চট্টগ্রামে সংস্কৃতিচর্চা by এবনে গোলাম সামাদ
ভাষাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে একটি জাতির জাতীয় সংস্কৃতি। ষোড়শ শতাব্দী থেকে মুসলমান লেখকরা বাংলায় তাদের সাহিত্য রচনা শুরু করেন। এর আগেও তারা বাংলায় সাহিত্যচর্চা করতেন। তবে তার পরিচয় আমাদের কাছে এখনও সেইভাবে এসে পৌঁছেনি। তবে একটা কথা বিশেষভাবে বলতে হয়, তা হলো খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর আগে কোনো বাংলা সাহিত্যের পরিচয় পাওয়া যায় না।
চর্যাপদের ভাষা বাংলা কিনা, তা নিয়ে আছে যথেষ্ট বিতর্ক। যে ভাষাকে আমরা বাংলা বলি, তার পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে ১৪০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে, বড়ু চণ্ডিদাসের লেখায়। আর মুসলিম বাংলা সাহিত্যিকদের সুনির্দিষ্ট পরিচয় আমরা পাচ্ছি ষোড়শ শতাব্দী থেকে, যা নিয়ে ভাষা সাহিত্যের ইতিহাস রচকদের মধ্যে কোনো বিতর্ক নেই। প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের আলোচনায় চট্টগ্রাম অঞ্চলের নাম বিশেষভাবেই আসে। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে চট্টগ্রামের পরগলপুর নিবাসী কবি সৈয়দ সুলতান লিখেছেন তিনটি বই : ১. জ্ঞান প্রদীপ, ২. নবী বংশ ও ৩. শবে মেরাজ। শবে মেরাজ আসলে হলো নবী বংশ বইটির সূচনা অংশ। নবী বংশ বইতে আছে বারজন নবীর জীবন কাহিনী। সৈয়দ সুলতানের শিষ্য হলেন মোহাম্মদ খান। ইনি ‘মক্তুল হোসেন’ নামে একখানি কাব্যগ্রন্থ লিখেন। কাব্যের বিষয় কারবালার করুণ কাহিনী। বইটিকে সাহিত্যের ইতিহাস রচকরা যথেষ্ট মূল্য দিয়ে থাকেন। তাদের মতে এটি একটি উচ্চমানের কাব্যগ্রন্থ। মোহাম্মদ খান ছিলেন চট্টগ্রামের অধিবাসী। চট্টগ্রামের সঙ্গে লাগোয়া দেশ হলো আরাকান। আরাকানের রাজসভায় একসময় হতে পেরেছে বাংলা ভাষা সাহিত্যের চর্চা। সপ্তদশ শতাব্দীতে আরাকানে আবির্ভূত হন দৌলত কাজী ও আলাওলের মতো কবি। এরা কাব্য রচনা করেছেন বাংলায়। কিন্তু বাংলা লিখেছেন আরবি-ফারসি বর্ণমালায়, বাংলা অক্ষরে নয়। একসময় চট্টগ্রাম ও আরাকান অঞ্চলে আরবি-ফারসি বর্ণমালায় বাংলা লেখা হতো, বাংলা অক্ষরে নয়। চট্টগ্রামের মানুষ যে বাংলা ভাষায় কথা বলেন, ধ্বনিগতভাবে (চযড়হবঃরপ) তা প্রচলিত বাংলা থেকে অনেক আলাদা। যদিও এই বাংলা ভাষা গঠনগতভাবে (গড়ত্ঢ়যড়ষড়মু) সাধারণ বাংলা ভাষার অনুরূপ। কিন্তু সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম ও সংলগ্ন অঞ্চলের সাহিত্যিকরা তাদের আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করেননি। করেছেন সাধু বাংলার ব্যবহার। সেটা বিস্ময়কর। চট্টগ্রামে সাধু বাংলার মাধ্যমে সাহিত্যচর্চা হয়েছে আরাকানের রাজসভায়। ধারণা করা যায়, চট্টগ্রাম থেকে বাংলা ভাষার একটা প্রভাব সাহিত্যের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে পেরেছিল সাবেক বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। যেটা হতে পেরেছে আমাদের সংস্কৃতির কাঠামো। চট্টগ্রাম ও তত্সংলগ্ন অঞ্চলকে বাদ দিয়ে আমাদের ভাষা সাহিত্যের ইতিহাস আলোচনা করা যায় না। আলোচনা করা যায় না সাধারণভাবেই আমাদের সংস্কৃতির ইতিহাসকে নিয়ে। ক’দিন আগে ‘চট্টগ্রাম সংস্কৃতি কেন্দ্র’র আমন্ত্রণে আমি গিয়েছিলাম চট্টগ্রামে। এই সংস্কৃতি কেন্দ্রের মাধ্যমে চট্টগ্রামে গড়ে উঠতে পারছে একটা সত্ সাংস্কৃতিক আন্দোলন, যার কথা দেশবাসী যথেষ্ট অবগত নন। এরা সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক নিয়ে নতুন কিছু করার চেষ্টা করছেন। যাকে গোটা দেশেরই উচিত স্বাগত জানানো। তারা বিশেষ আঙ্গিকে কাব্যনাট্য লিখছেন এবং করছেন অভিনয়। তারা সঙ্গীত রচনা করছেন আর করছেন সেই সঙ্গীতের প্রচার। তারা দেশের নানা সমস্যা নিয়ে করছেন আলোচনা। ব্যাপকভাবে যাকে বলা যায় সংস্কৃতিচর্চারই অঙ্গ। তারা দু’বছর পর পর দেশের বিভিন্ন শক্তিধর বুদ্ধিজীবীকে করছেন পুরস্কৃত। যেটা হয়ে উঠেছে তাদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের বিশেষ অংশ।একটি দেশের সংস্কৃতি কোনো একটি বিশেষ গোষ্ঠীর চেষ্টায় গড়ে ওঠে না। বহু মানুষের প্রবর্তনা এসে যুক্ত হয় এর সঙ্গে; কিন্তু সব দেশেই সাংস্কৃতিক আন্দোলনে বিভিন্ন গোষ্ঠী রেখেছে তাদের মূল্যবান অবদান। চট্টগ্রাম সংস্কৃতি কেন্দ্র, মনে হয় এরকম অবদান রাখতে সক্ষম হতেই পারে। দেশের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছে ঢাকা। কিন্তু এই সংস্কৃতিচর্চার সবটুকুকে সত্ বলে অভিহিত করা যায় না। আমরা সেই সংস্কৃতিকে সত্ বলে মনে করতে পারি, যা আমাদের সমাজ বন্ধনকে দৃঢ় হতে সাহায্য করে। নিয়ন্ত্রিত করে আমাদের হেয় বৃত্তিগুলোকে। সেই সংস্কৃতিকে আমরা শ্রেয় বলে মনে করি, যা আমাদের মনকে আনন্দিত করে, কিন্তু তাকে উদ্দাম প্রবৃত্তির মধ্যে নিয়ে যেতে চায় না। যাকে বলে বাণিজ্যিক সংস্কৃতি, তার মধ্যে কোনো মহত্ আদর্শ সম্পৃক্ত হয়ে নেই। তা আমাদের মনকে কোনো না কোনোভাবে আমোদ প্রদান করে; তার বেশি কিছু করে না। তা করে না আমাদের চিত্তের পরিশ্রুতি বিধান। সঙ্গীতচর্চার ক্ষেত্রে এমন সঙ্গীত আছে যা মানুষের চারিত্রিক অধঃপতন ঘটাতে পারে। সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রে তাই সাবধান হওয়ার প্রয়োজনীয়তা আছে। আধুনিক মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, সংস্কৃতিকে বিচার করতে হবে দু’দিক থেকে। সংস্কৃতিকে বিচার করতে হবে তার আনন্দমূল্য (চষবধংঁত্ব-াধষঁব) দিয়ে। কিন্তু আনন্দমূল্যই সব কথা নয়। বিচার্য হতে হবে মানব জীবনে তার প্রভাব (ওহভষঁবহপব-াধষঁব) কীভাবে পড়ছে তা দিয়েও। চট্টগ্রামে গিয়ে মনে হলো, চট্টগ্রাম সংস্কৃতি কেন্দ্র সংস্কৃতির প্রভাবমূল্যকেও দিচ্ছে বিশেষ বিবেচনা। দেশের সব সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানকেই এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। যে সংস্কৃতি মানুষকে করে তুলতে চায় উচ্ছৃঙ্খল, করে তুলতে চায় যৌন বিকারগ্রস্ত, সেই সংস্কৃতিকে প্রশ্রয় দেয়া যায় না। চট্টগ্রামে গিয়ে আমি দেখলাম, যারা আমাকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়েছিলেন, তারা এই বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন। চট্টগ্রামে ঘুরে আমার মনে চট্টগ্রামের ইতিহাসের অনেক কথাই জাগল। জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম থেকে ঘোষণা করেছিলেন স্বাধীনতা। ঢাকা থেকে কেউ এটা করতে পারেননি। চট্টগ্রামের রাজনৈতিক পরিবেশ ছিল এমন যে, তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করতে উত্সাহ পেয়েছিলেন। ঢাকার কোনো মেজর এই উত্সাহ পাননি। তারা কেউ ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে দেননি স্বাধীনতার ঘোষণা।
বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার নিয়ে এখনও যথেষ্ট গবেষণা হয়নি। সাধারণভাবে মনে করা হয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার শুরু হয়। আর সেটা শুরু হতে পারে মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির সামরিক অভিযানের মাধ্যমে। কিন্তু মনে করার কারণ আছে যে, চট্টগ্রাম ও বাংলাদেশের সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে এর অনেক আগেই ইসলাম প্রচার শুরু হতে পেরেছিল আরব বণিকদের মাধ্যমে। চট্টগ্রাম ও সমুদ্র উপকূলবর্তী বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ইসলাম ছড়িয়ে পড়েছিল বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। চট্টগ্রামে আছে বাবা বদরের দরগা। এই বদর কে ছিলেন তা আমরা জানি না। আরবি ভাষায় বদর মানে পূর্ণিমার চাঁদ। আজকের পৃথক রাষ্ট্র বাংলাদেশ গঠিত হতে পেরেছে প্রধানত বাংলাভাষী মুসলমানের সংগ্রামের ফলে। এর মূলে যেমন ভাষা, তেমনি আবার কাজ করে চলেছে ইসলামী মূল্যবোধ। চট্টগ্রামে ইসলামী মূল্যবোধ বিশেষভাবেই বিরাজমান সেখানকার মানুষের মধ্যে। এক্ষেত্রেও আমাদের ঐতিহ্যের একটা শিকড় হয়তো খুঁজে পাওয়া যায় চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষের মধ্যে।
চট্টগ্রামের ভৌগোলিক পরিবেশ বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে ভিন্ন। এখানে ছিল অনেক মাটির পাহাড় (টিলা) এবং এখনও আছে যার অনেকখানি অবশিষ্ট। কিন্তু টিলা কেটে করা হচ্ছে নগরায়ন, যা দিচ্ছে সাবেক চট্টগ্রামের ভৌগোলিক প্রকৃতিকে অনেক ভিন্ন করে। চট্টগ্রামের পশ্চিমে সমুদ্র। কর্ণফুলী মোহনায় অনেকদিন আগে থেকেই গড়ে উঠতে পেরেছিল সমুদ্র বন্দর। এই পরিবেশে একসময় যেখানে হতে পেরেছে বাংলা ভাষা সাহিত্যের চর্চা। আর সেখান থেকে তার প্রভাব ছড়াতে পেরেছে অন্যত্র। এই ইতিহাসও ভাবতে বিচিত্র মনে হয়। সমুদ্রপথে চট্টগ্রাম