প্রজাপতি নবান্ন-উৎসব by মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান
১৬ নভেম্বর ২০০৯। প্রায় সব পত্রিকাতেই বেশ ঘটা করে ছাপা হয়েছে নবান্ন উত্সবের রং-বেরংয়ের শহুরে ছবি। কিছু কিছু পত্রিকার প্রথম পাতার একেবারে শীর্ষ সংবাদ ওটি। রঙিন ছবি- রঙিন শিরোনাম আর ফুর্তির রং তো ঝলক দিচ্ছে ছবিতে, শিরোনামে খবরের বিবরণে। আগের রাতে টিভিতে দেখলাম ‘পদক-পাদক’ও দেয়া হচ্ছে।
যাই হোক, ১৬ তারিখের দৈনিক জনকণ্ঠের প্রথম পাতার ছবিটা দেখে হঠাৎ চোখের কোণে পানির অস্তিত্ব অনুভব করলাম। অথচ ছবিটা ছিল উল্লাসের। বহু বিচিত্র বসনে-ভূষণে, রঙে-চঙে, হাস্যে-লাস্যে উদ্ভাসিত কয়েকজন রমণী একে অপরের মুখে অন্ন তুলে দিচ্ছেন। বড় পুলকিত চিত্র। দেখতে দেখতে তাদের কথা মনে পড়ল—যারা এই অন্ন উত্পন্ন করেন, যারা জন্মগ্রহণ করেন পৈতৃক সূত্রে পাওয়া মহাজনের ঋণ কাঁধে নিয়ে, মৃত্যুবরণ করেন ছেলের ঘাড়ে সেই ঋণ চাপিয়ে দিয়ে। এখানে অবশ্য ‘মৃত্যুবরণ’ শব্দটির ব্যবহার অতি বেমানান হয়ে গেছে; বরং বলা যায়, রোগে-শোকে, অনাহারে-অপুষ্টিতে ভুগে, বিনা চিকিত্সায় ‘প্যাট্ করে মরে যায়’ ছেলের ঘাড়ে দাফন-কাফনের আর এক ঝামেলা চাপিয়ে। আর রোদ-বৃষ্টি, ঝড়-ঝঞ্ঝা, খরা-বন্যার সঙ্গে লড়াই করে কাটিয়ে যায় পরাজিত জীবন। আমারই লেখা নবান্ন বিষয়ক একটি গানের কয়েকটি পঙিক্ত মনে পড়ে গেল—‘ধান বিকিয়ে ফিরবে স্বামী
এবার আবার দেখব আমি
শোধ হয়েছে মহাজনের দেনা,
হয়নি আমার নাকের নোলক কেনা।...’ (শিল্পী আবিদা সুলতানা, সুর সুজেয় শ্যাম)
এসব প্রজাপতি রঙা অনুষ্ঠানের আয়োজকরা দয়া করে একবার কৃষকদের পাড়াগাঁয়ে যাবেন কি এই অঘ্রানে? দেখে আসবেন কি, কোন কৃষক পরিবার কপালে টিপ, কমলা বা সোনালি বা ধানি রং শাড়ি পরে চুলে ফুলের মালা বা গুচ্ছ ঝুলিয়ে ‘নেত্য-গীত’ করছেন? সাহস আছে? থাকলে যান না, দশ-বার কোটি কৃষক পরিবারে গিয়ে নিরন্ন মুখে মুখে এক লোকমা অন্ন তুলে দিয়ে আসুন। যদি না থাকে, বন্ধ করুন এই প্রহসন-কৃষকদের প্রতি এই উপহাস। আমার দৃঢ়বিশ্বাস, শিল্পী এসএম সুলতানের স্বপ্নের কৃষকদের একজনও যদি বাস্তবে থাকতেন, তবে তিনি বল্লম বাগিয়ে তেড়ে আসতেন এসব নাচাল ধৃষ্টতার দিকে। আর এই প্রহসনে অংশগ্রহণকারীরা আতঙ্কে মুখ লুকিয়ে বলে উঠতেন—‘এ-মা-কি অসভ্য চাষা!’
