সেখানে তিষ্ঠানো দায় হয়ে পড়ে। যাই হোক, বাংলাদেশ টেম্পল যে প্রতিবছর বাঙালি বৌদ্ধদের এমন মিলনমেলায় পরিণত হয় সে দৃশ্য না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। আমি দেখলাম, বাংলাদেশ থেকে কয়েকশ’ তীর্থযাত্রী তো এসেছেনই, সেই সঙ্গে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসকারী অনেক বাঙালি বৌদ্ধ এসেছেন সপরিবারে। ত্রিপুরা, দুর্গাপুর, আহমদাবাদ, দিল্লি, চণ্ডীগড়, অন্ধ্র প্রদেশসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা বৌদ্ধ পরিবারের সঙ্গে পরিচয় হলো। তারা যে শুধু বেড়াতে এসেছেন তাই নয়, স্বেচ্ছায় হাসিমুখে শ্রম দিচ্ছেন দিনের পর দিন; রান্নাবান্নার আয়োজন থেকে সব কিছুতেই তাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। এসব পরিবার ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমল থেকে ভারতের বাসিন্দা। শুনলাম তারা প্রতিবছর চেষ্টা করেন কঠিন চীবরদান উত্সবে বুদ্ধগয়ায় আসার জন্য। সেখানে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ টেম্পল আত্মীয় মিলনের যে সুযোগ সৃষ্টি করেছে তাতে তারা ভীষণ খুশি। প্রতিবছর এমন ২/৪টি ঘটনা ঘটে যে, দীর্ঘদিন পর ভারতীয় ও বাংলাদেশী নিকটাত্মীয়দের সঙ্গে দেখা হয়। কেউ কাউকে ঠিকমত চিনেন না। একপর্যায়ে পরিচয় হয়, তখন জড়িয়ে ধরে হাউমাউ কান্না, সে এক বিরল দৃশ্য। আমি এবার এমন দু’জন ছেলেকে দেখেছি তারা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় দূরে থাকুক, শুদ্ধ বাংলাও বলতে পারে না। কিন্তু তাদের শেকড় যে চট্টগ্রামে এ সত্য তারা ভুলেনি। প্রতি বছর এখানে আসে নাড়ির টানে।
কঠিন চীবরদান অনুষ্ঠানে উত্তোলন করা হয় ভারত এবং বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিরোধের ঊর্ধ্বে ওঠে সাধারণ মানুষের মধ্যে মিলনের সেতু রচনাকারী বাংলাদেশ টেম্পল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলেই আজ ভারতের বিহার রাজ্যের বুদ্ধগয়ায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের পতাকাও উড়ছে। তবে একটা তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা না বললেই নয়। বুদ্ধগয়ার কনভেনশন হচ্ছে, সেখানে কোনো মন্দিরে কঠিন চীবরদান উত্সব হলে অন্যসব মন্দিরের ভিক্ষুদের আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং তারা আসেন। বাংলাদেশ টেম্পল ছাড়াও বুদ্ধগয়ায় ভারতীয় বাঙালি বৌদ্ধদের পরিচালনায় দুটি মন্দির কমপ্লেক্স আছে। বাংলাদেশ টেম্পলের কঠিন চীবরদান উত্সবে সব দেশের মন্দিরের প্রতিনিধিরা এসেছিলেন, শুধু ভারতীয় বাঙালি বৌদ্ধদের পরিচালিত মন্দির দুটি থেকে একজনও আসেননি। পরে জেনেছি, বাংলাদেশ টেম্পলের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক একেবারেই শীতল। বুঝলাম, বুদ্ধগয়ায় ধর্ম-কর্ম করতে এসেও বাঙালি আপন চরিত্র বিসর্জন দিতে রাজি নয়।
No comments