অঞ্চলের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হতে পেরেছিল ইরানের সঙ্গে। ফারসি ভাষা সাহিত্যের একটা বিশেষ প্রভাব তাই পড়তে পেরেছিল এই অঞ্চলে। ফারসি লাইলী-মজনু কাহিনীনির্ভর করে চট্টগ্রাম নিবাসী কবি বাহারাম খান বাংলা ভাষায় রচনা করেন লাইলী-মজনু কাব্য। বাংলা ভাষায় লাইলী-মজনু নিয়ে যারা কাব্য রচনা করেছেন বাহারাম খানকে সাধারণত ধরা হয় তাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। ইনি সম্রাট আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে তাঁর কাব্যগ্রন্থটি রচনা করেন। বাংলা সাহিত্যে মুসলমান কবিরা একটি নতুন জিনিস যোগ করেন, যা হিন্দু লেখকরা দিতে পারেননি। তা হলো, ধর্মনিরপেক্ষ প্রণয়মূলক কাব্য কাহিনী।
ইংরেজরা প্রথমে চায়নি কলকাতা অঞ্চলে ঘাঁটি গাড়তে। তারা দখল করতে চেয়েছিল চট্টগ্রাম বন্দর ও তার সংলগ্ন এলাকা। কিন্তু পর্তুগিজরা অনেক আগেই এই অঞ্চলের দখল নিয়ে ফেলে। পর্তুগিজদের সঙ্গে নৌ-যুদ্ধে হারে ইংরেজরা। ইংরেজরা পরে ঘাঁটি গড়ে কলকাতায়। ইংরেজ আমলে কলকাতা শহর হয়ে ওঠে বাংলা ভাষা সাহিত্যের কেন্দ্র। কিন্তু আগে সে তা ছিল না।
পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান সংখ্যায় বেশি ছিলেন না। কলকাতা শহরকে ঘিরে যে সাহিত্য-সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে তার সুযোগ তারা সেভাবে নিতে পারেনি। শিক্ষা-দীক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বাংলাভাষী মুসলমানের পিছিয়ে যাওয়ার এটা ছিল একটা বড় কারণ। ১৯৪৭ সালে ও তার আগে তদানীন্তন বাংলা প্রদেশের সব শহরেই থাকতে দেখা যায় হিন্দুর সংখ্যাগরিষ্ঠতা। একমাত্র চট্টগ্রাম শহরই ছিল ব্যতিক্রম। চট্টগ্রামের মুসলমানরা সওদাগরী কাজকর্মে ছিলেন বেশ এগিয়ে। নজরুল জন্মেছিলেন পশ্চিমবঙ্গে। কিন্তু তিনি কবি হিসেবে বিশেষভাবে আদ্রিত হন চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামের মানুষ তাই নজরুলের স্মৃতিতে স্থাপন করেছেন নজরুল মঞ্চ। সেরকম মঞ্চ বাংলাদেশের আর কোথাও নেই। এটাও তাঁদের সংস্কৃতি চেতনার বিশেষ পরিচয়বহ। নজরুলের বিখ্যাত কবিতা চক্রবাক, বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি, চট্টগ্রামে বসে লেখা।
মনে হচ্ছে ঢাকা নয়, চট্টগ্রাম থেকেই ছড়িয়ে পড়তে পারে বাংলাদেশের অন্যত্র সত্ সংস্কৃতি গড়ার আন্দোলন। কারণ এখানে এমন কিছু মানুষের সঙ্গে আমার পরিচয় হলো, যাদের বিত্ত আছে, আর আছে সেই সঙ্গে চিত্ত। সংস্কৃতি বিকাশের ক্ষেত্রে বিত্ত ও চিত্ত—উভয়েরই প্রয়োজন হয়।
যদিও ঢাকাতেই চলেছিল জোর রাজনৈতিক আন্দোলন। কিন্তু ২৫ মার্চের পর ঢাকা হয়ে পড়েছিল মুহ্যমান। কিংকতর্ব্য
বিমূঢ়। চট্টগ্রামের কিছু মানুষ এ সময় এগিয়ে এসেছিলেন সাহসে ভর করে। আর তারা অনুপ্রাণিত করেছিলেন তরুণ মেজর জিয়াকে। আর এই ইতিহাসকে মনে হয় মহলবিশেষ বিকৃত করতেই চাচ্ছে।
No comments