ব্রিটিশ অধনীস্থ বাংলায় ‘কোলকেতে’ বাবু কালচারের উত্থানের যুগে, ব্রিটিশ প্রভুর অতি অনুগত দাসমানসিকতার বাবুদের হাতে এসব অনুষ্ঠানের জন্ম প্রভুর মনোরঞ্জনার্থে। সাম্রাজ্যবাদী প্রজাপীড়ক ব্রিটিশদের শাসনে কৃষকরা কত ‘পুলকে’ আছে তা তুলে ধরার জন্য। মনে পড়ে, পরম শ্রদ্ধায় মনে পড়ে, আমার এক শিক্ষকের কথা। যশোর এমএম কলেজের বাংলার অধ্যাপক শ্রী ননী গোপাল দাস। উনি অবশ্য ‘শ্রী’ শব্দটাও লিখতেন না নিজের নামের আগে। আমরা তো ‘স্যার’ বলেই সম্বোধন করতাম। ‘স্যার’ শব্দটাও তার পছন্দের ছিল না। নেহায়েতই কলেজের শৃঙ্খলার কারণে তিনি মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু তার কোনো সহকর্মী বা বহিরাগত কেউ যখন তাকে ‘ননীবাবু’ বলে ডাকতেন, তখন ক্ষেপে যেতেন তিনি। বলতেন, “আমি ‘বাবু’ নই ‘দাস’। আমার বাপ-ঠাকুরদারাও দাসত্বই করেছে, ফিরিঙ্গির পা চেটে বাবু হয়নি।” এমনিতে, ব্রিটিশ শাসনে এদেশী কেরানিকুলকে বাবু বলা হতো। হেড ক্লার্ক বা বড় বাবু হতে পারাটা তখন শিক্ষিত বাঙালি হিন্দুদের জন্য ছিল সম্মানের সপ্তাকাশ স্পর্শের মতো। এই উভয় বাবু সম্প্রদায়ের সন্তান-সন্ততি এবং তাদের আনুকূল্যধন্যরাই এখনও বহন করে চলেছে সংস্কৃতির নামে এসব ভণ্ডামি। এর পুরোটাই কৃত্রিম। আসল বা আদির কোনো ছিটেফোঁটাও এর মধ্যে নেই। নেই, যাদের নামের মুখোশ পরে, এসব উত্সব, সেই প্রকৃত বা প্রাকৃতজনের কোনো অংশগ্রহণ। ‘কোলকেতে’ বাবুদের পদরেণু মস্তিষ্কে বহনকারী এদেশী কিছু মোসাহেবদের মাঝে মাঝেই বড় বড় বাড়ন্ত হয়। মাঝে মাঝে আবার দেশ ছেড়ে পালিয়ে প্রভুদের পদপ্রান্তে আশ্রিত হয়। একটি বিষয়ে আমি বিন্দুমাত্র-দ্বিধাহীনভাবে নিশ্চিত, তা হলো শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গ থেকে গ্রহণ করার মতো আজ আমাদের কিছুই নেই। কারণ পশ্চিমবঙ্গে বাংলা সংস্কৃতি সম্পূর্ণভাবে তার স্বাতন্ত্র্য বিচ্যুত। ভারতীয়, বিশেষ করে হিন্দি সংস্কৃতির করালগ্রাসে সাগ্রহে ঢুকে যেতে যেতে, সাপের ছেড়ে যাওয়া খোলসের মতো, খোলসটুকুই অবশিষ্ট আছে মাত্র। সে প্রসঙ্গে পরে লিখব। নবান্ন প্রসঙ্গেই আসি।
এদেশে কি নবান্ন উত্সব কখনোই ছিল না? ছিল। তবে এই প্রজাপতি উত্সব নয়। এদেশের কৃষকদের হাতে যখন তার উত্পাদিত ফসলের স্বত্ব ছিল তখন ফসল ওঠার পর তারা নানা ধরনের আনন্দ-উত্সব করতেন, পিঠাপুলি বানাতেন, গান-বাজনাও করতেন। লুটেরা আর্যরা এদেশে অভিযান চালিয়ে যখন থেকে তাদের ফসল লুটে নিয়ে যাওয়া ও অবশিষ্ট ফসলে অগ্নিসংযোগ করে ধ্বংস সাধন শুরু করে, তখন থেকে উত্সব পরিণত হয় মাতমে। এরপর বাদশাহী আমলে বা সম্রাটদের আমলে তাদের অনুগ্রহধন্য ছোট ছোট রাজন্যরা; এবং আরও পরে ব্রিটিশ আমলে সৃষ্টি হওয়া জমিদার শ্রেণী কৃষকের ভূমি অধিকার গ্রাস করে। ফসলের মালিক হয় তারা। নবান্ন অনুষ্ঠান চলে যায় তাদের হাতে। উত্পাদনকারী কৃষক সেখানে অসহায় দর্শকমাত্র। এই রাজন্য বা জমিদারদের কেউ কেউ শহরে বসবাস শুরু করে। ইংরেজ আমলে এসব বাঈজী নাচানো জমিদার বাবুদের আনুকূল্যেই বাবু কালচারের জন্ম। এদের দ্বারাই নবান্ন উত্সব হয়ে যায় শহুরে প্রজাপতি উত্সব। জমিদারি প্রথা পতনের ভেতর দিয়ে জন্ম হয় নব্যধনিক ও মহাজন শ্রেণীর। কৃষক আরও বেশি করে পরিণত হন ভূমিদাসে। আজও সে অবস্থাই চলছে। গ্রামে-গঞ্জে যে ছিটেফোঁটা নবান্ন উত্সব হয়, সেখানে হা-অন্ন কৃষক অসহায় দর্শকমাত্র। আর শহুরে তথাকথিত ‘কোলকেতে’ ভাবাদর্শ-প্রাণিত প্রজাপতিরা নবান্ন-উত্সবের নামে যা করে তা অন্ন উত্পাদনকারী কৃষকদের সাথে এক তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয়।
লেখক : কবি, গীতিকার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments