উত্তাল জাবি - প্রক্টরিয়াল বডিকে পদত্যাগের আলটিমেটাম
জাকারিয়া পলাশ, জাবি থেকে: জাবি ছাত্র জুবায়ের হত্যার বিচার দাবিতে উত্তাল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
পৃষ্ঠা ১৭ কলাম ৪
। গতকাল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ভবনের সামনের হাজার হাজার সাধারণ শিক্ষার্থী ও শিক্ষক প্রতিবাদ জানাতে মিলিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় দিবসকে প্রতিবাদ দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দিয়েছে শিক্ষক মহল। নিহত ইংরেজি বিভাগের ছাত্র ও ছাত্রলীগ কর্মী জুবায়ের আহমেদের খুনিদের সহযোগী ও ইন্ধনদাতাদের আজীবন বহিষ্কার ও আইনের আওতায় এনে বিচারসহ প্রক্টর ও নিরাপত্তা কর্মকর্তার পদত্যাগের দাবি করেছে তারা। বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ মেডিকেল ও পর্যাপ্ত এম্বুলেন্স দেয়ার দাবিও তুলে ধরে তারা।
আন্দোলনের জন্য গতকাল ক্লাস বর্জন করে মিছিলে নেমে আসে বিভিন্ন হল ও বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা। মিছিল করে তারা সকাল ১০টায় প্রশাসনিক ভবনে অবস্থান নেয়। এসময় সেখানে মোতায়েন করা দু’শতাধিক পুলিশ তাদের বাধা দিতে এসে গণজোয়ারের চাপে পিছু হটতে বাধ্য হয়। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ শিক্ষক সমাজ ও শিক্ষক সমিতির ব্যানারে শতাধিক শিক্ষক আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ দেন। এসময় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক এএ মামুন, সাধারণ সম্পাদক গণিত বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শরিফ উদ্দিন, নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মানস চৌধুরী, অধ্যাপক নাসিম আক্তার হোসাইন, দর্শন বিভাগের অধ্যাপক আনোয়ারুল্লাহ ভূঁইয়া, অধ্যাপক ফাহমিদা আহমেদ, ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক এটিএম আতিকুর রহমান, পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক এনামুল্লাহ পারভেজ, পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক এমএ মতিন বক্তব্য রাখেন। তারা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে দোষীদের শাস্তি দাবির পাশাপাশি আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রক্টরিয়াল বডিকে পদত্যাগের আলটিমেটাম দেয়। এসময় অধ্যাপক নাসিম আক্তার হোসাইন বলেন, আগামী ১২ তারিখ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় দিবস কিন্তু আমাদের প্রিয় ছাত্রের এ হত্যার বিচার না হলে আমরা কোন মতেই ‘বিশ্ববিদ্যালয় দিবস’ পালন করতে পারি না।
আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সব শিক্ষার্থী নোংরা রাজনীতির কারণে ক্যাম্পাস ছাড়া হয়েছে তাদের নিরাপত্তা দিয়ে ক্যাম্পাসে থাকার ব্যবস্থা করতে প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান শিক্ষকরা। ক্যাম্পাসে পুলিশ মোতায়েন করে শৃঙ্খলা বিধানের চেষ্টা না করে গণতান্ত্রিকভাবে সবার মতামত প্রকাশের ও অধিকার নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন তারা। এসময় প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি নোটিশের মাধ্যমে আগের দিন এক বছরের জন্য বহিষ্কার হওয়া তিন ছাত্রকে আজীবন বহিষ্কারের কথা জানানো হয়। আন্দোলনকারী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা এ বহিষ্কারাদেশকে প্রশাসনের ছলনাপত্র বলে ছিঁড়ে ফেলে দেয়। এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ও ইন্ধনদাতা সকলের পরিচয় প্রকাশ করে বিচারের আওতায় আনতে তারা দাবি জানায়। তারা দুপুর ১২টা পর্যন্ত প্রশাসন ভবনে অবস্থান করে। আজ আবারও মৌন মিছিল ও মানববন্ধনের কর্মসূচি নিয়েছে আন্দোলনকারীরা।
ছাত্রলীগের অবস্থান
ক্যাম্পাসের এ ঘটনায় ছাত্রলীগের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। গতকাল সকালে বিভিন্ন হলের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদেরকে ভয়ভীতি দেখিয়ে মিছিলে আসতে বাধ্য করে। তারা জুবায়ের হত্যার জন্য বিএনপি ও জামায়াত দায়ী বলে স্লোগান তোলে। এ ব্যাপারে ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক গোলাম রব্বানী বলেন, ভূতের মুখে রাম নাম শুনে অবাক হই। অধ্যাপক নাসিম আক্তার হোসাইন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় একটি মুক্ত চিন্তা চর্চার কেন্দ্র। এখানে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে সন্ত্রাসী রাজনীতিতে বাধ্য করা অগণতান্ত্রিক ও ন্যক্কারজনক। অন্যদিকে ছাত্রলীগের স্থগিত কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্ঝর আলম সাম্য বলেন, জুবায়ের ছাত্রলীগের একজন একনিষ্ঠ কর্মী ছিল। তাকে বর্তমান উপাচার্যের পালিত ছাত্রলীগ নামধারী সন্ত্রাসী বাহিনীর ক্যাডাররা হত্যা করেছে। এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে প্রশাসনের ইন্ধন আছে বলে তিনি দাবি করেন।
‘আমার ছেলাটারে ফিরাইয়া দাও’
শরিফুল হক শাহীন, কলাপাড়া থেকে জানান, কলাপাড়ার কৃতী সন্তান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ফাইনাল ইয়ারের মেধাবী ছাত্র জুবায়ের আহমেদের (২১) নির্মম হত্যাকাণ্ডে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে, শোকে নীরব গোটা পরিবার। গতকাল দুপুর একটার দিকে কলাপাড়া পৌর শহরের মদিনাবাগ এলাকার বাড়িতে গেলে দেখা যায়- আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশীসহ এলাকার বিভিন্ন স্তরের মানুষের উপস্থিতিতে পুরো বাড়িতে শোকের মাতম। ঘরের ভেতরে শোনা যাচ্ছিল কান্নার শব্দ। জুবায়েরের মা হাসিনা আহমেদ ছেলের কথা বলে বিলাপ করছিলেন। পাশে গিয়ে বসতেই বলল, ‘আমার ছেলাটারে আমার কোলে ফিরাইয়া দাও। আমি অরে দেখতে চাই। অরে ছাড়া ক্যামনে থাকমু।’
কথা প্রসঙ্গে জুবায়েরের মা আরও বললেন, ‘শনিবার দিন অর লগে ফোনে শেষ বারের মতো কথা কইছি। তহনও আমারে কইছে, মা আমার লাইগ্যা দোয়া কইরো। ও চইল্যা যাইবে বুইজ্যাইকি আমার কাছে দোয়া চাইছে।’ এভাবে একের পর এক কথা বলে মূর্ছা যাচ্ছিলেন।
জুবায়ের আহমেদের পিতা নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তোফায়েল আহমেদ বলেন, আমি সঠিক ও নিরপেক্ষ তদন্ত সাপেক্ষে এ হত্যাকাণ্ডের দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই। সে সঙ্গে এ কথাও বলবো আর কতো হত্যাকাণ্ড হলে পরে দেশের শিক্ষাঙ্গনসহ সর্বক্ষেত্রে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরে আসবে, তারও জবাব চাই।
তার পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, জুবায়ের আহমেদ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। রোববার তার লিখিত পরীক্ষা শেষ হয়েছে। পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে নিজ হলে ফেরার পথে ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার একটি গ্রুপের ক্যাডাররা তাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। ওইসব সন্ত্রাসী তার ওপর শারীরিক নির্যাতন চালিয়ে এক পর্যায়ে হাত-পায়ের রগ কেটে দেয়। সহপাঠী বন্ধুরা খবর পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পরিত্যক্ত স্থান থেকে মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে প্রথমে সাভারের এনাম হাসপাতালে এবং পরে গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে নিয়ে যান। সোমবার সকালে তার মৃত্যু হয়।
কে এই জুবায়ের?
জুবায়ের আহমেদের বাড়ি কলাপাড়া পৌর শহরের মদিনাবাগ এলাকায়। তার পিতা নৌবাহিনীর চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন। মা হাসিনা আহমেদ গৃহিণী। দুই ভাইয়ের মধ্যে সে ছিল ছোট। একমাত্র বড় ভাই মামুন সিলেটের লিডিং বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রভাষক। খেপুপাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে সে ২০০৫ সালে বিজ্ঞান বিভাগে ৪.৮৮ পেয়ে এসএসসি পাস করেছেন। খেপুপাড়া মোজাহার উদ্দিন বিশ্বাস কলেজ থেকে ২০০৭ সালে বাণিজ্য বিভাগে তিনি ৪.৯০ পেয়ে এইচএসসি পাস করেছেন। এরপর তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। এলাকায় তিনি ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না থাকলেও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর ছাত্রলীগ রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।
জুবায়েরের শিক্ষকদের বক্তব্য
খেপুপাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. সাহাদাত হোসেন বিশ্বাস বলেন, আমি এ বিদ্যালয়ে ২০০৪ সালে প্রধান শিক্ষক হিসেবে জয়েন করি। ওই সময় দেখলাম অসম্ভব মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও জুবায়ের লেখাপাড়ার পরিবর্তে খেলাধুলার দিকে ঝোঁক বেশি। আমার পারিবারিক সম্পর্কের কারণে তাকে লেখাপড়ার দিকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করতে থাকি। সে যে যাত্রা শুরু হয়েছে তারপর থেকে সে ক্রমান্বয়ে ভাল রেজাল্ট করতে থাকে।
খেপুপাড়া মোজাহার উদ্দিন বিশ্বাস কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল অধ্যাপক নূর বাহাদুর তালুকদার বলেন, মেধাবী ছাত্র জুবায়েরকে কখনও ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থকতে দেখিনি। নম্র, ভদ্র ও সবার সঙ্গে খুব অল্প সময়ের মধ্যে সে মিশতে পারতো। খুব ভাল ছেলে ছিল।
সহপাঠী ও বন্ধুদের বক্তব্য
জুবায়েরের সহপাঠী মো. আল আমীন বলেন, এলাকায় লেখাপড়া করা অবস্থায় সে ছিল অত্যন্ত ভদ্র জুবায়ের যে কোন প্রকার রাজনৈতিক বিরোধে জড়াতে পারে এটা আমরা কল্পনাও করতে পারিনি। আমরা তাকে নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি করছি। জুবায়েরের বন্ধু খায়রুল হাসান খালিদ বলেন, জুবায়ের ছিল খুব ভাল বন্ধু। আমরা তার হত্যাকারীদের বিচার চাই।
জুবায়েরের লাশের সঙ্গে আসা জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যায়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী নাজমুল হোসেন বলেন, জুবায়ের ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আলোকিত মুখ। আজ তাকে গোপালগঞ্জ কেন্দ্রীক ছাত্রলীগের রাজনীতির কারণে হত্যার শিকার হতে হলো। এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের ফাঁসি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির পদত্যাগ দাবি করছি।
প্রতিবেশীদের বক্তব্য
ঊম্মুলকুরা কিন্ডারগর্টেন স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপাল মো. আবু সালেহ বলেন, জুবায়েরের পিতা ও আমি এক সময় একই স্কুলে চাকরি করতাম। বর্তমানেও আমরা একই এলাকায় বসবাস করি। খুব ভাল ছেলে ছিল জুবায়ের। কারও সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ করেছে এমনটা কখনও শোনা যায়নি।
জুবায়েরের নামাজে জানাযা
মঙ্গলবার সকালে কলাপাড়া পৌর শহরের মদিনাবাগ ও এতিমখানা জামে মসজিদ মাঠে দু’দফা তার নামাজে জানাযা শেষে পৌর কবরস্থানে দাফন করা হয়।
জুবায়ের হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে কর্মসূচি
জুবায়ের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ ও হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে কলাপাড়া প্রেসক্লাবের সম্মুখে স্থানীয় বিদ্যালয়গুলোর ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, সুধীজন, রাজনৈতিক নেতা মিলে মানববন্ধন, কালোব্যাজ ধারণ ও প্রতিবাদসভা অনুষ্ঠিত হয়। মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন নিহত জুবায়েরের পিতা তোফায়েল আহমেদ, কলাপাড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, খেপুপাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. শাহাদাত হোসেন বিশ্বাস প্রমুখ। হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবিতে জুবায়েরের বন্ধুমহল পৌর শহরের বিভিন্ন স্থানে পোস্টার লাগিয়েছে।
পৃষ্ঠা ১৭ কলাম ৪
। গতকাল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ভবনের সামনের হাজার হাজার সাধারণ শিক্ষার্থী ও শিক্ষক প্রতিবাদ জানাতে মিলিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় দিবসকে প্রতিবাদ দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দিয়েছে শিক্ষক মহল। নিহত ইংরেজি বিভাগের ছাত্র ও ছাত্রলীগ কর্মী জুবায়ের আহমেদের খুনিদের সহযোগী ও ইন্ধনদাতাদের আজীবন বহিষ্কার ও আইনের আওতায় এনে বিচারসহ প্রক্টর ও নিরাপত্তা কর্মকর্তার পদত্যাগের দাবি করেছে তারা। বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ মেডিকেল ও পর্যাপ্ত এম্বুলেন্স দেয়ার দাবিও তুলে ধরে তারা।
আন্দোলনের জন্য গতকাল ক্লাস বর্জন করে মিছিলে নেমে আসে বিভিন্ন হল ও বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা। মিছিল করে তারা সকাল ১০টায় প্রশাসনিক ভবনে অবস্থান নেয়। এসময় সেখানে মোতায়েন করা দু’শতাধিক পুলিশ তাদের বাধা দিতে এসে গণজোয়ারের চাপে পিছু হটতে বাধ্য হয়। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ শিক্ষক সমাজ ও শিক্ষক সমিতির ব্যানারে শতাধিক শিক্ষক আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ দেন। এসময় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক এএ মামুন, সাধারণ সম্পাদক গণিত বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শরিফ উদ্দিন, নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মানস চৌধুরী, অধ্যাপক নাসিম আক্তার হোসাইন, দর্শন বিভাগের অধ্যাপক আনোয়ারুল্লাহ ভূঁইয়া, অধ্যাপক ফাহমিদা আহমেদ, ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক এটিএম আতিকুর রহমান, পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক এনামুল্লাহ পারভেজ, পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক এমএ মতিন বক্তব্য রাখেন। তারা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে দোষীদের শাস্তি দাবির পাশাপাশি আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রক্টরিয়াল বডিকে পদত্যাগের আলটিমেটাম দেয়। এসময় অধ্যাপক নাসিম আক্তার হোসাইন বলেন, আগামী ১২ তারিখ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় দিবস কিন্তু আমাদের প্রিয় ছাত্রের এ হত্যার বিচার না হলে আমরা কোন মতেই ‘বিশ্ববিদ্যালয় দিবস’ পালন করতে পারি না।
আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সব শিক্ষার্থী নোংরা রাজনীতির কারণে ক্যাম্পাস ছাড়া হয়েছে তাদের নিরাপত্তা দিয়ে ক্যাম্পাসে থাকার ব্যবস্থা করতে প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান শিক্ষকরা। ক্যাম্পাসে পুলিশ মোতায়েন করে শৃঙ্খলা বিধানের চেষ্টা না করে গণতান্ত্রিকভাবে সবার মতামত প্রকাশের ও অধিকার নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন তারা। এসময় প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি নোটিশের মাধ্যমে আগের দিন এক বছরের জন্য বহিষ্কার হওয়া তিন ছাত্রকে আজীবন বহিষ্কারের কথা জানানো হয়। আন্দোলনকারী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা এ বহিষ্কারাদেশকে প্রশাসনের ছলনাপত্র বলে ছিঁড়ে ফেলে দেয়। এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ও ইন্ধনদাতা সকলের পরিচয় প্রকাশ করে বিচারের আওতায় আনতে তারা দাবি জানায়। তারা দুপুর ১২টা পর্যন্ত প্রশাসন ভবনে অবস্থান করে। আজ আবারও মৌন মিছিল ও মানববন্ধনের কর্মসূচি নিয়েছে আন্দোলনকারীরা।
ছাত্রলীগের অবস্থান
ক্যাম্পাসের এ ঘটনায় ছাত্রলীগের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। গতকাল সকালে বিভিন্ন হলের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদেরকে ভয়ভীতি দেখিয়ে মিছিলে আসতে বাধ্য করে। তারা জুবায়ের হত্যার জন্য বিএনপি ও জামায়াত দায়ী বলে স্লোগান তোলে। এ ব্যাপারে ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক গোলাম রব্বানী বলেন, ভূতের মুখে রাম নাম শুনে অবাক হই। অধ্যাপক নাসিম আক্তার হোসাইন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় একটি মুক্ত চিন্তা চর্চার কেন্দ্র। এখানে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে সন্ত্রাসী রাজনীতিতে বাধ্য করা অগণতান্ত্রিক ও ন্যক্কারজনক। অন্যদিকে ছাত্রলীগের স্থগিত কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্ঝর আলম সাম্য বলেন, জুবায়ের ছাত্রলীগের একজন একনিষ্ঠ কর্মী ছিল। তাকে বর্তমান উপাচার্যের পালিত ছাত্রলীগ নামধারী সন্ত্রাসী বাহিনীর ক্যাডাররা হত্যা করেছে। এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে প্রশাসনের ইন্ধন আছে বলে তিনি দাবি করেন।
‘আমার ছেলাটারে ফিরাইয়া দাও’
শরিফুল হক শাহীন, কলাপাড়া থেকে জানান, কলাপাড়ার কৃতী সন্তান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ফাইনাল ইয়ারের মেধাবী ছাত্র জুবায়ের আহমেদের (২১) নির্মম হত্যাকাণ্ডে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে, শোকে নীরব গোটা পরিবার। গতকাল দুপুর একটার দিকে কলাপাড়া পৌর শহরের মদিনাবাগ এলাকার বাড়িতে গেলে দেখা যায়- আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশীসহ এলাকার বিভিন্ন স্তরের মানুষের উপস্থিতিতে পুরো বাড়িতে শোকের মাতম। ঘরের ভেতরে শোনা যাচ্ছিল কান্নার শব্দ। জুবায়েরের মা হাসিনা আহমেদ ছেলের কথা বলে বিলাপ করছিলেন। পাশে গিয়ে বসতেই বলল, ‘আমার ছেলাটারে আমার কোলে ফিরাইয়া দাও। আমি অরে দেখতে চাই। অরে ছাড়া ক্যামনে থাকমু।’
কথা প্রসঙ্গে জুবায়েরের মা আরও বললেন, ‘শনিবার দিন অর লগে ফোনে শেষ বারের মতো কথা কইছি। তহনও আমারে কইছে, মা আমার লাইগ্যা দোয়া কইরো। ও চইল্যা যাইবে বুইজ্যাইকি আমার কাছে দোয়া চাইছে।’ এভাবে একের পর এক কথা বলে মূর্ছা যাচ্ছিলেন।
জুবায়ের আহমেদের পিতা নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তোফায়েল আহমেদ বলেন, আমি সঠিক ও নিরপেক্ষ তদন্ত সাপেক্ষে এ হত্যাকাণ্ডের দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই। সে সঙ্গে এ কথাও বলবো আর কতো হত্যাকাণ্ড হলে পরে দেশের শিক্ষাঙ্গনসহ সর্বক্ষেত্রে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরে আসবে, তারও জবাব চাই।
তার পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, জুবায়ের আহমেদ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। রোববার তার লিখিত পরীক্ষা শেষ হয়েছে। পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে নিজ হলে ফেরার পথে ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার একটি গ্রুপের ক্যাডাররা তাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। ওইসব সন্ত্রাসী তার ওপর শারীরিক নির্যাতন চালিয়ে এক পর্যায়ে হাত-পায়ের রগ কেটে দেয়। সহপাঠী বন্ধুরা খবর পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পরিত্যক্ত স্থান থেকে মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে প্রথমে সাভারের এনাম হাসপাতালে এবং পরে গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে নিয়ে যান। সোমবার সকালে তার মৃত্যু হয়।
কে এই জুবায়ের?
জুবায়ের আহমেদের বাড়ি কলাপাড়া পৌর শহরের মদিনাবাগ এলাকায়। তার পিতা নৌবাহিনীর চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন। মা হাসিনা আহমেদ গৃহিণী। দুই ভাইয়ের মধ্যে সে ছিল ছোট। একমাত্র বড় ভাই মামুন সিলেটের লিডিং বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রভাষক। খেপুপাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে সে ২০০৫ সালে বিজ্ঞান বিভাগে ৪.৮৮ পেয়ে এসএসসি পাস করেছেন। খেপুপাড়া মোজাহার উদ্দিন বিশ্বাস কলেজ থেকে ২০০৭ সালে বাণিজ্য বিভাগে তিনি ৪.৯০ পেয়ে এইচএসসি পাস করেছেন। এরপর তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। এলাকায় তিনি ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না থাকলেও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর ছাত্রলীগ রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।
জুবায়েরের শিক্ষকদের বক্তব্য
খেপুপাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. সাহাদাত হোসেন বিশ্বাস বলেন, আমি এ বিদ্যালয়ে ২০০৪ সালে প্রধান শিক্ষক হিসেবে জয়েন করি। ওই সময় দেখলাম অসম্ভব মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও জুবায়ের লেখাপাড়ার পরিবর্তে খেলাধুলার দিকে ঝোঁক বেশি। আমার পারিবারিক সম্পর্কের কারণে তাকে লেখাপড়ার দিকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করতে থাকি। সে যে যাত্রা শুরু হয়েছে তারপর থেকে সে ক্রমান্বয়ে ভাল রেজাল্ট করতে থাকে।
খেপুপাড়া মোজাহার উদ্দিন বিশ্বাস কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল অধ্যাপক নূর বাহাদুর তালুকদার বলেন, মেধাবী ছাত্র জুবায়েরকে কখনও ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থকতে দেখিনি। নম্র, ভদ্র ও সবার সঙ্গে খুব অল্প সময়ের মধ্যে সে মিশতে পারতো। খুব ভাল ছেলে ছিল।
সহপাঠী ও বন্ধুদের বক্তব্য
জুবায়েরের সহপাঠী মো. আল আমীন বলেন, এলাকায় লেখাপড়া করা অবস্থায় সে ছিল অত্যন্ত ভদ্র জুবায়ের যে কোন প্রকার রাজনৈতিক বিরোধে জড়াতে পারে এটা আমরা কল্পনাও করতে পারিনি। আমরা তাকে নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি করছি। জুবায়েরের বন্ধু খায়রুল হাসান খালিদ বলেন, জুবায়ের ছিল খুব ভাল বন্ধু। আমরা তার হত্যাকারীদের বিচার চাই।
জুবায়েরের লাশের সঙ্গে আসা জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যায়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী নাজমুল হোসেন বলেন, জুবায়ের ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আলোকিত মুখ। আজ তাকে গোপালগঞ্জ কেন্দ্রীক ছাত্রলীগের রাজনীতির কারণে হত্যার শিকার হতে হলো। এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের ফাঁসি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির পদত্যাগ দাবি করছি।
প্রতিবেশীদের বক্তব্য
ঊম্মুলকুরা কিন্ডারগর্টেন স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপাল মো. আবু সালেহ বলেন, জুবায়েরের পিতা ও আমি এক সময় একই স্কুলে চাকরি করতাম। বর্তমানেও আমরা একই এলাকায় বসবাস করি। খুব ভাল ছেলে ছিল জুবায়ের। কারও সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ করেছে এমনটা কখনও শোনা যায়নি।
জুবায়েরের নামাজে জানাযা
মঙ্গলবার সকালে কলাপাড়া পৌর শহরের মদিনাবাগ ও এতিমখানা জামে মসজিদ মাঠে দু’দফা তার নামাজে জানাযা শেষে পৌর কবরস্থানে দাফন করা হয়।
জুবায়ের হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে কর্মসূচি
জুবায়ের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ ও হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে কলাপাড়া প্রেসক্লাবের সম্মুখে স্থানীয় বিদ্যালয়গুলোর ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, সুধীজন, রাজনৈতিক নেতা মিলে মানববন্ধন, কালোব্যাজ ধারণ ও প্রতিবাদসভা অনুষ্ঠিত হয়। মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন নিহত জুবায়েরের পিতা তোফায়েল আহমেদ, কলাপাড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, খেপুপাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. শাহাদাত হোসেন বিশ্বাস প্রমুখ। হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবিতে জুবায়েরের বন্ধুমহল পৌর শহরের বিভিন্ন স্থানে পোস্টার লাগিয়েছে।
No comments