সরকার কোম্পানি না কৃষকের পক্ষে?-ঝলক বীজ by রুদ্র মাসুদ
খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর দায় কৃষকের। সারের দাবি করলে প্রাণও দিতে হবে কৃষককেই। আর্থিক সংকটের কথা বলে কাটছাঁট নামের কাঁচিটিও চলে কৃষকের ভর্তুকির ওপর। ক্ষমতার রাজনীতি আর ভোটের বাজারেও কৃষকের কদর কম নয়। একটু আগ বাড়িয়ে, বর্তমান সরকার আবার নিজেদের কৃষকবান্ধব সরকার বলে দাবি করে। কৃষকের জন্য কেন্দ্র থেকে প্রান্ত পর্যন্ত জিগির তোলার প্রবণতাও নতুন কিছু নয়।
কিন্তু কৃষক আর কৃষি নিয়ে বাজারের মানদণ্ডে সরকারের অবস্থান বণিকের না কৃষকের পক্ষে সেই প্রশ্ন ইতিপূর্বে উঠেছে বলে মনে পড়ে না। প্রশ্নটি উঠেছে 'সফল কৃষিমন্ত্রী' আর 'কৃষকবান্ধব' সরকারের জমানায়। চিরায়ত নিয়ম অনুযায়ী সরকার হয়তো এই প্রশ্নের জবাব দেবে না; তবে আমাদের কৃষক সমাজ ঠিকই এ প্রশ্নটির জবাব জানে। হাইব্রিড ধান 'ঝলকের' বীজ বিপর্যয়ের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি, সরকার আসলেই বণিকের পক্ষে।
সরকার টাকা দিয়েও জনগণের জন্য খাদ্য কিনতে পারেনি, এটি বেশি দিনের ঘটনা নয়। তদারকি সরকারের সময়ে সারাদেশে ডিজেল ভর্তুকির টাকা বিতরণ, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর কৃষকের মাঝে বিশেষ কার্ড প্রদান, ১০ টাকায় ব্যাংক হিসাব খুলে সেখানে ভর্তুকির টাকা পেঁৗছে দেওয়াসহ আরও কত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। এসব কিছুরই মূল হচ্ছে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো। আমাদের নিজস্ব জাত, এমনকি দেশের কৃষি বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত নানা উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান বীজ বাদ দিয়ে বিদেশ থেকে বহুজাতিক কোম্পানির মাধ্যমে হাইব্রিড জাতের বীজ নিয়ে আসা হয় উৎপাদন বাড়ানোর নাম করে। সরকারের রাতারাতি উৎপাদন বাড়ানোর তৎপরতায় মওকা পেয়ে যায় বীজ বেনিয়ারা। বেশ ক'বছর ধরেই দেশের বড় বড় গ্রুপ অব কোম্পানি বীজের ব্যবসা চালিয়ে আসছে। তাদের হাত ধরেই এ বছর 'ঝলক' নামে আরেকটি বীজ বাজারে আসে। নানা অর্জন থাকলেও একটি কথা প্রায়ই শোনা যায়_ আমরা হুজুগে বাঙালি। সেই হুজুগকে কাজে লাগিয়ে রমরমা ব্যবসার ফাঁদ পেতেছে বীজ কোম্পানিগুলো। এখানে সাধারণ কৃষক কিংবা জনগণের কোনো স্বত্ব নেই। একচেটিয়া আধিপত্য বণিকশ্রেণী আর তাদের স্থানীয় ফড়িয়াবাজদের।
চলতি বছরের মধ্য এপ্রিলে হঠাৎ করেই খবর বের হয় নোয়াখালীর কয়েকটি এলাকার বোরোচাষিদের জমির ধান 'সাদা' চিটা হয়ে যাচ্ছে। দিকভ্রান্ত কৃষকরাও কূল করতে পারছেন না কেন এমনটি হচ্ছে। হাইব্রিড ধান ঝলক আবাদকারী কৃষকদের জমিতেই এমনটি ঘটছে। কৃষকরা ছুটছেন বীজ বিক্রেতা, উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তার কাছে; এমনকি জেলা-উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয়েও। কেউই বলতে পারছেন না কেন এমনটি হচ্ছে। একটি সময় গণমাধ্যম কর্মীদের কাছেও বিষয়টি গুরুত্ব পায়। কৃষকের বিপর্যস্ত ফসলের মাঠ থেকে কৃষি অফিস পর্যন্ত ছোটাছুটির পর অবশেষে জানা যায়, এক ধরনের বীজবাহিত রোগের কারণেই ঝলক ধান গাছে ধানের ছড়ার নিচে শুকিয়ে শেষতক সে ধান চিটা হয়ে যাচ্ছে।
প্রশ্ন উঠল, বীজেই যদি ভাইরাস থাকে তাহলে বিমান কিংবা স্থলবন্দরের কোয়ারেন্টাইন কর্তৃপক্ষের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া এ বীজ দেশে ঢুকল কীভাবে। বীজের গুণাগুণ পরীক্ষা করে ছাড়পত্র দিলে তবেই সেটি দেশের বাজারে প্রবেশ এবং বাজারজাত করার সুযোগ তৈরি হয়, না হলে নয়। এমন মতামত প্রকাশিত হয় প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়। কিন্তু এসব কথাবার্তার কিছু গায়ে মাখেনি সরকার, বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি, বিএডিসি, কোয়ারেন্টাইন কর্তৃপক্ষ বা হাইব্রিড ঝলক বীজের আমদানিকারক এনার্জিপ্যাক এগ্রো কোম্পানি। শেষতক সর্বস্ব হারানো কৃষকরা নোয়াখালী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে ক্ষতিগ্রস্ত ধান পোড়ানো, মানববন্ধন, জেলা থেকে শুরু করে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন, কৃষিমন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রীকে স্মারকলিপি প্রদান করেন। কৃষকদের এতসব চিৎকার-চেঁচামেচিতে শেষতক কৃষি বিভাগ ক্ষতিগ্রস্ত ঝলকচাষিদের একটি তালিকা করার উদ্যোগ গ্রহণ করে।
ততদিনে মাঠ থেকে বোরো কৃষকের গোলায় উঠে গেছে। কেবল ফাঁকা পড়ে আছে ঝলকচাষি কৃষকদের গোলা। কৃষকরা এ মহাবিপর্যয়ের জন্য ঝলকের বীজ কোম্পানির কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করে। কৃষি নিয়ে কর্মরত সংগঠন এবং গণমাধ্যমকর্মীরা ক্ষতিপূরণের বিষয়টি নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন সংলাপ চালিয়ে গেলেও সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো সাড়া মেলেনি। সরকারের উপরি-লেবেলে কিছু চিঠি চালাচালির মধ্যেই চাপা পড়ে যায় কৃষকের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার বিষয়টি। এর ফাঁকে পর্দার আড়ালে এনার্জিপ্যাক এগ্রো কোম্পানি আমাদের খামারবাড়ির কর্তাব্যক্তি এবং সচিবালয়ের কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্তাদের 'ম্যানেজ' করতে সমর্থ হয়! নোয়াখালীর সাত হাজারসহ সারাদেশে যেখানে লক্ষাধিক কৃষক ঝলক আবাদ করে সর্বস্বান্ত হয়েছে, সেখানে সারাদেশে মাত্র দুই হাজার কৃষককে ক্ষতিপূরণের পরিবর্তে 'ঝুঁকি' নিয়ে আগামী বোরো মৌসুমে ঝলকের প্রদর্শনী প্লট করে দেওয়ার ফরমান জারি করে খামারবাড়ির কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর।
কৃষি সম্প্রসারণের সরেজমিন উইং থেকে জারি করা ফরমানে গাজীপুর, বরিশাল, শেরপুর, নোয়াখালী, গোপালগঞ্জ এবং কিশোরগঞ্জ জেলার দুই হাজার কৃষককে দিয়ে ঝলকের প্রদর্শনী প্লট করাতে তালিকা তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয় এসব জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালককে। কেন্দ্রের নির্দেশনা অনুযায়ী তারা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কাছে সে নির্দেশনাটি পাঠিয়ে দেন।
লেখার এক পর্যায়ে বলেছিলাম হুজুগে বাঙালির মতো আমাদের কৃষকরা সরকারের উৎসাহে গোগ্রাসে হাইব্রিড গিলেছেনও। তবে ঝলকের প্রদর্শনী প্লটের তালিকা চাওয়ার পর নোয়াখালীর কৃষকরা তাতে আর হুজুগে মেতে ওঠেননি। ইউনিয়নের উপ-সহকারী কর্মকর্তা কিংবা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তারা শত চেষ্টা করেও নোয়াখালীর কয়েকটি উপজেলায় একজন কৃষককেও প্রদর্শনী প্লট করার জন্য রাজি করাতে পারেননি। বরং কৃষকরা তাদের ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন। কিন্তু প্রদর্শনী প্লট করার জন্য কৃষকদের রাজি করাতে 'কর্মকর্তা'দের মরিয়া ভাব দেখে বারবার মনে হয়েছে, কৃষকবান্ধব সরকার কি আসলেই কৃষকের স্বার্থ দেখছে, নাকি বীজ কোম্পানির স্বার্থ দেখছে? ঝলকের প্রদর্শনী প্লটের পরিচর্চা, বীজসহ সব ধরনের উপকরণ সরবরাহ করবে বীজ কোম্পানি এনার্জিপ্যাক। এ কাজের মাধ্যমে তারা প্রমাণ করার চেষ্টা করবে গেল মৌসুমেও তাদের বীজ ভালো ছিল, আমাদের কৃষকের অনভিজ্ঞতা এবং আবহাওয়ার কারণে ঝলক ধানের বিপর্যয় হয়েছে। এর মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত ঝলকচাষিদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া থেকে নিজেদের রক্ষার পথ পাবে বীজ কোম্পানি। একই সঙ্গে নতুন করে ঝলক জাতের ধানবীজ বিপণন করতে অসুবিধা হবে না।
এত কিছুর পরও আমাদের কৃষি বিভাগের কোনো নড়াচড়া নেই। ক্ষতির ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও ক্ষতিগ্রস্ত কৃষককে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কোনো কার্যকর উদ্যোগ নিতে দেখা যাচ্ছে না এখনও। তারা শুধুই (?) বীজ কোম্পানির স্বার্থ রক্ষার্থেই সচেষ্ট। কৃষক আসলে করবে কী? বীজ কোম্পানিগুলো যেমন বীজের নিশ্চয়তা (ওয়ারেন্টি) দিচ্ছে না, তেমনি সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দেশে শস্য বীমাও চালু হয়নি। ফলে রাষ্ট্রের খোরাকি মেটানোর জন্য কৃষককেই মরতে হচ্ছে, এটি যেন কৃষকের দায়।
সবশেষে ঝলকচাষি কৃষকদের সালাম ও অভিবাদন। তারা প্রদর্শনী প্লট তৈরির নামে এনার্জিপ্যাক এগ্রো কোম্পানি এবং কৃষি বিভাগের প্রতারণামূলক প্রস্তাবনাটি প্রত্যাখ্যান করার সাহস দেখিয়েছেন। কৃষকদের এই তেজ এবং অহংবোধই হোক আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পাথেয়।
রুদ্র মাসুদ :সাংবাদিক
editor@chalomannoakhali.com
No comments